মনে আছে স্ট্যানিস্লর কথা?
সেই যে গ্রেট নর্দার্ন ওয়ারের সময় পোল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় অগাস্টাসকে উৎখাত করে সুইডিশ রাজা দ্বাদশ চার্লস যাকে ক্ষমতায় বসিয়েছিলেন। সুইডেনের সামরিক সহায়তায় স্ট্যানিস্ল (Stanisław I Leszczyński) ক্ষমতা ধরে রেখেছিলেন ১৭০৪-০৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। সুইডেনের ভাগ্য বিপর্যয়ে তিনিও সিংহাসন হারান। স্ট্যানিস্লকে আশ্রয় দেন তার জামাতা, ফ্রান্সের সম্রাট পঞ্চদশ লুই। তিনি আশা পোষণ করতেন একদিন শ্বশুরকে আবার পোলিশ মুকুট ফিরিয়ে দেবেন। অস্ট্রিয়া আর রাশিয়া আবার স্ট্যানিস্লর ঘোর বিরোধী ছিল।
পটভূমি
ফ্রেডেরিক দ্বিতীয় অগাস্টাস স্যাক্সোনির ইলেক্টর হিসেবে দায়িত্ব নেন ১৬৯৪ সালে। তিন বছর পর তিনি হলেন পোল্যান্ডের রাজা। স্ট্যানিস্লর কাছে পাঁচ বছর ক্ষমতা বিসর্জন দিলেও মিত্রদের হস্তক্ষেপে তিনি সিংহাসন ফিরে পেলেন। তার ছেলের নামও ফ্রেডেরিক অগাস্টাস, যিনি বিয়ে করেন হলি রোমান এম্পেরর প্রথম জোসেফের মেয়ে মারিয়া জোসেফাকে।
সেকেন্ড ট্রিটি অফ ভিয়েনার পর ইউরোপে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার আশাবাদ তৈরি হয়। আপাতদৃষ্টিতে প্রধান তিনটি শক্তি- ফ্রান্স, স্পেন এবং ইংল্যান্ডের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিরাজ করছে বলেই মনে হলো। কেউ তখনও ধারণা করতে পারেনি এই শান্তি আসলে ঝড়ের পূর্বের থমথমে ভাব। ফ্রান্স স্পষ্টতই উদ্বিগ্ন। ভিয়েনা চুক্তি ইংল্যান্ডের সাথে দীর্ঘ প্রায় পনের বছরের সুসম্পর্কে ফাটল ধরিয়েছে। ইংলিশ জাহাজ সাগরে বিস্তার করেছে আধিপত্য। আবার ষষ্ঠ চার্লসকেও সাইজে রাখা দরকার। তিনি ডাচি অফ লরেইনকে হাবসবুর্গ ঘাঁটি বানাবার ব্যবস্থা পাকা করছেন।
ফরাসিদের দরকার শক্তিশালী মিত্র, ইংল্যান্ডেকে টেক্কা দিতে যার আছে দুর্বার নৌবহর। আর প্রয়োজন ষষ্ঠ চার্লসকে লরেইন থেকে দূরে রাখা। সাথে যোগ হয়েছে লুইয়ের বহুদিনের খায়েশ, ইতালিকে সাম্রাজ্যভুক্ত করা, সেখানে তখন অস্ট্রিয়ার শাসন। ফলে পঞ্চদশ লুই আগ্রহী তার আত্মীয় স্পেনের পঞ্চম ফিলিপের সাথে জোট বাধতে, যাতে ইতালিতে আগ্রাসন চালানো সহজ হয়। কাকতালীয়ভাবে স্পেনের রাজপুত্র ডন কার্লোস ঠিক সময় অবস্থান করছিলেন টাস্কানে। পারমাতে শিবির করে আছে স্প্যানিশ সৈন্যদল।
জোটসঙ্গী হিসেবে স্পেনের সাথে লুই চাইছিলেন সার্ডিনিয়ার রাজা চার্লস ইম্যানুয়েল এবং জার্মান রাষ্ট্রগুলোকে। জার্মানরা পারবে হাবসবুর্গ সম্রাট ষষ্ঠ চার্লসকে একদিক থেকে আটকে রাখতে। বাকিরা মিলে পোলিশ রাজা আর হাবসবুর্গদের উচিত শিক্ষা দেবে। তবে সব কথার শেষ কথা হলো শ্বশুরকে বসাতে হবে পোল্যান্ডের সিংহাসনে। লুই সুইডেনকেও প্রস্তাব দেন স্ট্যানিস্লকে সমর্থন দিলে গ্রেট নর্দার্ন ওয়ারে তাদের হারানো অনেক অঞ্চল তিনি ফিরিয়ে দিতে রাজি আছেন। কিন্তু ডেনমার্কের দিক থেকে হুমকি আসায় সুইডেন নিরপেক্ষতার ফয়সালা করে।
এমন না যে লুইয়ের ষড়যন্ত্র খুব গোপন কিছু ছিল। অস্ট্রিয়া আর রাশিয়া তার বিপক্ষে মৈত্রীর আলোচনা আরম্ভ করে। প্রুশিয়াকেও তারা যোগ দিয়ে আহ্বান জানায়। হলি রোমান এম্পায়ারের প্রতি বিশ্বস্ততার শপথ থেকে ফ্রেডেরিক উইলিয়াম রাজি হন। তিনি আসলে রাশিয়া আর অস্ট্রিয়ার মতো বড় পরাশক্তিকে সেই মুহূর্তে ঘাঁটাতে চাইছিলেন না।
পোল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় অগাস্টাসের স্বাস্থ্য তখন ভেঙে পড়ছে। রাজপুত্র যাতে নির্বিবাদে ক্ষমতা নিতে পারে সেজন্য তার উৎকণ্ঠার অন্ত নেই। আশেপাশের পরাশক্তিগুলোর ঘুঁটি চালাচালি তার নজর এড়ায়নি। তিনি প্রথমে রাশিয়ান সম্রাজ্ঞী অ্যানকে অনুরোধ করলেন ছেলের প্রতি সমর্থন দিতে, বিনিময়ে তিনি রাশিয়ার হাতে কিছু এলাকা ছেড়ে দেবেন। কিন্তু রাশিয়ানরা স্ট্যানিস্ল আর রাজপুত্র কাউকেই তখন সমর্থন দেবে না জানিয়ে দেয়। অগাস্টাস এবার ফ্রেডেরিক উইলিয়ামের সাথে যোগাযোগ করলেন। পুত্রকে সমর্থন করলে পোল্যান্ডের একাংশ প্রুশিয়ার হাতে তুলে দেবার প্রস্তাব দিলেন।
ফ্রেডেরিক চাচ্ছিলেন লোভনীয় এই প্রস্তাবে রাজি হতে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত অস্ট্রিয়া আর রাশিয়াকে না চটানোর মতো বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন তিনি। অনন্যোপায় অগাস্টাস ঠিক করলেন অস্ট্রিয়া, রাশিয়া আর প্রুশিয়া তিন পক্ষকেই তিনি পোল্যান্ডের কিছু কিছু এলাকা দিয়ে দেবেন, তবুও ক্রাউন প্রিন্সের যাতে সিংহাসনে বসতে অসুবিধা না হয়। কিন্তু তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আগেই ১লা ফেব্রুয়ারি, ১৭৩৩ সালে অগাস্টাসের মৃত্যু হল। বারুদের পিপা আগেই তৈরি ছিল, এখন শুধু সলতেতে আগুন ধরল।
পোল্যান্ডের নতুন রাজা নির্বাচনের দায়িত্ব ছিল পোলিশ-লিথুয়ানিয়ান এক যৌথ পরিষদ, সেইমে’র (Sejm) হাতে। পোল্যান্ড-লিথুয়ানিয়া মিলে একটি কমনওয়েলথ ছিল যার রাজা বংশপরম্পরায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে সিংহাসনে বসতে পারতেন না, তাকে নির্বাচিত হয়ে আসতে হত সংসদের দ্বারা। পোলিশ-লিথুয়ানিয়ান সংসদ ছিল দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট, উচ্চকক্ষের নাম ছিল ডায়েট আর নিম্নকক্ষ সেইম। নির্বাচনের দায়িত্ব ছিল সেইমের হাতে যার সদস্য মূলত অভিজাত সম্প্রদায়। প্রশাসনিক কাজ চালানো এবং নির্বাচনের জোগাড়যন্ত্রের ভার নেন পোটোকি (Theodore Potocki) নামে এক রাজনীতিবিদ।
পোটোকি ছিলেন স্ট্যানিস্লর শুভানুধ্যায়ী, অধিকাংশ পোলিশও স্ট্যানিস্লর প্রতি সমর্থন দেয়। ফলে রাশিয়া এবং অস্ট্রিয়ার চাপ সত্ত্বেও পোটোকি সম্ভাব্য রাজার তালিকা থেকে স্ট্যানিস্লর নাম কাটতে রাজি হলেন না। নিজেদের পছন্দমতো আর কোনো প্রার্থী না পেয়ে অবশেষে রাশিয়া এবং অস্ট্রিয়া দ্বিতীয় অগাস্টাসের পুত্রকে পোল্যান্ডের রাজা তৃতীয় অগাস্টাস হিসেবে সমর্থন জানাল। অগাস্টাস ষষ্ঠ চার্লসকে প্র্যাগম্যাটিক স্যাঙ্কশন মেনে নেয়ার আশ্বাস দিলেন। এদিক অগাস্টের ২৬ তারিখ সেইমে’র অধিবেশনে উপস্থিত হলে স্ট্যানিস্লকে পোল্যান্ডের রাজা নির্বাচন করা হলো। সেপ্টেম্বরের শুরুতে তাকে মুকুট পরিয়ে দেয়া হয়।
রাশিয়া আর অস্ট্রিয়া যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। ওদিকে সেপ্টেম্বরেই ফরাসিরা চার্লস ইম্যানুয়েলের সাথে চুক্তি করে ফেলল, গঠিত হল লীগ অফ তুরিন। শর্ত মোতাবেক সার্ডিনিয়া ইতালিতে ফরাসি এবং স্প্যানিশ সেনাদের সব রকম সহায়তা দিতে সম্মত হয়। ওদিকে স্পেনের সাথে আলাদা চুক্তিমতে ঠিক হলো ফরাসিরা পাবে স্যাভয়, সার্ডিনিয়ার অধিভুক্ত হবে মিলান এবং মান্টুয়া, আর স্পেন নেবে সিসিলি, নেপলস, পারমা, টাস্কান এবং পিয়াসেঞ্জা। কিন্তু গোড়াতেই কিছু গলদ ছিল। চার্লস ইম্যানুয়েল কিছুতেই ইতালিতে স্প্যানিশ আধিপত্য মেনে নিতে আগ্রহী ছিলেন না। তিনি কেবল নেপলস আর সিসিলিই স্পেনের কাছে ছাড়তে রাজি ছিলেন। তবে যুদ্ধের দামামা বাজতে শুরু করলে অসন্তোষ আপাতত চাপা রেখে তিনি সবার সাথে সেনা সমাবেশ করলেন।
রাশিয়ান আক্রমণ
স্ট্যানিস্লর ক্ষমতা নেবার ১২ দিনের মাথায় রাশান সেনাদল ওয়ারশ আক্রমণ করে। সামরিক সহায়তার জন্য স্ট্যানিস্ল সম্পূর্ণ নির্ভরশীল ছিলেন ফরাসিদের ওপর, কিন্তু তারা তখনও সবকিছু গুছিয়ে উঠতে পারেনি। ফলে স্ট্যানিস্ল আর তার সমর্থকেরা পালিয়ে গেলেন ডানজিগে। রাশানরা তৃতীয় অগাস্টাসকে ক্ষমতায় বসিয়ে ডানজিগ অবরোধ করে। কিন্তু তীব্র প্রতিরোধে তারা শহর দখল করতে পারছিল না। ১৭৩৪ সালের মে মাসে জেনারেল মুনিখ (Münnich) দায়িত্ব নিয়ে অবরোধ তীব্র করলেন। কিন্তু গোলাবারুদের অভাবে তার হামলা ব্যাহত হচ্ছিল। সরঞ্জাম সরবরাহের সব থেকে সুবিধাজনক রাস্তা ছিল প্রুশিয়ার উপর দিয়ে, কিন্তু ফ্রেডেরিক উইলিয়াম তার রাজ্যের উপর দিয়ে আর্টিলারির কোন মালামাল পরিবহন করতে দিচ্ছিলেন না। ফলে প্রুশিয়া বিশ্বাসঘাতকতা করছে বলে মুনিখ সম্রাজ্ঞী অ্যানের কাছে পত্র পাঠান। অবশেষে কিছু মর্টার আর কামান এসে পৌঁছল।
প্লিলো এবং ফরাসি দীর্ঘসূত্রিতা
মে মাসের শেষ দিকে তিনটি ব্যাটালিয়ন নিয়ে ফ্রেঞ্চ সেনাপতি ল্যামট বর্তমান গিদান্সক (Gdańsk) উপসাগরের তীরে ভাইজালমুন্ডে (weichselmünde) অবতরণ করলেন। রাশান অবস্থান দেখে তিনি বুঝলেন তার স্বল্প সৈন্য এবং অপ্রতুল সরঞ্জাম দিয়ে আক্রমণ করা আত্মহত্যারই নামান্তর। ফলে তিনি চলে গেলেন কোপেনহেগেনে। সেখানে ফরাসি রাষ্ট্রদূত প্লিলো (Comte de P lélo) কাপুরুষের মতো পালিয়ে আসায় ল্যামটকে তীব্রভাবে ভর্ৎসনা করেন। তিনি নিজে সেনাদলের দায়িত্ব নিয়ে পোল্যান্ডে উপস্থিত হন। সংঘর্ষের পর আহত প্লিলোসহ ফরাসি সেনারা রাশানদের হাতে বন্দি হয়। তখন পর্যন্ত ফ্রান্স পরিস্থিতি হালকাভাবে নিয়েছিল। কিন্তু তাদের সেনারা রাশানদের কাছে মার খেলে তারা নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হলো।
রাশিয়া যখন পোল্যান্ডে প্রবেশ করে তখন ফ্রান্স অটোমানদের সাথে আলোচনা শুরু করেছিল। অটোমানরা চিরশত্রু হাবসবুর্গদের বিরুদ্ধে অখণ্ড পোল্যান্ডকে বাফার হিসেবে চাইত। তাদের দাবি ছিল ফ্রান্স অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে অস্ট্রিয়া এবং রাশিয়ার বিপক্ষে তুরস্কের সাথে প্রতিরক্ষা জোট গঠন করবে। কিন্তু চুক্তির শর্ত নিয়ে ফরাসিরা গড়িমসি করতে থাকে। অটোমানদের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে লাখখানেক সৈন্য সমাবেশ করা হয়েছিল, যারা আদেশ পাওয়া মাত্র পোল্যান্ডের দক্ষিণ দিক থেকে অভিযান শুরু করতে পারত। তারা আক্রমণ করলে রাশিয়াকে ডানজিগের অবরোধ তুলে নিতে হত, এবং স্ট্যানিস্লর সমর্থকদেরও রাশিয়ানদের উপর হামলা করার সাহস বেড়ে যেত।
কিন্তু প্লিলোর পতনের পর ফ্রান্স যখন চুক্তি স্বাক্ষর করে ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। চুক্তির কপি কন্সট্যান্টিনোপোলে পৌঁছে ১০ জুলাই, ওদিকে ২রা জুলাই ডানজিগ চলে গেছে রাশিয়ানদের হাতে। স্ট্যানিস্ল পালিয়ে যান প্রুশিয়াতে। অগাস্টাস হলেন পোল্যান্ডের সর্বময় কর্তা। তিনি এবার আনুষ্ঠানিকভাবে প্র্যাগম্যাটিক স্যাঙ্কশন অনুমোদন করেন এবং লাটভিয়ার কিছু অঞ্চল রাশিয়াকে ছেড়ে দেন।
ইতালির ক্যাম্পেইন
ফরাসি, স্প্যানিশ এবং সার্ডিনিয়ান জোট বরঞ্চ ইতালিতে অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে প্রচুর সফলতা লাভ করে। ফরাসি আর সার্ডিনিয়ান সেনারা ১৭৩৪ সালের ফেব্রুয়ারির ভেতরেই প্রায় পুরো মিলান এবং মান্টুয়ার বেশ কিছু এলাকায় নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা করল। ওদিকে ২০ হাজারের মতো স্প্যানিশ সেনা মার্চ করে ঢুকে পড়ল টাস্কানে, সিয়েনা শহরে বসালো তাদের হেডকোয়ার্টার। পারমা থেকে ডন কার্লোস সিয়েনাতে এসে অভিযানের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিলেন। ফরাসি আর সার্ডিনিয়ানরা আশা করেছিল কার্লোস তাদের সাথে যোগ দেবেন। কিন্তু স্প্যানিশদের ছিল নিজস্ব এজেন্ডা। কার্লোস মে মাসের ভেতরে নেপলস দখল করে নেন। ইতালিয়ানরা নানা কারণে অস্ট্রিয়ান শাসনে রুষ্ট ছিল, তারা কার্লোসকে সহায়তা করে। অস্ট্রিয়ান সেনারা বিভিন্ন জায়গাতে পরাজিত হতে থাকে। ১৭৩৫ খ্রিষ্টাব্দের জুনে সিসিলির সর্বশেষ দুর্গের পতনের পর ৩রা জুলাই পালের্মোতে কার্লোস সিসিলির রাজা হিসেবে শপথ নেন।
এদিকে জেনারেল মার্সির (Graf von Mercy) অধীনে একদল অস্ট্রিয়ান সেনা পারমাতে ফরাসি-সার্ডিনিয়ান লাইনে হামলা চালিয়ে ব্যর্থ হয়। জেনারেল যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হন। ১৫ সেপ্টেম্বর অস্ট্রিয়ান জেনারেল কনিগসএগ (Graf von Koenigsegg) সেচিয়া নদীর তীরে ফরাসি ক্যাম্প তছনছ করে দেন। কিন্তু চার দিন পরেই গুয়াস্তালার (Guastalla) লড়াইয়ে অস্ট্রিয়ান বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। তবে তারা অ্যাডা নদীর তীর ধরে ডিফেন্সিভ লাইন বজায় রাখতে সক্ষম হলো, মান্টুয়ার অধিকাংশ এলাকাও তাদের হাতে রয়ে যায়।
পরের বছর ফরাসি, স্প্যানিশ এবং সার্ডিনিয়ান মিলিত সেনাদল মান্টুয়া অবরোধ করলেও নিজেদের মধ্যে বিবাদের জেরে কোনো সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। এরই মধ্যে খবর এলো ষষ্ঠ চার্লস আর ফরাসি সম্রাটের মাঝে শান্তি আলোচনা শুরু হয়েছে। ফলশ্রুতিতে অবরোধ তুলে নিয়ে জোট বাহিনী পিছিয়ে এলো। ফরাসি মধ্যস্থতায় অস্ত্রবিরতি স্বাক্ষরিত হয়।
জার্মান ক্যাম্পেইন
১৭৩৪ সালে জেনারেল বারউইকের (Berwick) নেতৃত্বে ফরাসিরা রাইন পাড়ি দিয়ে জার্মানিতে ঢুকে পড়ে। প্রথমেই তারা দখল করে নেয় ডাচি অফ লরেইন। তারপর পতন ঘটল কেল শহরের। মে মাসে ফরাসিরা অস্ট্রিয়ানদের একটি দলকে পরাস্ত করে ফিলিপসবার্গ অবরোধ করে। একই সময় কাছের হেলিবোর্ন (Heilbronn) শহরে এসে পৌঁছেন ষষ্ঠ চার্লসের বিশ্বস্ত সহযোগী, স্যাভয়ের ইউজিন। তিনি অপেক্ষা করছিলেন মিত্রদের জন্য। জুন মাস থেকে ১০ হাজার প্রুশিয়ান সেনা দফায় দফায় তার সাথে যোগ দেয়। জুলাইয়ের ৭ তারিখ ক্রাউন প্রিন্স ফ্রিটজ নিজে ইউজিনের সাথে মিলিত হন। এক সপ্তাহ পর তার পিতা ফ্রেডেরিক উইলিয়ামও চলে আসেন। ইউজিন ফরাসিদের অবরোধের পেছনে অবস্থান নেন। কামানের গোলা বিনিময়ের সময় ফরাসি জেনারেল বারউইক মারা গেলেও তার উত্তরসূরি অবরোধ জারি রাখেন। চলমান সংঘর্ষে প্রুশিয়ান সেনাদের দক্ষতা এবং ক্রাউন প্রিন্সের দৃঢ়তা সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করল।
যুদ্ধের পাশাপাশি কূটনৈতিক প্রচেষ্টাও অব্যাহত ছিল। রণাঙ্গনে থাকা অবস্থাতেই ফ্রেডেরিক উইলিয়ামকে অস্ট্রিয়ার সম্রাট এবং রাশিয়ান জারিনা চিঠি পাঠিয়ে স্ট্যানিস্লকে হস্তান্তরের অনুরোধ করেন। ফ্রেডেরিক তা নাকচ করে দেন। তিনি একমাস পরে প্রুশিয়া ফিরে গেলে আবারো নতুন করে একই অনুরোধ পেলেন। এবারও তার উত্তর ছিল নেতিবাচক। তিনি ফ্রিটজকেও ফিলিপসবার্গ থেকে ফিরিয়ে আনেন। তবে ষষ্ট চার্লসের প্রতি সেনা সহায়তা অব্যাহত ছিল। ১৭৩৫ সালে জুড়ে জার্মানিতে দুই পক্ষের মাঝে অচলাবস্থা বিরাজ করে। এমন পরিস্থিতিতে রাশিয়ান ২০,০০০ সেনার এক বাহিনী জার্মানিতে প্রবেশ করলেও শান্তি আলোচনা শুরু হয়ে যাওয়াতে তারা ফিরে যায়।
ট্রিটি অফ ভিয়েনা
অক্টোবরের ৫ তারিখ, ১৭৩৬ সাল।
ভিয়েনাতে সব পক্ষের উপস্থিতিতে প্রাথমিক শর্তের ভিত্তিতে থার্ড ট্রিটি অফ ভিয়েনা অনুমোদিত হলো। চূড়ান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ১৭৩৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ নভেম্বর। ষষ্ঠ চার্লস মারিয়া থেরেসার উত্তরাধিকার নিশ্চিত করতে সক্ষম হন, কিন্তু তাকে হারাতে হয় অনেক। ডাচি অফ লরেইন চলে যায় স্ট্যানিস্লর অধিকারে, শর্ত হলো তিনি পোলিশ উত্তরাধিকারের সকল দাবি ত্যাগ করবেন এবং তার মৃত্যুর পর ফরাসিরা ডাচির নিয়ন্ত্রণ নেবে। ইতালির কেবল পারমা আর পিয়াসেঞ্জা অস্ট্রিয়ার অধীনে থাকল। সিসিলি এবং টাস্কানসহ বিস্তীর্ণ এলাকা হলো স্প্যানিশ সাম্রাজ্যভুক্ত। ওদিকে সার্ডিনিয়াও কিছু এলাকা পেল। যদিও স্পেন এবং সার্ডিনিয়া খুশি ছিল না, কিন্তু তারা শেষ পর্যন্ত মেনে নেয়। প্রুশিয়ার সেরকম কোন ভূখণ্ডগত লাভ হয়নি। ফ্রেডেরিক উইলিয়াম আসলে চাপে পড়েই এই যুদ্ধে পক্ষাবলম্বন করেছিলেন, তিনি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।
প্রুশিয়ার ক্ষমতার পরিবর্তন
রাজা ফ্রেডেরিক উইলিয়ামের স্বাস্থ্য দিনে দিনে ভঙ্গুর হয়ে পড়ছিল। এর মাঝেই তিনি ফ্রিটজের বিয়ের ব্যবস্থা করেন। পাত্রী ব্রান্সউইকের ডিউকের কন্যা, এলিজাবেথ। ১৭৩৩ সালের জানুয়ারিতে তাদের বিয়ে হয়। তবে ফ্রিটজ পরবর্তীতে এলিজাবেথকে রাষ্ট্রীয়ভাবে রানীর মর্যাদা দিলেও স্ত্রীর প্রতি বরাবরই শীতল আচরণ করতেন। খুব সম্ভবত এই বিয়ে তার অনিচ্ছাতেই হয়েছিল।
১৭৪০ সালের ৩১ মে রাজা ফ্রেডেরিক উইলিয়াম অসুস্থ বোধ করতে থাকেন। মৃত্যু সন্নিকটে বুঝতে পেরে তিনি যাজক ডেকে পাঠালেন।এর অল্পক্ষণ পরেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সোলজার কিং। প্রুশিয়ার সিংহাসনে উপবিষ্ট হলেন নতুন রাজা। বাবার বিদ্রূপাত্মক নাম ফ্রিটজ ত্যাগ করে তিনি হলেন দ্বিতীয় ফ্রেডেরিক। কিন্তু ইতিহাসে তাকে আমরা জানি অন্য এক নামে-ফ্রেডেরিক দ্য গ্রেট।