১৯৯৪ সালের ১২ ডিসেম্বর তুরস্ক থেকে আগত একদল ব্যক্তি আজারবাইজান সফর করেন। তাদের মধ্যে ছিলেন তুর্কি গোয়েন্দা সংস্থা ‘এমআইটি’র কর্মকর্তা কোরকুৎ একেন, তুর্কি পুলিশের বিশেষ বাহিনী ‘পোলিস ওজেল হারেকাত দাইরেসি’র কর্মকর্তা ইব্রাহিম শাহিন ও আয়হান চারকিন এবং ‘এমআইটি’র এজেন্ট আব্দুল্লাহ চাৎলি। একেন ছিলেন তুর্কি সেনাবাহিনীর বিশেষ বাহিনীর একজন প্রাক্তন কর্মকর্তা এবং তিনি ১৯৭৪ সালের সাইপ্রাস আক্রমণসহ বেশ কয়েকটি সামরিক অভিযানে অংশগ্রহণ করেছিলেন। শাহিন ও চারকিন তুরস্কের অভ্যন্তরে কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদী ও অন্যান্য মিলিট্যান্ট গ্রুপের বিরুদ্ধে পরিচালিত বিভিন্ন অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন। আর চাৎলি ছিলেন তুর্কি উগ্র জাতীয়তাবাদী দল ‘এমএইচপি’র আধা–সামরিক সংগঠন ‘উলকু ওজাকলারি’র প্রধান এবং একজন চিহ্নিত খুনি।
তারা আজারবাইজান সফরে গিয়েছিলেন একজন ক্ষমতাবান আজারবাইজানি আধা–সামরিক কর্মকর্তার আমন্ত্রণে। এই কর্মকর্তার নাম ছিল রোভশান জাভাদভ। জাভাদভ ছিলেন আজারবাইজান সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হাসপাতালে কর্মরত একজন সার্জন, কিন্তু তিনি পরবর্তীতে সোভিয়েত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সামরিক অ্যাকাডেমিতে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন এবং মেজর পদ লাভ করেন। তিনি আফগান যুদ্ধে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে অংশগ্রহণ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তার কমিউনিজমবিরোধী মনোভাবের কারণে তার আবেদন খারিজ করে দেয়া হয়। পরবর্তীতে তিনি গাঞ্জা শহরের পুলিশ পরিদর্শক নিযুক্ত হন। ১৯৮৭ সালে তিনি ও তার বড় ভাই মাহির জাভাদভ গাঞ্জা ও কারাবাখ অঞ্চলে ‘তাকামুল’ নামক একটি গুপ্ত সংগঠন গড়ে তোলেন, যেটি ক্রমশ একটি আধা–সামরিক বাহিনীতে রূপ নেয়। নাগর্নো–কারাবাখে আজারবাইজানি ও আর্মেনীয়দের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব ক্রমশ সশস্ত্র রূপ নিতে থাকলে আজারবাইজানি সরকার ১৯৯০ সালের আগস্টে ‘তাকামুল’কে আনুষ্ঠানিকভাবে আজারবাইজানি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অঙ্গীভূত করে নেয় এবং এটির নামকরণ করা হয় ‘খুসুসি তায়িনাৎলি পোলিস দাস্তাসি’ (আজারবাইজানি: Xüsusi Təyinatlı Polis Dəstəsi, ‘KhTPD’)। জাভাদভকে কর্নেল পদমর্যাদা প্রদান করা হয়।
জাভাদভ নাগর্নো–কারাবাখ যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন এবং তিনি সামরিক শক্তিবলে নাগর্নো–কারাবাখের সম্পূর্ণ অংশ আর্মেনীয়দের কাছ থেকে পুনর্দখল করার পক্ষপাতী ছিলেন। ১৯৯৩ সালে তিনি আজারবাইজানি সরকারের উপ–স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৯৯৩ সালের জুনে তিনি ও সুরাত হুসেয়নভ হায়দার আলিয়েভের ক্ষমতা লাভকে সমর্থন করেন এবং ১৯৯৩ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে আলিয়েভকে সমর্থন করেন। কিন্তু ১৯৯৪ সালের মে মাসে আলিয়েভ আর্মেনিয়ার সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষর করার পর আলিয়েভ ও জাভাদভের মধ্যে তীব্র মতবিরোধ দেখা দেয়, কারণ এই যুদ্ধবিরতি চুক্তি অনুযায়ী নাগর্নো–কারাবাখ ও এর আশেপাশের ৭টি আজারবাইজানি জেলা আর্মেনীয়দের দখলে থেকে গিয়েছিল। এমতাবস্থায় জাভাদভ প্রকাশ্যে আলিয়েভের বিরোধিতা করতে শুরু করেন এবং ঘোষণা দেন যে, তিনি পরবর্তী নির্বাচনে আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হলে আলিয়েভকে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে অভিশংসন করবেন।
১৯৯৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর আজারবাইজানি আইনসভার উপ–সভাপতি আফিয়াদ্দিন জালিলভ এবং আজারবাইজানি সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান শামসি রাহিমভ নিজ নিজ বাসভবনের কাছে খুন হন। জালিলভ ও রাহিমভ ছিলেন আলিয়েভের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। আজারবাইজানি সরকার তাদের খুনের জন্য রোভশান জাভাদভের ভাই মাহির জাভাদভকে দায়ী করে এবং জাভাদভের ইউনিটের তিনজন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। এদের মধ্যে ছিল জাভাদভের ইউনিটের অফিসার এলচিন আলিয়েভ এবং মাহির জাভাদভের ব্যক্তিগত দেহরক্ষী ও গাড়িচালক। মাহির জাভাদভ প্রকাশ্যে এই অভিযোগ অস্বীকার করেন এবং সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানিয়ে ‘KhTPD’ সদস্যদের মুক্তি দাবি করেন।
১ অক্টোবর আজারবাইজানি অ্যাটর্নি জেনারেল আলী ওমারভ এই বিষয়ে আলোচনা করার জন্য মাহির জাভাদভকে অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ে আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু মাহির জাভাদভ সেখানে পৌঁছানোর পর তাকে গ্রেপ্তার করার চেষ্টা করা হয় এবং প্রত্যুত্তরে KhTPD সদস্যরা সরকারি সৈন্যদের পরাজিত ও বন্দি করে কার্যালয়টি দখল করে নেয়। এই পর্যায়ে মাহির জাভাদভ ও আলিয়েভের মধ্যে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয় এবং আলিয়েভ দাবি করেন যে, KhTPD সদস্যদের গ্রেপ্তারের পিছনে তার হাত ছিল না। আলোচনার ফলশ্রুতিতে মাহির জাভাদভ অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় ছেড়ে যান এবং বন্দি সরকারি সৈন্যদের ছেড়ে দেন। বিনিময়ে গ্রেপ্তারকৃত KhTPD সদস্যদের মধ্যে দুজনকে তৎক্ষণাৎ মুক্তি প্রদান করা হয়। একই সময়ে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী সুরাত হুসেয়নভ একটি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আলিয়েভকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টা করেন, কিন্তু তার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। জাভাদভের KhTPD এই অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করেনি, ফলে তখনকার মতো আলিয়েভ ও জাভাদভ ভ্রাতৃদ্বয়ের মধ্যে এক ধরনের ‘অস্বস্তিকর শান্তি’ (uneasy peace) বজায় থাকে।
এদিকে তুর্কি গোয়েন্দা সংস্থা ‘এমআইটি’ হায়দার আলিয়েভকে ক্ষমতাচ্যুত করে ‘আজারবাইজান খালক জাবহাসি’ দলভুক্ত প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি আবুলফাজ এলচিবেকে পুনরায় রাষ্ট্রটির ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করার পরিকল্পনা করছিল। তুর্কি প্রচারমাধ্যমের ভাষ্যমতে, ‘এমআইটি’র কর্মকর্তা ও তুর্কি সেনাবাহিনীর প্রাক্তন কর্নেল নেজাবেত্তিন এরগেনেকোন এবং তার সহযোগীরা ছিলেন এই অভ্যুত্থানের মূল পরিকল্পনাকারী। তুর্কি মন্ত্রী আয়ভাজ গোকদেমির, তুর্কি পুলিশের মহাপরিচালক মেহমেত আগার এবং তদানীন্তন তুর্কি প্রধানমন্ত্রী তানসু চিলারের উপদেষ্টা আজার ওকান ও সুলেয়মান ইয়ুজেওরাল এই পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তুর্কি উগ্র জাতীয়তাবাদী দল ‘এমএইচপি’র নেতা আল্পআরসালান তুর্কেশ এই পরিকল্পনার একজন জোরালো সমর্থক ছিলেন। তুর্কি প্রচারমাধ্যমের বক্তব্য অনুসারে, তুর্কি অপরাধ জগতের কিছু ব্যক্তিও এই অভ্যুত্থানের ব্যাপারে উৎসাহী ছিল, কারণ তারা ভেবেছিল, এই অভ্যুত্থান সংঘটিত হলে আফগানিস্তান থেকে তুরস্ক পর্যন্ত মাদক পাচার অপেক্ষাকৃত সহজ হয়ে যাবে।
আজারবাইজানে নিযুক্ত এমআইটির রেসিডেন্ট এরতুরুল গুভেন, তুর্কি সহযোগিতা সংস্থা ‘তুর্ক ইশবিরলিই ভে কোঅর্দিনাসিওন আজান্সি’র (তুর্কি: Türk İşbirliği ve Koordinasyon Ajansı, ‘TİKA’) প্রতিনিধি ফেরমান দেমিরকোল এবং ধর্ম সংক্রান্ত উপদেষ্টা আব্দুলকাদির সেজগিন হয় এই পরিকল্পনায় সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন, নয়ত পরিকল্পনাটি সম্পর্কে স্পষ্টভাবে অবগত ছিলেন। এদের মধ্যে দেমিরকোল ছিলেন সবচেয়ে বেশি সক্রিয়। তিনি একপর্যায়ে আজারবাইজানে নিযুক্ত রুশ রাষ্ট্রদূত ভালতের শোনিয়ার সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় লিপ্ত হন। পরবর্তীতে তিনি তুরস্কে এসে এলচিবের সঙ্গে অভ্যুত্থান–পরবর্তী সরকার গঠন নিয়ে আলোচনা করেন। আলিয়েভের সম্ভাব্য পতনের পর দেমিরকোল নিজে আজারবাইজানের উপ–রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত হতে চেয়েছিলেন।
আজারবাইজানের অভ্যন্তরে রোভশান জাভাদভের KhTPD এর পাশাপাশি আবুলফাজ এলচিবের ‘আজারবাইজান খালক জাবহাসি’ এবং প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ইসগান্দার হামিদভের ‘বোজ গুর্দ’ দলও জড়িত ছিল। উল্লেখ্য, ‘বোজ গুর্দ’ ছিল তুর্কি উগ্র জাতীয়তাবাদী আধা–সামরিক সংগঠন ‘উলকু ওজাকলারি’র অনুরূপ এবং সংগঠন দুটির মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। এমআইটির পরিকল্পনা অনুযায়ী, অভ্যুত্থানের পর খালক জাবহাসি ও বোজ গুর্দ দল দুটি হতো নতুন আজারবাইজানি সরকারের রাজনৈতিক ভিত্তি।
তুর্কি প্রধানমন্ত্রী চিলার পরিকল্পনাটি অনুমোদন করেন এবং ‘এমআইটি’ পরিকল্পনাটি বাস্তবায়নের প্রস্তুতি নিতে থাকে। এই পর্যায়ে এমআইটি ও কর্নেল রোভশান জাভাদভ উক্ত পরিকল্পনাটি বাস্তবায়নের জন্য জোটবদ্ধ হয়। অভ্যুত্থানের জন্য জাভাদভের ইউনিটের অফিসারদের প্রশিক্ষণ প্রদানের উদ্দেশ্যে ১৯৯৪ সালের ডিসেম্বরে তুরস্ক থেকে একটি বিশেষ দল আজারবাইজানে গমন করে। এমআইটি কর্মকর্তা একেন, তুর্কি পুলিশ কর্মকর্তা শাহিন ও চারকিন এবং এমআইটির ‘নিজস্ব’ খুনি চাৎলি এই দলেরই অংশ ছিলেন। অবশ্য তুর্কিদের কার্যক্রম জাভাদভের অফিসারদের প্রশিক্ষণ প্রদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তারা জাভাদভের সৈন্যদেরকে অস্ত্রশস্ত্র ও অর্থ সরবরাহ করে এবং অভ্যুত্থানের জন্য প্রস্তুত করতে থাকে।
তুর্কিরা তাদের কার্যক্রম গোপন রাখার চেষ্টা করে, কিন্তু তাদের পক্ষে তাদের এই পরিকল্পনা গোপন রাখা সম্ভব হয়নি। মার্কিন বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা ‘সিআইএ’ ও রুশ অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা ‘ফেদেরালনায়া স্লুঝবা কন্ত্ররাজভেদকি’ (রুশ: Федера́льная Слу́жба Контрразве́дки, ‘ФСК’/’FSK’) আজারবাইজানে তুর্কিদের কার্যক্রমের ওপর কড়া নজর রাখছিল এবং তুর্কিদের অভ্যুত্থান পরিকল্পনা সম্পর্কে জেনে গিয়েছিল। তদুপরি, রোভশান জাভাদভের কিছু ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন প্রাক্তন সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা ‘কেজিবি’র গুপ্তচর এবং হায়দার আলিয়েভের সমর্থক। তারা যথাসময়ে জাভাদভ ও তুর্কিদের পরিকল্পনা সম্পর্কে আলিয়েভকে জানিয়ে দেন। ফলে আলিয়েভ প্রথম থেকেই এই অভ্যুত্থান পরিকল্পনা সম্পর্কে অবগত ছিলেন।
১৯৯৫ সালের ১২ মার্চ আজারবাইজানি আইন–শৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষ জানতে পারে যে, তাউজ অঞ্চলে সীমান্তরক্ষীরা বাধা দেয়ার পরেও ৪টি গাড়ি জর্জিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে এবং KhTPD এর কর্মকর্তারা গাড়িগুলোকে পাহারা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আজারবাইজানি সৈন্যরা গাড়িগুলোকে আটকাতে সক্ষম হয় এবং সেগুলো থেকে ৫০ টন তামা উদ্ধার করে। এদিকে ১৩ মার্চ কাজাখ অঞ্চলে মোতায়েনকৃত KhTPD ইউনিট ও কিছু সশস্ত্র বেসামরিক নাগরিক শহরটির পুলিশ সদর সপ্তর দখল করে নেয় এবং একটি সরকারি সৈন্যদলকে বন্দি করে। তারা বেশ কয়েকটি আর্মার্ড ভেহিকল হস্তগত করে এবং আগস্তাফার দিকে অগ্রসর হয়ে পথিমধ্যে একটি পুলিশ ফাঁড়ি দখল করে নেয়। আগস্তাফায় পৌঁছে তারা সেখানকার পুলিশ সদর দপ্তর দখল করে নেয় এবং পুলিশ সদস্যদের নিরস্ত্র করে। পরে তারা তাউজ অঞ্চলে সরকারি সৈন্যদের ওপর আক্রমণ চালায়, কিন্তু সরকারি সৈন্যরা তাদের আক্রমণ প্রতিহত করে।
এদিকে জাভাদভ বিদ্রোহ শুরু করে দেয়ার পরপরই তুর্কি রাষ্ট্রপতি সুলেয়মান দেমিরেল আলিয়েভের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং তাকে এই অভ্যুত্থান সম্পর্কে ‘সতর্ক’ করে দেন। তিনি দাবি করেন যে, তার অগোচরে এমআইটির কিছু কর্মকর্তা এই অভ্যুত্থানের আয়োজন করেছিল। এক্ষেত্রে অবশ্য দেমিরেলের বক্তব্য সত্যি না মিথ্যা, সেটা যাচাই করার কোনো উপায় নেই। যদি দেমিরেলের বক্তব্য মিথ্যা হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে ধরে নেয়া যেতে পারে যে, অভ্যুত্থানে জাভাদভ ব্যর্থ হলে তুর্কি–আজারবাইজানি সম্পর্কে যাতে চূড়ান্ত অবনতি না ঘটে, সেজন্য আলিয়েভকে এই ‘সতর্কবার্তা’ প্রেরণ করে তিনি আলিয়েভকে সন্তুষ্ট রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এমনিতেও আলিয়েভ এই অভ্যুত্থান পরিকল্পনা সম্পর্কে অনেক আগে থেকেই অবগত ছিলেন এবং এজন্য বিদ্রোহ শুরু হওয়ার পর তিনি অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়েননি। বরং তিনি বিদ্রোহ দমনের জন্য সর্বশক্তি নিযুক্ত করেন।
১৪ মার্চ আজারবাইজানি টেলিভিশনে প্রচার করা হয় যে, আজারবাইজানি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রামিল উসুবভ KhTPD কে নির্মূল করার আদেশ দিয়েছেন। আজারবাইজানি সরকারের ভাষ্য ছিল, KhTPD সম্পূর্ণভাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে এবং অপরাধ জগতের সঙ্গে মিলে সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। KhTPD এর অধিনায়ক রোভশান জাভাদভ ও তার সৈন্যদেরকে তিন দিনের মধ্যে তাদের সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র ও অন্যান্য সরঞ্জাম জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। ১৫ মার্চ আলিয়েভ জাভাদভকে উপ–স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ থেকে বরখাস্ত করেন এবং আজারবাইজানি সৈন্যরা ভারী অস্ত্রশস্ত্রসহ আগস্তাফায় আক্রমণ চালিয়ে শহরটি বিদ্রোহীদের কাছ থেকে পুনর্দখল করে নেয়। একই দিন সন্ধ্যায় জাভাদভ ও তার সমর্থকরা বাকুতে অবস্থিত একটি KhTPD ঘাঁটি থেকে আলিয়েভ, আইনসভার সভাপতি রাসুল গুলিয়েভ ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রামিল উসুবভের পদত্যাগ দাবি করেন।
১৬ মার্চ বাকুতে সরকারি বাহিনী ও বিদ্রোহীদের মধ্যে চূড়ান্ত যুদ্ধ শুরু হয়। বিদ্রোহীরা তাদের ঘাঁটির আশেপাশের স্কুল ভবন ও অন্যান্য ভবন দখল করে নেয় এবং নেফতচিলার স্টেশন বরাবর অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু আজারবাইজানি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমান্ড্যান্ট পোস্টগুলোর কাছে সরকারি সৈন্যরা তাদের অগ্রযাত্রা প্রতিহত করে। ১৭ মার্চ ভোরে অতিরিক্ত সরকারি সৈন্য এসে ঘটনাস্থলে পৌঁছায় এবং ধীরে ধীরে KhTPD সদস্যরা পশ্চাৎপসরণ করতে থাকে। এর মধ্যে রোভশান জাভাদভ গুলিবিদ্ধ হন এবং হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে মৃত্যুবরণ করেন। সাড়ে ১১টার দিকে বিদ্রোহীরা সাদা পতাকা উত্তোলন করে, কিন্তু আরো প্রায় মিনিট দশেক গোলাগুলি অব্যাহত থাকে। লড়াইয়ের ফলাফল ছিল আজারবাইজানি সরকারি বাহিনীর পরিপূর্ণ বিজয়।
আজারবাইজানি সরকারের প্রদত্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এই ব্যর্থ অভ্যুত্থানে মোট ৪৫ জন নিহত হয়। এদের মধ্যে ২৫ জন ছিল আজারবাইজানি সেনাবাহিনীর সদস্য এবং ২ জন ছিল পুলিশ কর্মকর্তা। KhTPD এর ১১ জন সদস্য এই লড়াইয়ে নিহত হয়। এর পাশাপাশি ৭ জন বেসামরিক নাগরিকও এই লড়াইয়ে প্রাণ হারায়। প্রায় ১১৭ জন ব্যক্তি এই লড়াইয়ের ফলে আহত হয়। এই লড়াইয়ে অংশগ্রহণকারী ৩৬ জন সৈন্যকে আজারবাইজানি সরকার ‘আজারবাইজানের জাতীয় বীর’ পদকে ভূষিত করে।
এই ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর KhTPD কে বিলুপ্ত করা হয় এবং অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে শত শত KhTPD সদস্য ও তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর পাশাপাশি বেশ কয়েকজন সৈন্য, পুলিশ ও বেসামরিক নাগরিককেও এই অভ্যুত্থান প্রচেষ্টায় জড়িত থাকার দায়ে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃতদের ৩ বছরের কারাদণ্ড থেকে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত বিভিন্ন মাত্রার শাস্তি প্রদান করা হয়, অবশ্য পরবর্তীতে আজারবাইজানে মৃত্যুদণ্ড প্রদান নিষিদ্ধ ঘোষণার পর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। তদুপরি, আজারবাইজানি জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী নামিগ আব্বাসভ উগ্র জাতীয়তাবাদী ‘বোজ গুর্দ’ দলকে এই অভ্যুত্থান প্রচেষ্টায় জড়িত থাকার দায়ে অভিযুক্ত করেন এবং ৩১ মার্চ তাদের সমস্ত কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
এই অভ্যুত্থান প্রচেষ্টায় তুর্কিদের সংশ্লিষ্টতা সম্পর্কে আজারবাইজানি সরকার ভালোভাবেই অবগত ছিল এবং অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা আরম্ভ হওয়ার পরপরই তারা এর সঙ্গে জড়িত আজারবাইজানে অবস্থানরত তুর্কি নাগরিকদের খোঁজ করতে শুরু করে। বাকুতে নিযুক্ত ‘টিকা’র প্রতিনিধি ফেরমান দেমিরকোল (যিনি অভ্যুত্থান সফল হলে আজারবাইজানের উপ–রাষ্ট্রপতি হতে চেয়েছিলেন) বাকুতে অবস্থিত তুর্কি দূতাবাসে আশ্রয় প্রার্থনা করেন, কিন্তু তুর্কি রাষ্ট্রদূত দেমিরকোলের মাত্রাতিরিক্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষার জন্য তার ওপর ক্ষিপ্ত ছিলেন এবং এজন্য তাকে আশ্রয় দিতে অস্বীকৃতি জানান। দেমিরকোল আব্দুলকাদির সেজগিনের বাড়িতে আশ্রয় নেন। আজারবাইজানি সরকার দেমিরকোলকে গ্রেপ্তার করতে চাচ্ছিল, কিন্তু তুর্কি সরকার এরকম কিছু যাতে না হয় সেটি নিশ্চিত করার জন্য তুর্কি প্রধানমন্ত্রীর সচিব আলী তুনজের ও এমআইটির ‘ইন্টেলিজেন্স ডিপার্টমেন্টে’র প্রধান ইয়ালচিন এরতানকে বাকুতে প্রেরণ করে। তারা প্রায় ৬ ঘণ্টা আলিয়েভের সঙ্গে আলোচনা করেন এবং তাদের অনুরোধে শেষ পর্যন্ত আলিয়েভ দেমিরকোলকে ছাড় দিতে রাজি হন। অবশ্য অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত তুর্কি ব্যবসায়ী কেনান গুরেলকে আজারবাইজানি পুলিশ গ্রেপ্তার করে এবং তাকে কারাদণ্ড প্রদান করা হয়।
সামগ্রিকভাবে, ১৯৯৫ সালে তুর্কি গোয়েন্দা সংস্থা কর্তৃক আজারবাইজানে পরিচালিত অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। কিন্তু এর ফলে তুর্কি–আজারবাইজানি সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য কোনো অবনতি লক্ষ করা যায়নি। আর্মেনিয়ার সঙ্গে চলমান দ্বন্দ্ব এবং রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য আজারবাইজানের তুরস্কের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা প্রয়োজন ছিল। অন্যদিকে, তুর্কি সরকার এই ব্যর্থ অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার বিষয়টি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ধামাচাপা দিতে আগ্রহী ছিল। এজন্য উভয় পক্ষই উক্ত অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার পরেও পরস্পরের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখে এবং রাষ্ট্র দুটির মধ্যকার সম্পর্ককে ‘এক জাতি, দুই রাষ্ট্র’ হিসেবে আখ্যায়িত করতে থাকে।
অবশ্য এই অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার পর ভিতরে ভিতরে উভয় পক্ষই যে একে অপরের ক্ষিপ্ত ছিল না, এমনটা নয়। ফলশ্রুতিতে অন্তত ২০১০–এর দশকের প্রথম ভাগ পর্যন্ত আজারবাইজান তুরস্কের কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের গোপনে সহায়তা প্রদান করত এবং ২০০০–এর দশকে তুরস্ক আর্মেনিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের প্রচেষ্টা চালায় (যদিও সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়)। কিন্তু এসবের পরেও একবিংশ শতাব্দীতে তুরস্ক ও আজারবাইজান অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছে এবং ২০২০ সালের নাগর্নো–কারাবাখ যুদ্ধের পর এই সম্পর্কের ব্যাপ্তি আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে।