মোসাদ- পৃথিবীর গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সেরা বললেও খুব একটা ভুল হবে না। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই প্রায় অসম্ভব সব মিশনকে বাস্তব করাই যেন মোসাদের লক্ষ্যে পরিণত হয়েছিল। নাৎসি নেতাদের খুঁজে বের করে তাদের হত্যা করা কিংবা ইসরায়েলে নিয়ে গিয়ে বিচার করা, শত্রুভাবাপন্ন রাষ্ট্র নেতাদের হত্যার জন্য গোপন মিশন- এসবে বেশ বিখ্যাত (কিংবা কুখ্যাত) মোসাদ। কিন্তু নিজেদের বিমানবাহিনীর সুবিধার জন্য শত্রুপক্ষের একটি যুদ্ধবিমান চুরি করে নিয়ে আসা, তাও মিগ-২১? শুনতে অবাস্তব মনে হলেও মোসাদের তত্ত্বাবধানে ইসরায়েল ঠিক এ কাজটিই করেছিল। জেমস বন্ডের সিনেমার থেকেও চাঞ্চল্যকর ছিল সে অভিযান।
সোভিয়েত রাশিয়ায় তৈরি মিগ-২১ ছিল গত শতাব্দীর ষাটের দশকের সেরা ফাইটার জেট। ১৯৫৯ সালে উৎপাদন শুরু হওয়া মিগ-২১ রাশিয়ার বাইরে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করত রাশিয়ার কৌশলগত মিত্র মিশর, সিরিয়া আর ইরাক। ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই আমেরিকার সাথে ইসরায়েলের সম্পর্ক অনেক ভালো। আর স্নায়ুযুদ্ধের সে সময়ে স্নায়ুযুদ্ধের বাইরেও ইসরায়েলকে ভাবতে হত তাদের অস্তিত্ব নিয়ে।
প্রতিষ্ঠার পর থেকেই আরব দেশগুলো ছিল ইসরায়েলের শত্রু, যুদ্ধ পর্যন্ত হয়েছে উভয় পক্ষের মধ্যে। আর এসব যুদ্ধে আরব দেশগুলোর যুদ্ধবিমানের কাছে বেশ নাজেহাল হতে হতো ইসরায়েলের যুদ্ধ বিমানগুলোকে। এ কারণে শত্রুর হাতে থাকা মিগ-২১গুলোর ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে ইসরায়েলের একপ্রকার জেদ চেপে যায়। আর বিস্তারিত জানার জন্য একটি মিগ-২১। কিন্তু ইসরায়েল চাইলেই রাশিয়ার কাছে মিগ-২১ কিনতে পারবে না। ফলে তাদের হাতে উপায় থাকে একটিই, মিগ-২১ চুরি করে নিয়ে আসা!
যেমন ভাবা তেমন কাজ। মিগ-২১ চুরি করে আনার দায়িত্ব দেয়া হয় মোসাদের উপরে। শত্রুর কাছ থেকে বিমান চুরির এই ‘মহৎ’ উদ্যোগের কোড নাম হয় অপারেশন ডায়মন্ড। ষাটের দশকের শুরুতেই মোসাদ এ ব্যাপারে কাজ শুরু করে। ইসরায়েলের ঠিক পাশেই মিশর হওয়াতে তাদের প্রথম লক্ষ্য ছিল মিশর থেকে চুরি করা।
একজন মিশরীয় পাইলটকে রাজি করানোর দায়িত্ব দেয়া হয় মোসাদ এজেন্ট জিন থমাসকে। থমাস আর তার এজেন্টরা আদিব হান্না নামে একজন মিশরীয় পাইলটকে টার্গেট করে তাদের কাজ করানোর জন্য। তারা তাকে ১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দেবার প্রস্তাবও দেয় মিগ-২১ নিয়ে ইসরাইলে যাবার জন্য। কিন্তু হান্না তাদের কথায় রাজি তো হয়নি, উল্টো মিশরীয় কর্তৃপক্ষকে থমাসের এই পরিকল্পনার কথা জানিয়ে দেয়। গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে থমাসসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে মিশরীয় কর্তৃপক্ষ। এরপর তাদের ফাঁসিতে ঝোলানো হয় অপরাধ প্রমাণিত হওয়াতে।
এ ঘটনার দুই বছর পর ইসরায়েল না চাইতেই এক সফলতা পায়। দুর্নীতিগ্রস্থ এক মিশরীয় পাইলট, ক্যাপ্টেন আব্বাস হেলমি, তার উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে বিরোধের জের ধরে তার ইয়াক-১১ বিমান নিয়ে ইসরায়েলে পালিয়ে যায়। কোনোরকম চেষ্টা ছাড়াই ইসরায়েলের এই সফলতা আসলেও মাত্র দু’মাস পরেই হেলমিকে হত্যা করা হয় দক্ষিণ আমেরিকায়। ধারণা করা হয়, মিশরীয় গোয়েন্দাবাহিনীই হত্যা করে তাকে। ইয়াক-১১ প্রশিক্ষণ বিমান হওয়াতে আর পাইলট মারা যাওয়াতে ইসরাইল তাদের দরকারি কোনো তথ্যই পায়নি এ ঘটনা থেকে।
মিশরে ব্যর্থ হবার পর মোসাদ চেষ্টা করে ইরাকে। কিন্তু ইরাকেও প্রথমে ব্যর্থ হতে হয় মোসাদকে। তবে আগেরবারের মতো ভুল করেনি এবার মোসাদ এজেন্টরা। দুই ইরাকি পাইলটকে রাজি করাতে ব্যর্থ হলে মোসাদ এজেন্টরা দুই পাইলটকে মারাত্মকভাবে আহত করে রাখে যাতে তারা এ ব্যাপারে কাউকে কিছু জানাতে না পারে।
তবে মোসাদের ভাগ্য খোলে ১৯৬৪ সালে। ইরাকে বাস করা এজরা জেলখা নামের এক ইহুদী ইরানের তেহরানে ইসরাইলের দূতাবাসে যোগাযোগ করেন এক ইরাকি পাইলটের ব্যাপারে। মোসাদের কাছে এজরা জেলখার সাংকেতিক নাম ছিল ‘ইউসুফ’। জেলখা ছোট থেকেই পরিবারহীন, বড় হয়েছিলেন এক খ্রিস্টান পরিবারের কাছে। কিন্তু সময়ের সাথে তিনি সেই পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে ওঠেন। তবে সেই পরিবারের এক কর্তা একবার তার সাথে খারাপ ব্যবহার করার পর তিনি তার ইহুদী পরিচয়ের গুরুত্ব বুঝে ইসরায়েলের সাথে যোগাযোগ করেন। জেলখা ইরাকে সেই পরিবারের সাথেই ছিলেন বাকি সময়, কিন্তু কাজ করেছেন মোসাদের স্লিপিং এজেন্ট হিসেবে।
মুনির রেদফা নামের সেই ইরাকি পাইলট ছিলেন ইরাকি বিমানবাহিনীর একজন পাইলট। কিন্তু শুধুমাত্র খ্রিস্টান হবার কারণে তিনি কর্মক্ষেত্রে অনেক বৈষম্যের শিকার হতেন। পদোন্নতি পেতেন না সহজে, পোস্টিং সবসময় দুর্গম এলাকায় হতো। ফলে ইরাক আর ইরাকী বাহিনীর উপরে ক্ষিপ্ত ছিলেন তিনি। সুযোগ খুঁজছিলেন ইরাক ছেড়ে চলে যাবার। রেদফার রাগের আরেকটি কারণ ছিল, বিনা কারণে কুর্দিদের উপরে হামলা করা। নিজের এসব হতাশা আর রাগের কথা জেলখাকে জানালে তিনি সে কথা ইসরায়েল কর্তৃপক্ষকে জানান। আর মোসাদ এটিকেই তাদের সবচেয়ে বড় সুযোগ হিসেবে দেখে।
মোসাদ তাদের একজন নারী এজেন্টকে পাঠায় রেদফার সাথে যোগাযোগের জন্য। প্রথমে রেদফার সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তোলে সেই এজেন্ট, রেদফার নিজের কাছ থেকেই তার হতাশা আর রাগের কথাগুলো শোনে সে। এরপরই মোসাদ এজেন্ট তার আসল পরিকল্পনা শুরু করে। বিভিন্নভাবে বুঝিয়ে রেদফাকে রাজি করায় ইউরোপে মোসাদ এজেন্টদের সাথে দেখা করার ব্যাপারে। রেদফা রাজি হলে ইউরোপে মোসাদের একজন অফিসারের সাথে দেখা করেন তিনি। রেদফাকে ১ মিলিয়ন ডলার, ইসরাইলের নাগরিকত্ব এবং চাকরির আশ্বাস দেয়া হয় তার মিশন সফল করতে পারলে।
ধর্মীয় কারণে চাকরি নিয়ে হতাশাগ্রস্থ রেদফাকে রাজি করানোর এই সংস্করণটি ইসরায়েলের ভাষ্য। কিন্তু সাবেক ইরাকী গোয়েন্দা কর্মকর্তা আহমাদ সাদিক এবং মিশরীয় ইতিহাসবিদ নূর বারাদি পুরো ঘটনার ভিন্ন একটি গল্প বলেছেন। ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত ইরাকের সাথে গ্রেট ব্রিটেনের বেশ ভালো সম্পর্ক ছিল। কিন্তু ১৯৫৮ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের পর পরিস্থিতি উল্টে যায়, নতুন সামরিক শাসকরা পশ্চিমা দেশ বাদ দিয়ে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাশিয়ার সাথে সম্পর্কের দিকে মনোযোগ দেয়। এরই প্রেক্ষিতে ইরাক মিগ-১৯ ও মিগ-২১ কিনে সোভিয়েত থেকে।
কিন্তু পরিস্থিতি আবার পাল্টে যায় ১৯৬৩ সালের আরেকটি সামরিক অভ্যুত্থানের পরে। এবারের শাসকরা ছিলেন পশ্চিমাঘেঁষা, ফলে আমেরিকা আর ব্রিটেনের সাথে আবারো সম্পর্ক জোড়া লাগে। ১৯৫৮-৬৩ সালে সামরিক বাহিনীতে থাকা বেশিরভাগ উর্ধ্বতন কর্মকর্তার চাকরি চলে যায় আগের সরকারের সাথে ভালো সম্পর্ক থাকার কারণে। এই সুযোগে মিগ-২১ এর প্রশিক্ষণ থাকা রেদফা হয়ে যান ইরাকের স্কোয়াড্রন-১১ এর ডেপুটি কমান্ডার। স্কোয়াড্রন-১১ ছিল ইরাকের মিগ-২১ এর একমাত্র স্কোয়াড্রন। রেদফার ধর্মীয় পরিচয় এখানে কোনো ভূমিকাই পালন করেনি, বরং দেশের প্রতি আনুগত্যই ছিল মূল।
অন্যদিকে ইসরায়েল ইরাকের পাইলটদের প্রভাবিত করে মিগ-২১ চুরি করার মিশন তখনও ছাড়েনি। তাদের সামনে সুযোগ আসে, যখন ১৯৬৫ সালে ১৫ জন ইরাকি পাইলট আমেরিকা যায় প্রশিক্ষণের জন্য। মোসাদ তাদের নারী এজেন্টদের ব্যবহার করে তরুণ পাইলটদের এক এক করে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। প্রথম চেষ্টায় একজন রাজি না হলে তাকে হত্যা করা হয়। তবে পাইলট হত্যার পর ইরাক তার পাইলটদের দেশে ডেকে নিয়ে যায়। কিন্তু ফেরার সময় তিনজন পাইলটের সাথে ফেরে তিনজন মোসাদ এজেন্ট, তাদের বান্ধবী হিসেবে। সেই তিনজন পাইলটের একজন রেদফা।
পাইলটদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলে তাদের নিজেদের কবজায় আনাই ছিল মোসাদের মূল লক্ষ্য। রেদফার সাথে যে এজেন্ট ছিল, তার নাম ছাড়া আর কিছুই জানা যায় না। লিসা ব্রাট নামের সেই মহিলা এজেন্ট খুব সম্ভবত আমেরিকান ছিলেন বলে ধারণা করা হয়। রেদফার আগে অন্য দুজন পাইলটকেও রাজি করানোর চেষ্টা করে তাদের সাথে আসা এজেন্টরা। কিন্তু তাদের কেউই রাজি না হওয়াতে হত্যা করা হয় দুজনকেই। এরপর যখন রেদফাকে প্রস্তাব দেয়া হয় তখন তিনিও প্রথমে রাজি হননি। কিন্তু তাকেও হত্যার হুমকি দিলে তিনি শেষপর্যন্ত লিসার সাথে ইউরোপে গিয়ে অন্য মোসাদ এজেন্টদের সাথে দেখা করতে রাজি হন।
রেদফা স্বেচ্ছায় রাজি হন কিংবা ভয়ের জন্য সেটি নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে, তবে তিনি যে একপর্যায়ে রাজি হয়েছিলেন সেটি নিশ্চিত। তবে রেদফাও নিজের কিছু শর্ত জুড়ে দেন অন্য সবকিছুর সাথে। তার পরিবার ও আত্মীয়স্বজনকে ইরাক থেকে বের করে আনতে হবে। রেদফা পালিয়ে যেতে সফল হতে পারুক বা না পারুক, ইরাকে তার পরিবার থাকলে তাদের অচিন্ত্যনীয় অত্যাচারের শিকার হতে হবে তার জানা ছিল। তাই তিনি সবকিছুর আগে তার পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চান।
মোসাদ তার প্রস্তাবে রাজি হলে রেদফা ইসরায়েলে যান পরিকল্পনা চূড়ান্ত করতে। সফলভাবে ইসরায়েলে প্রবেশ করতে পারলে যে বিমানবন্দরে অবতরণ করবেন, সেটিও দেখে আসেন রেদফা। ইসরাইলের তৎকালীন বিমানবাহিনী প্রধান ও উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা করেন সম্ভাব্য ফ্লাইট পাথ নিয়ে। ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ রেদফাকে পুরো মিশনের বিপদগুলোও জানিয়ে দেয়। পুরো মিশনটি যে একপ্রকার সুইসাইড মিশন ছিল, সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না।
সবকিছু ঠিকঠাক হলে মোসাদ তাদের এজেন্ট পাঠায় ইরাকে, রেদফার পরিবারের সদস্যদের নিরাপদে ইসরাইলে নিয়ে যাবার জন্য। নিরাপত্তার খাতিরে পরিবারের কাউকেই জানানো হয়নি আসলে কী ঘটতে যাচ্ছে। রেদফা তার স্ত্রী ও কন্যা নিয়ে প্যারিসে যান। রেদফা তার স্ত্রীকেও কিছু জানাননি এ ব্যাপারে। তাই তার স্ত্রী প্রথমে ভেবেছিলেন তারা ছুটি কাটাতে গিয়েছেন প্যারিসে! কিন্তু যখন মোসাদ এজেন্ট তার সাথে দেখা করে, তখন তিনি অবাক হয়ে যান। প্রথমে রেগে গিয়ে ইরাকী কর্তৃপক্ষের কাছে সব কিছু ফাঁস করে দেবার হুমকিও দেন। কিন্তু মোসাদ এজেন্টরা তাকে শান্ত করতে সক্ষম হয়। ফলে নতুন পরিচয়ে ইসরায়েলি পাসপোর্ট নিয়ে সন্তানদের নিয়ে ইসরায়েলে যাবার জন্য রাজি হন রেদফার স্ত্রী। অন্যদিকে ইরাকে মোসাদ এজেন্টরা দায়িত্ব পায় রেদফার পরিবারের অন্যদের ইরাক থেকে বের করার। কিন্তু সবার আগে অপেক্ষা করতে থাকে রেদফার, সে বিমান নিয়ে পালাতে সক্ষম হলেই পরিবারের সদস্যদের ইসরায়েলে নেয়া হবে। তার আগেই কিছু করলে যে কেউ সন্দেহ করে বসতে পারে, ভণ্ডুল হতে পারে পুরো পরিকল্পনা।
এদিকে ১৯৬৬ সালের জুলাইয়ে রেদফাকে স্কোয়াড্রন-১১ এর কমান্ডার হিসেবে নিয়োগ পান রেদফা। কিন্তু তারপরেও তিনি চাইলেই যেকোনো দিন তার এয়ারবেস থেকে ইসরায়েলে পালিয়ে যেতে পারেন না। তার সামনে সুযোগ আসে ১৯৬৬ সালের ১৬ আগস্ট। খুবই স্বাভাবিকভাবে তার দিনের কার্যক্রম করেন অন্যান্য দিনের মতোই। সেদিনের রুটিন ফ্লাইটে যাবার আগে গ্রাউন্ড ক্রুদের তিনি নির্দেশ দেন তার বিমানের জ্বালানি ট্যাঙ্ক পূর্ণ করে দিতে। জ্বালানি ট্যাঙ্ক পূর্ণ করার জন্য এয়ারবেসে থাকা রাশিয়ানদের অনুমতি লাগত, কিন্তু গ্রাউন্ড ক্রুরা স্বাভাবিকভাবেই বিদেশীদের খবরদারি খুব একটা পছন্দ করত না। তাই বেশিরভাগ সময় তারা রাশিয়ানদের জানাতই না সে ব্যাপারে। তারই সুযোগ নেন রেদফা। গ্রাউন্ড ক্রুরাও বিদেশীদের খবরদারির থেকে নিজের দেশের অফিসারদের কথা বিনা প্রশ্নে মানাটাই পছন্দ করতেন।
সর্বোচ্চ সম্ভব জ্বালানি নিয়ে রেদফা তার রুটিন ফ্লাইট শুরু করেন। কিন্তু বাগদাদ থেকে বের হতেই তিনি রুটিন ফ্লাইট পাথ থেকে মুখ ঘুরিয়ে রওনা দেন ইসরায়েলের দিকে। প্রথমদিকে ইরাকীরা বুঝতে না পারলেও বুঝতে পারার সাথে সাথে রেদফাকে নির্দেশ দেয় ফিরে আসার। কিন্তু রেদফা ততক্ষণে তার রেডিও বন্ধ করে দিয়েছেন। প্রায় ৩০ হাজার ফুট উপর দিয়ে তিনি আঁকাবাঁকাভাবে যেতে থাকেন ইসরায়েলের দিকে। অন্যদিকে, রেদফার পালানোর ব্যাপারে নিশ্চিত হবার পর ইরাকে থাকা মোসাদ এজেন্টরা রেদফার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের ইরানের সীমান্তের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর কুর্দি সেনাদের সাহায্যে তাদের ইরানে প্রবেশ করানো হয়। সেখান থেকে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় ইসরায়েলে।
এদিকে রেদফাকে ইসরায়েলে যেতে হলে জর্ডানের আকাশ দিয়ে যেতে হবে। জর্ডানের নিরাপত্তাবাহিনীর রাডারে তার বিমান ধরা পড়লে তারা মনে করে এটি সিরিয়ার বিমান। তারা সিরিয়ার সাথে যোগাযোগ করলে বলে সিরিয়া জানায় এটি তাদেরই ট্রেনিং বিমান! দুই পক্ষের ভুল বোঝাবুঝিতে আসলে ফায়দা হয় রেদফার। নিরাপদে চলে যান ইসরায়েলের কাছাকাছি।
ইসরায়েলে প্রবেশের সাথে সাথে ইসরাইলি বিমানবাহিনীর মিরাজ বিমান এস্কোর্ট করে নিয়ে যায় রেদফাকে। অনেক উঁচু আর সর্বোচ্চ গতিতে চালানোর ফলে রেদফার মিগের জ্বালানি একেবারে শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। নিরাপদেই কোনো প্রকার ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই ইরাক আর জর্ডানকে ফাঁকি দিয়ে রেদফা অবতরণ করেন ইসরায়েলে। সফল হয় মোসাদের মিগ চুরির অভিযান! রেদফার নিয়ে যাওয়া মিগ-২১ টিকে নতুন করে রঙ করে ইসরায়েল, আর সাংকেতিক নম্বর হয় ০০৭। সংখ্যাটা যে জেমস বন্ডের অনুকরণে সেটি বুঝতে আশা করি কারোরই কষ্ট হবার কথা না। তবে আন্তর্জাতিক মিডিয়াসহ জনসাধারণের জন্য খুব কম তথ্যই প্রকাশ করেছে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ। পুরো মিশনের সাথে জড়িতদের বেশিরভাগ মানুষ সম্পর্কেই কোনো তথ্য প্রকাশ করেনি তারা। ছবি বা অন্যান্য তথ্যও খুব একটা প্রকাশ করেনি ইসরায়েল।
রেদফার নিয়ে যাওয়া মিগ-২১ নিয়ে ইসরায়েলিরা পরবর্তীতে অনেক গবেষণা চালিয়েছে। এর শক্তি আর দুর্বলতাগুলো খুঁজে বের করে। মিগের বিরুদ্ধে নিজেদের বিমানগুলোর লড়াইয়ের ব্যাপারে নতুন করে প্রশিক্ষণ দেয় ইসরায়েল। রেদফার মিগ অভিজ্ঞতাও সেক্ষেত্রে তাদের সাহায্য করেছিল। আর রেদফার এই অবিশ্বাস্য অভিযানের ফলেই ১৯৬৭ সালের জুন মাসে আরব দেশগুলোর বিরুদ্ধে ছয় দিনের যুদ্ধে ইসরায়েলি বিমানবাহিনী একের পর এক সাফল্য পায়। কোনো বিমান না হারিয়েই আরবদের ছয়টি মিগ-২১ ধ্বংস করে ইসরায়েল। ১৯৬৮ সালে আমেরিকাকে মিগ-২১ ধার দেয় ইসরায়েল, যেন আমেরিকাও তাদের নিজেদের মতো করে নিজেদের প্রস্তুত করতে পারে। ইসরায়েলে রেদফা বীর হলেও ইরাকে তিনি বিশ্বাসঘাতক। রেদফার এই বিশ্বাসঘাতকতার দাম দিতে হয় ইরাকের খ্রিস্টানদের। ২০০৩ সালের আগে ইরাকের বিমানবাহিনীতে কোনো খ্রিস্টান যোগ দিতে পারেনি!
তথ্যসূত্র
1. Ian Black and Benny Morris (2007). Israel’s Secret Wars: A History of Israel’s Intelligence Service
ফিচার ইমেজ- Defense Aviation