তাইওয়ান মিরাকল: তাইওয়ানের অর্থনীতি পাল্টে গেল যেভাবে | পর্ব-০৩

[দ্বিতীয় পর্ব পড়ুন]

তাইওয়ানে ১৯৫৩ সালে ভূমি সংস্কার আইনের মাধ্যমে জমিদারি ব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘটানোর পর অসংখ্য পতিত জমি চাষের আওতায় চলে আসে। এতে দেশের মোট জাতীয় উৎপাদন বেড়ে যায়। কৃষিখাত প্রাপ্ত উদ্বৃত্ত মুনাফা থেকে পুঁজিপতিরা শিল্পখাতে বিনিয়োগ শুরু করে। কিন্তু তাইওয়ানের বাজার আগে থেকেই বিদেশি পণ্যে সয়লাব থাকার কারণে দেশি শিল্পের প্রসার ঘটছিল না তেমন। চিয়াং কাই শেকের নেতৃত্বাধীন কুয়োমিনতাং সরকার সেজন্য পৃথিবীর অনেক উন্নয়নশীল দেশের মতো ‘ইমপোর্ট সাবস্টিটিউশন ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশন’ নীতি গ্রহণ করে।

দেশীয় শিল্প টিকিয়ে রাখতে এই ধরনের পদক্ষেপ জরুরি ছিল। কুয়োমিনতাং সরকার বিদেশি পণ্যের পরিমাণ নির্ধারণ করে দেয়, এছাড়া প্রতিটি পণ্যের উপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করে। এতে বিদেশি কোম্পানিগুলো আগের মতো মুনাফা অর্জন করতে পারছিল না। উপরন্তু বিভিন্ন বিধিনিষেধ ও কড়া শুল্ক ব্যবস্থার জন্য পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় আগের মতো সস্তা মূল্যে পণ্য সরবরাহ সম্ভব হচ্ছিল না তাদের পক্ষে। তাই তাইওয়ানের শিল্পপণ্যের বাজার থেকে তারা ধীরে ধীরে সরে যায়, তাইওয়ানের নিজস্ব শিল্পগুলো তাদের সরে যাওয়ার ফলে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছিল, সেটিও পূরণ করে।

প্রধানত তিনটি শিল্পের ক্ষেত্রে ‘ইমপোর্ট সাবস্টিটিউশন ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশন’ নীতি গ্রহণ করা হয়– কীটনাশক, প্লাস্টিক ও পোষাক। এর মধ্যে কীটনাশক শিল্প সরকারি মালিকানায় পরিচালিত হলেও প্লাস্টিক ও পোষাকশিল্প বেসরকারি মালিকানায় ছেড়ে দেয়া হয়। পোষাকশিল্পের ক্ষেত্রে যেন কোনো ক্ষতি না হয়, সেজন্য সরকার উৎপাদিত পণ্যগুলোর বিক্রয় নিশ্চিত করত। এই তিনটি শিল্পকে বাড়তি সুবিধা প্রদানের জন্য করও মওকুফ করা হয়। বাইরের দেশের কোনো প্রতিষ্ঠান এসে যেন এই পণ্যগুলোর বাজার নষ্ট করতে না পারে, সেটাও সরকারের পক্ষ থেকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হতো। বিদেশি সাহায্যের এক বড় অংশ ব্যয় হতো এই শিল্পগুলোর পেছনে। যেমন– আমেরিকান সরকারের পক্ষ থেকে সাহায্য হিসেবে নগদ অর্থ না দিয়ে সুতা প্রদান করা হতো। তাইওয়ান সরকার ভর্তুকি হিসেবে টেক্সটাইল শিল্পে এই সুতাগুলো প্রদান করতো। এতে পোষাকশিল্পে উৎপাদন খরচ কমে আসে। এসব শিল্পে যেন দুর্নীতি না হয়, সেই সম্পর্কেও সরকার সজাগ ভূমিকা পালন করে।

পগেগেগেগপগ
‘ইমপোর্ট সাবস্টিটিউশন ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশন’ নীতির সুবিধাপ্রাপ্ত তিন শিল্পের একটি ছিল তাইওয়ানের পোষাক শিল্প;
image source: taiwantoday.tw

কীভাবে তাইওয়ানের অর্থনীতিতে শিল্পখাতের প্রসার ঘটলো, তা দেখে নেওয়া যায় পরিসংখ্যানের মাধ্যমে। ১৯৪৯-৬২ সাল পর্যন্ত প্রতিবারই তাইওয়ানের অর্থনীতিতে কৃষিখাত, শিল্পখাতের চেয়ে বেশি অবদান রাখে। ১৯৫২ সালে তাইওয়ানের অর্থনীতিতে কৃষিখাতের অবদান ছিল প্রায় ৩২.২০ শতাংশ, অপরদিকে শিল্পখাতের অবদান ছিল মাত্র ১৬.৭০ শতাংশ। ১৯৬১ সালে অর্থনীতিতে শিল্পখাতের অবদান বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ২৩.৭০ শতাংশে, কৃষিখাতের অবদান কমে দাঁড়ায় ২৫ শতাংশে। ১৯৬২ সালে তাইওয়ানের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো অর্থনীতিতে কৃষিখাতের আধিপত্য কমিয়ে দিয়ে শিল্পখাত সবচেয়ে বড় অবদান রাখে। পরিষ্কারভাবে দেখা যাচ্ছে, দশ বছরের ব্যবধানে তাইওয়ানের অর্থনীতিতে শিল্পখাতের প্রভাব অনেক বেশি বেড়ে গিয়েছিল, অপরদিকে ক্রমান্বয়ে কমে আসছিল কৃষিখাতের অবদান। শিল্পখাতের প্রসার ঘটার জন্য তাইওয়ানের অর্থনীতি ধীরে ধীরে রপ্তানিনির্ভর হতে শুরু কর। এভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয় দেশটির পক্ষে। আর এই দশ বছরে শিল্পখাতের গড় বৃদ্ধি ঘটছিল ১২.৩৯ হারে, যেখানে কৃষিখাতে তা ছিল ৪.২৪ হারে।

যেহেতু চীনের জাতীয়তাবাদী কুয়োমিনতাং সরকার চীন থেকে পালিয়ে এসেছিল, তাই স্বাভাবিকভাবেই চীনের মাও সে তুং নেতৃত্বাধীন সরকারের সাথে তাদের বৈরিতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। আমেরিকা এই সুযোগে তাইওয়ানের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে। কুয়োমিনতাং সরকার বুঝতে পেরেছিল, চীনের লাল আগ্রাসন থেকে বাঁচতে সামরিক বাহিনীর আধুনিকীকরণ ও পশ্চিমের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের বিকল্প নেই। এজন্য আমেরিকা ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশ থেকে যখন বড় অংকের অনুদান ও সাহায্য আসতে শুরু করে, তখন তাইওয়ান সরকার নিজেদের অর্থনীতির স্বার্থেই সেগুলো গ্রহণ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যেসব দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ ছিল, সেসব দেশে কমিউনিস্টদের রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের সম্ভাবনা ছিল। এজন্য যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর তড়িঘড়ি করে আমেরিকা ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তা প্রদান করে। তাইওয়ান এভাবেই বৈদেশিক অনুদান ও সাহায্য পাওয়া শুরু করে। অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করেন, সেসময় আমেরিকার সাহায্য না পেলে তাইওয়ান এত দ্রুত যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠে শিল্পখাতের প্রসার ঘটাতে পারত না।

ওতওতওগকআ
চীনের সামরিক আগ্রাসন থেকে বাঁচতে আমেরিকার সহায়তায় তাইওয়ান সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়ন শুরু করে;
image source: thinkchina.sg

তাইওয়ানের কুয়োমিনতাং সরকার ‘ইমপোর্ট সাবস্টিটিউশন ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশন’ নীতি গ্রহণ করে স্থানীয় উদীয়মান শিল্পগুলোকে বাড়তি সুবিধা দেয়ার জন্য। প্রায় দশ বছর ধরে এই সুবিধা কাজে লাগিয়ে একসময় স্থানীয় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো শক্ত ভিত্তি লাভ করে। সেজন্য ষাটের দশকের শুরুর দিকে যখন দেশীয় কোম্পানির পণ্যে তাইওয়ানের বাজার সয়লাব হয়ে যায়, তখন এই নীতির প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে আসে। আমদানি পণ্যের উপর বিধিনিষেধ আরোপ, বাড়তি কর আরোপ এসব কারণে আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্ব খুব বেশি খুশি ছিল না। একসময় আমেরিকা তাদের সাহায্য ও অনুদান প্রদান বন্ধ করে দেয়। যেহেতু আগের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা সফলভাবে বাস্তবায়ন হয়ে গিয়েছিল, তাই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কুয়োমিনতাং সরকারের প্রয়োজন ছিল নতুন অর্থনৈতিক পরিকল্পনা হাতে নেয়া, যা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রাখতে সহায়ক হবে। এজন্য পরবর্তীতে রপ্তানিসহায়ক অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণ করা হয়।

বিশ্ববাজারে তাইওয়ান সুবিধা করতে পারবে কি না– সেই সম্পর্কে কুয়োমিনতাং সরকার বেশ সন্দিহান ছিল। কিন্তু আমেরিকা ও তাইওয়ানের অর্থনীতিবিদদের পরামর্শে তারা রপ্তানিভিত্তিক অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করে। তাইওয়ান সরকার দেখতে পায়, রপ্তানি বাণিজ্যের মাধ্যমে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। হাতে পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা থাকলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সহজ হয়ে ওঠে, বিভিন্ন শিল্পের কাঁচামাল কেনা যায় সহজেই। বলে রাখা ভালো, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে তাইওয়ানে মুদ্রাস্ফীতি ও বৈদেশিক মুদ্রার অভাব ছিল খুব বেশি, যা কুয়োমিনতাং সরকারকে বেশ ভোগায়। আমেরিকা যে পরিমাণ বৈদেশিক সহায়তা ও অনুদান প্রদান করত, সেটি তাইওয়ানের মোট জাতীয় উৎপাদনের প্রায় ৬ শতাংশ ছিল। আমেরিকা বন্ধ করে দেয়ার ফলে দেশের বাজেট ঘাটতির যে সম্ভাবনা ছিল, সেটাও কাটিয়ে ওঠার প্রধান কৌশল ছিল রপ্তানিভিত্তিক বাণিজ্যিক পরিকল্পনা প্রণয়ন।

িতপএপগপগগ
আমেরিকার সাহায্য তাইওয়ানের অর্থনীতির বিকাশে বড় ভূমিকা রেখেছিল; image source: ibon.org

কুয়োমিনতাং সরকার চীনের মূল ভূখণ্ড থেকে পালিয়ে তাইওয়ানে আসার পর দেশে ব্যাপক অভিবাসন ঘটে। কারণ চিয়াং কাই শেক নেতৃত্বাধীন জাতীয়তাবাদী সরকারের অনুগত সরকারি কর্মচারী, সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা ও সৈন্যসহ অসংখ্য ব্যক্তি চীনের মূল ভূখণ্ড থেকে পালিয়ে তাইওয়ানে চলে আসে। এই বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থানও কুয়োমিনতাং সরকারের চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। পরবর্তীতে অর্থনীতিবিদদের পরামর্শে সরকার বুঝতে পারে, যদি রপ্তানিভিত্তিক বাণিজ্য পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়, তাহলে স্বাভাবিকভাবে দেশীয় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাণিজ্য সম্প্রসারণ করতে হবে। এতে তাদের প্রতিষ্ঠানে আরও বেশি পরিমাণ শ্রমিক প্রয়োজন হবে, যা বাড়তি অভিবাসীদের দ্বারা পূরণ করা সম্ভব। ফলে চীন থেকে যে মানুষগুলো তাইওয়ানে আসে, তাদের বেকারত্ব কুয়োমিনতাং সরকারের উপর খুব বেশি চাপ সৃষ্টি করবে না। আর সস্তাশ্রমের জন্য বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোকেও দুশ্চিন্তা করতে হবে না।

Related Articles

Exit mobile version