আপনি কি ভ্যাম্পায়ারে বিশ্বাস করেন? সত্যিকারের ড্রাকুলার গল্প শুনেছেন কখনো? সুধীবৃন্দ, আপনাদের সামনে আজ উপস্থাপন করা হচ্ছে রিচার্ড চেজকে। না, তিনি বিখ্যাত কোনো ব্যক্তি নন। বরং কুখ্যাত মানুষদের তালিকায় বেশ উপরের দিকে আছে তার নাম। ৭০ এর দশকের শেষদিকে উত্তর ক্যালিফোর্নিয়ায় রীতিমতো ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে রাখা এই ব্যক্তি একজন সিরিয়াল কিলার। জ্যাক দ্য রিপার কিংবা জেফরি ড্যাহমারের মতো অতটা সাড়া জাগানিয়া না হলেও রিচার্ড চেজের উন্মত্ততা আপনাকে নিয়ে যাবে হরর গল্পের রাজ্যে।
১৯৫০ সালের ২৩ মে জন্মগ্রহণ করা এই সিরিয়াল কিলার পুলিশের খাতা থেকে সাধারণ জনগণ- সবার কাছে পরিচিত ‘সেক্রামেন্তোর ভ্যাম্পায়ার’ কিংবা ‘দ্য ভ্যাম্পায়ার কিলার’ নামে। জন্মসূত্রে নাম তার রিচার্ড ট্রেনটন চেজ। আক্ষরিক অর্থেই সে ছিল ভ্যাম্পায়ার। হ্যাঁ, খুন করে ভিক্টিমদের রক্ত চুষে খেত সে। তাছাড়া ন্যাক্রোফিলিয়াক বা মৃতদেহের সাথে সংগমকারী হিসেবেও কুখ্যাত সে। সেক্রামেন্তো শহরে নিজের সাম্রাজ্য গড়ে তোলে রিচার্ড। স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ এই সিরিয়াল কিলারের ভিক্টিমের সংখ্যা কিন্তু মাত্র ৬। অথচ ছোট্ট এই সংখ্যার পেছনে লুকিয়ে আছে কত বড় নৃশংসতা, তা কল্পনাতীত।
রক্ষণশীল পরিবারের সন্তান রিচার্ড ছোটবেলা থেকেই বাবার কাছে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়। বাবার প্রতি ভয় থেকে তার মধ্যে তৈরি হয় মানসিক বৈকল্য। শৈশবে হাতে তুলে নেয় অ্যালকোহলের বোতল, পাশবিক নির্যাতন চালায় জীবজন্তুর উপর আর আগুন লাগিয়ে দেয় যত্রতত্র। টিনএজার হিসেবে সে তার স্বাভাবিক যৌন জীবনযাপন করার জন্য বেছে নেয় ভয়ংকর কিছু বদভ্যাস, যার মধ্যে রয়েছে নেক্রোফোলিয়া বা মৃতের সাথে সহবাস থেকে শুরু করে প্রাণীহত্যা পর্যন্ত নানা কিছু। এই সময় থেকেই তার মধ্যে গড়ে ওঠে নানা ধরনের বিভ্রম এবং তার বাবা তাকে জোরপূর্বক আলাদা অ্যাপার্টমেন্টে পাঠিয়ে দেন। নিজের বাড়িতে উঠে তার পৈশাচিকতার মাত্রা বেড়ে যায় আরেক কাঠি। নিজ হাতে প্রাণী হত্যা করে কাঁচাই সেগুলো খাওয়া শুরু করে রিচার্ড!
ম্যাকডোনাল্ড ট্রেইডের মতে, একটি শিশুর মধ্যে যদি তিনটি লক্ষণ দেখা যায় তবে তার সোশিওপ্যাথ হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। চেজের শৈশবে এই তিনটি লক্ষণ খুব স্পষ্টভাবেই ধরা পড়ে। আট বছর বয়স পর্যন্ত নিয়মিত বিছানা ভেজাতো সে, দশ বছর বয়সী চেজের প্রধান আকর্ষণ ছিল আগুন আর প্রাণীহত্যার প্রতি। জেফরি ড্যাহমারের মধ্যেও ঠিক এই বৈশিষ্ট্যগুলোই খুঁজে পাওয়া যায়। সোশিওপ্যাথ বা সাইকোপ্যাথরা সমাজে প্রচলিত নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করে না, তাদের ভেতর আশপাশের কারো প্রতি কোনো সহানুভূতি কাজ করে না। ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করা, সহিংসতা, অন্যকে আঘাত করে মানসিক তৃপ্তি অর্জন করা, নিজের অপরাধে অনুতপ্ত না হওয়া- মোট কথা, সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষ যা করার কথা ভাবতেও পারে না, তাতেই নিজের সর্বস্ব সুখ খুঁজে নেয়া সাইকোপ্যাথে পরিণত হয় চেজ।
ছোটবেলা থেকেই নেশাজাতীয় দ্রব্য এবং অ্যালকোহলে আসক্ত হয়ে পড়ে চেজ। তার প্রথম অ্যাপার্টমেন্টের জানালায় দাঁড়িয়ে দিব্যি এলএসডি গ্রহণ করতো সে, মারিজুয়ানার ধোঁয়া ছাড়ত অবলীলায়। কেউ দেখে ফেলবে কিংবা এতে তার ক্ষতি হবে, এসব ভয় একবারও কাজ করতো না রিচার্ডের মধ্যে। সব মিলিয়ে তার মধ্যে হাইপোকন্ড্রিয়া, প্যারানয়েড স্কিৎজোফ্রেনিয়ার স্পষ্ট লক্ষণ দেখা যায়। ধ্বংসাত্মক এই মানসিক ব্যাধিগুলোর কারণে একজন মানুষ কতটা নিচে নামতে পারে বা সমাজে বাজে প্রভাব ফেলতে পারে, তার নমুনা স্বরূপ পোস্টার বয় খেতাব অর্জন করে চেজ।
১৯৭৫ সালে প্রথমবারের মতো তাকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে চিকিৎসা প্রদান করার উদ্যোগ নেয়া হয়। চলতে থাকে ভারি ডোজের সাইকোট্রোপিক ড্রাগ। মানসিক চিকিৎসাকেন্দ্রে থাকাকালীন অবস্থায়ও চলতে থাকে তার প্রাণীহত্যা। চিকিৎসকরা ঘাবড়ে গিয়ে তাড়াহুড়ো করে তাকে বিদায় দিয়ে দেয়। অসম্পূর্ণ থেকে যায় তার চিকিৎসা। হঠাৎ করে অ্যান্টি-স্কিজোফ্রেনিয়ার ওষুধ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তার ব্যবহারে আসে আরও খারাপ পরিবর্তন। নিজের শরীরের কথা ভুলে গিয়ে সে উন্মাদ হয়ে ওঠে বন্দুক নিয়ে। খুব শীঘ্রই একদিন প্রতিবেশীদের বাড়ি থেকে তার রক্তাক্ত শরীর উদ্ধার করা হয়, পাগলের মতো চিৎকার করছিল রিচার্ড।
১৯৭৭ সালে তার ০.২২ পিস্তল দিয়ে পাশের বাড়ির রান্নাঘরে গুলি চালায় রিচার্ড। কেউ হতাহত হয়নি, কিন্তু তার নিজের মধ্যেই যেন ঘটে যায় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন। খুনের নেশা পেয়ে বসে তাকে। দুই দিন পরেই অ্যাম্ব্রোস গ্রিফিন নামক এক ড্রাইভারকে খুন করে খুনির খাতায় নাম লেখায় রিচার্ড। দরজা ভাঙা, অনধিকার অনুপ্রবেশ, চুরি ও বিকৃত যৌনাচার চলতে থাকে তার পাশাপাশি।
১৯৭৮ সালের জানুয়ারি মাসে ডেভিড এবং টেরেসা ওয়ালিনের ঘরের দরজা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে রিচার্ড। ডেভিড তখন কাজে ছিল। ময়লা ফেলতে বাড়ির উঠানে গিয়েছিল টেরেসা। সেখানেই ব্রাশফায়ার করে তার শরীর ঝাঁঝরা করে ফেলে রিচার্ড। মাথার একটি ক্ষত থেকেই মৃত্যু হয় টেরেসার। টেরেসার মৃতদেহের সাথে সঙ্গমে লিপ্ত রিচার্ড তার শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ থেকে রক্ত চুষে খেতে থাকে। সেই রক্তে স্নানও করে সে। ছুরি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তার শরীর থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ করে রিচার্ড। কুকুরের মল মৃতের মুখে ঢুকিয়ে সে দফা টেরেসাকে এক প্রকার মুক্তি দেয় সে।
তারও ঠিক দু’দিন পর, এভিলিন মিরোথের বাড়িতে প্রবেশ করে চেজ। বাইশ মাস বয়সী ভাতিজা ডেভিডকে ঘুম পাড়াচ্ছিল এভিলিন। সাথে ছিল ছয় বছরের ছেলে জ্যাসন আর প্রতিবেশী ড্যান মেরেডিথ। একই পিস্তল ব্যবহার করে সবার আগে ড্যানের মাথায় গুলি করে রিচার্ড, এরপর একে একে খুন করে বাচ্চা দুটোকে। সবশেষে এভিলিনকে হত্যা করে তার লাশের সাথে মিলিত হয় রিচার্ড, তার গলা চুষে রক্ত পান করে। তলপেটে ছুরি চালিয়ে বইয়ে দেয় রক্তের বন্যা, গোসল করে সেই রক্তে। মানসিক বিকারগ্রস্ত এই সিরিয়াল কিলার নিজের পরিচয় লুকানোর কোনো চেষ্টাই করেনি। ঘরভর্তি প্রমাণ রেখে ক্রাইম সিন থেকে বেরিয়ে আসে সে। ছোট্ট ডেভিডের মৃতদেহ চুরি করে তার মগজ, রক্ত খেতে থাকে নির্বিচারে। বিভিন্ন অঙ্গচ্ছেদ করে শিশুটির অবশিষ্ট দেহাংশ ফেলে দিয়ে আসে নিকটবর্তী চার্চে।
এতো এতো প্রমাণ ফেলে আসায় খুব সহজেই তাকে শনাক্ত করে পুলিশ। তার অ্যাপার্টমেন্টের চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ভিক্টিমদের শরীরের বিভিন্ন অংশ উদ্ধার করে তারা। এছাড়া রক্তের দাগ লাগানো কাপড়, ব্লেন্ডার, তার সেই বহুল ব্যবহৃত ০.২২ ক্যালিবারের পিস্তল, থালা-বাসনে লেগে থাকা মানুষের মগজের দাগ, ফ্রিজে রাখা রক্ত- এক নজরেই পুলিশকে বুঝিয়ে দেয় এই লোককেই এতোদিন ধরে খুঁজছিল তারা। সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হলো, যে ক’টি হত্যাকাণ্ড সে ঘটিয়েছে, সেই দিনগুলোতে তার ঘরে ঝুলানো ক্যালেন্ডারে লাল কালি দিয়ে বড় করে দাগ দিয়ে রেখেছিল ‘টুডে’ (আজ) লিখে। ঠিক একইভাবে দাগানো ছিল পরবর্তী খুনের সম্ভাব্য আরও ৪৪ দিন!
রিচার্ডকে গ্রেপ্তার করে আদালতে নেয়া হলে বিচারক গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন। ১৯৭৯ সালের ৮ মে, এভাবে ধুঁকে ধুঁকে মরার চেয়ে একবারে মরে যেতে অ্যান্টি-ডিপ্রেশনের ওভারডোজ ওষুধ সেবন করে প্রাণত্যাগ করে নির্মম এই ভ্যাম্পায়ার সিরিয়াল কিলার।