“একজন সফল পুরুষের পেছনে একজন নারীর অবদান থাকে”– অন্তত ইতিহাসের পাতায় রাজকীয় অন্দরমহলের নারীরা অনেকবারই এই প্রবাদের সত্যতা প্রমাণ করেছেন। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় রাজরাজড়ার ভূমিকায় বরাবর পুরুষই ছিল মসনদে। কিন্তু রাজদরবারের সেসব মহাপ্রতাপশালী পুরুষের গড়ে ওঠা বা সফল হবার পেছনে, প্রায়ই ছিল সংগ্রামী কোনো নারীর প্রচেষ্টা বা উচ্চাভিলাষী নারীর স্বপ্নালু অনুপ্রেরণার গল্প।
রূপ-গুণের পাশাপাশি এই নারীদের রাজ্য পরিচালনার দক্ষতা, সাহস যুগিয়েছিল তাদের জীবনসঙ্গীকে। তাদের সংস্পর্শে থেকেই পুরুষেরা হয়েছেন অপরাজেয়। কখনো এই নারীরাই নিশ্চিত হারের মুহূর্তকে দাবার চালের মতো ঘুরিয়ে দিয়েছেন রাজপ্রাসাদে বসে, হয়েছেন দিগ্বিজয়ী পুরুষের তলোয়ারের ধার, হয়েছেন মানবতার সেবার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
এতসব কীর্তিগাথা সবসময় প্রাসাদের বাইরে আসার সুযোগ পেতো না। তারপরও কিছু গল্প ‘কিংবদন্তি’ হয়ে রাজ্য ছাড়িয়ে, ছড়িয়ে যায় জগন্ময়। এমনই এক বিরল কীর্তিমান থিওডোরা। ছিলেন বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের সম্রাজ্ঞী। সম্রাট প্রথম জাস্টিনিয়ানের জীবনসঙ্গী হয়ে একসঙ্গে সাম্রাজ্য পরিচালনা করেছেন। বুদ্ধি আর কৌশল দিয়ে শত্রুদের হাত থেকে বাঁচিয়েছেন পুরো সাম্রাজ্যকে।
কিন্তু থিওডোরার এই বর্ণিল জীবনের সূচনা হয়েছিল মুহূর্তের ভালোলাগা থেকে। একজন অতি-সাধারণ প্রজা ও নর্তকী থেকে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের সেইসময়কার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নারীতে পরিণত হওয়ার গল্প নিয়েই আজকের লেখাটি।
জন্ম ও বেড়ে ওঠা
থিওডোরার জন্মস্থান নিয়ে ইতিহাসবিদদের দ্বন্দ্ব বহুদিনের। কারো মতে, থিওডোরার জন্ম ৪৯৭ খ্রিস্টাব্দে গ্রিসের উপকূলীয় অঞ্চল ক্রিটের একটি দ্বীপে। আবার অনেকের মতে, তার জন্ম হয়েছিল সিরিয়ায়। তার বাবা কনস্টান্টিনোপলে এক সার্কাস দলের সাথে কাজ করতেন ভালুক প্রশিক্ষক হিসেবে। থিওডোরা সেখানে প্রথমে একজন মূকাভিনয় শিল্পী হিসেবে যোগ দিলেও পরবর্তীকালে পেশা বদলে অভিনেত্রীর খাতায় নাম লেখান।
সেই সময়ে কনস্টান্টিনোপলের এলাকাগুলোতে সার্কাসের দল আর অভিনয়শিল্পীদের আনাগোনা ছিল প্রচুর। কিন্তু পেশা হিসেবে অভিনয়কে সেখানে খুব একটা ভালো চোখে দেখা হতো না। জীবিকার প্রয়োজনে অভিনেত্রীদের অনেকসময় নগ্ন হয়েও নাচতে হতো শহরের পার্টিগুলোতে। সেই নর্তকী হিসেবেই শহরে থিওডোরার বেশ নাম হয়ে গিয়েছিল।
দেহসৌষ্ঠব আর নাচের খ্যাতির সূত্র ধরে এক ব্যক্তির সঙ্গে থিওডোরা পাড়ি জমান উত্তর আফ্রিকা। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৬। সেখানে চার বছর অবস্থান করে আবার কনস্টান্টিনোপলে ফিরে আসেন তিনি। যাত্রাপথে মিসরের রাজধানী আলেকজান্দ্রিয়ায় যাত্রাবিরতি নেন। ঘটনাক্রমে সেখানে খ্রিস্টধর্মের বিশেষ এক সম্প্রদায়ের প্রতি তিনি ঝুঁকে পড়েন।
‘মনোফিজিটিম‘ নামের এই সম্প্রদায়ের বিশ্বাস ছিল, যিশু কোনো মানুষ ছিলেন না, তিনি পুরোপুরি একজন ঈশ্বর। এই মতবাদে দীক্ষিত হওয়ার পর, থিওডোরা রাজধানীতে চলে আসেন। এখানে এসে নিজের জীবিকা বদলে ফেলেন এবং সুতো বোনার কাজ করে দিন পার করতে লাগলেন।
জাস্টিনিয়ানের চোখে থিওডোরা
জাস্টিনিয়ানের প্রকৃত নাম ছিলো ফ্লেভিয়াস জাস্টিনিয়ানাস। তিনি ছিলেন সম্রাট জাস্টিনের ভাইপো। জাস্টিনের কোনো সন্তান না থাকায় চাচার কাছে সন্তানের মতোই বেড়ে ওঠেন জাস্টিনিয়ান।
রাজধানীতে রেখে সমর-শিক্ষা দেওয়া হয় জাস্টিনিয়ানকে। সময়ের সাথে সাথে একজন দক্ষ যোদ্ধা হয়ে ওঠেন তিনি। চাচার সংস্পর্শে থেকে সাম্রাজ্য পরিচালনার আদব-কায়দাও শিখে নেন অল্পসময়ে। চাচা জাস্টিন নিজেও ভাইপোর মতামতকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিতেন। কারণ, তাকেই ভবিষ্যত বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের হাল ধরতে হবে।
থিওডোরার সঙ্গে জাস্টিনিয়ানের পরিচয় রাজধানী কনস্টান্টিনোপলেই। মুহূর্তের পরিচয়েই রূপবতী থিওডোরার প্রেমে পড়েন। তারপর নিয়মিত মেলামেশার কারণে থিওডোরার বুদ্ধিমত্তার পরিচয়ও পেতে থাকেন তিনি, যা তাকে থিওডোরার প্রতি আরও দুর্বল করে তোলে। সেই থেকে ভালোবাসার মানুষটিকেই নিজের জীবনসঙ্গিনী বানানোর স্বপ্নে বিভোর হন জাস্টিনিয়ান।
রোমান আইন অনুযায়ী, রাজপরিবারের সদস্য হয়ে কেউ কোনো অভিনেত্রীকে নিজের জীবনসঙ্গিনী বানাতে পারবেন না। এই আইনের কারণে, জাস্টিনিয়ানের অপেক্ষার পালা দীর্ঘ হতে শুরু করে। অবশেষে সম্রাট প্রথম জাস্টিন পুরনো এই আইনকে সংশোধন করেন। ফলে জাস্টিনিয়ানের জন্য থিওডোরাকে বিয়ে করতে আর কোনো বাধা রইলো না।
বিশাল বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের জন্য জাস্টিনিয়ান ও থিওডোরার বিয়ে ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ সম্রাট জাস্টিন মৃত্যুবরণ করলে জাস্টিনিয়ানই হবেন সম্রাট। তাই সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে জাস্টিনিয়ান-থিওডোরার ঐতিহাসিক বিয়ের অনুষ্ঠান। তদুপরি, বহু পুরনো রোমান আইন সংশোধন করে অভিনেত্রীদের বিয়ে করার রীতি চালু হওয়ার কারণেও এই বিয়েতে যোগ হয়েছিল ভিন্নমাত্রা।
সম্রাট জাস্টিন ৫২৭ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করলে জাস্টিনিয়ান আনুষ্ঠানিকভাবে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের শাসনভার গ্রহণ করেন। এর মধ্য দিয়ে সাম্রাজ্যের জন্য এক নতুন যুগের সূচনা হয়। সম্রাটকে ছাপিয়ে সম্রাজ্ঞী থিওডোরার রাজ্য পরিচালনার অসাধারণ নৈপুণ্য সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
একজন শাসক থিওডোরা
কনস্টান্টিনোপলের শাসনভার গ্রহণ করার কয়েক বছরের মাথায় সাম্রাজ্য জুড়ে বিক্ষোভ শুরু হয় জাস্টিনিয়ানের বিরুদ্ধে। শহরজুড়ে বিক্ষোভকারীরা ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি চালাতে থাকে। বিক্ষোভ ও সহিংসতা দমনে ব্যর্থ হয়ে জাস্টিনিয়ান সেখান থেকে সরে যাওয়ার চিন্তা করেন। সভাসদরাও এই সিদ্ধান্তে সায় দিচ্ছিলেন।
এদিকে সম্রাটের পিছু হটার খবর পেয়ে থিওডোরা সভাসদদের ডেকে নেন। তারা ইতোমধ্যে পালিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এমন সংকটাপন্ন মুহূর্তে থিওডোরা তাদের সামনে নিজের অবস্থান তুলে ধরেন এবং তাদের কী করণীয়, তা বোঝাতে চেষ্টা করেন।
জাস্টিনিয়ানকেও থিওডোরা বোঝাতে সক্ষম হন যে, কাপুরুষের মতো পালিয়ে না গিয়ে লড়াই করে মৃত্যু একজন সম্রাটের মৃত্যু অনেক সম্মানের। বিক্ষোভকারীরা যদি রাজপ্রাসাদে ঢুকে পড়ে, তবে লড়াই করাই হবে সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ।
থিওডোরার অনুপ্রেরণায় জাস্টিনিয়ান আবার যেন মনোবল ফিরে পেলেন। এখানে থেকেই বিক্ষোভ দমন করবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন। তাই সেনাপতি বেলিসারিয়াসকে পাঠান সহিংস এই বিক্ষোভ দমন করতে।
বেলিসারিয়াস তার সেনাবাহিনী নিয়ে শহর জুড়ে অভিযান চালাতে থাকেন। ঐতিহাসিকদের মতে, এই অভিযানে ত্রিশ হাজারের অধিক মানুষ প্রাণ হারায়। সূর্য অস্তমিত হওয়ার আগেই শহর জুড়ে কেবল রক্তের বন্যা বইতে থাকে। অবশেষে হাজার মানুষের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জাস্টিনিয়ান তার সিংহাসন রক্ষা করতে সক্ষম হন। ইতিহাসে দাঙ্গায় রূপ নেওয়া এই বিক্ষোভকে নিকা’র দাঙ্গা নামে অভিহিত করা হয়।
জাস্টিনিয়ান তার সিংহাসন রক্ষা করতে পারলেও সর্বত্র কেবল ক্ষতের চিহ্ন। দালানকোঠাসহ সব স্থাপনাই ভেঙে পড়েছিল। এটা সাম্রাজ্যের জন্য খারাপ সংবাদ হলেও, থিওডোরা একে দেখেছিলেন সুযোগ হিসেবে- শহরকে নতুন করে গড়ে তোলার সুযোগ! তার আগ্রহ দেখে জাস্টিনিয়ানও হালে পানি পান।
দু’জনে মিলে কনস্টান্টিনোপল শহরকে আবার নতুনভাবে সাজিয়ে তুলতে শুরু করেন। তাদের প্রয়াসে কনস্টান্টিনোপল তখন সেইসময়কার সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যশৈলীর জন্য বিশ্বে পরিচিতি পায়। বিখ্যাত ‘আয়া সোফিয়া’ বিক্ষোভকারীদের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং একে আবার নতুন করে তৈরি করা হয়।
থিওডোরার কীর্তি তখন মানুষের মুখে-মুখে। দাঙ্গা দমন করে শহর রক্ষা করার কারণে থিওডোরা রাতারাতি সবার প্রিয়ভাজনে পরিণত হন। সম্রাট নিজের যোগ্য সঙ্গিনীকে তাই নিজের পাশে বসান সাম্রাজ্য পরিচালনার জন্য। এর ফলে, কোনো সিদ্ধান্তই আর সম্রাট একা নিতেন না। গুরুত্বপূর্ণ কাজ এবং আদেশের আগে জাস্টিনিয়ান থিওডোরার মতামত ও পরামর্শ চাইতেন।
নারী ক্ষমতায়নের এমন দৃষ্টান্ত সেই যুগে বিরল ছিল। থিওডোরা তার নিপুণ কৌশল আর বুদ্ধিমত্তা দিয়ে সম্রাটের সহযোগী হয়ে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যকে নিয়ে গেছেন অন্যরকম এক উচ্চতায়। প্রাসাদে, রাজ্য জয়ের কৌশল নির্ধারণে কিংবা সমরে- সব জায়গাতেই সম্রাজ্ঞী থিওডোরার দূরদর্শী চিন্তাভাবনার ছাপ পাওয়া যায়।
জনদরদী এক সম্রাজ্ঞী
একজন শাসক হিসেবে থিওডোরা ছিলেন যথেষ্ট প্রজাহিতৈষী। তিনি মানুষের জন্য যত কাজ করে গিয়েছেন, তার অধিকাংশই ছিল নারীদের অধিকার সংরক্ষণের জন্য। নারীরা যাতে বাবার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতে পারে, তার জন্য তিনি আইন প্রণয়ন করেন।
বিবাহ-বিচ্ছেদের সময় নারীরা যাতে সমান অধিকার পায়, সেটি নিশ্চিত করেন থিওডোরা। তাছাড়া কেউ যাতে জোর করে কোনো মেয়েকে অভিনয় পেশায় বাধ্য না করতে পারে, সেজন্য তিনি কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করেন। বলা হয়ে থাকে, ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যের চেয়ে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের নারীরা এই সময়ে বেশি অধিকার ও সম্মান পেয়েছিলেন।
থিওডোরা রক্ষণশীল গির্জার অনুসারী না হলেও, জাস্টিনিয়ান ছিলেন এর অন্ধ অনুগামী। ধর্মীয় বিশ্বাসের এই ভিন্নতা তাদের ভেতর কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। বরং, থিওডোরা যখন নিজ ধর্মের অনুসারীদের অধিকার সংরক্ষণের পদক্ষেপ নেন, জাস্টিনিয়ান তাকে যথাসাধ্য সহায়তা করেন। ধর্মীয় সম্প্রীতির এমন নজির সেই সময়ে বিরল ছিল।
সম্রাজ্ঞীর মৃত্যু
৫৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ জুন কনস্টান্টিনোপল শহরেই মৃত্যুবরণ করেন থিওডোরা। তার মৃত্যুর কারণ নিয়ে মতভেদ থাকলেও, বেশিরভাগ ইতিহাসবিদের মতে, থিওডোরা ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তাকে পবিত্র অ্যাপোস্টোলে সমাহিত করা হয়, যে অপূর্ব স্থাপনাটি তাদেরই হাতে গড়া।
থিওডোরার এই মৃত্যু সম্রাটের মনকে দারুণভাবে ব্যথিত করে। থিওডোরার মৃত্যুর পরও জাস্টিনিয়ান প্রায় ২০ বছর বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য পরিচালনা করেন। তার কাজের মধ্য দিয়ে থিওডোরার চিন্তা ও দর্শন ফুটে উঠেছিল প্রবলভাবে।
পশ্চিমা গির্জাগুলো জাস্টিনিয়ান ও থিওডোরাকে ‘সেইন্ট’ হিসেবে অভিহিত করে। একজন খুব নগণ্য অভিনেত্রী থেকে থিওডোরা হয়ে উঠেছিলেন বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের এক অনন্য ভিত্তি। কেবল রূপ-সৌন্দর্যেই নয়, শাসকের মানদণ্ডেও থিওডোরা ছিলেন সর্বগুণে গুণান্বিতা। তার চিন্তা-চেতনার আধুনিকত্ব তাকে সবার কাছে করে তুলেছিল অনন্যা। তাই বহু নারীর গল্প ইতিহাসের পাতা থেকে হারিয়ে গেলেও, ঠিকই ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে রয়ে গেছে থিওডোরার নাম।