তের শতকের শেষ ভাগে ওঘুজ তুর্কী গোত্র নেতা ওসমান গাজীর হাত ধরে আনাতোলিয়ার উত্তর-পশ্চিমাংশে যাত্রা শুরু করে অটোম্যান সাম্রাজ্য। ইতিহাস বিখ্যাত এ সাম্রাজ্য পৃথিবীর বুকে টিকে ছিলো প্রায় ছয় শতাব্দী ধরে। চৌদ্দ শতকের মাঝামাঝি সময়ে তারা ইউরোপের দিকে অগ্রসর হয় এবং বলকান অঞ্চল জয়ের মাধ্যমে একটি আন্তঃমহাদেশীয় শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। পনের শতকের মাঝামাঝি সময়ে কনস্টান্টিনোপল জয়ের মাধ্যমে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের পতন ঘটান অটোম্যান সুলতান দ্বিতীয় মেহ্মেদ।
অটোম্যান সাম্রাজ্য তার ক্ষমতার সোনালী সময়টি পার করেছে অবশ্য ষোড়শ-সপ্তদশ শতকের সময়কালটিতে। তখন তাদের নেতা হিসেবে সিংহাসনে আসীন ছিলেন সুলতান প্রথম সুলাইমান। তখন এটি একটি বহুজাতিক, বহুভাষিক সাম্র্যাজ্যে পরিণত হয়েছিলো। দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের অধিকাংশ, মধ্য ইউরোপের কিছু অঞ্চল, পশ্চিম এশিয়া, ককেশাস অঞ্চল, উত্তর আফ্রিকা এবং হর্ন অফ আফ্রিকা বলে পরিচিত উত্তর-পূর্ব আফ্রিকার উপদ্বীপের উপর ছিলো তাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ।
আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময়ে এসে অবশ্য দৃশ্যপট পাল্টাতে শুরু করে। প্রায় সাড়ে চারশ বছর বয়সী এ সাম্রাজ্যেটিও যেন তখন বয়সের ভারে ন্যুজ হওয়া শুরু করেছিলো। ইউরোপীয় প্রতিপক্ষ রাশিয়ান সাম্রাজ্য ও হ্যাবসবুর্গ সাম্রাজ্যের তুলনায় তাদের সামরিক শক্তি ততদিনে হ্রাস পাওয়া শুরু করেছিলো। এরই ফলস্বরুপ আঠারো শতকের শেষ এবং উনিশ শতকের শুরুর দিকে বেশ কিছু যুদ্ধে পরাজয় মেনে নিতে হয় তাদের।
পরবর্তীতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় নিজেদের হারানো গৌরব ফিরে পাবার আশায় জার্মানীর সাথে বন্ধুত্বের হাত মেলায় তারা। অবশ্য ততদিনে অটোম্যান সাম্রাজ্যের ঘরের ভেতরেও আগুন লেগে গিয়েছিলো। বিশেষ করে অটোম্যানদের হাত থেকে মুক্তির উদ্দেশ্যে শুরু হওয়া আরব বিদ্রোহ বেশ ভালোই ঝামেলা তৈরি করেছিলো সাম্রাজ্যটির অগ্রযাত্রার পথে। আর্মেনিয়ান, অ্যাসাইরিয়ান ও গ্রীকদের উপর চালানো গণহত্যার কথা এক্ষেত্রে অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয় অটোম্যান সাম্রাজ্যের সূর্য অস্তমিত হবার পথে চূড়ান্ত ভূমিকাটি পালন করলো। এরপর তাদের অধীনে থাকা বিভিন্ন অঞ্চলই হাতছাড়া হয়ে যেতে থাকে। প্রায় ছয়শ বিশ বছরের বৃদ্ধ অটোম্যান সাম্রাজ্যের জন্য শেষ পর্যন্ত কবর খুঁড়েছিলো তুর্কীদের স্বাধীনতা যুদ্ধ। এ যুদ্ধে তুর্কীদের বিজয়ই বিশ্বে অটোম্যান সুলতানী শাসন ব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘটিয়ে দেয়, পতন ঘটায় ইসলামিক খেলাফতের। সেই হিসেবে অটোম্যান রাজবংশের দ্বিতীয় আব্দ আল-মাজিদকেই বলা যায় এখন পর্যন্ত মুসলিম বিশ্বের সর্বশেষ খলিফা।
দীর্ঘ এ সময়কালে নানা ঘাত-প্রতিঘাত, উত্থান-পতন, জয়-পরাজয়ের মাঝে দিয়ে গিয়েছে সাম্রাজ্যটি। ছয় শতাব্দী জুড়ে বিস্তৃত এ শাসনামলে মোট ছত্রিশজন সুলতান বসেছিলেন অটোম্যানদের নেতার আসনে। অভ্যুদয়, অরাজকতা, বিস্তৃতি, রুপান্তর, নিশ্চলাবস্থা ও পুনর্গঠন, আধুনিকীকরণ ও অবসান- এ সাত ভাগে ভাগ করা যায় ছত্রিশ সুলতানের শাসনামলকে।
অটোম্যান সাম্রাজ্যের অভ্যুদয়
অটোম্যান সাম্রাজ্যের অভ্যুদয়ের সময়কে মোটামুটি ১২৯৯ সালে এর প্রতিষ্ঠা লাভ থেকে শুরু করে ১৪৫৩ সালে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টান্টিনোপল জয় পর্যন্ত বিস্তৃত বলে ধরে নেয়া যায়। এ সময়েই পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন সুলতানের শাসনামলে বিকশিত হতে থাকে অটোম্যান সাম্রাজ্য। শুরুতে পার্শ্ববর্তী অন্যান্য রাজ্যের মতো অটোম্যান সাম্রাজ্যও নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে মূলত স্থানীয় নানা সেনাপতি ও সামন্ত রাজ্যের শাসনের উপর নির্ভরশীল ছিলো। ধীরে ধীরে সময় যেতে থাকে, পরিবর্তিত হতে থাকে অটোম্যান সাম্রাজ্যের অবস্থাও। সামরিক-অর্থনৈতিক উন্নতি তাদের রাজ্য বিস্তারের পক্ষে আরো সহায়ক ভূমিকা পালন করতে থাকে।
এ সময়ে অটোম্যানদের সফলতার পেছনে একক কোনো কারণকে মূল নিয়ামক হিসেবে দাঁড়া করাতে নারাজ ঐতিহাসিকেরা। বরং তাদের মতে পরিবর্তিত নানা পরিবেশের সাথে দ্রুত নিজেদের খাপ খাওয়াতে পারাই ছিলো নবগঠিত রাজ্যের সফলতার মূল কারণ। পনের শতকের মাঝামাঝি সময়ে গিয়ে তৎকালীন অটোম্যান সুলতান যেন প্রকৃত সুলতানির স্বাদ পেলেন। এতদিন ধরে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা সাম্রাজ্যের সুলতানের হাতে তখন কেন্দ্রের শাসন প্রতিষ্ঠা করার মতো যথেষ্ট ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব এসেছিলো। আর এর সুফল ভোগ করা প্রথম সুলতান হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন সুলতান দ্বিতীয় মেহ্মেদ।
অটোম্যান সাম্রাজ্যের অভ্যুদয়কালীন সুলতানদের মাঝে একে একে সিংহাসনে এসেছেন ওসমান গাজী, ওরহান গাজী, প্রথম মুরাদ ও প্রথম বায়েজিদ। আজকের মূলত ওসমান গাজীকে ঘিরেই সাজানো হয়েছে আমাদের পুরো লেখা।
ওসমান গাজী
অটোম্যান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ওসমান গাজী। ১২৯৯ সালে তার হাত ধরে যাত্রা শুরু করা অটোম্যান সাম্রাজ্যের সূর্য ১৯২২ সালে সুলতানি শাসনের বিলোপ সাধনের মধ্য দিয়ে অস্ত যায়। কারো কারো মতে ১৯২৩ সালে রিপাবলিক অফ টার্কির অভ্যুদয়ের মাঝ দিয়ে, আবার কারো মতে ১৯২৪ সালে খেলাফতের পতনের মাঝ দিয়ে পতন ঘটে ওসমান গাজীর প্রতিষ্ঠিত অটোম্যান সাম্রাজ্যের।
দুঃখজনক ব্যাপার হলো- ওসমান গাজীর শাসনামল সম্পর্কে খুব কমই জানা গিয়েছে। তার মৃত্যুর প্রায় এক শতাব্দী পর ঐতিহাসিকেরা তার জীবনী রচনায় হাত দিয়েছিলেন। তাই ওসমান গাজীর জীবন সম্পর্কে প্রচলিত কথাগুলোর কোনটা বাস্তব আর কোনটা কাল্পনিক, সেগুলোর মাঝে পার্থক্য করা ঐতিহাসিকদের জন্য বেশ কঠিনই বটে।
ওসমান গাজী কবে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সেই বিষয়েও রয়েছে বিতর্ক। ১২৫৪, ১২৫৫ কিংবা ১২৫৯- এ তিন বছরের যেকোনো একটিতেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি। তার জন্মের সময়ের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে একটু কথা না বললেই নয়।
মোটামুটি ৩৩০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে যাত্রা শুরু করা বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের বয়স ততদিনে নয়শ বছর ছাড়িয়ে গিয়েছিলো। তখন কনস্টান্টিনোপল ছিলো এর রাজধানী। স্বাভাবিকভাবেই অতীতের জৌলুশ অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছিলো সাম্রাজ্যটি। ১২০৪ খ্রিষ্টাব্দে চতুর্থ ক্রুসেডের সময় ল্যাটিন নাইটদের হাতে কনস্টান্টিনোপলের পতন যেন বাইজান্টাইনদের দুর্বলতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। এ বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের পূর্ব পাশে ছিলো সেল্জুক সাম্রাজ্য। পূর্ব এশিয়া মাইনর, সিরিয়া, মেসোপটেমিয়া, আর্মেনিয়া, পারস্যের কিছু অংশ এবং পশ্চিম তুর্কিস্তান ছিলো এ সেল্জুক সাম্রাজ্যের অন্তর্গত। তবে মোঙ্গল অধিপতি চেঙ্গিস খানের আক্রমণে এ সেল্জুকদের অবস্থাও হয়ে পড়েছিলো বেশ নাজুক। শেষ পর্যন্ত কোজাদাঘের যুদ্ধে মোঙ্গলদের কাছে চূড়ান্ত পরাজয়ে সেল্জুকরা তাদের বশ্যতা মেনে নিতে বাধ্য হয়। তবে সেল্জুকদের শাসন ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করার আগ্রহ ছিলো না মোঙ্গলদের। তাই শুধুমাত্র তাদের কাছ থেকে বার্ষিক কর নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতো তারা। একদিকে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের দুর্বলতা, অন্যদিকে সেল্জুকদের পরাজয় বরণ এবং সবশেষে মোঙ্গলদেরও কোনো আরোপিত শাসন ব্যবস্থা না থাকায় এশিয়া মাইনরে কেমন যেন এক থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছিলো।
এই সেল্জুক ও বাইজান্টাইনদের সীমান্তবর্তী এক এলাকায় অনেক জাতি-ধর্ম-বর্ণের লোকের বাস ছিলো। এখানে যেমন শহুরে সভ্য লোকেরা থাকতো, তেমনি সন্ধান মিলতো যাযাবরদেরও। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও মোঙ্গলদের আক্রমণে পূর্বাঞ্চল থেকে সেখানে আসা লোকদের অনেকেই ছিলো তুর্কমান বংশীয়। কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ সেখানে ছিলো না বললেই চলে। পুরো এলাকাটি নানা ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে একেক অংশ একেক নেতা নিয়ন্ত্রণ করতো।
এমনই এক নেতার নাম ছিলো আর্তুগ্রুল। তিনিই ছিলেন ভবিষ্যৎ অটোম্যান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ওসমান গাজীর বাবা। একদিন আর্তুগ্রুল তার ছোট দলটি নিয়ে এশিয়া মাইনরের পশ্চিম দিক বরাবর যেতে যেতে একদল মানুষকে যুদ্ধরত অবস্থায় দেখতে পান। সেখানে একটি দলে সৈন্যসংখ্যা ছিলো তুলনামূলক কম। এর্তোগ্রাল আগপিছ না ভেবে সেই ছোট দলের সাথে ভিড়ে গেলেন নিজের দলটি নিয়ে। শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে সেই ছোট দলটি জয়ীও হয়ে গেলো। এবার আসলো পরিচয়ের পালা। আর্তুগ্রুল জানতে পারলেন যে, ছোট দলটি আসলে ছিলো সেল্জুক সুলতান আলাউদ্দীনের। আর পরাজিত পক্ষটি ছিলো মোঙ্গল আক্রমণকারীদের। আর্তুগ্রুলের এমন কাজে আলাউদ্দীন খুবই খুশী হলেন। তাই তাকে বাইজান্টাইন সীমান্তবর্তী সগুত এলাকার শাসনকর্তা নিযুক্ত করে গেলেন তিনি। বাইজান্টাইনদের হাত থেকে সীমান্তে সেল্জুক সাম্রাজ্যকে রক্ষা করাই ছিলো আর্তুগ্রুলের মূল দায়িত্ব। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এ দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালন করে যান তিনি। ১২৮৮ সালে মৃত্যুবরণ করেন আর্তুগ্রুল। তার মৃত্যুর পর গোষ্ঠীর দায়িত্ব এসে বর্তায় ওসমান গাজীর হাতে।
ওসমান গাজীর শাসক জীবন নিয়ে কিছু বলার আগে তার সম্পর্কে সবচেয়ে প্রচলিত যে কাহিনীটি আছে, যার সত্য বা মিথ্যা নির্ণয় সম্ভব হয় নি আজও, সেই সম্পর্কে একটু জেনে নেয়া যাক।
ওসমানের স্বপ্ন
তরুণ বয়স থেকেই সবার কাছে ধর্মভীরু হিসেবে পরিচিত ছিলেন ওসমান। একসময় তিনি শেখ এদেবালি নামক এক ধর্মগুরুর ব্যক্তিত্ব ও জ্ঞানের গভীরতায় মুগ্ধ হয়ে নিয়মিত তার সাথে দেখা করতে যেতেন। এস্কিসেহির শহরের এক গ্রাম ইতবার্নুতে এদেবালির সাথে দেখা করতে যেতেন ওসমান। একদিন এদেবালির সাথে দেখা করতে গিয়ে তার মেয়ে মাল হাতুনের সাথে ঘটনাক্রমে দেখা হয়ে যায় তার। মাল হাতুনের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তাকে ভালোবেসে ফেলেন ওসমান। ফলে এদেবালির বাড়িতে তার যাওয়া-আসার মাত্রাও বেড়ে যায়। একসময় তিনি এদেবালিকে তার মনের কথা খুলে বলেন। কিন্তু ওসমানের সাথে নিজের সামাজিক পদমর্যাদা কাছাকাছি না হওয়ায় এদেবালি এ বিয়েতে রাজি হন নি।
এমন প্রত্যাখ্যান সহজে মেনে নিতে পারেন নি তরুণ ওসমান গাজী। তাই প্রায়ই বন্ধুদের কাছে নিজের হতাশা ব্যক্ত করতেন তিনি। সমস্যা হলো- তার কাছে মাল হাতুনের রুপের বর্ণনা শুনতে শুনতে তার বন্ধুদের মাঝেও মেয়েটির প্রতি আকর্ষণ জন্মাতে শুরু করে। এদেরই একজন ছিলেন এস্কিসেহিরের এক তরুণ নেতা। তিনিও এদেবালির কাছে মাল হাতুনকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। কিন্তু তার ভাগ্যেও ওসমানের মতো প্রত্যাখ্যান জুটলো। কিন্তু একজন নেতাকে এভাবে ফিরিয়ে দিয়ে এদেবালি কিছুটা ভয় পেয়ে গেলেন। তাই নিজের বাসা পাল্টানোর সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি।
ওদিকে এস্কিসেহিরের সেই নেতার মনে আস্তে আস্তে ওসমান সম্পর্কে বিরুপ মনোভাব জন্মাতে শুরু করে। একসময় তিনি তাকে প্রতিপক্ষ হিসেবেই দেখা শুরু করে দেন। একদিন ওসমান তার ভাই গোকাল্পকে নিয়ে পার্শ্ববর্তী ইনয়ানীর জমিদারের দুর্গে ঘুরতে গিয়েছিলেন। তখনই সেই নেতা তার আরেক বন্ধু মাইকেলকে নিয়ে সেই দুর্গ ঘেরাও করে বসেন এবং জমিদারকে বলেন ওসমানকে তার হাতে তুলে দিতে। কিন্তু অতিথির এমন অমর্যাদা করতে রাজি হচ্ছিলেন না সেই জমিদার। তাই শত্রুরা দুর্গের বাইরে অবরোধ করে বসে। পরবর্তীতে ওসমান ও তার ভাইয়ের বাহিনীর আকস্মিক আক্রমণে তাদের সেই প্রতিরোধ ভেঙে যায়। তরুণ নেতা কোনোমতে জান নিয়ে পালাতে সক্ষম হলেও ধরা পড়ে যান মাইকেল। পরবর্তীতে অবশ্য এ মাইকেলের সাথেই ওসমানের চমৎকার বন্ধুত্ব হয়েছিলো।
এভাবে যুদ্ধ জয়ের ফলে ওসমান একজন বন্ধু পেলেন ঠিকই, কিন্তু মনের মানুষটি তখনো ছিলো তার ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। এভাবেই কেটে যায় দুটি বছর। দুশ্চিন্তায় ওসমানের স্বাস্থ্যেরও অবনতি ঘটে।
এতকিছুর পরেও এদেবালির সাথে ওসমানের যোগাযোগ ঠিকই ছিলো। এক রাতের কথা। এদেবালির বাড়িতে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন ওসমান গাজী। মাল হাতুনকে নিয়ে সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়েন তিনি। ঘুমের মাঝেই তিনি এমন এক স্বপ্ন দেখেন ইতিহাসে বেশ বিখ্যাত হয়ে আছে।
“ওসমান এবং এদেবালি এক জায়গায় বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। হঠাৎ করেই এদেবালির বুকের ভেতর থেকে একটি পূর্ণ চাঁদ বের হয়ে তা আবার ধীরে ধীরে ওসমানের বুকের ভেতর হারিয়ে যায়।
এরপরই বেশ চমৎকার একটি গাছ ধীরে ধীরে বড় হতে শুরু করে। তার যেন আর থামার নাম নেই, বড় হচ্ছে তো হচ্ছেই। এভাবে গাছটির শাখা-প্রশাখা, ছায়া পৃথিবীর দিগন্তের প্রায় তিন ভাগকে ঢেকে ফেলার আগপর্যন্ত বড় হতেই থাকে। এ গাছের নিচে ছিলো চারটি পাহাড়- ককেশাস, অ্যাটলাস, টোরাস ও হীমাস। দেখে মনে হচ্ছিলো যে, এ পাহাড়গুলোর উপর ঠেস দিয়েই দাঁড়িয়ে আছে সুবিশাল সেই গাছ। গাছটির গোড়া থেকে বেরিয়ে এসেছিলো টাইগ্রিস, ইউফ্রেটিস, দানিয়ুব ও নীল নদ। বড়-ছোট পাল তোলা অনেক জাহাজই ঘুরে বেড়াচ্ছিলো সেসব জায়গায়।
মাঠগুলো ভরে গিয়েছিলো খাদ্যশস্যে, পাহাড়গুলোর আশেপাশেও ছিলো বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল। পাহাড়গুলোর মধ্যবর্তী এলাকা জুড়ে ছিলো জাঁকজমকপূর্ণ শহরের উপস্থিতি। অগণিত গম্বুজ, পিরামিড, ওবেলিস্ক, মসজিদের মিনার আর সুউচ্চ টাওয়ার জানান দিচ্ছিলো সেই শহরটির আভিজাত্যের মাত্রা। তাদের শীর্ষভাগে শোভা পাচ্ছিলো এক অর্ধচন্দ্র। দূর থেকে ভেসে আসছিলো মুয়াজ্জিনের আজানের সুমধুর ধ্বনি। হাজার হাজার নাইটিঙ্গেলের মনমাতানো ডাকের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিলো সেই আজানের সুর।
মিষ্টি কন্ঠের অসংখ্য পাখির সমাবেশ ঘটেছিলো সেখানে। তাদের কিচিরমিচির ডাক যেন মাতাল করে ছাড়ছিলো গাছটিকেও। গাছটির প্রতিটি পাতাই ছিলো তুর্কীদের পুরনো আমলের খঞ্জরের মতো দেখতে। হঠাৎ করেই বাতাসের বেগ যেন বেড়ে গেলো। আর সেই সাথে পাতাগুলোর তীক্ষ্ম দিকগুলোও বিশ্বের নানা শহরের দিকে মুখ করে ঘুরে গেলো। তবে সেগুলো বিশেষভাবে কনস্টান্টিনোপলের দিকে মুখ করে ঘুরে ছিলো। দুটো সাগর ও দুটো মহাদেশের মিলনস্থলে অবস্থিত সেই শহরটিকে দুটো স্যাফায়ার ও দুটো এমারেল্ডের মাঝে বসানো একটি ডায়মন্ডের মতো লাগছিলো। এর ফলে বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান পাথরই যেন হয়ে উঠেছিলো সেটি। ওসমান গাজী যখন সেই দৃষ্টিনন্দন পাথর বসানো আংটি নিজের আঙুলে ঢোকাতে যাচ্ছিলেন, তখনই তার ঘুম ভেঙে যায়।”
ঘুম থেকে উঠে ওসমান এদেবালিকে তার স্বপ্নের কথা জানালেন। এদেবালি বুঝলেন যে, এটি কোনো সাধারণ স্বপ্ন নয়। বরং এর মাঝেই লুকিয়ে আছে ওসমান ও তার মেয়ে মাল হাতুনের এক হওয়া থেকে শুরু করে ওসমানের ভবিষ্যতে অনেক ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির মালিক হওয়ার ইঙ্গিত। এরপর তাই আর আপত্তি করলেন না তিনি। নিজের পছন্দের শিষ্য দরবেশ তোরুদকে ডেকে এনে ওসমান আর মাল হাতুনের বিয়ে পড়ানোর ব্যবস্থা করেন তিনি।
এবার আসা যাক আসল কথায়। এতক্ষণ ধরে ওসমানের এত বড় স্বপ্নের কথা পড়ে অনেকেরই অবিশ্বাসে ভ্রু কুঁচকে গেছে নিশ্চিত। এটাই স্বাভাবিক। কারণ ওসমানের বিখ্যাত এ স্বপ্নের কথা কিন্তু লেখা হয়েছিলো তার মৃত্যুর একশ বছরেরও বেশি সময় পরে। তাই ধারণা করা হয় যে, এ স্বপ্নের কথা আসলে কোনো উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা ছাড়া আর কিছুই না। অটোম্যান সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তনের ইতিহাসকে আরো মহিমাময় করে তুলতে এবং সেই সাথে ওসমান গাজীর অর্জন ও সাফল্যকে আরো চমৎকারভাবে সবার কাছে তুলে ধরতেই এ কল্পনার আশ্রয় নেয়া হয়েছিলো। অবশ্য অটোম্যান ঐতিহাসিকেরা সব সময়ই তাদের সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তনের এ ইতিহাসটিকে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সবার সামনে তুলে ধরতেন।
তবে এটা সত্য যে, শেখ এদেবালি নামে আসলেই এক ব্যক্তি ছিলেন যার সাথে ওসমানের খাতিরের সূত্র ধরেই তার মেয়ে মাল হাতুনের সাথে ওসমানের বিয়ে হয়। তবে মাইকেল ও দরবেশ তোরুদের অস্তিত্ব নিয়ে সন্দেহ আছে কিছু কিছু ইতিহাসবিদের।
বিজয় অভিযান
১২৮৮ সালে বাবার স্থলাভিষিক্ত হন ওসমান গাজী। তার বাবা নিষ্ঠার সাথে নিজের দায়িত্ব পালন করে গেলেও কখনো আশেপাশের এলাকাগুলো জয়ের দিকে নজর দেন নি। অন্যদিকে গোত্র প্রধানের দায়িত্ব নিয়েই ওসমান দেখতে পেলেন যে, আশেপাশের অন্যান্য গোত্র প্রধানরা তাদের এলাকা বিস্তারে সচেষ্ট হয়ে উঠেছেন। এসব দেখে তিনি নিজেও তার এলাকার পরিধি বাড়ানোর প্রস্তুতি নিতে থাকলেন।
১২৯৯ সালে ওসমান যখন মোঙ্গল সাম্রাজ্যে বার্ষিক কর পাঠালেন না, তখনই আসলে প্রতীকী অর্থে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। ১৩০০ সাল থেকেই একে একে বিভিন্ন অঞ্চল জয় করতে শুরু করে ওসমান গাজীর নেতৃত্বাধীন বাহিনী। সাকারয়া নদীর পশ্চিমাঞ্চল, এস্কিসেহিরের দক্ষিণ ভাগ, অলিম্পাস পর্বত ও মারমারা সাগরের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল তার সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। এস্কিসেহির, বিলেজিক, ইনোনু থেকে শুরু করে ইয়েনিশেহিরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দূর্গ ও নগর নিজেদের দখলে নিয়ে নেয় ওসমান বাহিনী। নবগঠিত অটোম্যান রাজ্যের রাজধানী হিসেবে বেছে নেয়া হয় ইয়েনিশেহিরকে। বার্সা, নিকাইয়া কিংবা নিকোমিডিয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ ও সুরক্ষিত নগরগুলো দখল করার মতো শক্তি অবশ্য তখনো অর্জন করতে পারে নি তার বাহিনী।
অলিম্পাস পর্বতের পাদদেশে অবস্থিত বার্সা ছিলো বেশ সুরক্ষিত এক নগরী। এর চারদিক ছিলো উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা। সেই সাথে বিভিন্ন দূর্গ ও প্রতিরক্ষা টাওয়ার প্রতিনিয়ত এর নিরাপত্তা নিশ্চিত করে চলেছিলো। ১৩০৮ সালে মারমারা সমুদ্রে পৌঁছে বার্সার পার্শ্ববর্তী স্থলভূমি দখলে নিয়ে তাদেরকে স্থলপথে বাইরের জগত থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয় ওসমান গাজীর বাহিনী। অবশ্য তখনও মুদান্য়া বন্দর দিয়ে বার্সার অধিবাসীরা দরকারি রসদ আনা-নেয়া ও অন্যান্য যোগাযোগের কাজ চালাতো। সরাসরি আক্রমণ চালিয়ে নগরটি দখল করার সুযোগ না থাকায় ওসমান তার বাহিনীকে এর চারদিকে অবরোধ অব্যাহত রাখতে বলেন। ১৩২১ সালে শেষ পর্যন্ত ওসমানের বাহিনী মুদান্য়া বন্দরের দখল নিতে সক্ষম হলে বার্সা বাইরের জগত থেকে একেবারেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। অবশ্য বার্সার অধিবাসীরাও এত সহজে হার মানতে রাজি ছিলো না। তাই এরপরেও আরো পাঁচ বছর পর্যন্ত তারা মাথা নত করে নি ওসমান গাজীর বাহিনীর কাছে। শেষ পর্যন্ত ১৩২৬ সালের ৬ এপ্রিল তারা পরাজয় মেনে নিতে বাধ্য হয়।
বার্সা জয় ছিলো অটোম্যান সাম্রাজ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক ঘটনা। এতদিন ধরে নানা যুদ্ধে ওসমান গাজী জয় পেলেও সেগুলো ছিলো বিভিন্ন বর্বর জাতির বিরুদ্ধে জয়। অন্যদিকে বার্সা ছিলো তৎকালীন এক গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক কেন্দ্র। এ জয়ের ফলে মধ্যপ্রাচ্য ও পূর্ব ইউরোপে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক মানচিত্রের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠলো অটোম্যানরা।
ততদিনে অবশ্য বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছিলেন ওসমান গাজী। ১২৫৪ খ্রিষ্টাব্দকে তার জন্ম সাল ধরে নিলে তখন তার বয়স ছিলো ৭২ বছর। বয়সজনিত নানা অসুস্থতার জন্য তখন বড় ছেলে ওরহান গাজীর হাতেই নিজ বাহিনীর দায়িত্ব অর্পন করেছিলেন তিনি। অবশ্য সৌভাগ্যই বলতে হবে তার। কারণ মৃত্যুর আগে বার্সা দখল হওয়ার সুখবরটি ঠিকই জেনে যেতে পেরেছিলেন তিনি। কথিত আছে যে, মৃত্যুর আগে তিনি ওরহানকে উপদেশ দিয়ে গিয়েছিলেন রাজ্য পরিচালনার ব্যাপারে-
“বাবা, আমি মারা যাচ্ছি। আমি কোনো দুঃখ ছাড়াই মারা যাবো। কারণ তোমার মতো একজনকে আমি উত্তরসূরি হিসেবে রেখে যাচ্ছি। ন্যায়পরায়ণ হয়ো, সদগুণকে ভালোবেসো আর দয়াশীল হয়ো। তোমার অধীনস্ত সবাইকেই সমান নিরাপত্তা দিও। আর নবীজীর (সাঃ) প্রচারিত আইনকে আরো প্রসারিত করো। দুনিয়াতে এগুলোই একজন রাজপুত্রের দায়িত্ব এবং এগুলোই তাদের জীবনে জান্নাতের আশীর্বাদ বয়ে আনে।”
সদ্য সাম্রাজ্যভুক্ত বার্সা নগরীতে তাকে কবর দিতে বলেছিলেন ওসমান। সেই সাথে একে অটোম্যান সাম্রাজ্যের রাজধানী বানানোর নির্দেশও দিয়ে যান তিনি। কিছুকাল পরেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন অটোম্যান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ওসমান গাজী। শেষ ইচ্ছানুযায়ী তাকে বার্সাতেই কবর দেয়া হয়।
মৃত্যুকালে বাইজান্টাইন ও মোঙ্গল- এ উভয়পক্ষের নিয়ন্ত্রণ মুক্ত এক স্বাধীন রাজ্য রেখে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন ওসমান গাজী। বাইজান্টাইনদের দুর্বলতা অনুধাবন করতে পেরে তিনি তাদের উপর বিভিন্ন সময়ই আক্রমণ চালিয়েছিলেন। তার যুদ্ধ জয়ের অন্যতম কারণ ছিলো যে, তিনি বিভিন্ন গোত্রপতীদেরকে তার যুদ্ধের আদর্শে উদ্বুদ্ধ করে এক পতাকাতলে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন। অধিকাংশ ইতিহাসবিদও এ ব্যাপারে একমত পোষণ করে থাকেন।
ব্যক্তি ও শাসক হিসেবে সকলের কাছেই বেশ সম্মান ও শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন ওসমান গাজী। জনগণের সাথে ন্যায়সঙ্গত আচরণ ও সবাইকে সমান দৃষ্টিতে দেখার ব্যাপারেও সুনাম ছিলো তার। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই তার কাছে সমমর্যাদা পেতো। তারপরেও ওসমান গাজী সম্পর্কে একটি কাহিনী প্রচলিত আছে যার সত্যতা অবশ্য প্রশ্নবিদ্ধ। একবার তিনি নাকি একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রীক দূর্গে আক্রমণ চালাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার চাচা দুন্দার এমন চিন্তা-ভাবনাকে বেশ বিপদজনক মনে করে তাকে এসব থেকে দূরে থাকার উপদেশ দেন। চাচার এমন উপদেশকে নিজের সিংহাসন ও মর্যাদার প্রতি এক প্রকার হুমকি হিসেবেই দেখেছিলেন তিনি। তাই চুপচাপ ধনুকটা তুলে নিয়ে একটি তীর ছুঁড়ে চাচার জীবন সাঙ্গ করে দিয়েছিলেন ওসমান গাজী।
অটোম্যান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ওসমান গাজীর জীবনী এখানেই শেষ করছি। পরবর্তী লেখায় থাকবে দ্বিতীয় সম্রাট ওরহান গাজীকে নিয়ে বিস্তারিত কথাবার্তা। ততদিন পর্যন্ত সবার সুস্বাস্থ্য কামনা করে আজ এখানেই বিদায় নিচ্ছি।