সড়ক কিংবা নৌপথের তুলনায় আকাশপথে ভ্রমণ অনেকটাই নিরাপদ। কিন্তু তারপরেও প্রায় সময়ই বিভিন্ন যাত্রীবাহী বা সামরিক বিমান দুর্ঘটনার মুখে পতিত হয়। বিমান দুর্ঘটনার ইতিহাসে সাধারণ দুর্ঘটনার বাইরে এমন কিছু ঘটনাও আছে, যেখানে সকল যাত্রী সহ পুরো বিমানটিই সম্পূর্ণ নিখোঁজ হয়ে গেছে। দীর্ঘ সময়ব্যাপী এবং দীর্ঘ এলাকা জুড়ে অনুসন্ধান চালানোর পরেও সেগুলোর কোনো খোঁজ মেলেনি, জানা জায়নি আসলে কী ঘটেছে বিমানটির এবং এর যাত্রীদের ভাগ্যে। চলুন জেনে নেই এরকমই কিছু রহস্যময় বিমান নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা।
মালয়েশিয়া এয়ারলাইনের ফ্লাইট ৩৭০
রহস্যজনকভাবে বিমান নিখোঁজের সবচেয়ে বড় এবং আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা এটি। ২০১৪ সালের ৮ই মার্চ কুয়ালালামপুর ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকে বেইজিং ক্যাপিটাল ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে যাওয়ার সময় মাঝপথে ২২৭ জন যাত্রী এবং ১২ জন ক্রু সহ নিখোঁজ হয়ে যায় মালয়েশিয়া এয়ারলাইনের একটি যাত্রীবাহী বিমান, ফ্লাইট ৩৭০ (MH370)।
যাত্রীবাহী বিমানটিতে মোট ১৫টি দেশের নাগরিক ছিল, যাদের মধ্যে ১৫২ জনই ছিল চীনের। বিমানটি এবং এর আরোহীদের সন্ধানে একাধিক রাষ্ট্রের উদ্যোগে শুরু হওয়া যৌথ অনুসন্ধান কার্যাক্রম ছিল বিশ্বের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় আয়োজনের এবং সবচেয়ে দীর্ঘকাল ব্যাপী পরিচালিত অনুসন্ধান কার্যক্রম। আকাশপথ, জলপথ এবং পানির নিচে বিভিন্ন ধাপে প্রায় তিন বছর ধরে এই অনুসন্ধান কার্যক্রমে সর্বমোট ব্যয় হয় আনুমানিক ১৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। কিন্তু ২০১৫-১৬ সালে বিমানটির বিচ্ছিন্ন কিছু অংশ ছাড়া মূল বিমানটির কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। এমনকি পরিষ্কার আবহাওয়ায় বিমানটির নিখোঁজ হওয়ার বা যাত্রাপথ পরিবর্তন করার কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যাও পাওয়া যায়নি।
রহস্যজনকভাবে এই বিমানটির নিখোঁজ হওয়ার পেছনের কারণ হিসেবে ইন্টারনেটে বিভিন্ন গুজব ছড়িয়ে পড়ে। তদন্ত কর্মকর্তারা অবশ্য এসব গুজব অস্বীকার করেছেন। এর তদন্ত অবশ্য এখনও শেষ হয়নি। এ বছরের শেষের দিকে তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার কথা আছে।
ট্রান্স-আটলান্টিক সি-১২৪ ফ্লাইট
বিমান নিখোঁজের অন্যতম অদ্ভুত ঘটনা এটি। ১৯৫১ সালের ২৩শে মার্চ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনীর ডাগলাস সি-১২৪ গ্লোবমাস্টার-টু নামের একটি বিমান নিউ মেক্সিকো থেকে ইংল্যান্ডের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। মাঝপথে আয়ারল্যান্ডের কাছাকাছি আটলান্টিক মহাসাগরের উপরে থাকা অবস্থায় বিমানটির কার্গোতে আগুন ধরে যায়। আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে পাইলট সমুদ্রের উপরেই বিমানটি অবতরণ করাতে বাধ্য হন। নিরাপদেই তিনি বিমানটিকে অবতরণ করাতে সক্ষম হন।
বিমানটিতে ৫৩ জন যাত্রীর জন্য যথেষ্ট সংখ্যক জীবন রক্ষাকারী ভেলা ছিল, যেগুলোর প্রতিটিতে পাঁচজন করে অবস্থান নিতে পারতো। সেসব ভেলার প্রতিটিতে পর্যাপ্ত খাবার-দাবার, ফ্লেয়ার, রেডিও সহ বিভিন্ন ধরনের জীবন রক্ষাকারী সামগ্রী ছিল। যাত্রীরা ভেলাগুলোতে অবস্থান নেন এবং তাদের সঠিক অবস্থান নিকটবর্তী জাহাজ ক্যাসকোকে জানিয়ে দেন।
মার্কিন বিমান বাহিনীর একটি বি-৫০ বিমান সন্ধ্যার দিকে ঘটনাস্থলে পৌঁছে এবং যাত্রীদেরকে ভেলার উপরে অবস্থানরত দেখতে পায়। জ্বালানী কম থাকায় বিমানটি ফিরে যায়। কিন্তু পরের দিন সকালে উদ্ধারকারী জাহাজ ক্যাসকো যখন ঘটনাস্থলে পৌঁছে, ততক্ষণে প্লেনটি তার ৫৩ যাত্রী, তাদের ভেলা সহ সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ক্যাসকো ঘটনাস্থলে শুধু একটি পোড়া কাঠের টুকরা এবং একটি ব্রিফকেস ছাড়া আর কিছুই পায়নি। পরবর্তী দিনগুলোতে ব্রিটিশ জাহাজ, সাবমেরিন এবং প্লেনের সাহায্যে বিস্তৃতি এলাকা জুড়ে অনুসন্ধান চালানো হলেও প্লেনটির বা ৫৩ যাত্রীর ভাগ্যে কী ঘটেছিল, সে রহস্যের কোনো সমাধান পাওয়া যায়নি।
ভিয়েতনাম যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লাইট ৭৩৯
ফ্লাইং টাইগার লাইন ফ্লাইট ৭৩৯ ছিল মার্কিন সেনাবাহিনীর একটি বিমান, যেটি ১৯৬২ সালের ১৬ মার্চ প্রশান্ত মহাসাগরের উপর থেকে নিখোঁজ হয়ে যায়। প্লেনটিতে ৯৩ জন মার্কিন সেনা এবং ৩ জন দক্ষিণ ভিয়েতনামী সেনা ছিল। এটি ক্যালিফোর্নিয়ার ট্র্যাভিস এয়ার ফোর্স বেইজ থেকে ভিয়েতনামের সায়গনে যাচ্ছিল। গুয়াম দ্বীপপুঞ্জে জ্বালানি পূর্ণ করে ফিলিপিনের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করার ৮০ মিনিট পরে পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর থেকে এটি নিখোঁজ হয়ে যায়। এর ১০৭ জন আরোহীর করো কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।
ফ্লাইট ৭৩৯ এর খোঁজে পরিচালিত অনুসন্ধান কার্যক্রম ছিল প্রশান্ত মহাসাগরের ইতিহাসের সর্ববৃহৎ অনুসন্ধান প্রকল্প। মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগের চারটি শাখার বিমান এবং জাহাজ ৮ দিন ধরে প্রায় ৫,২০,০০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে অনুসন্ধান চালায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা প্লেনটির কোনো ধ্বংসাবশেষ বা আরোহীদের কোনো চিহ্ন খুঁজে পায়নি।
ঘটনাটির একমাত্র সম্ভাব্য সাক্ষ্য পাওয়া যায় একটি তেলবাহী জাহাজের নাবিকদলের কাছ থেকে, যারা দাবি করে তারা সে সময় মাঝ আকাশে প্রচন্ড উজ্জ্বল আলো দেখতে পেয়েছিল। ধারণা করা হয়, প্লেনটি মাঝ আকাশে বিস্ফোরিত হয়ে এরপর পানিতে তলিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ব্যাপক অনুসন্ধানের পরেও প্লেনটির কোনো ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়া যায়নি।
একই দিনে একই আরেকটি প্লেনও প্রায় একইভাবে বিধ্বস্ত হয়েছিল, যেটা গোপন মিলিটারি কার্গো বহন করছিল। সেই প্লেনটিও ছিল ফ্লাইং টাইগার লাইনের প্লেন এবং সেটিও ট্র্যাভিস এয়ার ফোর্স বেইজ থেকে যাত্রা শুরু করেছিল। ঘটনা দুটির মধ্যে অস্বাভাবিক মিল থাকায় তা মিডিয়াতে বেশ আলোচনার জন্ম দেয়। অনেকেই এর পেছনে ষড়যন্ত্রের আশঙ্কা ব্যক্ত করে, যদিও পরবর্তীতে তদন্তে সেরকম কিছু পাওয়া যায়নি।
বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের ফ্লাইট ১৯
ফ্লাইট ১৯ হচ্ছে ৫টি যুদ্ধবিমানের সমষ্টিগত নাম, যেগুলো ১৯৪৫ সালের ডিসেম্বর মাসের ৫ তারিখে বারমুডা ট্রায়াঙ্গল থেকে নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিল। বোমারু বিমানগুলো ফ্লোরিডার ন্যাভাল এয়ার স্টেশন ফোর্ট লডেরডেল থেকে যাত্রা শুরু করেছিল সমুদ্রের উপরে অনুশীলন করার জন্য। কিন্তু বারমুডা ট্রায়াঙ্গলে যাওয়ার পর পরই তারা যোগাযোগ হারিয়ে ফেলে। বিমানগুলোতে অবস্থিত ১৪ জন বৈমানিক এবং ক্রুর সবাই নিরুদ্দেশ হয়ে যায়।
ফ্লাইট ১৯ এর বিমানগুলো বোমা নিক্ষেপের অনুশীলনী শেষ করে ফেরার পথে আবহাওয়া খারাপ হতে শুরু করে। তারা সম্ভবত পথ হারিয়ে ফেলে। তাদের বিমানগুলোতে যান্ত্রিক গোলোযোগও দেখা দিতে শুরু করে। ততক্ষণে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে এবং ফ্লাইট ১৯ এর বৈমানিকরা বুঝতে পারে যে, তারা হয়তো আর ফিরতে পারবে না। তাদেরকে খুঁজে বের করার জন্য এবং পথ দেখিয়ে ফেরত আনার জন্য একাধিক প্লেন এবং জাহাজকে বার্তা দেওয়া হয়।
সন্ধ্যা ৭টা ২৭ মিনিটে ন্যাভাল এয়ার স্টেশন ব্যানানা রিভার থেকে একটি বিবিএম-৫ বিমান যাত্রা করে ফ্লাইট ১৯-কে খুঁজে বের করার জন্য। কিন্তু ৭টা ৩০ মিনিটে একটি রেডিও মেসেজ দেওয়ার পর থেকে তার সাথেও সবার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ফ্লাইট ১৯ এর ১৪ জন ছাড়াও বিবিএম-৫ এর মধ্যেও ১৩ জন যাত্রী চিরদিনের জন্য হারিয়ে যায় সমুদ্রের বুকে।
রহস্যময় এ ঘটনা নিয়ে অনেক তদন্ত হয়েছে, কিন্তু ছয়টি প্লেনের কোনোটিরই কোনো ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়া যায়নি। তদন্তে ফ্লাইট ১৯ এর ধ্বংসের কারণ অজানা বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে পিবিএম-৫ এর ধ্বংসের কারণ হিসেবে অনুমান করা হয়, এটি হয়তো মাঝ আকাশে বিস্ফোরিত হয়ে গিয়েছিল।
ভারতের আন্তোনভ আন-৩২ মিলিটারি ট্রান্সপোর্ট এয়ারক্রাফট
২০১৬ সালের ২২ জুলাই, বঙ্গোপসাগরের উপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় ভারতীয় বিমান বাহিনীর একটি দুই ইঞ্জিন বিশিষ্ট আন্তোনভ আন-৩২ মিলিটারি ট্রান্সপোর্ট এয়ারক্রাফট নিখোঁজ হয়ে যায়। প্লেনটিতে মোট ২৯ জন যাত্রী ছিল, যাদের মধ্যে ২৩ জন সামরিক সদস্য, আর বাকি ৬ জন বিমানের ক্রু। সামরিক সদস্যদের মধ্যে ১১ জন ছিল ভারতীয় বিমান বাহিনীর কর্মকর্তা। প্রায় দু’মাস অনুসন্ধানকার্য পরিচালনার পরেও প্লেনটির বা এর আরোহীদের কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।
বিমানটি সকাল ৮টা ৩০ মিনিটে চেন্নাইয়ের তাম্বারাম এয়ার ফোর্স স্টেশন থেকে যাত্রা শুরু করে। এর গন্তব্য ছিল আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের পোর্ট ব্লেয়ারে। বেলা ৯টা ১২ মিনিটে চেন্নাইয়ের ২৮০ কিলোমিটার পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরের উপরে থাকা অবস্থায় এটি রাডারের সাথে যোগাযোগ হারিয়ে ফেলে। ধারণা করা হয়, এটি হয়তো সমুদ্রের উপর বিধ্বস্ত হয়েছে।
ভারতীয় নৌবাহিনী এবং ভারতীয় কোস্ট গার্ড বিমানটির ধ্বংসাবশেষের খোঁজে বিশাল অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু করে। এটি ছিল ভারতের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অনুসন্ধান কার্যক্রম। শুরুতে পাঁচটি বিমান, ১২টি জাহাজ এবং ১টি সাবমেরিন অংশ নেয়। পরবর্তীতে মোট ১৬টি জাহাজ এবং ৬টি বিমান এই অনুসন্ধানকার্যে অংশগ্রহণ করে। প্রায় দুই মাস পরেও প্লেনটির কোনো চিহ্ন পাওয়া না যাওয়ায় ১৫ই সেপ্টেম্বরে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুসন্ধানের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয় এবং সকল আরোহীকে মৃত ঘোষণা করা হয়।