এন্ডিউরিং দ্য আনএন্ডিউরেবল
আগস্ট ১২-১৫, ১৯৪৫
ধোঁয়া ছড়াতে ছড়াতে উদ্ধারকারী ট্রেনটি এগিয়ে আসছিলো। সাচিকো সেদিকেই একনজরে তাকিয়ে ছিলো। দরজাগুলো খুলে গেলো। বাবা সাচিকোকে ট্রেনে তুলে দিলেন। ভেতরের প্রতিটি সিট, প্রতি ইঞ্চি জায়গা আহতদের দিয়ে ভরে গিয়েছিল।
এই ভিড়ের মধ্য দিয়েই কোনোমতে ভেতরে এগিয়ে গেলো সাচিকো। মা, বাবা, সাচিকো, আকি, ইচিরো, মিসা, আর মামা একসাথে বসে পড়লো। দম নিতেও খুব কষ্ট হচ্ছিলো সাচিকোর।
ট্রেনটি আস্তে আস্তে সামনের দিকে চলতে শুরু করলো।
কোনো পানি নেই।
নেই কোনো খাবারও।
পরের স্টেশনে গিয়ে ট্রেনটি থামলো। আহতরা ট্রেনের দরজায় ভিড় জমিয়েছিলো। বাইরে অপেক্ষমাণ গাড়িতে উঠতে অনেকেই জানালা দিয়ে লাফিয়ে ট্রেন থেকে নামলো।
ট্রেনটি আবার চলতে শুরু করলো। আকির কাঁধের যন্ত্রণাটা বেড়ে গিয়েছিলো। ইচিরোর অনেক জ্বর উঠে গেলো। মিসাও কেমন যেন হতোদ্যম হয়ে পড়লো।
সাচিকোর গলা জ্বলছিলো। বাঁচার জন্য বাতাসের চাইতে পানিকেই তখন তার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হচ্ছিলো।
“তোমাকে অবশ্যই টিকে থাকতে হবে”, বাবা বলতে লাগলেন, “আমাদের অবশ্যই মনের মাঝে আশা রাখতে হবে যে, আমরা বেঁচে থাকতে থাকতেই শিমাবারায় পৌঁছতে পারবো।”
এক দিন।
দুই দিন।
তিন দিন।
চার দিন।
ট্রেনটি যখন শিমাবারার উদ্দেশ্যে ছুটছিলো, সম্রাটের সুপ্রিম ওয়্যার লিডারশিপ কাউন্সিলের সদস্যরা তখন আত্মসমর্পণের শর্তগুলো নিয়ে একে অপরের সাথে তর্ক করছিলো। জাপানের কী হবে? কাউন্সিল থেকে সিদ্ধান্ত আসতে দেরি হচ্ছিলো, আর ওদিকে বি-২৯ বোমারু বিমানগুলো জাপানের উপর বোমা হামলা চালিয়েই যাচ্ছিলো। ৬৬টি জাপানী শহর ইতোমধ্যেই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। আর খুব বেশি বাকিও ছিলো না।
আগস্ট ১৫; উদ্ধারকারী ট্রেনটি শিমাবারায় পৌঁছলো। সাথে সাথেই উদ্ধারকর্মীরা আহতদের স্ট্রেচারে করে ট্রেন থেকে নামাতে লাগলেন এবং প্লাটফর্মে সারি বেঁধে এমনভাবে সাজাতে লাগলেন, যেভাবে মাছের বাজারে মাছগুলো সাজানো থাকে।
দুপুরের দিকে রেডিওতে অপরিচিত কণ্ঠের এক লোকের ধারণকৃত বক্তব্য প্রচার করা হলো। এটা ছিলো সম্রাট হিরোহিতোর কণ্ঠস্বর। মানুষজন আশ্চর্য হয়ে গেলো। জাপানের জনগণ এর আগে কখনোই হিরোহিতোর কোনো বক্তব্য শোনেনি। দাপ্তরিক ভাষাতেই হিরোহিতো তার বার্তা পৌঁছে দিলেন সকলের উদ্দেশ্যে,
“The war situation has developed not necessarily to Japan’s advantage . . . we have resolved to pave the way for a grand peace for all generations to come by enduring the unendurable and suffering what is insufferable.”
একজন লোক সাথে সাথেই সম্রাটের বক্তব্যগুলো সহজ করে সকলের জন্য বুঝিয়ে দিচ্ছিলো।
“অস্ত্র সমর্পণ বাদে আমাদের হাতে আর কোনো রাস্তাই খোলা ছিলো না।”
স্টেশন, রাস্তাঘাট- কোনো জায়গার মানুষজনই যেন নিজেদের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না। কেউ কেউ হাঁটু ভেঙে বসে পড়লো। কাঁদতে লাগলো কেউ, কেউ বসে গেলো প্রার্থনায়।
যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে।
একেবারেই শেষ হয়ে গেছে।
বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ করেছে জাপান। মার্কিন সামরিক বাহিনী দেশটিতে তাদের ঘাঁটি স্থাপন করবে। দু’হাজার বছর পর প্রথমবারের মতো জাপানের নিজ ভূমিতে শত্রুসেনারা স্বচ্ছন্দে হেঁটে বেড়াবে।
সামনের দিনগুলোতে আর কী কী দুর্ভোগ অপেক্ষা করছে কে জানে?
টু ব্রাদার্স
আগস্ট ১৫ – মধ্য সেপ্টেম্বর, ১৯৪৫
সাচিকোর পরিবারের লোকজন শিমাবারা স্টেশনে একসাথে বসে ছিলো। এখন তারা কী করবে? আকি ব্যথায় কাতরাচ্ছিলো। কাঁধ আর পিঠের পুড়ে যাওয়া জায়গাগুলো সংক্রমণে লাল হয়ে গিয়েছিলো। সেখান থেকে তরল পদার্থ চুইয়ে পড়ছিলো। আর সে-ও ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছিলো।
আর ইচিরো! ওরই বা কী অবস্থা?
বাবা ওর দিকে ঝুঁকে নরম গলায় বলতে লাগলেন, “ইচিরো, নাগাসাকি থেকে এতটা পথ এসেছ তুমি বাবা। উঠে দাঁড়াও।”
কিন্তু ইচিরো উঠে দাঁড়াতে পারলো না। ওর মাথা ঘোরাচ্ছিলো, শরীরটাও গরম ছিলো। জ্বর কমার কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছিলো না। তার চুল পড়ে যাচ্ছিলো। দাঁতের মাঢ়ি থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছিলো। আকি আর ইচিরো- দুজনকেই কোনো হাসপাতালে ভর্তি করাটা আবশ্যক হয়ে পড়েছিলো।
শিমাবারার হাসপাতালটা প্রয়োজনের তুলনায় বেশ ছোটই ছিলো। মেঝেতে মাত্র ছয়টি মাদুর বিছানো ছিলো। একটি বাদে বাকি সবগুলোতেই রোগী ছিলো। আকি আর ইচিরো দুজনেরই সেই মুহুর্তে খালি সেই মাদুরে জায়গা পাওয়াটা দরকার ছিলো। কিন্তু সময় যতই যেতে লাগলো, ইচিরোর অবস্থার ততই অবনতি ঘটতে লাগলো।
শেষপর্যন্ত সিদ্ধান্ত হলো, মামা আকি আর মিসাকে নিয়ে যাবেন বাবার আত্মীয়দের বাড়িতে। ওদিকে ইচিরোর সাথে হাসপাতালে থাকবে সাচিকো, বাবা আর মা। তাদেরকে থাকতে হবে হাসপাতালের মেঝেতে। তারপরও তারা তাদের সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করবে ইচিরোর যন্ত্রণা লাঘবের।
হাসপাতালে থাকা স্বল্পসংখ্যক ডাক্তার ও নার্স রাত-দিন যন্ত্রের মতো খেটে যাচ্ছিলো। মজুত থাকা সামান্য কিছু মলম, মারকিউরোক্রোম কিংবা কখনো ভেজিটেবল অয়েল লাগিয়ে দিচ্ছিলো আহতদের ক্ষতস্থান এবং পুড়ে যাওয়া জায়গাগুলোতে। ইচিরোর ক্ষত বাইরে থেকে কিছুই দেখা যাচ্ছিলো না, কিন্তু দিন দিন তার অবস্থা খারাপ হতে লাগলো। সে কিছুই খেতে কিংবা পান করতে পারছিলো না। পুরো শরীর জুড়ে রক্তবর্ণের গুটি দেখা দিলো।
“একটা সুস্থ-সবল ছেলে কীভাবে এতটা অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে?”, জানতে চাইলেন মা। যদি তিনি কেবল বুঝতে পারতেন তার ছেলের অসুস্থতার প্রকৃত কারণটা, তাহলে তিনি নিজেই সেবা-যত্ন করে ইচিরোকে সুস্থ করে তুলতে পারতেন বলে তার বিশ্বাস ছিলো। সন্তানের দেখাশোনা কীভাবে করতে হয়, এটাও জানা উচিত- এমনটাও ভাবতে লাগলেন মা। বাবা-মা হিসেবে তারা সবসময় অতীতের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই কাজ করেছেন।
বাবা কেবল মাথা নেড়ে বললেন, “অতীত এখন একেবারেই অর্থহীন।”
আগস্টের ২৪ তারিখ হাসপাতালের মেঝেতে নিস্তেজ অবস্থায় শুয়ে ছিলো ইচিরো, আর একটু পর পর প্রলাপ বকছিলো। এই ইচিরোই একসময় সাচিকোকে দেখেশুনে রেখেছে। অথচ আজ সে ঠিকমতো সাচিকোর হাতটাও ধরতে পারছিলো না।
সাচিকোর দিকে ফিরে বাবা চিৎকার করে বললেন, “তাড়াতাড়ি নার্স ডেকে আনো।”
সাচিকো সাহায্যের জন্য দৌড়ে গেলো। কিন্তু সে কেবল এককাপ পানিই নিয়ে ফিরতে পারলো। তার হাত দুটো এতটাই কাঁপছিলো যে, কাপ থেকে কিছু পানি উপচে তার সামনে পড়ে গেলো। সে নিচু হয়ে ইচিরোর মুখে পানি ঢালতে চাইলো। কিন্তু ইচিরোর গলা দিয়ে পানি নামলো না।
একজন নার্স একটি গামলায় করে কিছু বরফের টুকরা আনলেন। এর একটি টুকরা তিনি ইচিরোর জিহ্বায় দিলেন।
“সাচিকো”, খুব দুর্বল গলায় কথা বলে উঠলো ইচিরো, “বোন আমার, সবার খেয়াল রেখো।”
সাচিকো চিৎকার করে কিছু বলতে চাইলো, কিন্তু তার গলায় কথাগুলো যেন আটকে গেলো।
বাবা সাচিকোর হাতটি ধরে ইচিরোর হাতের উপর রাখলেন।
“সবার খেয়াল রেখো”, এটুকু ফিসফিসিয়ে বলেই ইচিরো মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লো।
সাচিকো একনজরে তার মৃত বড় ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো।
“ইচিরো! ইচিরো! ফিরে আসো!”
… … … …
মামা আর মিসার সাথে দেখা করতে এবং আকিকে হাসপাতালে আনতে বাবা-মা সেই আত্মীয়ের বাসায় গেলেন। হাসপাতালে কেবলমাত্র একটি মাদুরই ফাঁকা ছিলো। বাবা-মা সেখানেই আকিকে আস্তে আস্তে শুইয়ে দিলেন। সে ব্যথায় কুঁকড়ে উঠলো। কিন্তু পরক্ষণেই পুরো রুমটা একনজরে দেখে জানতে চাইলো, “ইচিরো কোথায়?”
“ইচিরো মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে”, মিথ্যা কথা বললেন বাবা। তিনি আকির দিকে ঝুঁকে এলেন, “একই কথা তোমার বেলাতেও খাটে। তুমি আমাদের পরিবারের বড় সন্তান। মনোযোগ দিয়ে শোনো। যে মানুষটা বেঁচে থাকে, সে তার সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে হলেও বেঁচে থাকার চেষ্টা চালিয়ে যায়। তোমার এখনও দুনিয়া ছেড়ে যাবার সময় হয়নি। যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে।”
আকির চোখ বড় বড় হয়ে এলো, “তুমি কী বললে বাবা?”
“যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে”, বাবা আবারও বললেন।
এবার ঢোক গিললো আকি, কষ্ট করে জানতে চাইলো, “যুদ্ধের ফলাফল কী?”
“আমরা হেরে গেছি।”
“কী!”, খুব কষ্ট করে উঠে বসলো আকি। “আমরা হেরে গেছি?”
বাবা কী বলেন সেটা শুনতে বাবার দিকে মুখ ফেরালো সাচিকো।
“হ্যাঁ, আমরা হেরে গেছি।”, বাবা আস্তে আস্তে বললেন, “জাপান যুদ্ধে হেরে গেছে।”
“কিন্তু, এটা কীভাবে সম্ভব!”, আকি একনজরে বাবার দিকে তাকিয়ে রইলো। উত্তেজনায় কাঁপছিলো সে, চোখের পানি বহু কষ্টে আটকে রেখেছিলো। “সবাই বলবলি করছিলো, আমরা জিততে যাচ্ছি। জাপান জিততে যাচ্ছে।”
বাবা চুপচাপ বসে রইলেন, দু’হাত দিয়ে ঢেকে রেখেছিলেন মুখটা।
“বাবা, তুমি কাঁদছ কেন?” জিহ্বা দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে নিলো আকি। “আমার বিশ্বাস হয় না যে, আমরা হেরে গেছি। বাবা, তোমার চোখের পানি মোছো। আমাদের জাপানী ভাইদের জন্য হলেও তোমার চোখের পানি মোছো। জয়ের আগপর্যন্ত আমরা লড়বো। বাবা, গান গাও- ‘উমি ইয়ুকাবা’।”
হঠাৎ করে আকি মাদুরে শুয়ে পড়লো, ক্লান্ত স্বরে বললো, “বাবা, প্লিজ, এমনভাবে গাও যেন আমি নিজেই একজন কামিকাযে পাইলট। গাও, ‘যদি আমি সমুদ্রে যাই’।”
বাবা ধরা গলায় গান গাইতে শুরু করলেন। চোখ বন্ধ করে তার সাথে সুর মেলালো আকিও,
যদি আমি সমুদ্রে যাই,
আমার মৃতদেহ তীরে ভেসে আসবে।
যদি আমি পাহাড়ে যাই,
আমার মৃতদেহ ঘাসে পড়ে রইবে।
তবে, যদি আমি সম্রাটের জন্য মারা যাই,
তাহলে আমার কোনো দুঃখ রইবে না।
সাচিকোর বড় ভাই আকিও শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো। তার মাথাটা বাবার কোলে ঢলে পড়লো। সাচিকো কিছুই বলতে পারলো না। মনের ভেতরের কথাগুলোও যেন আজ পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
এই সিরিজের পূর্ববর্তী পর্বসমূহ
১) পর্ব – ১ || ২) পর্ব – ২ || ৩) পর্ব – ৩ || ৪) পর্ব – ৪ || ৫) পর্ব – ৫ || ৬) পর্ব – ৬