নোবেল পুরস্কারের ক্যাটাগরির প্রশ্নে আপনি নিঃসন্দেহে ছয়টি বিভাগের কথাই বলবেন হয়তো। তবে অর্থনীতিতে দেয়া পুরস্কার আদৌ নোবেল পুরস্কার কিনা- সেই ধারণা নিয়ে আছে দ্বিমত। কারণ আলফ্রেড নোবেল তার উইলে পাঁচটি বিষয়ে পুরস্কার রেখেছিলেন: রসায়ন, সাহিত্য, শান্তি, পদার্থবিদ্যা, এবং শারীরবিদ্যা বা ওষুধ। তার স্মৃতিতে অর্থনীতিতে পরবর্তীতে যে পুরস্কার প্রদানের ব্যবস্থা চালু হয়, তা অপর পাঁচটির অনুরূপ কিনা এবং নতুন একটি বিষয় যুক্ত করার অন্তরালে ইতিহাস ও বিজয়ী নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে সাজানো আজকের এই লেখা।
শুরুর ইতিহাস
আলফ্রেড নোবেলের উইল অনুসারে ১৯০১ সাল থেকে নোবেল কমিটির আয়োজনে ধারাবাহিকভাবে পাঁচটি বিষয়ে নোবেল পুরস্কার দেওয়া শুরু হয়। তবে অর্থনীতিকে নতুন কোনো বিষয় হিসেবে যুক্ত করার পেছনে নোবেল কমিটির ভূমিকা নেই। বরং এই পুরস্কারের পেছনে রয়েছে সুইডিশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং সরকারের কোন্দল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে সুইডিশ আর্থিক ব্যবস্থা সরকারের স্বল্প সুদের হার নীতি দ্বারা পরিচালিত হতো। কম সুদের হারের লক্ষ্য ছিল কর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং নির্মাণকে উদ্দীপিত করা, যা ঋণ গ্রহণের প্রবণতা বৃদ্ধির পাশাপাশি মুদ্রাস্ফীতি বাড়িয়ে দেয়। তখন সুইডিশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক (বিশ্বের প্রাচীনতম কেন্দ্রীয় ব্যাংক, Sveriges Riksbank) সরাসরি নির্বাচিত সরকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল।
১৯৫৫ সালে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক প্রধানমন্ত্রী টেজ এরল্যান্ডার দ্বারা পার অ্যাসব্রিঙ্ক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর নিযুক্ত হন। প্রধানমন্ত্রী এরল্যান্ডারের আদেশের সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত হতে অ্যাসব্রিঙ্ক ১৯৫৭ সালের জুলাই মাসে সরকারের সাথে আলোচনা না করেই ঋণের ওপর সুদের হার ৪ থেকে ৫ এ উন্নীত করার মাধ্যমে ব্যাংকের স্বাধীনতা ঘোষণার চেষ্টা করেন। এটি ‘সুদের হার অভ্যুত্থান’ নামে পরিচিতি পায়। এই সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করে এবং ক্ষমতাসীন সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির অনেক সদস্য রিকসব্যাংকের গভর্নর হিসেবে অ্যাসব্রিঙ্কের পদত্যাগ দাবি করেন। প্রধানমন্ত্রী উপস্থিত বুদ্ধিমত্তা দিয়ে শক্ত কিছু শর্তারোপ করলে সেবারের মতো অ্যাসব্রিঙ্ক পিছিয়ে যান।
তবে তিনি রিকসব্যাংকের স্বাধীনতার আরেকটি সম্ভাব্য উৎস চিহ্নিত করেন— সরকারি বন্ড হোল্ডিংয়ের থেকে প্রাপ্ত আয়। সুইডিশ পার্লামেন্ট ব্যাংককে সমস্ত অর্থ কোষাগারে হস্তান্তরের জন্য চাপ দিয়ে আসছিল। কিন্তু ব্যবসা ও ঋণ দেওয়ার জন্য অর্থের প্রয়োজন, এই কারণ দেখিয়ে অ্যাসব্রিঙ্ক তা ফেরত দিতে আপত্তি জানান। এছাড়া একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণা ফাউন্ডেশন স্থাপন এবং ১৯৬৮ সালে ব্যাংকের ৩০০ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করতে প্রচুর অর্থের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কেও তিনি অবগত করেন। তদুপরি, পার্লামেন্ট কিছু অর্থ ব্যাংকের নিকট গচ্ছিত রেখে বেশিরভাগ ফেরত নিয়ে নেয়।
এত অর্থ হস্তান্তর অ্যাসব্রিঙ্কের মোটেই পছন্দ হয়নি। তিনি ছিলেন পরিবর্তনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ এবং অভ্যুত্থানে বিশ্বাসী একজন মানুষ। পার্লামেন্টের সাথে তার টানাপোড়েনের মধ্যেই ব্যাংকের ৩০০ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ঘনিয়ে আসে। অর্থনীতিতে অসামান্য অবদানকারীদের বিশেষ সম্মাননা প্রদানে এই অর্থ ব্যবহার করা সম্ভব কিনা এ বিষয়ে তিনি তোড়জোড় শুরু করলেন। পাঠকের হয়তো বুঝতে বাকি নেই, রিকসব্যাংকের তদানীন্তন গভর্নর পার অ্যাসব্রিঙ্কই অর্থনীতিতে নোবেল সম্মাননা সৃষ্টির মূল কারিগর। সরকারের সাথে অ্যাসব্রিংকের কলহের ইতিহাস ‘দ্য নোবেল ফ্যাক্টর: দ্য প্রাইজ ইন ইকোনমিক্স, সোশ্যাল ডেমোক্রেসি এন্ড দ্য মার্কেট টার্ন‘ বই থেকে এসেছে, যা অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনৈতিক ইতিহাসবিদ অ্যাভনার অফার এবং উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্যাব্রিয়েল সোডারবার্গের লেখা।
অ্যাসব্রিঙ্কের মাথাতেই আলফ্রেড নোবেলের নাম যুক্ত করে অর্থনীতিতে পুরস্কারের ধারণা জন্ম নেয় এবং তিনি বিষয়টি একজন তরুণ অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অ্যাসার লিন্ডবেকের কাছে ঘরোয়াভাবে উত্থাপন করেন। প্রস্তাব শোনার সঙ্গে সঙ্গে লিন্ডবেক ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখান। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তারা রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি অব সায়েন্সেসের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাব পেশ করেন। রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি অব সায়েন্সের সদস্যদের মধ্যে অর্থনীতিবিদরা এই ধারণা পছন্দ করলেও একাডেমির পদার্থবিদরা ঘোর আপত্তি জানান। অনেক বাদানুবাদ ও আলাপ-আলোচনার পর অবশেষে একাডেমির সভায় প্রস্তাবটি গৃহীত হয়।
পরবর্তীতে প্রস্তাবটি নোবেল ফাউন্ডেশনের কাছে উত্থাপন করা হলে বোর্ড সদস্যদের ধারণাটি পছন্দ হয়, বিশেষ করে যখন রিকসব্যাংক পুরস্কারের অর্থ হস্তান্তরের পাশাপাশি (যা ৮ মিলিয়ন সুইডিশ ক্রোনার, বা ৯,৩০,০০০ ডলার) একটি বার্ষিক ফি প্রদানের প্রস্তাব দেয়। আয়োজনের সর্বশেষ ধাপ ছিল ডিনামাইট নির্মাতা আলফ্রেড নোবেলের বয়োজ্যেষ্ঠ জীবিত বংশধরের সম্মতি গ্রহণ, এবং তিনি তা দিয়েছিলেন, পাশাপাশি জোর দিয়ে বলেছিলেন, পুরস্কারটিকে বলা হবে, ‘আলফ্রেড নোবেলের স্মৃতিতে অর্থনৈতিক বিজ্ঞানের পুরস্কার’।
১৯৬৯ সালে রাগনার ফ্রিশ এবং জ্যান টিনবার্গেনকে অর্থনৈতিক বিজ্ঞানে প্রথম পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল। ১৯০১ সাল থেকে নোবেল পুরস্কারের মতো একই নীতি অনুসারে রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি অফ সায়েন্সস, স্টকহোম, সুইডেন দ্বারা অর্থনীতি বিজ্ঞানে পুরস্কার বিজয়ীদের নির্বাচন করা হয়। এই পুরস্কারের পুরো নাম ‘The Sveriges Riksbank Prize in Economic Sciences in Memory of Alfred Nobel‘।
মনোনয়ন ও বাছাই প্রক্রিয়া
রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি অব সায়েন্সের ইকোনমিক সায়েন্স প্রাইজ কমিটি অর্থনৈতিক বিজ্ঞানে পুরস্কারের জন্য প্রার্থীদের নির্বাচন করে। মনোনয়ন প্রত্যাশীদের নাম এবং মনোনয়ন সংক্রান্ত অন্যান্য তথ্য পরবর্তী ৫০ বছর পর্যন্ত প্রকাশ করা হয় না। অর্থনৈতিক বিজ্ঞানে পুরস্কারের জন্য তারাই প্রার্থী হিসেবে বিবেচিত হবেন যারা যোগ্য ব্যক্তিদের দ্বারা মনোনীত এবং অর্থনৈতিক বিজ্ঞান পুরস্কার কমিটি থেকে বিবেচনার জন্য নাম জমা দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ পেয়েছেন। কেউ নিজেকে মনোনয়ন দিতে পারে না। ইকোনমিক সায়েন্স প্রাইজ কমিটি এমন ব্যক্তিদের কাছে গোপনীয় ফর্ম পাঠায় যারা মনোনীত করার জন্য যোগ্য। যোগ্য মনোনয়নকারী সদস্যরা হলেন:
- রয়্যাল সুইডিশ একাডেমী অব সায়েন্সেসের সুইডিশ এবং বিদেশী সদস্য;
- আলফ্রেড নোবেলের স্মৃতিতে অর্থনৈতিক বিজ্ঞানে Sveriges Riksbank পুরস্কারের পুরস্কার কমিটির সদস্য;
- আলফ্রেড নোবেলের স্মৃতিতে অর্থনৈতিক বিজ্ঞানে Sveriges Riksbank পুরস্কারে ভূষিত ব্যক্তি;
- সুইডেন, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, আইসল্যান্ড এবং নরওয়ের বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজগুলোতে প্রাসঙ্গিক বিষয়ে স্থায়ী অধ্যাপক;
- কমপক্ষে ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজে সংশ্লিষ্ট চেয়ারের ধারক, বিভিন্ন দেশ এবং তাদের শিক্ষার আসনগুলোর মধ্যে যথাযথ বণ্টন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিজ্ঞান একাডেমি দ্বারা প্রাসঙ্গিক বছরের জন্য নির্বাচিত ব্যক্তি; এবং
- অন্যান্য বিজ্ঞানী যাদেরকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য একাডেমী উপযুক্ত মনে করতে পারে।
মনোনয়ন প্রক্রিয়া শুরু হয় সেপ্টেম্বর মাসে মনোনয়ন ফর্ম পাঠানোর মাধ্যমে। ইকোনমিক সায়েন্সেস প্রাইজ কমিটি প্রায় তিন হাজার মনোনয়নকারীকে গোপনীয় ফর্ম পাঠায়। ফর্মগুলো পূরণ করে অবশ্যই পরের বছরের ৩১ জানুয়ারির মধ্যে কমিটির কাছে জমা দিতে হবে। কমিটি ফেব্রুয়ারির মধ্যে প্রাথমিকভাবে প্রায় ২৫০-৩০০ জন প্রার্থী বাছাই করে যাদের নাম একাধিক মনোনীতকারী জমা দেন। পরবর্তীতে ইকোনমিক সায়েন্সেস প্রাইজ কমিটি প্রাথমিকভাবে বাছাইকৃত প্রার্থীদের কাজের মূল্যায়নের জন্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেয়। এই পর্যন্ত আসতে মার্চ থেকে মে পর্যন্ত সময় লাগে।
জুন থেকে আগস্টের মধ্যে একাডেমিতে জমা দেওয়ার জন্য সুপারিশসহ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। প্রতিবেদনে কমিটির সকল সদস্যের স্বাক্ষর থাকে। সেপ্টেম্বরে কমিটি চূড়ান্ত প্রার্থীদের সুপারিশসহ প্রতিবেদন একাডেমির সদস্যদের কাছে জমা দেয়। একাডেমির অর্থনৈতিক বিজ্ঞান বিভাগের দুটি সভায় প্রতিবেদনটি নিয়ে আলোচনা হয়। অক্টোবরের শুরুতে, একাডেমি অব সায়েন্সেস সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের মাধ্যমে অর্থনৈতিক বিজ্ঞানে বিজয়ীদের নির্বাচন করা হয় এবং বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হয়। ডিসেম্বরের ১০ তারিখ ইকোনমিক সায়েন্স পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান স্টকহোমে অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে পুরস্কার বিজয়ীরা তাদের পুরস্কার পান, যার মধ্যে একটি নোবেল পুরস্কার পদক ও ডিপ্লোমা এবং পুরস্কারের পরিমাণ নিশ্চিত করে একটি ডকুমেন্ট থাকে।
ইকোনমিকস নোবেল আদতেই নোবেল?
আলফ্রেড নোবেলের উইল অনুসারে ১৯০১ সাল থেকে যে পাঁচটি সুপ্রসিদ্ধ ও আকর্ষণীয় পুরস্কার দেয়া হয়, আর অর্থশাস্ত্রে প্রদত্ত এ পুরস্কার এক নয়। এর টাকাটাও ‘নোবেল’ ফাউন্ডেশনের মূল পুঁজি থেকে আসে না, আসে সুইডিশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেয়া একটি বড় অনুদান থেকে। নোবেল ফাউন্ডেশন অনুষ্ঠান আয়োজন ও পুরস্কার প্রদানের দায়িত্বে থাকে। সুইডিশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নামের সাথে নোবেল যুক্ত করে পুরস্কারকে অতিরিক্ত মর্যাদা প্রদান করা হয়েছে। এমনকি নোবেল ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইটে লেখা আছে:
The prize in economic sciences is not a Nobel Prize. In 1968, Sveriges Riksbank (Sweden’s central bank) instituted ‘The Sveriges Riksbank Prize in Economic Sciences in Memory of Alfred Nobel’, and it has since been awarded by the Royal Swedish Academy of Sciences according to the same principles as for the Nobel Prizes that have been awarded since 1901.
অপর পাঁচটি পুরস্কারের মতো এ পুরস্কার সম্পর্কেও যাবতীয় তথ্য নোবেলপ্রাইজ ওয়েবসাইটে দেয়া হয়। অর্থনৈতিক বিজ্ঞানে নোবেল মেমোরিয়াল মূল ধারার নোবেল প্রাইজের একই নীতি অনুসরণ করে প্রদান করা হয় বলে একে নোবেল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সহজ ভাষায়, নোবেল ফাউন্ডেশন কর্তৃক আয়োজিত একই নীতিতে ভিন্ন একটি পুরস্কার। মিডিয়া ও অর্থনীতি পেশা একে নোবেল পুরস্কারের মর্যাদা দেয়। তবে নিয়মের নাম যা-ই হোক, সারা বিশ্বে এটি নোবেল পুরস্কার নামেই পরিচিত।
পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে সুইডেনের আর্থিক ব্যবস্থা নিয়ে রাজনৈতিক ঐক্যমতের সাথে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যে বিরোধপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল তার পরিধি ছিল অভ্যন্তরীণ, কিন্তু প্রভাব রেখেছিল বিশ্বব্যাপী। Sveriges Riksbank অবশেষে ১৯৯৯ সালে সরকারের নিয়ন্ত্রণ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে এবং সারা বিশ্বে নীতি নির্ধারকদের ফোকাস বেকারত্বের বিরুদ্ধে লড়াই থেকে মুদ্রাস্ফীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের দিকে স্থানান্তরিত হয়, যেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকাররা আরও বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন।