জলদস্যু নামটা শুনলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে রুক্ষ স্বভাবের এক নাবিকের চেহারা। যার আপাদমস্তক ময়লা আর বিদঘুটে পোশাকে ঢাকা। বিস্তীর্ণ ফেনিল জলরাশির বুক চিরে সে তার দলবল নিয়ে ঘুরে বেড়ায় আর ওঁত পেতে থাকে লুণ্ঠনের আশায়। সুযোগ পেলেই আক্রমণ করে জিম্মি করে ফেলে জাহাজের সবাইকে। তারপর তাদের মালামাল কব্জা করে দ্রুত সেখান থেকে সটকে পড়ে। কখনোবা হত্যা করে ফেলে জিম্মিদের। গল্প-সিনেমার বদৌলতে জলদস্যুদের নিয়ে রোমাঞ্চকর সব ঘটনা সম্পর্কে জানি আমরা। বারবারোসা ব্রাদার্স, স্যার ফ্রান্সিস ড্রেক, ক্যাপ্টেন কিড এর মতো ভয়ানক জলদস্যুদের গল্প আমরা হয়তো শুনেছি। তবে নারী পাইরেটরাও সমুদ্রের বুকে কম ত্রাস তৈরি করেনি। এমন কয়েকজন নারী জলদস্যুর গল্পই শুনব আজ।
১. র্যাচেল ওয়াল
ঐতিহাসিকদের মতে, র্যাচেল ওয়াল ছিলেন একমাত্র আমেরিকান নারী পাইরেট। পেনসিলভানিয়ায় জন্ম নেওয়া র্যাচেল খুব অল্প বয়সেই ঘর ছেড়েছিলেন। ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে জর্জ ওয়াল নামক এক জেলেকে বিয়ে করেন তিনি। বিয়ে করার পর তারা বোস্টনে চলে আসেন এবং জীবিকা নির্বাহের তাগিদে একসময় অপরাধ জগতের সঙ্গে জড়িয়ে যান। তাদের পরিকল্পনামতো, ১৭৮১ সালে আরও কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে একটি ছোট বোট কেনেন। নতুন সঙ্গীদের নিয়ে ওয়াল দম্পতি নিউ ইংল্যান্ডের উপকূল ধরে যাত্রা শুরু করেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল অন্য জাহাজগুলোর কাছে নিজেদেরকে ঝড়ে আক্রান্ত জেলে হিসেবে উপস্থাপন করা। কোনো জাহাজ যদি তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে, তবে উদ্ধারকারীদের আক্রমণ করে সব লুটে নেবেন তারা।
তাদের পরিকল্পনা খুবই নিখুঁত ছিল, যার কারণে বহু জাহাজকে তারা বোকা বানাতে সক্ষম হয়েছিলেন। এভাবেই পুরো এক বছর তারা কোনোরকম ঝামেলা ছাড়াই উপকূলীয় এলাকায় নিজেদের রাজত্ব বজায় রাখেন।
কেউ ওয়াল দম্পতির জলদস্যুতার পথে বাধা হয়ে না দাঁড়াতে পারলেও, প্রকৃতি ঠিকই তাদের বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ১৭৮২ সালে এক প্রবল সামুদ্রিক ঝড়ের কবলে পড়ে জর্জসহ আরও কয়েকজন জলদস্যু মারা যায়। ভাগ্যগুণে র্যাচেল বেঁচে যান এবং জলদস্যুতার কাজ ছেড়ে দেন।
স্বামীকে হারিয়ে তিনি আবারো একা হয়ে পড়েন। একা হলেও জীবিকার তাগিদে তিনি ছিনতাইয়ের কাজ শুরু করেন। বেশ কিছু বছর ছিনতাই করেই কাটিয়ে দেন। কিন্তু এখানেও তার ভাগ্য খুব একটা সহায় হলো না। ১৭৮৯ সালে বোস্টনে এক নারীর কাছ থেকে ছিনতাইয়ের অপরাধে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার বিরুদ্ধে জলদস্যুতাসহ বেশ কয়েকটি অভিযোগ আনা হয়। সবগুলো অভিযোগ প্রমাণিত হয় এবং সে বছরের ৮ই অক্টোবর, তার ফাঁসির রায় দেয় বোস্টনের একটি আদালত।
২. রানী থিউটা
খ্রিস্টপূর্ব ২৩১ সালে ইলিরিয়া’র রাজা অ্যাগ্রনের মৃত্যু হলে তার সন্তানকে সিংহাসনে বসানো হয়। কিন্তু সন্তান প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়ায় মা থিউটা শাসনকাজ পরিচালনার সুযোগ পান। ইলিরিয়া’র আশপাশের অঞ্চলগুলোর উপর প্রভাব বিস্তার করতে রানী থিউটা তৎপর ছিলেন। তবে প্রচলিত সামরিক অভিযানে না গিয়ে অভিনব এক কায়দা প্রয়োগ করেন তিনি। নিজের চার বছরের শাসনামলে জলদস্যুতার মাধ্যমে আশপাশের এলাকাগুলোকে অস্থিতিশীল করে তোলেন।
রোমানদের বাণিজ্যিক জাহাজগুলো প্রতিনিয়ত থিউটা’র জলদস্যু বাহিনী দ্বারা আক্রান্ত হতে শুরু করে। একসময় অ্যাড্রিয়াটিক সাগর থেকে আয়নিয়ান সাগর পর্যন্ত নিজের প্রভাব বলয় তৈরি করেন তিনি। এতে করে গ্রিস এবং ইতালির বাণিজ্যিক পথগুলো হুমকির মুখে পড়ে যায়।
আর রানী থিউটা’র এরকম ক্ষমতাবান হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান আর্দিয়াই উপজাতির। ইতোপূর্বে তাদের সঙ্গে ইলিরিয়া’র শীতল সম্পর্ক থাকলেও সেটা ঘুচে যায়। আর্দিয়াই উপজাতিকে জীবিকার সন্ধান দিয়ে রানী তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি করেন।
এদিকে রোমানরা নিজেদের ধৈর্য হারিয়ে ইলিরিয়া’য় নিজেদের প্রতিনিধি দল পাঠায়। তাদের অবাক করে দিয়ে থিউটা জানান, “তার উপজাতি জলদস্যুতাকে বৈধ ব্যবসায়ের অংশ হিসাবে দেখছে!” শান্তি আলোচনা নাগালের বাইরে চলে যায় যখন, তখন রোমানদের পাঠানো প্রতিনিধিদের বন্দী করা হয় এবং পরে হত্যা করা হয়।
থিউটার কাছ থেকে এমন জবাব পেয়ে রোমান বাহিনী দফায়-দফায় ইলিরিয়া আক্রমণ করে। দু বছরের সামরিক অভিযানের পর থিউটা হার মানতে বাধ্য হন। নিজের সিংহাসন ছেড়ে দেওয়া এবং আর্দিয়াই উপজাতি রোমানদের বার্ষিক কর দেওয়ার শর্তে রোমানরা সামরিক অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা করে। পরবর্তী সময়ে রানী থিউটা আবার নিজের বাহিনী সংগঠিত করতে চাইলেও সফল হননি।
৩. গ্রেস ও’মালে
গ্রেস ও’মালে এমন এক সামাজিক প্রেক্ষাপটে বেড়ে উঠেছিলেন, যেখানে নারীদের শিক্ষাগ্রহণ এবং বাড়ি থেকে বের হওয়া ছিল একরকম নিষিদ্ধ। ঠিক সেই সময়ে সমুদ্রের বুকে ২০টি জাহাজের এক বিশাল বহর নিয়ে জলদস্যুতার পেশা শুরু করেছিলেন তিনি। ব্রিটিশ রাজতন্ত্রকে বুড়ো আঙুল দেখানো গ্রেস জন্মেছিলেন এক প্রভাবশালী পরিবারে। যে পরিবার পশ্চিম আয়ারল্যান্ডের উপকূলে নিজেদের রাজত্ব কায়েম করেছিল। ১৫৬০ এর দশকে পরিবারের কর্তৃত্ব লাভ করার পর পারিবারিক ঐতিহ্যকে আরও চাঙ্গা করে তোলেন গ্রেস ও’মালে।
ইংরেজ ও স্প্যানিশ বাণিজ্যিক জাহাজগুলোতে লুণ্ঠন চালানোই ছিল তার বাহিনীর প্রধান মিশন। তাছাড়া প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষের সর্দারদের আক্রমণের পারিবারিক ঐতিহ্যও ধরে রেখেছিলেন গ্রেস। সমুদ্রে তার অভিযান এবং শেষে পালানোর গল্পগুলো নিয়েও অনেক কিংবদন্তি তৈরি হয়েছে। এরকম কথাও প্রচলিত আছে যে, সন্তান প্রসবের পরদিনই নাকি আবার অভিযানে বেরিয়েছিলেন এই নারী পাইরেট!
১৫৭৪ সালে ব্রিটিশ রাজপরিবারের সামরিক বাহিনী গ্রেস ও’মালে’র বিরুদ্ধে সমুদ্রে অভিযান পরিচালনা করে। এই অভিযানে গ্রেস ধরা পড়লে তাকে ১৮ মাসের জন্য জেলে যেতে হয়। জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর গ্রেস আবার নিজের পুরনো পেশায় ফিরে যান। তার জলদস্যু বাহিনীকে রুখতে এবার ব্রিটিশরা বড় নৌবহর প্রেরণ করে। সামুদ্রিক অভিযান শেষে গ্রেস ও’মালে এবং তার সন্তানদের বন্দি করা হয়।
গ্রেস রানী এলিজাবেথের কাছে মুক্তির আবেদন করেন। তাকে এবং তার সন্তানদের পরবর্তীতে মুক্তি দেওয়া হয়। তবে শর্ত ছিল, তারা আর কখনো জলদস্যুতার সঙ্গে নিজেদের জড়াবে না। কিন্তু চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করে তারা আবার সমুদ্রে নেমেছিলেন। ১৬০৩ সালে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত সমুদ্রে নিজের অপকর্ম চালু রেখেছিলেন গ্রেস ও’মালে।
৪. চ্যাং সাও
জলদস্যুতার ইতিহাসে ভয়ঙ্কর এক নারীর নাম চ্যাং সাও। অল্প বয়সেই জলদস্যুদের দ্বারা অপহৃত হন তিনি। পরবর্তীতে ১৮০১ সালে দুর্ধর্ষ চীনা পাইরেট চ্যাং-কে বিয়ে করেন। দু’জনে মিলে নিজেদের আরও শক্তিশালী জলদস্যু বাহিনীতে রূপান্তর করেন। তাদের শ’খানেক জাহাজ আর ৫০,০০০ এর বেশি লোকবল ছিল। যারা মূলত দক্ষিণ চীন সাগরে মাছ ধরার নৌকা এবং পণ্যবাহী জাহাজগুলোতে আক্রমণ করত। সেইসঙ্গে উপকূলবর্তী গ্রামগুলোও তাদের হাত থেকে রেহাই পায়নি।
১৮০৭ সালে স্বামীর মৃত্যুর পর বিশাল এই বাহিনীর দায়িত্ব এসে পড়ে সাও-এর উপর। নিজের বিশ্বস্ত সহযোগী চ্যাং পাও-কে সঙ্গে নিয়ে তিনি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দিকে নজর দেন। পরের কয়েক বছর এ অঞ্চলে লুটপাট চালায় তার বাহিনী। ফলে, এসব অঞ্চলের নৌবাহিনীগুলোর সহজ লক্ষ্যবিন্দুতে পরিণত হন চ্যাং।
নিজ বাহিনীর অভ্যন্তরে শৃঙ্খলা রক্ষার ব্যাপারে কঠোর ছিলেন এই নারী। তাই কোনো বন্দি নারীকে ধর্ষণের শাস্তি হতো মৃত্যুদণ্ড। নিজ বাহিনীতে শৃঙ্খলা আর শত্রুদের প্রতি অমানবিক হওয়ার কারণেই এই অঞ্চলের পরাশক্তিতে পরিণত হয় তার বাহিনী। যা চীনাদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
১৮১০ সালে ব্রিটিশ এবং পর্তুগিজ নৌবাহিনী যৌথভাবে চ্যাং সাও-এর বাহিনীর বিরুদ্ধে নৌ অভিযান শুরু করে। ফলে, চ্যাং একসময় আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন। আত্মসমর্পণ করলেও নিজের অবৈধ সম্পদ ছেড়ে দিতে রাজি ছিলেন না তিনি। ফলে সেগুলো হেফাজতে রেখেই তাদের জাহাজগুলো ডুবিয়ে দেওয়া হয়। অবসরে গেলেও জলদস্যুতা থেকে প্রাপ্ত অর্থ তিনি জুয়ার ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছিলেন। ১৮৪৪ সালে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত চ্যাং এই ব্যবসা চালিয়ে যান।
৫. জ্যানি ডি ক্লিসন
জ্যানি ডি ক্লিসন এর গল্পটা অন্য সবার চেয়ে আলাদা। জলদস্যুতার পথে পা বাড়ানোর মতো কোনো পরিবেশে বড় হননি তিনি। কিন্তু নিয়তি তাকে বাধ্য করেছে প্রতিশোধ নিতে। তৃতীয় অলিভার ডি ক্লিসনের স্ত্রী ছিলেন জ্যানি, তাদের পাঁচটি সন্তানও ছিল। সবমিলিয়ে ফ্রান্সের ব্রিটানি’র সম্ভ্রান্ত নারীর তকমা জুটেছিল তার। কিন্তু ইংল্যান্ড আর ফ্রান্সের মধ্যকার স্থলযুদ্ধ শুরু হলে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে স্বামী অলিভারকে মৃত্যুদণ্ড দেন ফ্রান্সের রাজা ষষ্ঠ ফিলিপ। স্বামী হত্যার প্রতিশোধ নিতে বদ্ধপরিকর ছিলেন জ্যানি।
তাই নিজের সকল সম্পত্তি বিক্রি করে তিনটি যুদ্ধজাহাজ তৈরি করেন এবং একটি বাহিনী গঠন করেন। যে বাহিনীর নামকরণ করেন ‘ব্ল্যাক ফ্লিট’। তার সবগুলো জাহাজই কালো রঙের ছিল, যাদের পালগুলো রক্তলাল কাপড় দিয়ে তৈরী। ১৩৪৩-১৩৫৬ সাল পর্যন্ত ইংলিশ চ্যানেল জুড়ে রাজত্ব গড়ে তুলেন জ্যানি ডি ক্লিসন। এই পথে চলাচল করা রাজা ফিলিপের সকল জাহাজ একে একে ডুবিয়ে দিতে শুরু করে তার বাহিনী। তাদের মালামালগুলো সাগরে ফেলে দেওয়া হয়, সেইসঙ্গে নৌভ্রমণে বের হওয়া সকল ধনীদেরও শিরশ্ছেদ করা হয়।
রাজা ফিলিপের বাহিনী বারবার জ্যানি ডি ক্লিসনের বাহিনীকে তাড়া করলেও দমাতে সক্ষম হয়নি। একসময় নিজের প্রতিশোধ পূরণ হয়েছে ধরে নিয়ে ক্ষান্ত দেন তিনি। সমুদ্র থেকে ফিরে এসে আবার বিয়ে করেন জ্যানি। ১৮৫৯ সালে ‘ডি ক্যাসল’-এ ফিরে আসার পর এখানেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। তখন থেকেই ডি ক্যাসল নিয়ে নানা কিংবদন্তি ডালপালা মেলতে শুরু করে।