ভালোবাসার টানে পরিবর্তিত হয়েছে ইতিহাস, এমন নজির রয়েছে অসংখ্য। প্রতিটি প্রণয়ের সাথে কেবল সেই কপোত-কপোতী নয়, তাদের ঘিরে থাকা আরও অসংখ্য মানুষের জীবনযাত্রার গল্পও পাল্টে যায়। তবে যখন একটি সম্পর্কে দুজনের বেশি মানুষ জড়িয়ে পড়ে, তখন সেই সম্পর্কে স্বাভাবিকতার চেয়ে জটিলতার মাত্রা বেড়ে যায় অনেকখানি। ইতিহাস বিখ্যাত কিছু প্রেমকাহিনীতে তৃতীয় ব্যক্তির আগমন পারিবারিক সম্পর্কে রেষারেষির পাশাপাশি রাজকীয় কাজেও ভজঘট পাকিয়ে দিয়েছে। তেমনই কিছু দুনিয়া কাঁপানো ত্রিভুজ প্রেমকাহিনী নিয়ে সাজানো হয়েছে আমাদের আজকের আয়োজন।
১. স্পার্টার রানী হেলেন, রাজা মেনেলাউস এবং ট্রয়ের রাজপুত্র প্যারিস
‘হেলেন’ শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ আলোকবর্তিকা। আজ থেকে প্রায় তিন হাজার বছর আগে, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দরীর উপাধিতে ভূষিত হওয়া এই নারী জীবনভর থেকেছেন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। প্রগাঢ় এক ত্রিভুজ প্রেমে জড়িয়ে এখনো পর্যন্ত লোকমুখে বাঁচিয়ে রেখেছেন নিজের অস্তিত্ব। মাত্র ১৭ বছর বয়সী তরুণী হেলেনের সাথে বিয়ে হয় মেনেলাউসের, দুজনের বয়সের ব্যবধান ছিল বেশ ভালো। শুরু থেকে মেনেলাউসকে খুব একটা পছন্দ হয়নি হেলেনের, জমে ওঠেনি তাদের মধ্যকার দাম্পত্য সম্পর্ক। তাই ট্রয়ের (বর্তমান তুরস্ক) সুদর্শন তরুণ যুবরাজ প্যারিসকে দেখে নিজেকে সামলাতে পারেননি স্পার্টার (বর্তমান গ্রীস) রানী হেলেন। কাজেই প্যারিস যখন দেবতাদের নামে শপথ করে হেলেনকে সারাজীবনের জন্য পাশে রাখার প্রস্তাব দেয়, তখন নিজের অজান্তেই উত্তেজিত হয়ে ওঠেন তরুণী রানী। প্রেমিকের ডাকে সাড়া দিতে উন্মুখ হেলেন সুযোগের অপেক্ষায় বসে থাকেন।
স্বামী মেনেলাউস শহর ছেড়ে বাইরে যেতেই নব প্রেমিক-প্রেমিকা দম্পতি স্পার্টা ছেড়ে পালিয়ে আসে ট্রয়ে। এখানে তারা সুখে-শান্তিতে বসবাস করছিল। সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল, যতদিন না মেনেলাউস তাদের পিছু নিয়ে ট্রয়ে এসে হাজির হয়। মেনেলাউস একা এলেও খুব একটা সমস্যা ছিল না, কিন্তু সে পুরো যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে, এক প্লাটুন সৈন্য সহ প্যারিসকে শিক্ষা দিতে চলে আসে। খুব শীঘ্রই ট্রয় জড়িয়ে পড়ে বিশাল এক যুদ্ধে, যা প্রায় দশ বছরব্যাপী চলতে থাকে। হেলেনকে শুধু হেলেন না বলে ‘হেলেন অফ ট্রয়’ বলাই বোধহয় সমুচিত হবে, এই পরিচয়ের জন্যই তো সবকিছু ছেড়ে প্যারিসের হাত ধরে চলে এসেছিলেন তিনি। কিন্তু রক্তক্ষয়ী এই যুদ্ধের দামামা বাজানোর জন্য তাকেই আজীবন দোষী সাব্যস্ত করে এসেছে একদল ঐতিহাসিক। তবে আরেকদল ঐতিহাসিক বলেন, ‘ভালোবাসা আর যুদ্ধে সবকিছুই সঙ্গত’। হেলেন ভালোবেসেছিলেন নিঃস্বার্থভাবে, নিজের মন থেকে। এই যুদ্ধের সাথে জড়িয়ে আছে মেনেলাউসের আত্মসম্মানবোধ। ত্রিভুজ এই প্রেমকাহিনীতে বেচারা যে প্রতারণার শিকার হয়েছিল, তার শোধ নিতেই গোটা বিশ্বকে এক অবিস্মরণীয়, নির্মম ও নৃশংস যুদ্ধ উপহার দিয়ে যায় মেনেলাউস।
২. এডউইনা মাউন্টব্যাটেন, লর্ড লুই মাউন্টব্যাটেন এবং জওহরলাল নেহরু
ভারতবর্ষের সর্বশেষ বড়লাট এবং স্বাধীন ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেল লর্ড লুই মাউন্টব্যাটেন প্রায় পাঁচ বছর ব্যাপী ব্রিটিশ নৌবাহিনীর প্রধান ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রপক্ষের প্রধান নৌ সেনাপতিও ছিলেন তিনি। ১৯৪৭ সালের মার্চ মাসে এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে ব্রিটিশ সরকার তাকে ভারতের গভর্নর জেনারেল করে পাঠায়। সে বছরের আগস্ট মাসেই ভারত ছেড়ে চলে যান তিনি, তবে তার আগে স্বাধীনতা অর্জন করে ভারত ও পাকিস্তান। সংক্ষিপ্ত এই ভারত সফরে তার সঙ্গী ছিলেন স্ত্রী এডউইনা মাউন্টব্যাটেন এবং ১৭ বছর বয়সী কন্যা পামেলা। তখনই ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সাথে প্রণয়ের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন এডউইনা। এমনকি তাদের সম্পর্ক শারীরিক পর্যায়েও পৌঁছেছিল বলে গুজব শোনা যায়।
নেহেরুর সাহচর্যে ব্যতিক্রমী কিছু খুঁজে পেয়েছিলেন এডউইনা, নিয়মিত চিঠি বিনিময় হতো তাদের। এ ব্যাপারে লর্ড মাউন্টব্যাটেন কিছু জানতেন কিনা তা নিয়ে দীর্ঘদিন যাবত প্রশ্ন ছিল সাধারণ জনগণের মনে। পাঁচ বছর আগে সেসব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে পামেলা প্রকাশ করে তার বই ‘ডটার অফ এম্পায়ার: লাইফ অ্যাজ এ মাউন্টব্যাটেন’। সেখানে এডউইনা এবং নেহরুর মধ্যকার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সম্পর্কের কথা স্বীকার করেছে পামেলা, তবে সে সম্পর্ক যে কখনো যৌনতার পর্যায়ে গড়ায়নি তা-ও স্পষ্ট করে জানিয়েছে সে। ভারত ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে ভালোবাসার নিদর্শন স্বরূপ নিজের পান্নার আংটিটি নেহরুকে দিয়ে যেতে চেয়েছিলেন এডউইনা। তবে নেহরু যে সেটা নেবেন না, তা বুঝতে পেরে নেহরুর কন্যা ইন্দিরাকেই উপহারটি দিয়ে যান তিনি। ১৯৪৮ সালের জুন পর্যন্ত স্বাধীন ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেলের দায়িত্ব পালন করে ব্রিটেনে ফিরে যান লর্ড মাউন্টব্যাটেন। ৫৮ বছর বয়সে এডউইনা মারা যাওয়ার আগপর্যন্ত তার সাথে চিঠির মাধ্যমে নেহরুর সম্পর্ক অটুট ছিল বলে জানা যায়। তবে এই এক প্রেমকাহিনীর বদৌলতে ভারত ও ব্রিটেনের মধ্যে বন্ধুত্বসুলভ সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
৩. রাজা অষ্টম এডওয়ার্ড, ওয়ালিস সিম্পসন এবং আর্নেস্ট সিম্পসন
বিংশ শতাব্দীর বেশ কুখ্যাত এক নারী হিসেবে পরিচিত ওয়ালিস সিম্পসন। তার কারণেই ব্রিটিশ রাজপরিবারের সিংহাসন ছেড়ে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের হাতে শাসনভার সোপর্দ করে সাধারণ জীবন বেছে নেন এডওয়ার্ড। যে প্রেমের টানে এত বড় ত্যাগ স্বীকার করলেন তিনি, ভালোবাসার সেই মানুষটিকে কিন্তু তৎক্ষণাৎ পাওয়ার কোনো উপায় ছিল না তার। কেননা ওয়ালিস তখনো আমেরিকার আর্নেস্ট সিম্পসনের আইনসঙ্গত স্ত্রী ছিলেন। রাজপরিবারের সকল সদস্য অসংখ্যবার বোঝানোর চেষ্টা করেছেন এডওয়ার্ডকে যে, ওয়ালিস কখনোই তার যোগ্য স্ত্রী হবে না। ডেভিড (এডওয়ার্ডের একটি ডাকনাম) এর আগে কয়েকজন নারীর সাথে প্রণয়ের সম্পর্ক গড়ে তুললেও, অন্য কারো ব্যাপারে এতোটা পাগলপারা হয়ে যাননি। রাজপরিবারের সদস্যদের বক্তব্য ছিল, ডেভিড চাইলেই যখন ব্রিটেনের সেরা সুন্দরীদের যে কাউকে স্ত্রী হিসেবে বেছে নিতে পারে, তাহলে অন্যের স্ত্রীকে সে কেন গ্রহণ করতে যাবে? কিন্তু ভালোবাসার কাছে হেরে যায় সমস্ত যুক্তিতর্ক। ক্ষমতার চেয়ে প্রেম বেশি শক্তিশালী তা প্রমাণ করতেই তিনি রাজপ্রাসাদ ছেড়ে রাজপথে আশ্রয় নেন।
সে সময় ব্রিটেনের আইন অনুযায়ী, বিবাহ বিচ্ছেদ হওয়ার আগপর্যন্ত প্রেমিক-প্রেমিকার একসাথে থাকার কোনো নিয়ম ছিল না। কাজেই ১৯৩৬ সালে সিংহাসন ছেড়ে এলেও এডওয়ার্ড-ওয়ালিস দম্পতির বিয়ে হয় ১৯৩৭ সালে, মাত্র ২০ জন অতিথির উপস্থিতিতে। ব্রিটেন ছেড়ে ফ্রান্সের বাহামায় গিয়ে সুখের নীড় রচনা করে তারা। ইতিহাস অবশ্য ক্ষেত্রবিশেষে এ কারণে ওয়ালিসকে বাহবা জানায়। কারণ সিংহাসন পরিচালনার মতো যথেষ্ট বিচক্ষণতা ডেভিডের ছিল না বলেই মনে করেন তারা।
৪. চেঙ্গিস খান, বর্তে এবং অজ্ঞাতনামা এক শত্রু
এই ত্রিভুজ প্রেমকাহিনীটি গড়ে ওঠার পিছনে প্রধান ভূমিকা রাখে এক হতভাগ্য নারীর দুর্দশার গল্প। চেঙ্গিস খান, ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ংকর এক রাজা, যিনি নৃশংসতাকে হাতিয়ার বানিয়ে জয় করেছেন মঙ্গোলের বিশাল সাম্রাজ্য, অল্পবয়সে প্রেমে পড়েন বর্তে নামের এক অনিন্দ্য সুন্দরী কন্যার। সে সময় অবশ্য চেঙ্গিস খানের নাম ছিল তেমুজিন, পরিচয় ছিল অজ্ঞাত। তার বয়স ছিল মাত্র ১০ বছর। আর দশজন সাধারণ বালকের মতো প্রথম দেখায় ভালো লেগে যাওয়ার স্বপ্নকুমারীকে নিয়ে কল্পনায় বিভোর হয়ে ওঠে তেমুজিন। কিন্তু তারা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধে হওয়ার আগেই স্থানীয় এক শত্রুবাহিনী দ্বারা অপহৃত হয় বর্তে। সেখানে কেটে যায় আট মাস। কথিত আছে, এই দীর্ঘ সময়ে অপহরণকারী দলের এক সদস্যের সাথে প্রণয়ের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে বর্তে। একদিকে চেঙ্গিস, আরেকদিকে অজ্ঞাতনামা সেই শত্রু, কী করবে বর্তে কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। কিশোরী বর্তেকে উদ্ধারের জন্য জম্মু খাঁর সাহায্য নিয়ে এক অভিযান চালায় চেঙ্গিস। বীরের বেশে প্রেয়সীকে উদ্ধার করে আনার কিছুদিনের মধ্যেই যোচি নামের একটি পুত্রসন্তানের জন্ম দেয় বর্তে।
এরপর বর্তের সাথে বিয়ে হয় তেমুজিনের, তাদের ঘর আলো করে আসে বেশ কয়েকটি সন্তান। কিন্তু চেঙ্গিস খানের বড় ছেলের পিতৃপরিচয় নিয়ে একটি প্রশ্ন ঐতিহাসিকদের মনে বরাবরই ছিল। চেঙ্গিস খান যখন বর্তেকে উদ্ধার করে আনে তখন কি বর্তে গর্ভবতী ছিল? তবে কি এই সন্তানটি বর্তের সেই অজ্ঞাতনামা প্রেমিকের? এসব প্রশ্নের উত্তর জানার এখন আর কোনো উপায় নেই। তবে এখানে একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, যোচির হাতে পরিবারের ক্ষমতা তুলে দিতে অস্বীকৃতি জানায় চেঙ্গিস। বলা বাহুল্য, এই একটি সিদ্ধান্ত চেঙ্গিস খানের উত্তরাধিকারীদের মধ্যে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের একটি সংঘাতের জন্ম দেয়।
৫. লেডি ফ্রান্সেস্কা দা রিমিনি, জিয়ানসিওতো দা মালাতেস্তা এবং পাওলো দা মালাতেস্তা
ইতালির ইতিহাসে এই ত্রিভুজ প্রেমকাহিনীটি খুব বেশি গুরুত্ব না রাখলেও দান্তের ‘ডিভাইন কমেডি’ এবং একটি অপেরার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে গল্পটি। শিল্প এবং সাহিত্যে অবশ্য ত্রিমুখী এই সম্পর্কটিকে ইতিহাসের ভিলেন হিসেবেই চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রকৃত অর্থে, ত্রয়োদশ শতাব্দীর ইতালিতে রেভেনা (লেডি ফ্রান্সেস্কা দা রিমিনি) নাম্নী এক নারীর সাথে প্রণয়ের পরে পরিনয় ঘটে জিয়ানসিওতো নামের সেসময়কার বেশ বিখ্যাত এক ব্যক্তির। কিন্তু বিয়ের কিছুদিন পরেই জিয়ানসিওতো নয়, রেভেনা প্রেমে পড়ে যান তার ছোট ভাই পাওলোর। নতুন এই কপোত-কপোতীর পরকীয়া ধরে ফেলতে খুব বেশি সময় লাগেনি জিয়ানসিওতোর। ক্রোধে অন্ধ জিয়ানসিওতো ভাই এবং স্ত্রী দুজনকেই হত্যা করে সমাপনী ঘোষণা করে এই অবৈধ প্রেমকাহিনীর।
গল্পটি সত্য, চরিত্রগুলোও সত্য। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে শিল্পী-সাহিত্যিকরা এর সাথে রঙ মাখিয়ে, তথ্য বিকৃত করে জনগণের মনোরঞ্জনের জন্য চটুলভাবে উপস্থাপন করেছে গল্পটিকে। ব্যতিক্রম নন দান্তেও। তার অনবদ্য কবিতায় রিমিনি আর পাওলোকে উপস্থাপন করা হয়েছে ধোঁকাবাজ, যৌন উত্তেজক ও জঘন্য চরিত্রের অধিকারী হিসেবে।