মিশরের রাজধানী কায়রোর এক রেঁস্তোরার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন এক বুড়ো। কাঁধে তার ময়লামাখানো একটা ঝুলি। পরনের পোশাক দেখে তাকে সঙ মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। কারণ, এই ধরনের পোশাক এখন জাদুঘর আর নাট্যমঞ্চ- এই দুই জায়গা বাদে বাকি সব জায়গায় বেমানান। সবাই রেঁস্তোরার দরজা দিয়ে যাওয়ার সময় অবাক হয়ে ওঁর দিকে একপলক ফিরে দেখছেন। অনেকে মুচকি হাসি দিয়ে ফের নিজের কাজে ফিরে যাচ্ছেন।
বুড়োর বড্ড ক্ষুধা লেগেছে। তিনি ভিতরে গিয়ে বসলেন। তারপর এদিক ওদিক দেখতে দেখতে চোখ গিয়ে পড়লো সামনের টেবিলে বসা এক তরুণের খাবারের দিকে। তিনি বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন। “একি সর্বনাশ!”
চোখের পলকে বুড়ো লাফ দিয়ে উঠে এক থাবায় মাটিতে ফেলে দিলেন তরুণের খাবার। তরুণ বেচারা কিছু বুঝে উঠার আগেই খপ করে তার কলার চেপে ধরলেন সেই বুড়ো। রেস্তোরার বাকি সবাই হাঁ হয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলো কিছু না বুঝতে পেরে।
বুড়ো চোখ রাঙিয়ে তরুণকে চিৎকার করে বললেন, “তোমার কতো বড় সাহস তুমি দিব্যি আমার গডকে চিবিয়ে খাচ্ছো! এতো বড় পাপ করতে একটুও ভয় করলো না?”
রেঁস্তোরার সবাই চোখ পাকিয়ে উঠলেন। “গডকে চিবিয়ে খাচ্ছে? কে সেই গড?”
বুড়ো আঙুল দিয়ে ইশারা করলেন মেঝেতে পড়ে থাকা কিছু মাশরুমের কারির দিকে! “এই সেই গড! মাশরুম আমার গড!”
প্রাচীন মিশরের কেউ যদি হঠাৎ করে ফিরে আসে উপরের কাল্পনিক গল্পের মতো করে, তাহলে এরকমই কিছু ঘটবে সেটা নিশ্চিত বলা যায়। কারণ মাশরুম এখনকার যুগে উপাদেয় খাদ্য হিসেবে নাম কুড়োলেও এর যাত্রা কিন্তু খাবার হিসেবে শুরু হয়নি, বরং দেবতা হিসেবেই হয়েছিলো এর উত্থান!
শুধু মন্দির সোপানেই থেমে যায়নি এর যাত্রা। হাজারো রূপকথা, পৌরাণিক গাথা, অমরত্ব লাভের চাবিকাঠি, জাদুবিদ্যা, এমনকি গোটা একটি শহরের উৎপত্তিতেও ছিল এই মাশরুমের প্রভাব। আমাদের আজকের প্রবন্ধে মাশরুম সম্পর্কিত উল্লেখযোগ্য কিছু পৌরাণিক কাহিনীতে আলোকপাত করা হয়েছে।
প্রাচীন সভ্যতায় মাশরুম
প্রাচীন যুগের বড় বড় সভ্যতাগুলোর মধ্যে মিশর সভ্যতা অন্যতম। প্রাচীন মিশরের মানুষরা বিশ্বাস করতেন যে, ঈশ্বর আর মাশরুমের মাঝে বিশেষ যোগসূত্র বিদ্যমান। তারা মাশরুম কে ‘ঈশ্বরপুত্র’ হিসেবে সম্বোধন করতেন।
তৎকালীন পুরোহিতরা বিশ্বাস করতেন যে, ঈশ্বর অসিরিস বজ্রপাতের মাধ্যমে আশীর্বাদ স্বরূপ বন্য মিশরীয় মাশরুম পৃথিবীতে প্রেরণ করেন। এই মাশরুম ফারাও ব্যতীত আর কারো জন্য ভক্ষণ করা ছিল দন্ডনীয় অপরাধ। হায়ারোগ্লিফিকের পাঠোদ্ধার করে এর কারণ হিসেবে পাওয়া গেছে- ফারাওরা বিশ্বাস করতেন এই মাশরুম ভক্ষণের মাধ্যমে তারা অমরত্ব লাভ করবেন।
এদিক থেকে গ্রিক সভ্যতা ব্যতিক্রম। গ্রিকরা মাশরুমের তেমন একটা ধার ধারতেন না। গ্রিকরা মাশরুম দেখলে আর সেদিকে যেতেন না।
মাশরুম মানেই তাদের কাছে বিষাক্ত কোনো কিছু বুঝাতো এবং একে অমঙ্গলের প্রতীক হিসেবে ধরা হতো। কারণ গ্রিসে জন্মানো বুনো মাশরুম মারাত্মক বিষাক্ত ছিল।
তবে গ্রিক পুরাণে অ্যাম্ব্রোসিয়া মাশরুমের উল্লেখ রয়েছে। এই মাশরুমের পানীয় পানের মাধ্যমে গ্রিক দেবতারা দীর্ঘায়ু লাভ করতেন বলে কথিত আছে। একদল ঘুঘু পাখির মাধ্যমে প্রথম এই মাশরুম দেবালয়খ্যাত ‘অলিম্পাসের চূড়া’য় আনয়ন করা হয়।
রোমানরা মাশরুম খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করলেও তারা বিষাক্ত মাশরুমকে Death Fungus বা ‘মৃত্যু ছত্রাক’ হিসেবে চিনতেন। মাশরুমের উৎপত্তি নিয়ে রোমানদের বিশ্বাস মিশরীয়দের সদৃশ। রোমান গড জুপিটার পৃথিবীর বুকে বজ্রপাত প্রেরণ করেন। বজ্রপাত আঘাতস্থলে রাশি রাশি মাশরুম গজিয়ে উঠে জুপিটারের আশীর্বাদস্বরূপ।
লিথুনিয়ার পুরাণে মাশরুমকে দেবতা ভেলোনিয়াসের আঙুল হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। আর ভেলোনিয়াস হচ্ছে মৃত্যু দেবতা।
মধ্যযুগে উত্তর আমেরিকার ওজাক অঞ্চলে পূর্ণিমার রাতে মাশরুম জড়ো করে যাদুকররা ‘ভুডু’ ম্যাজিক করতেন। ওই অঞ্চলে অন্যান্য সময় মাশরুম স্পর্শ করা এবং খাওয়া নিষিদ্ধ ছিল।
মেসো-আমেরিকার রহস্যময় মাশরুম মূর্তি
মেসো-আমেরিকা অঞ্চল মূলত মধ্য আমেরিকার দেশ মেক্সিকো থেকে বেলিজ, গুয়াতেমালা, হন্ডুরাস, নিকারাগুয়া হতে কোস্টারিকা পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকা। এই অঞ্চল মূলত ইতিহাসে মায়ান-আজটেক সভ্যতার কারণে বহুল পরিচিত। ইউরোপের বড় বড় সভ্যতাই শুধু মাশরুম উপাসনা করতো না। তার বিস্তৃতি মেসো-আমেরিকাতেও ছিল।
মেসো-আমেরিকা সভ্যতায় মাশরুম নির্ভর ‘কাল্ট’ বা ধর্মাচার প্রচলিত ছিল। এই অঞ্চলে মাশরুমের আদলে তৈরি মানুষের ছোট ছোট মূর্তি পাওয়া যায়। অনেকের মতে এটা মানুষের প্রতিকৃতি আবার অনেকে দ্বিমত পোষণ করে এটাকে দেবতার মূর্তি হিসেবে দাবি করেন। একদল গবেষক অবশ্য অন্যদিকে মোড় নেন। প্রাচীন যুগে Psilocybin নামক মাশরুম খেয়ে Hallucination বা মতিভ্রমের মাধ্যমে শুদ্ধিলাভ করার অর্চনা পালিত হতো। এগুলো সেই অর্চনার মূর্তি বলে তারা জোরালো দাবি করেন।
পুরাতত্ত্ববিদরা পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হন যে, মূর্তিগুলোর নির্মাণকাল কলোম্বাস আমেরিকা আবিষ্কারেরও প্রায় ১০০ বছর আগে।
মজার ব্যাপার হলো ঢেঁকি যেমন স্বর্গে গেলেও ধান ভানে তেমনি বিশ্বাসের বদল হলেও এই অঞ্চলের মানুষদের মাশরুমপ্রীতি এতো সহজে বদলায়নি। যিশুখ্রিস্টের ধর্মবাণী বিশাল আটলান্টিক পেরিয়ে মেসো-আমেরিকার বুকে পদার্পণ করার পরই ধীরে ধীরে পতন ঘটে আদিধর্মের। তারপরও Psilocybin এর অর্চনা এখনো ক্ষুদ্র পরিসরে পালিত হয় মেক্সিকোর প্রত্যন্ত অঞ্চলে।
ক্রুশবিদ্ধ যিশুক্রিস্ট এবং পবিত্র মাশরুম
ক্রুশবিদ্ধ যিশুর প্রতীকী ছবি খ্রিস্টানধর্মের অন্যতম প্রতীক হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। অপরদিকে প্রাচীনযুগে গড হিসেবে চিহ্নিত পবিত্র মাশরুম হিসেবে পূজা করা হতো Amanita Muscaria নামক মাশরুমকে।
কিন্তু যিশুর ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার সাথে এই মাশরুমের সম্পর্ক কোথায়?
গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখতে পাবেন ক্রুশবিদ্ধ যিশুর সেই ছবির আদতের সাথে এই পবিত্র মাশরুম গডের আকার সাদৃশ্যপূর্ণ। এই নিয়ে রীতিমতো গবেষণার মাধ্যমে এবং আরো হাজারো খ্রিস্টান চিত্রকর্মের মাঝে মাশরুম মিথ-এর মিল খুঁজে পেয়েছেন গবেষকরা।
খ্রিস্টানধর্মের চিত্রকর্মে মাশরুম-পুরাণের প্রভাব নিয়ে John A Rush ২০১১ সালে প্রকাশ করেন তার সচিত্র গবেষণাগ্রন্থ The Mushroom in Christian Art.
কিন্তু John Rush এর আরো আগে এই বিষয় নিয়ে গবেষণা করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেন পুরাতত্ত্ববিদ John M Allegrol। তিনি ১৯৭০ সালে প্রকাশ করেন The Sacred Mushroom and the Cross।
বইটি প্রকাশ করে যেন বোমা ফাটিয়ে দেন John Allegrol! কিন্তু তার এই গবেষণাগ্রন্থ সমাদরের বদলে সমালোচনাই পায় বেশি। Time ম্যাগাজিন Jesus as Mushroom শিরোনামে তাকে কটাক্ষ করে একটি ফিচার প্রকাশ করেন। বইটিকে দার্শনিক Joan Taylor ‘কুখ্যাত’ এবং ‘অদ্ভুত’ হিসেবে চিহ্নিত করে তিরষ্কার করেন। এখানেই শেষ হয়ে যায়নি ঝামেলা। কিছুদিন পরেই প্রকাশককে প্রকাশ্যে ক্ষমা প্রার্থনা করতে বাধ্য করা হয় এবং তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়।
দীর্ঘ ৪০ বছর অবহেলার পর বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর Carl Ruck বইটির আধুনিক সংস্করণ বের করেন যা ভূয়সী প্রশংসা পায়। নতুন করে Allegrol এর তত্ত্ব নিয়ে কাজ শুরু হয়। তবে আসল গবেষণা থেকে অনেক স্পর্শকাতর ব্যাপার বাদ দিয়ে দেওয়া হয়।
ঋগবেদের রহস্যময় গাছ ‘সোমা’ কি মাশরুম?
হিন্দুধর্মের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ বেদ এর অন্যতম অংশ হচ্ছে ঋগবেদ। ঋগবেদে উল্লেখিত রহস্যময় গাছের নাম ‘সোমা’। ঋগবেদের বর্ণনামতে সোমা দেখতে ছোট, লালচে রঙের গাছ। যার কোনো পাতা নেই। এমনকি মূল এবং ফুল-ফল কিছুই নেই এই গাছের। তবে এর মাঝে মাংসালো এবং রসালো কান্ড বিদ্যমান। ঋগবেদ অনুযায়ী সোমা গাছের রস জগতের সবচেয়ে মূল্যবান পানীয় যা দেবতাদের বলি-বিসর্জন এর সময় পরিবেশিত হতো। পুরাতত্ত্ববিদদের মতে দেবতাদের কাছে সোমার নির্যাস ছিল অমৃত যা পানের মাধ্যমে তারা অমরত্ব লাভ করেন।
উদ্ভিদবিজ্ঞানীদের মধ্যে সোমা নিয়ে নানান মতভেদ বিদ্যমান। অনেক গাছকেই সোমা হওয়ার ক্ষেত্রে গোণায় ধরেন তারা- এর মধ্যে কিন্তু বাদ যায়নি মাশরুমের নামও!
সোমার পানীয় পানের ঘটনা অনেকটা গ্রিক পুরাণের অ্যাম্ব্রোসিয়ার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ যা পান করে দেবতারা দীর্ঘায়ু লাভ করেছিলেন।
তবে এই গাছ মাশরুম কিনা সেটা নিয়ে শক্ত প্রমাণ দেখাতে পারেননি কেউই!
Fairy Ring এর fairy tale
হাজারো বছর ধরে প্রচলিত বিখ্যাত মিথ হচ্ছে Fairy Ring । একে ঘিরে আছে মজার মজার সব গল্প আর ভৌতিক সতর্কবাণী। কেউ বিশ্বাস করুক আর নাই করুক, বিজ্ঞানের কথা বলে হেসে উড়িয়ে দিলেও মাঝে মাঝে Fairy Ring দেখে এর ভেতর পা দিতে যেয়ে অনেকের বুক ধক করে উঠতেই পারে!
প্রায় ৬০ প্রজাতির মাশরুম এই ধরণের বলয় তৈরি করতে পারে। এরা মাঝে মাঝে গোল আংটির মতো করে মাঠে ঘাসের মধ্যে বড়ো আকারের বসতি স্থাপন করে। বৃত্তাকার এই মাশরুম সমাজকে ইংরেজিতে Fairy Ring বলা হয়। এটি একটি সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক ঘটনা। সবচেয়ে বড় Fairy Ring ফ্রান্সের বেলফোর্টে অবস্থিত যার ব্যাস প্রায় ৬০০ মিটার। এর বয়স আনুমানিক ৭০০ বছর।
প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ এই বলয়কে ঘিরে রসালো নানান কল্পকাহিনী গড়ে তুলেছে। পশ্চিম ইউরোপে এর উৎপত্তি হিসেবে বলা হয়েছে, আকাশের পরীরা সবাই মিলে বৃত্তাকার নাচের মাধ্যমে পূর্ণিমা উদযাপন করার ফলে এই বলয় সৃষ্টি হয়। এই বলয় নাকি বাস্তবজগত আর পরীদের জাদুর জগতের মাঝে একটি দরজা ছাড়া আর কিছু নয়!
জার্মানরা একে ‘ডাইনির আংটি’ নামেও ডাকে। এপ্রিলের ৩০ তারিখ সন্ধ্যায় সকল ডাইনি এক হয়ে বসন্ত উদযাপন করে থাকে। যার ফলে জন্ম নেয় এই বলয়।
তাই জার্মানীতে থাকা কেউ ভুলেও সেদিন সন্ধ্যায় জঙ্গলে যাবেন না! ডাইনির খপ্পরে পড়লে আর রক্ষা নেই!
এভাবে স্কটিশ, ডাচ, আইরিশ, নরডিস্ক প্রভৃতি মিথোলজিতে এরকম নানা বর্ণনায় একে রহস্যময় করে তুলেছে। কিন্তু সবক্ষেত্রেই এই বলয় একটি বিপদজনক ‘নো ফ্লাই জোন’।
কেউ যদি ভুলে সেখানে চলে যায়, তাহলে তার পরিণতি কী হবে?
প্রচলিত কিছু মিথ ঘেঁটে বের করা উল্লেখযোগ্য কিছু পরিণতি নিচে দেয়া হলোঃ
- কেউ যদি ভুলেও এর মাঝে পা রাখে, তাহলে সে পরীদের জগতে স্থানান্তরিত হয়ে যাবে।
- সে তরুণ অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে।
- মরণশীল জগতবাসীর কাছে সে অদৃশ্য হয়ে যাবে।
- অন্ধ হয়ে যাবে চিরতরে। এমনকি নরকেও তাকে অন্ধ অবস্থায় বেঁধে রাখা হবে।
- আমৃত্যু বলয় ঘিরে নৃত্যরত থাকবে প্রবেশকারী।
- তাকে আজীবন পরীদের কয়েদখানায় বন্দি থাকতে হবে।
এর থেকে পরিত্রাণের উপায়ও বলা আছে ডাচ পুরাণে। কেউ ভুলে সেখানে পা দিয়ে ফেললে সে যেন তখনি মাথায় উল্টো টুপি পরে ৭ বার বলয় ধরে উল্টোদিকে দৌড়াতে থাকে। তাহলে এই অভিশাপ কেটে যেতেও পারে। কারণ পরীরা নাকি উল্টো টুপি দেখলে বিভ্রান্ত হয়ে যায়!
এসবই প্রাচীনযুগের বিশ্বাস। এখনকার দিনে এসব কথা যে কেউ হেসে উড়িয়ে দিবেন। বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে তাল মিলিয়ে কোথায় হারিয়ে গেছে সেই ভয়ংকর পরীরা তা কেউই জানেন না। নাকি তারা নতুন ফন্দি বের করছে? একদিন হাজির হবে অদ্ভুত কোনো বলয় নিয়ে? সেটাও ভাবার বিষয়!
মাশরুম একটি সভ্যতার নাম
খ্রিস্টপূর্ব ত্রয়োদশ শতাব্দীতে গ্রিসের নিকট এক শহর ছিল। শহরের নাম মাইসিনি (Mycenae)। মাইসিনি শব্দের অর্থ হচ্ছে মাশরুম। তৎকালীন এই শহর প্রতিপত্তির শীর্ষে আরোহণ করেছিল। একে ঘিরে গড়ে উঠেছিল এক সভ্যতা।
একটি শহরের নাম কেন মাশরুম রাখা হলো? এর পিছনে কি মাশরুমের কোনো হাত আছে?
নামকরণের সাথে জড়িত ব্যক্তির নাম চলচ্চিত্রপ্রেমী প্রায় সবারই জানা। তিনি আর কেউ নন, ২০১০ সালে হলিউডে মুক্তি পাওয়া Clash of the Titans এর প্রধান চরিত্র Perseus.
গ্রিক পুরাণ অনুযায়ী অপ্রত্যাশিতভাবে ওরাকল পূর্ণ করতে যেয়ে নিজের পিতামহকে হত্যা করে বসেন এই বীর। এরপর নিজের প্রাণ বাঁচাতে জন্মভূমি ছেড়ে পালিয়ে যান Perseus. তখন পথিমধ্যে তার পানির পিপাসা পায় এবং তিনি পানির সন্ধানে এদিক ওদিক ঘোড়া নিয়ে যাত্রা করেন। কিন্তু তপ্ত মরুভূমিতে পানির সন্ধান মেলা যে ছিল ভার!
পথিমধ্যে এক জায়গায় Perseus এর তলোয়ার মাটিতে পড়ে যায়। তলোয়ার তুলতে গিয়ে তিনি কিছু মাশরুমের সন্ধান পান এবং মাশরুম নিংড়ে পানি পান করে পিপাসা মেটান। সন্তুষ্ট Perseus মাশরুমের প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ সেখানে গড়ে তুলেন মাইসিনি শহর।
মাইসিনি সভ্যতা নিয়ে তেমন বিস্তারিত দলিল না মিললেও এই শহর ইতিহাসের পাতায় সরবে পদচারণা করেছে। শহরটি পাহাড়ি এলাকায় অবস্থিত ছিল এবং এর ক্ষেত্রফল ছিল ৩০,০০০ বর্গ কি.মি.।
একে পুরাণে Golden Mycenae বা ‘সোনালি মাইসিনি’ হিসেবে ডাকা হতো। প্রতিবেশী শক্তিশালী সাম্রাজ্যের সাথে তাল মিলিয়ে মাইসিনিও দাপটের সাথে এর প্রভাব খাটাতো গ্রিসজুড়ে। বড় বড় যুদ্ধে মাইসিনির সৈনিকরা প্রতিপক্ষের ভীত কাঁপিয়ে দেওয়াতে ওস্তাদ ছিলেন।
কালের ঘূর্ণিতে আজ সেই মাইসিনির ধ্বংস হয়ে যাওয়া প্রাচীন পুরাকীর্তি ছাড়া অবশিষ্ট নেই কিছুই।
এভাবেই আদিম যুগ থেকে মানুষের সাথে বিবর্তিত হয়েছে মাশরুমের পরিচয়। কখনো গড, কখনো জাদুবিদ্যা, কখনো ঔষধ হিসেবে বা ভৌতিক অভিশাপস্বরূপ অথবা শহরের নাম, কখনো আবার মাদকদ্রব্য এবং সবশেষে রেঁস্তোরার ও রান্নাঘরে এসে পদার্পণ করেছে মাশরুম।
মাশরুম দিয়ে ঔষধ তৈরির ইতিহাসও নতুন নয়। মিথোলজির হাজারো গড, অতিকায় দানবের সাথে সমান তালে পাল্লা দিয়ে বৈচিত্র্যময় কাহিনী নিয়ে আসন গেড়েছে এই মাশরুম।
একদিকে এখনও আমাজনের গহীনে আদিম উপজাতিরা পাপমোচনের আশায় মাথা নুয়ে আত্মসমর্পণ করছেন মাশরুম গডের কাছে। অপরদিকে বড় বড় রেস্তোরার মেন্যুকার্ডে শোভা পাচ্ছে মাশরুমের নাম।
এর অতীতের অজানা পরিচয় নিয়ে ইতিহাসবেত্তা আর ভবিষ্যতের অনাগত পরিচয় নিয়ে বিজ্ঞানীরা রাতদিন নিরলস গবেষণা করে যাচ্ছেন।
মাশরুমের বিবর্তনের শেষটা দেখার আগ্রহ নিয়ে এখন উৎসুক দৃষ্টি মেলে রেখেছি ভবিষ্যতের থিয়েটারে। নাকি রান্নাঘরেই এর বিবর্তনের শেষ?
সেটা সময়ই বলে দিক।
ফিচার ইমেজঃ www.etsy.com