ক্যাসিও F-91W: প্রজন্মের স্মৃতিকাতরতার আবরণে মোড়া যে ঘড়ি

নব্বইয়ের শেষ কিংবা এই শতাব্দীর শুরুর সময়ে যাদের বেড়ে ওঠা, তাদের কাছে ক্যাসিও ঘড়ির বিশেষ স্মৃতি আছে। জন্মদিনের উপহার কিংবা পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের উপহার হিসেবে ক্যাসিও ঘড়ি ছিল এক চমৎকার উপহার। এছাড়াও বিয়েতে উপহার হিসেবে রেডিও-টেলিভিশনের সাথে তালিকায় ছিল এই ঘড়ি। তাই ক্যাসিওর সেই পরিচিত চেহারা খুব সহজেই স্মৃতিকাতরতার জন্ম দেয় আমাদের অনেকের মাঝেই। মোবাইল ফোনের ব্যাপক প্রচলন হওয়ার সাথে সাথে দুনিয়া জুড়েই ঘড়ির বাজারটা ফ্যাঁকাসে হতে শুরু করে। তবে বর্তমানে মেকানিকাল ওয়াচ কিংবা স্মার্টওয়াচ আর ফিটনেস ট্র্যাকারের কারণে ঘড়ি আবেদনের খানিকটা ফিরে পেয়েছে।

তবে একটা দীর্ঘ সময় জুড়ে বাংলাদেশের মানুষের গ্রাম, হাট, বন্দর কিংবা স্কুলের কলেজের ছাত্র কিংবা অফিসে যাওয়া মানুষের হাতে হাতে ছিল ঘড়ি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি যে ঘড়িটি দেখা যেত সেটি ছিল ‘Casio F-91W’। 

যে ঘড়িতে জড়িয়ে আছে কারো শৈশব কিংবা কারো কৈশোর; Image source: commons.wikimedia.org

এখন বাংলাদেশে যারা মধ্যবয়স্ক তাদের মধ্যে হয়তো খুব কম মানুষই পাওয়া যাবে যারা এই ঘড়িটি দেখেননি। শুধু বাংলাদেশেই না, সারা বিশ্বজুড়েই সর্বাধিক বিক্রিত ইলেকট্রনিক দ্রব্যের একটি হলো এই ক্যাসিও ঘড়ির মডেলটি। তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, ক্যাসিও কোম্পানি কখনোই আনুষ্ঠানিকভাবে এই ঘড়ির বিক্রির পরিমাণ জানায়নি। পৃথিবীর আনাচে-কানাচে এই ঘড়ির অস্তিত্ব দেখে এর জনপ্রিয়তার একটা ধারণা পাওয়া যায়। তবে ডিজাইন বেশ সহজবোধ্য হওয়ায় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে নকল ক্যাসিও ঘড়িও তৈরি আর বিক্রি হয়েছে।

১৯৪৬ সালে যাত্রা শুরু করা ক্যাসিও কোম্পানির অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আসে আশির দশকে। ক্যালকুলেটর আর হাতঘড়ির জগতে পায় ব্যাপক জনপ্রিয়তা। ক্যাসিও ঘড়ির নামের সাথে সমার্থক হয়ে ওঠা মডেল ‘Casio F-91W’ এর যাত্রা শুরু হয় ১৯৯১ সালে। খুবই সাদামাটা ধরনের এই ঘড়িটির এখনো অব্যাহত রেখেছে ক্যাসিও কোম্পানি। 

ক্যাসিও জি-শক

১৯৯১ সালে যে ডিজাইন দিয়ে এই ঘড়ির যাত্রা শুরু হয়েছিল তাতেও খুব একটা পরিবর্তন কখনোই আসেনি। রায়োসুকে মোরিয়াই নামের এক ডিজাইনার এই ঘড়ির ডিজাইন করেছিলেন। আশির দশকে ঘড়ির বাজার যখন বেশ চাঙ্গা, তখন বাজারে আসে নতুন নতুন ব্র্যান্ডের ঘড়ি। বিশ্বজুড়ে জাপানী ব্র্যান্ড ক্যাসিওর নাম ততদিনে দাঁড়িয়ে গেছে। স্থায়িত্বের দিকে ক্যাসিওকে টেক্কা দিতে পারে বাজারে এমন কোম্পানি খুব কমই ছিল। নব্বইয়ের দশকে উঠতি তরুণদের ঘড়ির বাজার ধরতে ক্যাসিও বিভিন্ন দামের ঘড়ি বাজারে ছাড়া শুরু করেছিল। এর মধ্যে জনপ্রিয় একটি মডেল ছিল ক্যাসিও জি-শক সিরিজ (G-Shock), জি-শক ঘড়িগুলোর ডিজাইন ছিল বেশ আকর্ষণীয়।

জি-শক সিরিজের DW-6400; Image source: Valerie Wallerus

জি-শক মূলত ‘গ্র্যাভিটেশনাল শক’ শব্দটি থেকে খানিকটা সংক্ষিপ্ত করে নেওয়া হয়েছে। একইসাথে পানি প্রতিরোধী, ১০ মিটার উঁচু জায়গা থেকে ফেলে দিলেও এর কিছু হবে না এবং ১০ বছরের মতো চলতে পারবে এমন ব্যাটারির সমন্বয়ে ঘড়ি তৈরির চিন্তা থেকেই জি-শকের জন্ম। ক্যাসিওর দাবীর বিপরীতে জি-শক ঘড়ি উঁচু দালান থেকেও ফেলে দেখা হয়েছে বিভিন্ন সময়। বলাই বাহুল্য যে, জি-শক উতরে গেছে সেসব পরীক্ষায়। 

ক্যাসিও ইঞ্জিনিয়ার কাইকুও আইবে প্রথম চিন্তা করেছিলেন কীভাবে ঘড়িকে আরও শক্তপোক্ত করা যায়। আর এই চিন্তা থেকেই ঘড়ি একটি শৌখিন সামলে রাখার বস্তু থেকে ধীরে ধীরে দানবীয় আকার ধারণ করতে থাকে। তবে একই ঘড়িতে অনেক সুবিধা যোগ করতে গিয়ে দামও বেড়ে যেতে থাকে এর। বিশ্বজুড়ে উঠতি বয়সের তরুণ ছাড়াও সামরিক বাহিনী, ফ্যাশন সচেতন, কঠিন পরিবেশে ভ্রমণকারী কিংবা খেলোয়াড়দের মধ্যে জি-শকের জনপ্রিয়তা ছিল ব্যাপক। তবে গড়পড়তা সাধারণ মানুষ যারা কাজের ফাঁকে হাত উঁচিয়ে শুধু সময় আর তারিখটাই দেখবে তাদের জন্য জি-শক সিরিজের ঘড়ির দাম নাগালের বাইরে যেতে শুরু করে।

তাই ক্যাসিও তাদের আশির দশকের ব্যাপক জনপ্রিয় জি-শক DW-5000C’র মতো দেখতে একটি সাধারণ ঘড়ি তৈরির কাজ শুরু করে। টাইম ম্যাগাজিনের দৃষ্টিতে পৃথিবী নামক গ্রহে সর্বকালের সেরা ১০০ গ্যাজেটের মধ্যে জি-শক DW-5000C একটি।

জি-শক সিরিজের ব্যাপক জনপ্রিয় মডেল ‘DW-5000C’ যার অনুকরণেই তৈরি হয় F-91W; Image source: www.gshock.com

DW-5000C’র মতোই ডিজাইন করা হয় F-91W ঘড়িটিকে, যার মধ্যে একইসাথে স্থায়িত্ব, দীর্ঘ ব্যাটারি আর স্বল্প মাত্রায় পানি প্রতিরোধী ক্ষমতার সমন্বয় ঘটানো যাবে খুব কম দামের মধ্যেই। তাই জি-শকের মতো ভারী ডিজাইন না করে এর ডিজাইন করা হয় খুবই সাদামাটা। সাদামাটা এই ডিজাইনটি পরবর্তীকালে সারা দুনিয়াতে ব্যাপক পরিচিতি পায়। ক্যাসিও কোম্পানির সার্বিক ব্র্যান্ড মূল্য আর আস্থার জায়গাকে নতুন মাত্রা দেয় এই ঘড়িটি। 

ঘড়ির ভেতরে

ঘড়ির বেশ কয়েকটি ধরন হয়, পৃথিবীজুড়ে একসময় সুইস মেকানিকাল ঘড়ির প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল ভীষণ। মেকানিকাল ঘড়ির নির্মাণ কৌশল অত্যন্ত সূক্ষ্ম। এই ঘড়ি নির্মাণে সময়ও লাগে বেশি, তাই স্বাভাবিকভাবেই ঘড়ির দামও বেশি। তাই দীর্ঘদিন ঘড়ি ছিল অভিজাতের শৌখিন দ্রব্য।

সুইস মেকানিকাল ঘড়ির (Patek Philippe) জটিল যন্ত্রাংশ; Image source: www.realmenrealstyle.com

তবে মেকানিকাল ঘড়ির বাইরেও অটোমেটিক এবং কোয়ার্টজ নামে দু’ধরনের ঘড়ি পাওয়া যায়। অটোমেটিক ঘড়িতেও থাকে সূক্ষ্ম যন্ত্রাংশের সমন্বয়, যেখানে ঘড়ি কাজ করে এর ব্যবহারকারীর হাতের গতিবিধি থেকে অর্জনকৃত শক্তি দিয়েই।

মেকানিকাল আর অটোমেটিকে সূক্ষ্ম যন্ত্রাংশের ব্যাপারটিই যেখানে প্রধান, সেখানে ১৯৬৯ সালে জাপানি কোম্পানি ‘সিকো’ সর্বপ্রথম কোয়ার্টজ ঘড়ি চালু করে, যা মেকানিকাল আর অটোমেটিক ঘড়ির সূক্ষ্ম যন্ত্রাংশকে ব্যাটারিচালিত মেশিন দিয়ে প্রতিস্থাপিত করে। এতে ব্যবহার করা হয় ‘ইলেকট্রনিক অসিলেটর’ যেটি কোয়ার্টজ স্ফটিক দিয়ে নিয়ন্ত্রিত। স্বল্প ওজনের আর কমমূল্যের ব্যাটারিচালিত হাতঘড়ির জগতে এক বিপ্লব শুরু হয় কোয়ার্টজ ঘড়ি দিয়েই।এই বিপ্লবের ফল অনেক জাপানী ঘড়ি নির্মাতা কোম্পানিই ঘরে তুলতে শুরু করে, অন্যদিকে ইউরোপীয় অভিজাত মেকানিকাল ঘড়ির চাহিদা সাধারণের মাঝে কমতে থাকে।

ক্যাসিও কোম্পানির F-91W ঘড়িটিও একটি কোয়ার্টজ ঘরানার ঘড়ি। এই ঘড়িটি চালানোও সোজা, ঘড়ির দুপাশে থাকা তিনটি বোতামের মাধ্যমেই নিয়ন্ত্রণ করা যায় যাবতীয় কাজ। একটি বোতাম দিয়ে আলো জ্বালানো যায়। এমন একটি সময় ছিল যখন দামি রেডিয়াম ডায়ালের ঘড়ি যাদের ছিল না, তাদের এই ক্যাসিও ঘড়ির হালকা হলুদাভ সবুজ লাইটটিই ছিল ভরসা। সন্ধ্যা কিংবা রাতে ঘড়িতে সময় দেখতে একটি বোতাম চাপাই ছিল যথেষ্ট। 

 এই ঘড়ির অন্যতম আকর্ষণীয় বিষয় ছিল এর বাতিটি; Image source: watchitallabout.com

লাইটের একই পাশে নীচে আছে ‘মোড’ বোতাম। মোড বোতামটি ঘড়ির মূল নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র, এটির মাধ্যমেই দিন, মাস, ঘণ্টা, তারিখ পরিবর্তন করা যায়। এর মাধ্যমে চালু করা যায় স্টপ-ওয়াচও।ঘড়ির আরেক পাশে আছে একটি বোতাম, যার মাধ্যমে ঘড়িটি ১২ ঘণ্টা নাকি ২৪ ঘণ্টায় সময় দেখাবে তা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। 

একনজরে ঘড়ির সব ফিচার; Image source: sg.carousell.com

এই ঘড়িতে আছে স্টপ-ওয়াচ, প্রতি ঘণ্টায় একটি করে সংকেত এবং এলার্ম। যে সময় এই ঘড়িটি বাজারে ছাড়া হয়েছিল, তার তুলনায় এই ঘড়িতে এত সুযোগের সমাবেশ আসলেই বিস্ময়কর। 

এছাড়াও এই ঘড়িটি স্বল্পমাত্রায় পানি প্রতিরোধী, জি-শক সিরিজের মতো এই ঘড়ি নিয়ে সাঁতার, গোসল কিংবা দীর্ঘসময় বৃষ্টিতে ভিজা না গেলেও হালকা বৃষ্টির ছাঁট কিংবা অল্প সময়ের জন্য পানিতে পড়ে গেলে এর কিছু হবে না। 

দীর্ঘস্থায়িত্ব 

ক্যাসিও F-91W ঘড়িটি অসাধারণ রকম স্থায়ী। সাত-দশ এমনকি বারো-পনেরো বছর পর্যন্ত টিকে যাওয়ার ইতিহাস আছে এই ঘড়ির। এই ঘড়ির মূল বহিরাবরণটি নির্মিত প্লাস্টিক দিয়ে, পেছনের চারটি স্ক্রু দিয়ে ইস্পাতের প্লেটের ভেতরে আছে ব্যাটারি এবং ঘড়ির মূল যন্ত্রাংশ।

কোয়ার্টজ ঘড়ি হওয়ার কারণে এতে দরকার ব্যাটারি, আর এতে ব্যবহার করা বোতাম আকৃতির ব্যাটারি। এই ক্যাসিও ঘড়িটি কোনো কৌতূহলী তরুণের হাতে পড়েছে আর সে খুলে আবার জোড়া লাগায়নি কিংবা খুলে জোড়া লাগাতে ব্যর্থ হয়নি এমন ঘটনা খুব কমই হয়েছে। তবে বোতাম ব্যাটারি এই ঘড়ির দীর্ঘস্থায়িত্বের অন্যতম প্রধান কারণ। দৈনিক ২৪ ঘণ্টা ব্যবহার, এলার্ম, লাইট আর স্টপওয়াচ প্রয়োজন অনুসারে ব্যবহার করে সাত থেকে দশ বছর অনায়াসেই ব্যবহার করা যায়। 

F-91W কালো প্লাস্টিক কেইসের আইকনিক মডেলটি ছাড়াও আরো কিছু পরিবর্তন এনে বিভিন্ন সময় বাজারে ছেড়েছিল ক্যাসিও।

F-91W এর যত রকমফের; Image source: www.reddit.com

বিবিসির চোখে এই ঘড়িটি ‘The strangely ubiquitous watch’, অবশ্য এই ঘড়ির বিশ্বজুড়ে অনেক দেশে নকলভাবে তৈরি হয়েছে। আসল F-91W-তে ক্যাসিও চেনার জন্য তাই প্রস্তুতকারীরা একটি টোটকা চালু করে। ডানদিকের বোতামটি ৩ সেকেন্ড চেপে রাখলে ক্যাসিও লেখাটি ইংরেজিতে ভেসে ওঠে।

আসল ক্যাসিও চেনার টোটকা; Image source: commons.wikimedia.org

সময়ের সাথে ঘড়ির আসল আবেদন কমে এসেছে অনেকখানি। মেকানিকাল কিংবা অটোমেটিক তো দূরে থাক, কোয়ার্টজ ঘড়িও স্মার্টফোনের কাছে নস্যি হয়ে গেছে। ইলেকট্রনিক স্মার্টওয়াচের কথা যদি হিসেবে নেওয়া তাহলে দেখা যাবে তাতে স্মার্টফোনের মতোই টাচস্ক্রিন, জিপিএস, হার্ট রেট সেন্সরসহ নানা ধরনের সুবিধা যোগ করা হয়েছে সময় দেখার পাশাপাশি। কারণ সময় যত এগিয়েছে ঘড়িতে শুধুই সময় দেখার সময় ততই কমে গিয়েছে।

প্রযুক্তি জগতের চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/

This article is about Casio F-91W, an iconic quartz timepiece.

Featured image source: commons.wikimedia.org

Related Articles

Exit mobile version