আমরা বিভিন্ন সময় টিভি কিংবা খবরের কাগজে প্রাণীদের অদ্ভুত আচরণ সম্পর্কে জেনে থাকি। এ প্রাণীগুলো তাদের বুদ্ধিমত্তার জন্য রাতারাতি সেলিব্রেটিতে পরিণত হয়। আবার কোনো প্রাণী যদি হুবহু মানুষের মতো আচরণ করে তাহলে কেমন হবে! বলছি একজোড়া বেবুনের কথা, যারা আলাদা দুটো কাজ করে রীতিমতো বিশ্বব্যাপী সাড়া ফেলে দিয়েছিল। একটা বেবুন দক্ষিণ আফ্রিকার রেলওয়েতে কাজ করে সবার নজর কেড়েছিল, অন্যটি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পুরোদস্তুর সৈনিক বেশে যুদ্ধ করেছিল! এই প্রাণী দুটোর অসাধারণ কর্মকান্ড নিয়েই জানব আজকে।
জ্যাক যখন রেলওয়ে কর্মচারী
হেন জেমস কেপটাউনে বন্দর কর্তৃপক্ষের রেলওয়ে বিভাগে কাজ করতেন। তার একটি শখ ছিল দুটো চলন্ত ট্রেনের একটি থেকে লাফিয়ে বিপরীত দিক থেকে আসা ট্রেনে পৌঁছানো। ১৮৭৭ সালে এক ট্রেন থেকে আরেক ট্রেনে লাফ দেওয়ার সময় জেমস চলন্ত ট্রেনের নিচে পড়ে গেলেন। সৌভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে ফিরলেও পা দুটো হারাতে হয় তাকে। এই ঘটনার পর জেমস সেখানকার চাকরি ছেড়ে দিয়ে ইউটেনহেগ স্টেশনে চাকরি নেন। তিনি হাঁটার জন্য কাঠের তৈরি কৃত্রিম পা তৈরি করেন, সঙ্গে একটি ট্রলিও তৈরি করেন দ্রুত যাতায়াতের জন্য।
জ্যাক নামের বেবুনটির সঙ্গে জেমসের পরিচয় হয় স্থানীয় একটি বাজারে। একটা বলদ ওয়াগন টেনে নিচ্ছিল, আর চালকের আসনে বসে নির্দেশনা দিচ্ছিল জ্যাক! জেমস মানুষের বদলে একটা বেবুনকে গাড়ি চালাতে দেখে অবাক হন, তারচেয়েও বেশি মুগ্ধ হন এমন একটি ব্যাপার ঘটতে দেখে। জেমস জ্যাকের মালিকের থেকে তাকে কিনে নেন এই ভেবে যে, সে হয়তো জেমসকে কাজে সহায়তা করতে পারবে। জ্যাককে নিয়ে বাড়ি ফেরার পর জেমস নিজের কাজগুলোর সঙ্গে জ্যাককে পরিচয় করিয়ে দিতে থাকেন। অল্প কিছুদিনের ভেতর জ্যাক মোটামুটি সবগুলো কাজ শিখে নেয়। যার ভেতর ছিল জেমসকে ওয়াগনে উঠতে সহায়তা করা, ট্রেনের সিগনালগুলো সঠিকভাবে স্যুইচ করা এবং কাজ শেষে কন্ডাক্টরকে চাবিগুলো দেয়া।
জ্যাকের কাজের গুণমুগ্ধ জেমস কখন যে প্রাণীটির প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন জানতেনই না! সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল, জ্যাকও নিজের কাজগুলো সঠিকভাবে করে যাচ্ছিল। তাকে শিখিয়ে দেওয়া হয়েছিল কীভাবে আঙুল ব্যবহার করে লিভার টেনে ধরে ট্র্যাক সিগনাল এদিক-ওদিক নিতে হয়। আর এটা করার জন্য জেমস আর জ্যাকের মাঝে একটা সাংকেতিক যোগাযোগ রক্ষার প্রয়োজন পড়ে। তাদের যোগাযোগের উপায়টিও ছিল বেশ মজার। একসময় জ্যাক নিজে থেকেই সিগনালগুলো ঠিকঠাক অপারেট করতে শুরু করে। কোনোরকম দ্বিধা ছাড়াই সে কাজগুলো করতে লাগলো। জেমস শুধু তার দিকে নজর রাখতেন, যাতে কোনো ভুল না হয়ে যায়।
ইতোমধ্যে জ্যাকের কর্মকান্ড আশপাশের মানুষের জানা হয়ে গিয়েছে। তাই প্রায়ই দূরদূরান্ত থেকে অনেকে আসতো শুধুমাত্র একটি বেবুন কীভাবে ট্রেনের ট্র্যাক পরিচালনা করছে সেটা দেখার জন্য, কিন্তু অনেকের কাছে জ্যাকের কর্মকান্ড ভালো লাগল না। ব্যাপারটি দেখতে বেশ মজার হলেও তাদের ধারণা ছিল এতে করে বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে যেকোনো সময়। তাই তারা রেল কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ জানাল। কর্তৃপক্ষ এমন খবর শুনে অবাক হলো, কারণ তারা জানত জেমস একজন সহকারী নিয়োগ করেছে। তাই বলে যে একটা বেবুনকে দিয়ে এমন কাজ করাচ্ছে, সেটা তারা খতিয়ে দেখেনি কখনো! কর্তৃপক্ষ ঘটনাটি জানার সঙ্গে সঙ্গে জেমসকে ডেকে পাঠায় এবং তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ ব্যাখ্যা করতে বলে। জেমস অভিযোগ সত্য বলে স্বীকার করে নেন এবং তাকে চাকরিচ্যুত না করার অনুরোধ জানান। কর্তৃপক্ষ যখন কিছুতেই মেনে নিচ্ছিল না তখন জেমস তাদের কাছে অদ্ভুত এক প্রস্তাব করে বসেন। জেমস বলেন, জ্যাককে কেন তারা পরীক্ষা করে দেখছে না! যাতে প্রমাণ হয় জ্যাক তার কাজে দক্ষ। কর্তৃপক্ষ অনেকটা তাচ্ছিল্যের ছলে তাকে একটা সুযোগ দিল। সেই সুযোগটাই লুফে নিলেন জেমস। তার নির্দেশনা অনুসারে জ্যাক সঠিক সময়ে হুইসেল শুনতে পেয়ে নিজের কাজ করে দেখিয়ে দিল।
রেল কর্তৃপক্ষ এতেই মুগ্ধ হয়ে যায় এবং জেমসকে তার চাকরি ফিরিয়ে দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে জ্যাকও রেল কর্তৃপক্ষের অনুমোদিত কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ পায়! পারিশ্রমিক হিসেবে তার জন্য সপ্তাহে ২০ সেন্ট এবং এক বোতল বিয়ারের অর্ধেক বরাদ্দ করা হয়। পরবর্তী ৯ বছর জ্যাক বিরতিহীন নিজের কাজ করে গেছে। যক্ষ্মায় ভুগে মারা যাওয়ার আগপর্যন্ত কোনোদিন জ্যাক নিজের কাজে ফাঁকি দেয়নি। মৃত্যুর পর জ্যাকের মাথার খুলি দক্ষিণ আফ্রিকার গ্রাহামসটাউনের আলবানি জাদুঘরে সংরক্ষণ করে রাখা হয়।
সৈনিক বেশে জ্যাকি
এবার এমন একটা বেবুনের গল্প বলব যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সৈনিকদের সঙ্গে যুদ্ধের ময়দানে নেমে পড়েছিল। তার কাজের দক্ষতার জন্য সামরিক বাহিনীতে পদোন্নতিও পেয়েছিল! এই বেবুনটির নাম জ্যাকি। তারও শুরুটা হয়েছিল অনেকটা জ্যাকের মতো।
আলবার্ট মার একদিন একটা বেবুনকে তার ফার্মের আশপাশে ঘুরঘুর করতে দেখেন। তিনি ভাবলেন প্রাণীটিকে হয়তো পোষ মানিয়ে নিজের সঙ্গে রেখে দেবেন। এভাবেই ভবঘুরে বেবুনটি আলবার্টের ঘরে জায়গা করে নিল।
মারের পরিবারের সঙ্গে অল্প কয়েকদিনের ভেতর জ্যাকির ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সবাই তাকে পরিবারের সদস্য হিসেবেই দেখতে পছন্দ করত। তারপর ১৯১৫ সালে মারকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য ডাকা হলো। কিন্তু মার জ্যাকিকে ছেড়ে যুদ্ধে যেতে কষ্ট পাচ্ছিলেন। মার যখন জ্যাকিকে সঙ্গে করে ফ্রান্সে নেওয়ার অনুমতি চাইলেন, অফিসাররা তাকে অনুমতি দিলেন! সেখানে যাওয়ার পর জ্যাকিকে সৈনিক হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হলো। তার জন্য ইউনিফর্ম বানানো হলো, সঙ্গে রেজিমেন্টাল ব্যাজ, ক্যাপ, বেতন বই সবই দেওয়া হলো।
সৈনিক হিসেবে জ্যাকি অন্য সবাইকে অনুসরণ করতে শুরু করে। যেমন- কোনো অফিসার পাশ দিয়ে গেলে সে দাঁড়িয়ে স্যালুট জানাত অফিসারকে। তাছাড়া প্রয়োজনে অফিসারদের সিগারেট জ্বালিয়ে দিত এবং তাদের সহকারী হিসেবে পেছনে দাঁড়িয়ে থাকত। নিজের কাজে জ্যাকি খুবই পারদর্শী হয়ে উঠেছিল যা অফিসারদের নজরে পড়েছিল। তাই তাকে তৃতীয় ট্রান্সওয়াল রেজিমেন্টের মাসকট হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় এবং সৈনিকদের সঙ্গে সর্বত্র তার যাতায়াত হতে থাকে। খোলা ময়দানে সৈনিকদের সঙ্গে থাকার কারণে বেশ কয়েকবার আহত হয় জ্যাকি। একবার নিজেদের ট্রেঞ্চে শত্রুরা বোমা হামলা শুরু করলে জ্যাকি ট্রেঞ্চের চারপাশে নিজেদের সুরক্ষার জন্য পাথরের দেয়াল তুলতে শুরু করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বোমার একটি টুকরো উড়ে এসে তার পায়ে লাগে।
রেজিমেন্টের ডাক্তাররা জ্যাকিকে স্ট্রেচারে করে ক্যাম্পের হাসপাতালে নিয়ে আসে এবং তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করে। জ্যাকির পায়ের আঘাতটি ছিল গুরুতর, যার কারণে তার ডান পা কেটে ফেলতে হয়েছিল। অপারেশনের সময় ক্লোরোফরমের ঘ্রাণ নাকে লাগায় বেহুঁশ হয়ে পড়ে জ্যাকি, যার কারণে চিকিৎসকরা ধরেই নিয়েছিল সে শীঘ্রই মারা যাবে। কিন্তু কয়েকদিন অচেতন থাকার পর জ্যাকি জ্ঞান ফিরে পায়।
যুদ্ধক্ষেত্রে সাহসিকতার জন্য জ্যাকিকে মেডেল দেওয়া হয় এবং কর্পোরাল হিসেবে পদোন্নতি পায় সে। যুদ্ধ শেষ হলে জ্যাকি আবার আলবার্ট মারের পরিবারে ফিরে আসে। ১৯২১ সালে মৃত্যুর আগপর্যন্ত জ্যাকি মারের পরিবারেই বাস করেছিল। যুদ্ধের আগে যেমন সবাই একসঙ্গে ছিল, ফেরার পর তেমন ব্যবহারই তার সঙ্গে করা হয়েছিল। অনেকটা বুড়ো বয়সে পরিবারের সান্নিধ্যে কাটিয়ে দেবার মতো।
প্রাচীনকাল থেকে মানবসমাজে প্রাণীদের আনাগোনা ছিল চোখে পড়ার মতো।জ্যাক ও জ্যাকির মতো এরকম বহু প্রাণী আছে যারা যুদ্ধ কিংবা অন্য কোনো কাজে মানুষকে সঙ্গ দিয়েছিল। বিশেষ করে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কুকুর, ভালুক, এমনকি বিড়ালেরও ব্যবহার হয়েছিল। মানুষের দৈনন্দিন কাজের সঙ্গেও এসব প্রাণীর কর্মকাণ্ড জড়িয়ে আছে বহু আগে থেকে।