দাবাপ্রেমীদের কাছে গ্যারি ক্যাসপারভ খুবই পরিচিত একটি নাম। দাবার জীবন্ত কিংবদন্তীদের ভেতর নিঃসন্দেহে তার নাম চলে আসবে। অনেকের মতেই তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ দাবাড়ু। ২০০৮ সালের ৩০ নভেম্বর রাশিয়ান রেডিও ইকো মস্কভিতে দেওয়া ঘণ্টাব্যাপী এক সাক্ষাৎকারে গ্যারি আলোচনা করেন অনেক কিছু নিয়েই। আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন মিখাইল তাল। এছাড়াও সোভিয়েত দাবার স্বর্ণোজ্জল দিনগুলো এবং তার পূর্বসূরিদের অনেকের কথাই বলেছেন তিনি। আলোচনা করেছেন আনাতলি কারপভ, অ্যালেক্সান্ডার অ্যালেখাইন, হোসে রাউল কাপাব্লাঙ্কা, বরিস স্পাস্কি, মিখাইল বতভিনিক, ভাসলি স্মিস্লভ, তিগ্রান পেত্রসিয়ান, পাউল কেরেসদের মতো দাবার কিছু মাস্টারমাইন্ডকে নিয়েও। বিশাল এই সাক্ষাৎকারটি নিয়ে আমাদের এবারের আয়োজন। পাঠকের সুবিধার্থে কয়েকভাগে বিভক্ত করে আমরা সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরব। আজ থাকছে এর প্রথম পর্ব।
উপক্রমণিকা
একজন ব্যতিক্রমধর্মী দাবাড়ু ছিলেন মিখাইল তাল। হোসে রাউল কাপাব্লাঙ্কার মতো ধ্রুপদী দাবা প্রতিভা ছিলেন না, কিংবদন্তী অনুযায়ী যিনি কি না শৈশবে শুধু বড়দের খেলা দেখেই খেলতে শিখেছিলেন। রিগা স্কুল ছাত্র মিশা (তালের ডাকনাম) তাল বিশ্বযুদ্ধের পর পরই দাবার ঘুঁটি চালতে শিখে যান। ১৯৪৬ সালে তিনি ছিলেন মাত্র ১০ বছরের বালক। কিন্তু যখন খেলা শিখে যান, তারপর যে একজন জিনিয়াস হতে যাচ্ছেন, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ ছিল না। তিন বছর পর, তাল লাতভিয়া যুব দলের হয়ে খেলেন। ১৭ বছর বয়সে তিনি লাতভিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ, এবং ২১ বছর বয়সে ইউএসএসআর চ্যাম্পিয়নশিপ নিজের করে নেন।
বলা যায়, সোভিয়েত ইউনিয়নে দাবা অনেক জনপ্রিয় ছিল, এখনকার রাশিয়া যে তুলনায় কিছুই নয়। দাবা জাতীয় খেলা ছিল। অধিকাংশ স্কুলে দাবার সার্কেল ছিল। বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ খেলাগুলো সংবাদপত্র এবং টিভিতে বিশ্লেষণ করা হত। লক্ষ লক্ষ মানুষ সেরা সব দাবাড়ুদের খেলার শৈলী এবং সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে সক্ষম হত।
মিখাইল তাল বেশ দ্রুত জনপ্রিয় এবং বিখ্যাত হয়ে ওঠেন, কারণ তিনি অন্যান্য সোভিয়েত গ্র্যান্ডমাস্টারদের তুলনায় সম্পূর্ণ ভিন্ন দাবা খেলতেন। অন্যান্যরা তাদের স্বীকৃত নেতা, বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন মিখাইল বতভিনিককে অনুসরণ করতেন, যিনি কিছুটা কম আক্রমণাত্মক এবং শান্ত, ক্যালকুলেটিং ও র্যাশনাল দাবা খেলতেন। তাল খেলেছিলেন তথাকথিত ভুল দাবা, যার মধ্যে ছিল বিনোদন, নান্দনিকতা, নাটকীয়তা ও সমন্বয়। তিনি ছিলেন কিংবদন্তী আমেরিকান দাবাড়ু পল মরফির মতো, যিনি ছিলেন মধ্য উনবিংশ শতকের অনানুষ্ঠানিক বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। তাল ছিলেন রাশিয়ান দাবাড়ু আলেকজান্ডার আলেখাইনের মতো, একমাত্র দাবা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন, যিনি অপরাজিত অবস্থায় মারা যান।
তাল ছোট এবং বড় যেকোনো পিস স্যাক্রিফাইস করতেন, অবস্থান এত জটিল করে তুলতেন যে তার প্রতিদ্বন্দ্বী বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সম্ভাব্য সব ভ্যারিয়েন্ট গণনা করতে পারত না এবং খেলার সময় সঠিক চাল বেছে নিতে না পেরে নার্ভাস হয়ে যেত, ভুল চাল দিয়ে হেরে যেত। পরবর্তীতে জটিল বিশ্লেষণের পর, বিশেষ করে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যখন শক্তিশালী দাবা কম্পিউটার আবিষ্কৃত হয়, এটা প্রায়ই প্রমাণিত হয় যে, তার পন, নাইট, বিশপ, রুক, কুইন ইত্যাদি স্যাক্রিফাইস অনেক ক্ষেত্রেই ভুল ছিল এবং তাকে পরাজয় এনে দিতে পারত। কিন্তু খেলায় এই কৌশলগুলোই তালকে একের পর এক জয় এনে দেয়।
১৯৬০ সালে, ২৪তম জন্মদিনের আগে, তাল বতভিনিকের বিপক্ষে এক বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ ম্যাচে মুখোমুখি হন, এবং তাকে শোচনীয়ভাবে হারিয়ে তৎকালীন সর্বকনিষ্ঠ বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হন। এটা ছিল তার ক্যারিয়ারের শিখর। পরে তার আরো অনেক বিজয় এসেছিল, কিন্তু তাল বেশিদিন দাবার সিংহাসন ধরে রাখতে পারেননি। পরের বছরই, ১৯৬১ সালে তাল রিটার্ন ম্যাচে বতভিনিকের কাছে হেরে যান। প্রায় মৃত্যু পর্যন্ত তিনি দাবা রেটিংয়ে শীর্ষ ১০ মধ্যে থেকেছেন। কিন্তু আর কখনও প্রথম হওয়া হয়ে ওঠেনি।
শৈশব থেকেই তালের স্বাস্থ্য ছিল বেশ ভঙ্গুর, এবং সেই সাথে তার জীবনযাত্রারও নেতিবাচক প্রভাব ছিল। আকর্ষণীয়, হাস্যরসিক, উচ্চশিক্ষিত এবং পার্টিপ্রিয় তাল তার জীবনের শেষ বছরগুলোতে খুব অসুস্থ ছিলেন। ১৯৯২ সালে তিনি মারা যান মাত্র ৫৬ বছর বয়সে।
মূল সাক্ষাৎকার
ইউজেনি কিসেলেভ (উপস্থাপক): আজকের অতিথির সাথে পরিচয় করিয়ে দেই। এই স্টুডিওতে আমার সাথে আছেন ১৩ তম বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন গ্যারি কাসপারভ।
গ্যারি কাসপারভ: গুড ডে।
উপস্থাপক: আমাদের প্রোগ্রামে অংশ নেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। প্রথম যে প্রশ্নটা আমি করতে চাই, আপনি কি তালকে ব্যক্তিগতভাবে চেনেন?
গ্যারি: হ্যাঁ, অবশ্যই। আমি তার বিপক্ষে খেলেছি।
উপস্থাপক: স্কোর কত ছিল?
গ্যারি: আমরা বেশ কিছু ম্যাচ খেলেছি, অনেক ড্র হয়েছে, আমি একটায় জিতেছি। এটাই ক্ল্যাসিক্যাল দাবার স্কোর। দ্রুতগতির দাবা ব্লিটজে স্কোর সমান-সমান। কিন্তু তালের বিরুদ্ধে একটা ম্যাচ আমার সবচেয়ে বেশি মনে আছে, ১৯৭৪ সালের মার্চ মাসে যেটি খেলা হয়েছিল।
ইউএসএসআর এর একটি টুর্নামেন্টে পাইওনিয়ার প্যালেস দলগুলো একে অপরের সাথে খেলেছিল, তাদের গ্র্যান্ডমাস্টার অ্যালামনাইগণ ছাত্রদের অধিনায়কত্ব করেছেন। আমাদের দল ফাইনালে পৌঁছে রিগার বিরুদ্ধে খেলেছে। তাল ছিলেন তাদের অধিনায়ক। তার সাথে সেই হ্যান্ডশেক, এক অন্যরকম অনুভুতি। আমার বয়স তখনও ১১ হয়নি, আর তাল নিজে আমার বিপক্ষে ছিলেন। আমি এতটাই তার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে গিয়েছিলাম যে ভাল খেলতে পারিনি এবং দ্রুত হেরে যাই। কিন্তু আমার এখনও সেই অনুভূতিগুলো মনে আছে।
তারপর আমরা ১৯৭৮ ইউএসএসআর চ্যাম্পিয়নশিপে প্রথম অফিসিয়াল খেলা খেলেছি। ১৮ ম্যাচের একটি ব্লিটজ গেম খেলেছি, ৭-৭ স্কোর ছিল, আমি সম্প্রতি এই ম্যাচগুলো দেখেছি। তারপরও খেলার মাঠে আমাদের অনেকবার দেখা হয়েছে। আমাদের মাঝে সুসম্পর্ক ছিল।
আমি তালের সাথে কিছু কাজ করেছি। ১৯৮০ সাল নাগাদ তিনি বাকু ভ্রমণ করেন, আমরা কয়েকটি ট্রেনিং ম্যাচ খেলেছি। তাল তার শেষ দিন পর্যন্ত দাবার সাথে যোগাযোগ ধরে রেখেছিলেন। তার মৃত্যুর মাত্র এক মাস আগে মস্কোতে একটি ব্লিটজ টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে তাকে খুব অসুস্থ দেখাচ্ছিল। কিন্তু তাল তখনও তালই ছিলেন। এই ব্লিটজ টুর্নামেন্টে আমি তার কাছে আমার একমাত্র ম্যাচ হেরেছি। দ্বিতীয় রাউন্ডে ফিরতি ম্যাচ আমি নিজের করে নিয়েছিলাম, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে শেষ পর্যন্ত দাবার প্রতি তার একটা আবেগ ও দক্ষতা ছিল। আমার জানামতে, তিনিই একমাত্র এমন খেলোয়াড় ছিলেন যার ভ্যারিয়েন্টগুলো ক্যালকুলেট করতে হত না, তিনি শুধু সেগুলো দেখতেন।
উপস্থাপক: একটু কী খুলে বলবেন ব্যাপারটা?
গ্যারি: আমরা হিসেব করে দেখি, প্রতিপক্ষ এই চাল দিয়েছে হেতু আমি অন্য চাল দেই। কিন্তু তাল ভ্যারিয়েন্টের সব স্তরের মধ্য দিয়ে দেখতেন যে, অষ্টম চাল এরকম হবে, এবং তা-ই হয়েও যেত। কিছু মানুষ গাণিতিক সূত্র দেখতে পান, তারা সাথে সাথে পুরো ছবিটি কল্পনা করতে পারেন। একজন সাধারণ মানুষকে হিসেব করতে হয়, এটা ভাবতে হয়, কিন্তু কিছু বিশেষ ব্যক্তি সব কিছু দেখতে পান। এটা মহান সঙ্গীতজ্ঞ, মহান বিজ্ঞানীদের মধ্যে ঘটে। তাল একেবারে অনন্য ছিলেন। তার খেলার ধরন অবশ্যই পুনরাবৃত্তিযোগ্য ছিল না। আমি যথেষ্ট পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি, কিন্তু তালের এই অন্তর্দৃষ্টি অনন্য ছিল। তিনি এমন একজন মানুষ ছিলেন যার উপস্থিতিতে অন্যরা নিজেদের মধ্যম মানের দাবাড়ু ভাবত।
তিনি এক অস্বাভাবিক জীবনযাপন করতেন। কোনো কিছু নিয়েই খুব বেশি ভাবনা-চিন্তা করতেন না, মাঝারি মানের জীবনযাপন করতেন। এবং এই বিশাল শক্তি সবসময় তার চারপাশে ছিল, ইতিবাচক শক্তি। তাল আমার জানা কয়েকজন পুরোপুরি ইতিবাচক ব্যক্তির মধ্যে একজন, যিনি বিতর্কিত ছিলেন না। দাবা তার স্বভাব অনুযায়ী খুব বিতর্কিত খেলা, কিন্তু তিনি ছিলেন না।
উপস্থাপক: যদি আমরা তাকে অন্যান্য দাবার ব্যক্তিত্বের সাথে তুলনা করার চেষ্টা করি? উদাহরণস্বরূপ, বতভিনিক, তিনি শুধু তালের কাছেই হারেননি, স্মিসলভের কাছেও হারেন এবং অবশেষে পেত্রসিয়ানের কাছে তার দাবার মুকুট হস্তান্তর করেন। কিন্তু তারপরেও, চল্লিশের দশকের শেষভাগ এবং পঞ্চাশের দশক ছিল পুরোই বতভিনিক যুগ। তালের পর দাবায় কী পরিবর্তন হয়েছে?
গ্যারি: আমি মনে করি, প্রত্যেক বিশ্বচ্যাম্পিয়নই তার সময়ের সেরা। এটি যেমন সেই প্রথম চ্যাম্পিয়নের ক্ষেত্রে খাটে, তেমনই বতভিনিকের জন্যও। বতভিনিকের আগ্রাসন প্রকৃত অর্থে ত্রিশের দশকের শুরু থেকেই। তিনি সেই তখন থেকেই সোভিয়েত দাবাড়ুদের মধ্যে সেরা ছিলেন। তিনি সোভিয়েত সরকার থেকেও প্রশংসায় ভাসতে থাকেন, স্তালিনের সাথে তার পত্রালাপও হয়। তাকে ১৯৩৬-৩৭ সালে বিশ্ব-চ্যাম্পিয়নশিপ খেলার সময় বিশেষ সুযোগও দেয়া হয়।
যখন তাল বতভিনিকের মুখোমুখি হন, তার পেছনে ২৫ বছরের এক লম্বা যুগ ছিল। বতভিনিকের খেলার শৈলী, এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, সেই যুগের চেতনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল, অত্যন্ত যৌক্তিক, ঠাণ্ডা মেজাজের এবং বৈজ্ঞানিক। তিনি দাবাকে স্বতন্ত্র বর্গক্ষেত্রে বিভক্ত করার চেষ্টা করেন এবং একের পর এক বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেন। এটা ছিল দাবার এক বৈপ্লবিক সাফল্য। এই মতবাদ কাজও করেছিল। স্মিসলভ ভিন্ন ছিলেন, কিন্তু তিনিও সেই ধ্রুপদী শৈলীতে (ক্লাসিক্যাল স্টাইলে) খেলেছেন।
চলবে …