‘প্রয়োজনীয়তাই উদ্ভাবনের জনক’- বাস্তব এই সত্যের সাথে আমাদের পরিচয় সেই ছোটবেলা থেকেই, বাংলা দ্বিতীয় পত্রের ভাব-সম্প্রসারণের খাতিরে। যুদ্ধও তেমনই একপ্রকার ‘প্রয়োজন’ এর জন্ম দেয় বিবাদমান পক্ষসমূহের মাঝে। সেই প্রয়োজন মেটাতে তাই সেসব দেশের বিজ্ঞানীরা তখন ঝাঁপিয়ে পড়েন নতুন কিছু উদ্ভাবন করতে, যা তাদের দেশকে যুদ্ধে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল লাভে সহায়তা করবে।
১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত চলা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ মানবজাতিকে এমনই অনেক উদ্ভাবনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। সেগুলোর মাঝে কতগুলো উদ্ভাবনের সুফল ভোগ করছি আমরা আজকের দিনে। এর পাশাপাশি এমন আরও কিছু উদ্ভাবন আছে, যেগুলো একদিকে যেমন উদ্ভট, তেমনই এর চিন্তা মানুষের মাথায় কীভাবে আসলো সেটা চিন্তা করেও আশ্চর্য হতে হয়। আজকের লেখায় আমরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রয়োজনীয়তার পরিপ্রেক্ষিতে নির্মিত এমনই কিছু উদ্ভট উদ্ভাবনের সাথে পরিচিত হবো।
১) গুস্তাভ রেলওয়ে গান
প্রস্তুতকারী দেশ: জার্মানি
সময়কাল: জুলাই ১৯৪২
গুস্তাভ রেলওয়ে গান এতটাই বড় ছিলো যে, একে বলা হয় এখন পর্যন্ত প্রস্তুতকৃত সবচেয়ে বড় বন্দুক। এর ব্যারেলই ছিলো প্রায় ৪৭ মিটার লম্বা। পুরো মেশিনটির ওজন ছিল ১,৩৫০ টন। দৃঢ়ভাবে সুরক্ষিত ম্যাজিনট লাইনের প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে দেবার উদ্দেশ্যে একে বানানো হয়েছিল।
১৯৩৪ সালে জার্মান সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে অস্ত্রটি বানানোর দায়িত্ব দেয়া হয় অস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ক্রুপ এজিকে। তাদেরকে বলা হয়েছিল যেন ১৯৪০ সালের বসন্তের মাঝেই তারা এটি বানিয়ে দেয়, যাতে করে ম্যাজিনট লাইনে আক্রমণের মধ্য দিয়ে ফ্রান্সে আক্রমণের সূচনা করা যায়। কিন্তু বিশালাকার এই বন্দুকের প্রস্তুতকালীন জটিলতার ফলে নির্মাণকাজ শেষ হতে হতে ১৯৪১ সাল লেগে যায়। সেই বছরেই টেস্ট ফায়ারিং শেষে ১৯৪২ সালের শুরুর দিকে সেভাস্তোপোলে এর ব্যবহার শুরু হয়।
মাত্র ৪৮ রাউন্ড গোলাবর্ষণ শেষেই গুস্তাভের ব্যারেলে সমস্যা দেখা দেয়, যেখানে টেস্ট ফায়ারিংয়ের সময় ২৫০ বার গোলাবর্ষণ করতে পেরেছিলো বন্দুকটি। বিশালাকার গুস্তাভকে জায়গামতো রাখতে দরকার পড়তো প্রায় ৪ হাজার মানুষের, আর একেকটি গোলাবর্ষণ করতে দরকার ছিলো পাঁচশো জন লোকের।
২) শেরম্যান ক্র্যাব
প্রস্তুতকারী দেশ: ব্রিটেন
সময়কাল: ১৯৪৪
ব্রিটিশরা অনেকদিন ধরেই এমন একটি ট্যাংক বানাতে চাচ্ছিলো, যার সামনে থাকা ঘূর্ণায়মান সিলিন্ডার এবং সেখানে যুক্ত চেইনের মাধ্যমে রাস্তায় থাকা মাইনের বিষ্ফোরণ ঘটিয়ে পেছনে থাকা বাহিনীর অন্যান্যদের চলাচলের পথ সুগম করে দেয়া সম্ভব। অবশেষে শেরম্যান ক্র্যাবের মাধ্যমেই তাদের এই পরিকল্পনার বাস্তবায়ন ঘটে। দক্ষিণ আফ্রিকার ক্যাপ্টেন আব্রাহাম ডু টোইটকে শেরম্যান ক্র্যাবের পরিকল্পনার জনক বলা হয়। তিনি তার আইডিয়াটি বিভিন্ন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারের সাথে শেয়ার করে বুঝতে চেয়েছিলেন যে, এমন কিছু বানানো সম্ভব কি না। তাদের কাছ থেকে সবুজ সংকেত পেয়েই তিনি ব্রিটেনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন।
প্রাথমিক সংস্করণের গঠনগত জটিলতাগুলো পরবর্তী সংস্করণসমূহে কাটিয়ে ওঠা গিয়েছিল। সামনে থাকা বোমা ধ্বংস করে এগোনোর সময় এটি ঘণ্টায় মাত্র ২ কিলোমিটার বেগে এগোতে পারতো। এভাবে এগিয়ে যাবার সময় অনেক বোমাই ধ্বংস হয়ে যেত। তবে সিলিন্ডারের সাথে যুক্ত চেইনগুলোও প্রায় সময়ই বিষ্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত হতো বিধায় তখন ট্যাংক থামিয়ে সেগুলো মেরামতের প্রয়োজনীয়তাও দেখা দিতো। চমৎকার এই উদ্ভাবনের স্বীকৃতিস্বরুপ ডু টোইট ১৯৪৮ সালে রয়্যাল কমিশনের কাছ থেকে ১৩ হাজার পাউন্ড অর্থ পুরস্কার হিসেবে লাভ করেন।
৩) গোলিয়াথ ট্যাংক
প্রস্তুতকারী দেশ: জার্মানি
সময়কাল: ১৯৪২ সালের প্রথমভাগ
জার্মান এই ট্যাংকগুলোকে মার্কিন সেনারা ডাকতো ডুডলবাগ বলে। ছোটখাট গড়নের এই ট্যাংকগুলো দূর থেকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে শত্রুপক্ষের ট্যাংক বা ক্যাম্পের কাছে পাঠিয়ে এরপর তাতে বিস্ফোরণ ঘটানো হতো। এটি চালানোর জন্য শুরুর দিকে ইলেকট্রিক বা পেট্রোল ইঞ্জিন ব্যবহার করা হলেও পরের দিকে দুটি সিলিণ্ডারবিশিষ্ট মোটরসাইকেলের ইঞ্জিন ব্যবহার করা হতো।
শত্রুপক্ষের ট্যাংক বিস্ফোরণের পাশাপাশি তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা উড়িয়ে দেয়া, ভূমিমাইনে বিস্ফোরণ ঘটানোর মতো কাজে লাগানো হতো গোলিয়াথ ট্যাংককে। সর্বোচ্চ ৬৫০ মিটার দূর থেকে নিয়ন্ত্রণযোগ্য এই ট্যাংক চালাতে একটি তারযুক্ত কন্ট্রোল বক্স ব্যবহৃত হতো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রায় সাড়ে ৭ হাজার গোলিয়াথ ট্যাংক তৈরি করা হয়েছিল।
উপরের অনুচ্ছেদ দুটো পড়ে গোলিয়াথ ট্যাংক সম্পর্কে যদি অনেক বিশাল কিছু ভেবে থাকেন, তবে এখন সেই বেলুন ফুটো করে দেয়া যাক। এই ট্যাংকগুলো তৈরির খরচ ছিলো মাত্রাতিরিক্ত। এত খরচ করে বানানো ট্যাংকগুলো ঘণ্টায় মাত্র ১০ কিলোমিটার বেগে চলতে পারতো। ফলে শত্রুপক্ষের ট্যাংক যদি থেমে না থাকতো, তাহলে সেই ট্যাংকের নাগাল পাওয়া গোলিয়াথের জন্য ছিলো অসম্ভব এক ব্যাপার। আবার এতে ব্যবহৃত তারের সীমিত দৈর্ঘ্যও এখানে বড় ধরনের সমস্যার সৃষ্টি করেছিল। কেউ এই তার কেটে দিলেই গোলিয়াথের চলার আর কোনো উপায় থাকতো না। আবার পাতলা বর্ম ব্যবহার করা হয়েছিল বিধায় স্মল আর্মসের ফায়ারেও গোলিয়াথের বারোটা বেজে যেত।
৪) প্রজেক্ট হাবাক্কুক
প্রস্তুতকারী দেশ: ব্রিটেন
সময়কাল: ১৯৪৩
চলছে যুদ্ধ, দরকার নতুন জাহাজ বানানোর, কিন্তু নেই সেসব জাহাজ বানানোর জন্য দরকারি ইস্পাত, অ্যালুমিনিয়ামের মতো কাঁচামালের সরবরাহ। এমতাবস্থায় চমৎকার এক কৌশল নিয়ে এলেন জিওফ্রে পাইক। তিনি বললেন, জাহাজ বানানো হবে ঠিকই, তবে ইস্পাত-অ্যালুমিনিয়াম দিয়ে না, আইসবার্গ তথা হিমশৈল দিয়ে!
পাইকের প্রস্তাবনানুসারে, সেই আইসবার্গটি প্রাকৃতিকভাবে গঠিত হতে পারে, আবার কৃত্রিমভাবেও তৈরি করা যেতে পারে। এরপর সেটি সুবিধামতো আকৃতি দিয়ে ফাঁপা করে দিতে হবে। পরবর্তীতে বিশালাকার এই বরফখণ্ডই সাগরের বুকে এয়ারক্রাফট পরিবহনের কাজে ব্যবহার করা হবে।
এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে অস্ট্রিয়ান বায়োলজিস্ট ম্যাক্স পেরুৎজের সাথে কাজ শুরু করেন পাইক। কিন্তু তারা দেখতে পান, তাদের কাজের জন্য যে বিশালাকার বরফ দরকার, তাতে নিজের ভারেই বরফটিতে ফাটল ধরতে শুরু করবে। পরবর্তীতে পাইক্রিটের (কাঠ থেকে প্রস্তুতকৃত মণ্ড ও বরফের মিশ্রণ) উদ্ভাবন তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথ সুগম করে দেয়। ফলস্বরুপ কানাডার আলবার্টায় অবস্থিত প্যাট্রিসিয়া লেকে একটি প্রোটোটাইপও নির্মাণে সক্ষম হয়েছিলেন তারা। পাইক্রিট প্লবনশীল ও বেশ দৃঢ় হলেও এর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ইনসুলেশন ও কুলিং সিস্টেমের দরকার ছিলো। আবার বরফ যেন গলে না যায়, সেজন্য রেফ্রিজারেশন সিস্টেমেরও দরকার ছিলো। অবশ্য প্যাট্রিসিয়া লেকে এই প্রোটোটাইপটি একেবারে গলে যেতে প্রায় তিনটি গ্রীষ্মকাল ধরে অপেক্ষা করতে হয়েছিলো।
এমন যুগান্তকারী আইডিয়ার কথা শুনে পাঠকের মনে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসার কথা যে, শেষপর্যন্ত প্রোটোটাইপ থেকে পাইক-পেরুৎজ বাস্তবেই এমন এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার তৈরি করতে পেরেছিলেন কি না। উত্তর- একেবারেই না। কারণ, এই বরফের জন্য দরকারি তাপমাত্রা এত বিশাল অংশ জুড়ে বজায় রাখা ছিলো একেবারেই অসম্ভব বিষয়।
৫) প্যাঞ্জার ৮ মস
প্রস্তুতকারী দেশ: জার্মানি
সময়কাল: ১৯৪৪
জার্মানরা যেন বড় বড় সবকিছু তৈরির রেকর্ডই নিজেদের দখলে রাখতে চাচ্ছিলো। আজকের লেখার শুরুতে গুস্তাভ রেলওয়ে গানের কথা বলা হয়েছিল, যা এযাবতকালে নির্মিত সবচেয়ে বড় বন্দুক। অন্যদিকে তৎকালে নির্মিত ট্যাংকসমূহের মাঝে মস ছিলো সবচেয়ে বড়। ১৮৮ টন ওজনের বৃহদাকার এই ট্যাংকটির বর্মের সবচেয়ে মোটা অংশের পুরুত্ব ২০০ মিলিমিটার পর্যন্ত ছিলো। প্রতিপক্ষের নিকট থেকে তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতির শিকার না হয়েই নিজেদের রাস্তা তৈরি করে নেবার লক্ষ্যেই মূলত এমন দানবাকৃতির ট্যাংক তৈরি করেছিলো জার্মানরা।
তবে এই দানবকে নিয়ে চ্যালেঞ্জও কম ছিলো না। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিলো এর জন্য এমন একটি ইঞ্জিন তৈরি করা, যা এই দানবকে এগিয়ে যেতে সহায়তা করবে। বেশ কিছু ইঞ্জিন দিয়েই চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু প্যাঞ্জার ৮ মসের গতিবেগ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২০ কিলোমিটার পর্যন্ত পৌঁছাতে পেরেছিল। আবার এত বিশাল ওজন নিয়ে কোনো ব্রিজের উপর দিয়েও এটি যেতে পারতো না।
মাত্র পাঁচটি প্যাঞ্জার ৮ মস বানানোর পরিকল্পনা ছিলো জার্মান সেনাবাহিনীর, যার মাঝে মাত্র দুটির প্রোটোটাইপ তৈরি করা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু সোভিয়েত আর্মিরা এদের টেস্টিং গ্রাউন্ড দখল করে নিলে মসের পক্ষে আর যুদ্ধে অংশ নেয়া সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
৬) ফু-গো বেলুন বোম
প্রস্তুতকারী দেশ: জাপান
সময়কাল: ১৯৪৪
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিলেও মিত্রপক্ষের অন্যান্য দেশের তুলনায় তাদের দেশের নাগরিকেরা বেশ নিরাপদই ছিলো, নিরাপদে ছিলো তাদের শহরগুলো। এর পেছনে মূল কারণ ছিলো শত্রুপক্ষ ও তাদের মাঝে বিদ্যমান বিশাল সমুদ্র।
বিষয়টি নজর এড়ায়নি জাপানের। তাই তারা এমন কিছু একটা করতে চাইলো, যাতে করে বিশাল এই দূরত্ব অতিক্রম করেও আমেরিকান জনগণের ক্ষয়ক্ষতি করা যায়, ধ্বংস করা যায় তাদের নানা স্থাপনা, সর্বোপরি ভয় ধরিয়ে দেয়া যাক দেশটির জনগণের মনে। এ লক্ষ্যেই তারা ফু-গো বোম বানায়। কাগজ দিয়ে তৈরি বেলুনগুলোর বিভিন্ন অংশ জোড়া লাগাতে ব্যবহার করা হয়েছিলো আলু থেকে প্রস্তুতকৃত ময়দা। এরপর সেখানে ভরে দেয়া হয়েছিলো থার্মাইট বোম।
জাপানী বিজ্ঞানীরা ভেবেছিলো, এই বোমগুলো আমেরিকা পর্যন্ত উড়ে গিয়ে বিস্ফোরণে বিস্ফোরণে কাঁপিয়ে তুলবে আমেরিকান জনগণের জীবন, আগুনের লেলিহান শিখায় দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকবে দেশটির নানা শহর। কিন্তু বাস্তবতা হলো, অল্প সংখ্যক বেলুনই আমেরিকা পর্যন্ত যেতে পেরেছিল। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিলো একেবারেই নগণ্য। আর আমেরিকান জনগণের মনে ভয় ধরিয়ে দেয়ার যে চিন্তা জাপানী বিজ্ঞানীরা করেছিলেন, তার সামান্যতম অংশও পূরণ হয়নি।