সারা বিশ্বজুড়ে প্রায় ১.৮ বিলিয়ন মুসলিমের কাছে রমজান মাস একটি পবিত্র সময়, সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোজা রেখে তারা এ সময়টি পার করে থাকে। কিন্তু কবে প্রথম এই মাসব্যাপী রোজা বাধ্যতামূলক করা হয়? ইসলামের পূর্বেই বা রোজা কেমন ছিল? এসব নিয়েই আমাদের আজকের আয়োজন।
রামাদান [رمضان] (ভাষাগত অপভ্রংশ: রমজান) শব্দটা এসেছে আরবি মূল রামিদা বা আর-রামাদ থেকে, যার মানে প্রচণ্ড উত্তাপ কিংবা শুষ্কতা। আরবি ক্যালেন্ডারের নবম মাস হলো রমজান। হযরত মুহাম্মাদ (সা) প্রথম ওহী পেয়ে নবী হয়েছিলেন ৬১০ সালের রমজান মাসেই। এ মাসের যে রাত্রিতে প্রথম আয়াতগুলো নাজিল হয় (সুরা আলাক এর প্রথম পাঁচ আয়াত) সে রাতকে বলা হয় শবে কদর বা লাইলাতুল কদর (আরবিতে লাইল=রাত)। বলা হয়েছে যে, রমজানের শেষ ১০ দিনের বিজোড় রাত্রির কোনো এক রাত্রি এই শবে কদর, প্রসিদ্ধমতে সেটা ২৭ তারিখ ধরে নেয়া হয়। যদিও আরেক মতে সেটি ২৩তম রাত্রি। তবে নিশ্চিতভাবে এই রাতটি পাবার জন্য ধর্মপ্রাণ মুসলিমগণ ইতিকাফ করে থাকেন, অর্থাৎ নির্জনে টানা ১০ দিন প্রার্থনা। আর এই রমজান শেষ হওয়া মানেই ঈদুল ফিতর যা মুসলিমদের প্রধান দুটি উৎসবের একটি।
পুরোপুরি প্রমাণিত না হলেও, মতবাদ আছে যে, নবী হযরত ইব্রাহিম (আ) এর সহিফা নাজিল হয়েছিল তৎকালীন রমজানের ১ম দিবসে, তাওরাত এসেছিল ৬ রমজান, যাবুর ১২ রমজান আর ইঞ্জিল ১৩ রমজান। যদিও আরবের বাহিরে রমজান মাস হিসেব করা হতো না, কিন্তু এই হিসেবটা ভিন্নজাতিক পঞ্জিকার সাথে মিলিয়ে স্থির করা হয়েছে বলে বলা হয়।
তবে পুরো এক মাস পবিত্র রমজান মাসের রোজা রাখার আদেশ অবতীর্ণ হয় যখন নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) এবং সাহাবীরা মক্কা থেকে মদিনাতে হিজরত করেন তার পরে। সেটা ছিল হিজরতেরও ১৮ মাস পরের ঘটনা। তখন আরবি শাবান মাস চলছিল।
“রমযান মাসই হলো সে মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে কোরআন, যা মানুষের জন্য হেদায়েত এবং সত্যপথ যাত্রীদের জন্য সুষ্পষ্ট পথ নির্দেশ আর ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী। কাজেই তোমাদের মধ্যে যে লোক এ মাসটি পাবে, সে এ মাসের রোযা রাখবে।” [পবিত্র কুরআন, বাকারা 2:185]
তবে এমন না যে, এর আগে কেউ রোজা রাখত না। অবশ্যই রাখত। কুরআনেই বলা রয়েছে যে, আগের জাতিগুলোর জন্যও রোজা বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল, সেটা রমজান না হলেও।
“হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরয করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর, যেন তোমরা পরহেযগারী অর্জন করতে পার।” [পবিত্র কুরআন, বাকারা 2:183]
এমনকি মক্কার মানুষেরাও ইসলামের পূর্বে রোজা রাখত, তবে সেটা কেবল মুহাররাম মাসের ১০ম দিন, আশুরার রোজা। কারবালার ঘটনা তখনও ঘটেনি, আশুরার প্রধান উপজীব্য ছিল হযরত মুসা (আ) এর নেতৃত্বে মিসর থেকে বনী ইসরাইলের মুক্তি এবং লোহিত সাগর দু’ভাগ হয়ে যাবার ঘটনা। আত্মসংযম আর আল্লাহ্র সন্তুষ্টির নিমিত্তে অন্যরাও রোজা রাখত বটে।
৭৪৭ সালের একজন আরব লেখক আবু যানাদ জানান যে, উত্তর ইরাকের আল জাজিরা অঞ্চলে অন্তত একটি মান্দাইন সমাজ ইসলাম গ্রহণের আগেও রমজানে রোজা রাখত। প্রথম থেকেই রমজানের রোজা রাখা শুরু হত নতুন চাঁদ দেখবার মাধ্যমে, তাই অঞ্চল ভেদে রোজার শুরুও ভিন্ন হতো। এখন মেরু অঞ্চলের কাছাকাছি দেশের মুসলিমরা প্রকৃতির স্বাভাবিক সময়ানুসারে সেখানে রোজা রাখতে পারে না, যেহেতু সেখানে দিনরাত্রির পার্থক্য করা দুরূহ। তাই নিকটতম স্বাভাবিক দেশের সময়সূচী কিংবা মক্কার সময় মেনে তারা রোজা রাখে এবং ভাঙে।
অতিরিক্ত ইবাদত হিসেবে রয়েছে তারাবিহ, যদিও সেটি বাধ্যতামূলক নয়, বরং সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ। নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) প্রথমদিকে জামাতের সাথে সে নামাজ আদায় করলেও পরে জামাতে করেন নি, পাছে সেটি মুসলিমদের জন্য বাধ্যতামূলক হয়ে পড়ে। তবে খলিফা উমার (রা) পুনরায় জামাতে আদায় করা শুরু করেন তার শাসনামলে। তবে শিয়াগণ তারাবিকে নবউদ্ভাবন বলে পরিত্যাগ করে থাকে। আট থেকে ২০ রাকাত পর্যন্ত তারাবিহ নামাজ আদায় করা হয়ে থাকে, তবে মক্কার হারাম শরিফে ২০ রাকাতই আদায় করা হয়। উল্লেখ্য, ফজরের ওয়াক্ত হবার পূর্বে খেয়ে রোজা রাখাকে সাহরি আর সূর্যাস্তের পর খেয়ে রোজা ভাঙাকে ইফতার বলা হয়।
অনেক খ্রিস্টানও রোজা রেখে থাকে, তবে কিছুটা ভিন্ন অর্থে। বাইবেলে বর্ণিত যীশু খ্রিস্ট নিজেও টানা ৪০ দিন রোজা রেখেছিলেন। (Matthew 4; Luke 4)। আদি খ্রিস্টানরাও রোজা রেখেছিলেন বলে বাইবেলে প্রমাণ পাওয়া যায়। (Acts 13:1-5; 14:23; 27:9); এখনো অনেক ধর্মপ্রাণ রোমান ক্যাথলিক খ্রিস্টান ইস্টার সানডেরআগের ছয় সপ্তাহ এই প্রথা পালন করেন, একে Lent বলা হয়।
উল্লেখ্য, আরবিতে সিয়াম বললেও উপমহাদেশে ফার্সি “রোজা” শব্দটাই বেশি প্রচলিত হয়ে গেছে। আরবি “সাওম” শব্দ কিংবা সিরিয়াক “সাওমা” অথবা আদি হিব্রু “সম” শব্দের মূল অর্থ “বিরত থাকা”। শুধু খ্রিস্টান বা মুসলিম নয়, ইহুদী ধর্ম, বৌদ্ধধর্ম, কনফুসীয়, সনাতন, তাও কিংবা জৈনবাদ- সকল ক্ষেত্রেই আছে উপবাসের প্রচলন। রমজানের রোজা ছাড়াও মুসলিমদের জন্য শাওয়াল মাসের যেকোনো ৬ দিন, প্রতি চন্দ্রমাসের ১৩-১৫ তারিখ, আরাফা দিবস, আশুরা দিবস ইত্যাদি দিবসে রোজা রাখার ব্যাপারে উৎসাহিত করা হয়েছে। তবে ঈদের দিন রোজা রাখা নিষিদ্ধ।
একমাত্র যে ধর্মের ব্যাপারে রেকর্ড পাওয়া যায় যেখানে রোজা রাখা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল সেটি হলো আদি পারস্যের ধর্ম বা জরথুস্ত্রুবাদ।
তবে মুসলিমদের মতো কঠোরভাবে রোজা রাখে কেবল ধার্মিক ইহুদীরাই। বছরে ছয় দিন তাদের বাধ্যতামূলক রোজা রাখতে হয়। সাব্বাথ (সাপ্তাহিক ছুটির শনিবার) দিবসে রোজা রাখা তাদের জন্য হারাম। ইয়ম কিপুর (হিব্রুতে ইয়ম=দিন, কিপুর=প্রায়শ্চিত্ত) এর দিন অবশ্যই অবশ্যই রোজা রাখতে হবে। এদিন ইহুদী বিশ্বাস মতে, এক বছরের ভাগ্য নির্ধারিত হয়। এবং তারা টানা ২৫ ঘণ্টা রোজা রাখে।
নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) যখন মদিনা এলেন, তখন তিনি দেখলেন ইহুদীরা আশুরার রোজা রাখছে। যদিও তারা ইসরায়েলে থাকতে ইহুদী ক্যালেন্ডার ব্যবহার করত, সেখানকার ইহুদী মাস তিশ্রির দশম দিবসে তারা রোজা রাখত (ইয়ম কিপুর)। আরবে তারা সেটার সাথে মিলিয়ে মুহাররামের দশম দিন আশুরার দিন রোজা রাখত। হযরত মুহাম্মাদ (সা) জিজ্ঞেস করলেন, তারা কেন রোজা রাখে? তারা উত্তর করল, এদিন আল্লাহ্ বনি ইসরাইলকে রক্ষা করেছিলেন এবং হযরত মুসা (আ) এজন্য রোজা রেখেছিলেন। তখন হযরত মুহাম্মাদ (স) মুসলিমদেরও এ রোজা রাখতে নির্দেশ দেন যেহেতু হযরত মুসা (আ) ইসলাম ধর্মেও নবী। তবে তিনি সাথে অন্তত একদিন অতিরিক্ত রাখতে বললেন, আগের দিন কিংবা পরের দিন। পেছনের কাহিনী মক্কাবাসীরা না জানলেও, তারা ঠিকই আগে থেকে এ দিন রোজা রাখত, এমনকি ইসলামের আগে হযরত মুহাম্মাদ (স) নিজেও রেখেছিলেন। রমজানের রোজা বাধ্যতামূলক হবার আগে এ রোজাটা সবাইকে রাখতে হত। রমজানের রোজা আসবার পর এ রোজা নফল হয়ে যায়।
অনেকের আগ্রহের বিষয় থাকতে পারে, নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) ও সাহাবীরা কী খেয়ে সাহরি বা ইফতার করতেন? নবীজী (সা) মাগরিবের আগে কয়েকটি ভেজা খেজুর খেতেন, তা না থাকলে শুকনো খুরমা/খেজুর, আর পানি। এটাই ছিল ইফতার। একবার তিনি সফরে থাকা অবস্থায় ছাতু ও পানি মিশিয়ে ইফতার করেছিলেন। সেহরির ক্ষেত্রেও প্রাধান্য দিতেন খেজুরকে। তবে এমনটা ভাবার কারণ নেই যে খেজুরগুলো ছোট ছোট, আরবীয় খেজুর যথেষ্ট বড়, অন্তত আমাদের দেশের তুলনায়।
সারা বিশ্বের ধর্মপ্রাণ মুসলিমগণ রমজান মাসটি পালন করে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের সাথে, এবং পরম আগ্রহে সাদরে বরণ করে নেয় রমজান শেষে ঈদকে। সবাইকে রামাদান মোবারাক!
তথ্যসূত্র
- পবিত্র কুরআন
- মুসলিম শরীফ, ১০৯৯,
- বায়হাকি, মেশকাত : ১৭৪,
- নাসায়ি: ২১৬২,
- আবু দাউদ, ২৩৪৫
- বুখারি শরিফ, মুসলিম শরিফ
- নিউ টেস্টামেন্ট, বাইবেল
- telegraph.co.uk/lifestyle/11524808/The-history-of-fasting.html