দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত ‘ক্রসওয়ার্ড পাজেল’ বা ‘শব্দজট ধাঁধা’ অনেকেই খেলে থাকেন। আবার অনেকে না খেললেও পত্রিকা খুললে ক্রসওয়ার্ড নিশ্চয়ই দেখে থাকবেন। শব্দে-শব্দে ধাঁধা খেলা কালের বিবর্তনে পত্রিকার পাতায় শব্দজট বা ক্রসোয়ার্ড পাজেল হিসেবে ছাপানো শুরু হতে থাকে। কোনো নির্দিষ্ট দিনের পত্রিকায় প্রকাশিত শব্দজট ধাঁধার উত্তর, পরের দিনের সংখায় প্রকাশিত হয়। আর এই শব্দে-শব্দে ধাঁধার আড়ালেই ২য় বিশ্বযুদ্ধের রণকৌশল ফাঁস হয়ে যাওয়ার ঘটনাও ইতিহাসে ঘটেছে! ভাবছেন গুপ্তচরের কাজ? নাকি কাকতালীয়? তাই এই ঘটনাকে ঘিরে তৈরি হয়েছে রহস্য। রহস্যের জট কিছুটা খুললেও কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি যে, এটি কোনো গুপ্তচরের কাজ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার পর, প্রথম থেকে হিটলারের নাৎসি বাহিনী দাপটের সাথে ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চল দখল করে নিচ্ছিলো। ১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত চলাকালীন এই যুদ্ধে, প্রথম প্রায় ৫ বছর জার্মানি তেমন কোনো পরাজয়ের শিকার হয়নি। ব্রিটেন এবং রাশিয়া বাদে ইউরোপের প্রায় পুরোটাই চলে গিয়েছিল নাৎসিদের দখলে!
১৯৪৪ সালের ৬ জুন। ব্রিটিশ, মার্কিন এবং কানাডিয়ান সেনাবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত মিত্রবাহিনী ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে ফ্রান্সের নরম্যান্ডি উপকূলে জার্মান নাৎসি বাহিনীর উপর আক্রমণ করে। নরম্যান্ডি যুদ্ধে মিত্রবাহিনীর জয়ের মাধ্যমে শুরু হয় ২য় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানদের পরাজয়ের ইতিহাস। বহু আকাঙ্ক্ষিত এই ব্যাটল অফ নরম্যান্ডির মিত্রবাহিনীর রণকৌশলের গোপন ৮টি সাংকেতিক নাম (Codename) কিনা যুদ্ধের আগেই ফাঁস হয়ে গিয়েছিল পত্রিকার শব্দজট ধাঁধার উত্তরে!
সংক্ষেপে নরম্যান্ডি আক্রমণ ও কিছু সাংকেতিক নাম
নরম্যান্ডি আক্রমণের স্থান হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছিল ফ্রান্সের উত্তরে অবস্থিত নরম্যান্ডির সমুদ্র উপকূলকে, যেখানে কোনো স্থায়ী সমুদ্রবন্দর নেই। নরম্যান্ডি উপকূলই ছিল জার্মানদেরকে ধোঁকা দেয়ার উত্তম জায়গা। তাই এই আক্রমণকে নরম্যান্ডির আক্রমণ নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। আর মিত্রবাহিনীর সেনারা সাংকেতিক নাম দিয়েছিল অপারেশন ওভারলর্ড (Operation Overlord)। কোন দিক দিয়ে আক্রমণ করা হবে ঠিক হয়ে যাওয়ার পর এবার আক্রমণের দিন ঠিক করার পালা।
মিত্রবাহিনীর কমান্ডার, জেনারেল আইসেনয়াওয়ার গুপ্তচরের মাধ্যমে জেনে গিয়েছিলেন যে, ১৯৪৪ সালের ৫ জুন থেকে বিপক্ষ বাহিনীর সেনা কমান্ডার মার্শাল রোমেল ছুটিতে থাকবেন। পাশাপাশি পূর্ণিমা এবং জোয়ারের পানির উচ্চতা কম থাকবে বলে মিত্রবাহিনীর পরিকল্পনা অনুসারে, ৫ তারিখেই আক্রমণের দিন ধার্য করা হয়েছিল। সামরিক সৈন্যরা এই দিনকে ঘিরেই তদের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কিন্তু ৫ তারিখে খারাপ আবহাওয়ার কারণে আক্রমণের দিন একদিন পিছিয়ে ৬ তারিখ করা হয়। এই দিনটিকে সাংকেতিক ভাষায় মিত্রবাহিনী ডি-ডে (D-Day) নামে ডাকতো।
তারা পুরো নরম্যন্ডি উপকূলকে ৫টি সমুদ্র সৈকতে ভাগ করে করে, বিপুল পরিমাণ সেনা এবং গোলাবারুদ সহ আক্রমণের ছক সাজিয়েছিলেন। এই পাঁচটি সমুদ্রসৈকতের সাংকেতিক নাম হলো ওমাহা (Omaha), উতাহ (Utah), প্লুটো (Pluto), গোল্ড (Gold) এবং সোর্ড (Sowrd)। এছাড়াও আক্রমণের জন্য একটি অস্থায়ী ভাসমান সমুদ্রবন্দর তৈরি করেছিল মিত্রবাহিনী। যার সাংকেতিক নাম ছিল মালবেরি (Mulberry)। আর সমুদ্রপথে সামগ্রিক নৌবহরের সাংকেতিক নাম ছিল নাম ছিল নেপচুন (Neptune)।
৬ তারিখ ভোরের আগেই মিত্রবাহিনীর প্রায় ৫ হাজার যুদ্ধজাহাজ গোপনে ইংলিশ চ্যানলেল পাড়ি দেয়। প্রায় ১ লক্ষ ৫৬ হাজার সৈন্য, ৩ হাজার সমরযান নরম্যান্ডি উপকূলে পৌঁছায়। এবং এক দিনের মধ্যে পূর্ব নির্ধারিত ৫টি সৈকতে আক্রমণ চালায়। এক দিনের মধ্যে, সহজেই এই জায়গাগুলোতে নিজেদের ঘাঁটি শক্ত করে ফেলে মিত্রবাহিনী। উতাহ সৈকতে জার্মানদের জোরালো প্রতিরক্ষা সত্ত্বেও প্রথমদিন মিত্রবাহিনীই এগিয়ে থাকে। এরপর এক সপ্তাহে মিত্রবাহিনীর প্রায় ৩ লক্ষ ২৬ হাজার সৈন্য, ৫০ হাজার যুদ্ধ বাহন এবং ১ লাখ টন গোলাবারুদ সহ পুরো নরম্যান্ডির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। আগস্টের মধ্যে ফ্রান্সকে জার্মান নাৎসি বাহিনীর হাত থেকে মুক্ত করে মিত্রবাহিনী।
প্রথমবারের মতো যুদ্ধে পিছু হটে জার্মানি। এই নরম্যান্ডির যুদ্ধকে বলা হয় মিত্রবাহিনীর জয়ের সূচনা। এই জয় দিয়েই পুরো ২য় বিশ্বযুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়। এর পরের এক বছর যুদ্ধ ছিল মিত্রবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। সবশেষে ১৯৪৫ এর মে মাসে, আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধে পরাজয় মেনে নেয় জার্মানি।
শব্দজট ধাঁধায় যুদ্ধের সংকেত ফাঁসের রহস্য
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেয়া নরম্যান্ডি আক্রমণ বা অপারেশন ওভারলর্ডের সাংকেতিক নামগুলো। মিত্রবাহিনীর আক্রমণের আগেই অর্থাৎ ডি ডের আগেই তৎকালীন ব্রিটিশ পত্রিকা দ্য টেলিগ্রাফের ক্রসওয়ার্ড বা শব্দজট ধাঁধার উত্তরে ফাঁস হতে থাকে। সে বছর ফেব্রুয়ারি মাসে দ্য টেলিগ্রাফের শব্দজট ধাঁধার একটি উত্তর ছিল JUNO। মার্চ এবং এপ্রিল মাসেও টেলিগ্রাফের দুটি শব্দজট ধাঁধার উত্তর ছিল যথাক্রমে GOLD এবং SWORD। এই তিনটিই নরম্যান্ডি আক্রমণের তিনটি সমুদ্রসৈকতের সাংকেতিক নাম। শব্দগুলো সাধারণ শব্দ হওয়ার কারণে হয়ত সেনা সদস্যদের চোখে পড়েনি। বা পড়লেও গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু ঘটনা যদি এইখানেই শেষ হতো, তাহলে কাকতালীয় বলে উড়িয়ে দেওয়া যেতো।
২ মে, ১৯৪৪, দ্য টেলিগ্রাফের শব্দজট ধাঁধার ৪ অক্ষরের একটি শব্দের সূত্র (Clue) One of the US (4)। মার্কিন বাহিনীর একজন কাউন্টার গুপ্তচর কর্মকর্তা সেদিন টেলিগ্রাফের ক্রসওয়ার্ডের সমাধান করছিলেন। তিনি এই সূত্র দেখেই বুঝতে পেরেছিলেন এর উত্তর হবে Utah, যা কিনা নরম্যন্ডি আক্রমণে, মার্কিন বাহিনীর অবতরণের নির্ধারিত সমুদ্র সৈকতের সাংকেতিক নাম! পরদিন তিনি উত্তর মিলিয়ে দেখেন, উত্তরে Utah ই লেখা! এরপরই টনক নড়ে মিত্রবাহিনীর।
এর তিন সপ্তাহ পর, ২২ মে ১৯৪৪। আক্রমণের মাত্র এক সপ্তাহের মতো বাকি। সেদিন একই পত্রিকা, দ্য টেলিগ্রাফের ক্রসওয়ার্ড ধাঁধার একটি ক্লু Red Indian on the Missouri River (5)। নিঃসন্দেহে এর উত্তর হবে OMAHA (স্থানীয় রেড ইন্ডিয়ানদের ওমাহা গোষ্ঠী বলে) যা কিনা নরম্যান্ডি আক্রমণের আরেকটি সাংকেতিক নাম। ঘটনা আরো সঙ্কটাপন্ন হয়ে ওঠে ৫ দিন পর। ২৭ মে টেলিগ্রাফের এই ক্রসোয়ার্ড ধাঁধাঁরও একটি সূত্র ছিল BIG WIG (8), আর পরের দিনের পত্রিকায় এই ধাঁধার উত্তর ছিল- Overlord! যা কিনা পুরো নরম্যান্ডি অপারেশনের সাংকেতিক নাম! এরই ধারাবাহিকতায় ৩০ মে এবং ১ জুন ১৯৪৪, টেলিগ্রাফের শব্দজট খেলায় দুটি ধাঁধার উত্তর ছিল যথাক্রমে Mulberry এবং Neptune!
নরম্যান্ডি আক্রমণের ৮টি সাংকেতিক নামই পত্রিকার পাতায় চলে এলো ধাঁধার ছলে! তাহলে কি জার্মান বাহিনী কোনো গুপ্তচরের সাহায্য নিয়েছে? নাকি টেলিগ্রাফের শব্দজট যে ব্যক্তি তৈরি করেন তিনিই মিত্রবাহিনীর সাথে বেইমানি করেছেন? ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর কাউন্টার ইন্টিলিজেন্স এমআই-৫ এর দুই কর্মকর্তা দ্য টেলিগ্রাফের ক্রসওয়ার্ড ধাঁধা প্রণেতা, লিওনার্ড ডাউইকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য খুঁজে বের করেন।
লিওনার্ড ডাউই ছিলেন ইংল্যান্ডের বুকহামে অবস্থিত স্ট্র্যান্ড বয়েজ স্কুলের প্রধান শিক্ষক। তিনি ১৯২৪ সাল থেকে দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকার শব্দজট ধাঁধা তৈরি করার কাজ করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলে এই স্কুলটির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে, এটিকে এফিংহামের সারেতে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। ছাত্রদের পাশাপাশি শিক্ষক হিসেবে লিওনার্ড ডাউইও সেখানে বদলি হয়ে গিয়েছিলেন। কাউন্টার ইন্টিলিজেন্স কর্মকর্তারা লিওনার্ড ডাউইকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তিনি তার তৈরি শব্দজটে এই ৫টি শব্দ কেন বেছে নিয়েছিলেন?
উত্তরে লিওনার্ড বলেছিলেন, কেন নিতে পারবো না? শব্দজটের ধাঁধায় শব্দ বাছাই করার জন্য কি কোনো আইন রয়েছে?
সেদিন লিওনার্ড ডাউই ব্রিটিশ ঐ দুই কর্মকর্তাকে বুঝাতে পেরেছিলেন যে, আসলেই তিনি নরম্যান্ডি আক্রমণ সম্পর্কে কিছু জানেন না। জগতে কাকতালীয় বলে যদি কিছু থেকে থাকে, তার বেলায়ও একই ব্যাপার ঘটেছে। এরপর কেটে গেছে ১৪ বছর। ১৯৫৮ সালে বিবিসির এক সাক্ষাৎকারে এই রহস্য নিয়ে মুখ খোলেন ডাউই নিজেই। তিনি সেই সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন,
ডি ডে’র পরদিন, অর্থাৎ নরম্যান্ডি আক্রমণের পরদিন দুই সেনা কর্মকর্তা স্ট্রান্ড স্কুলে এসে আমাকে আগাগোড়া জিজ্ঞাসাবাদ করেও তেমন কিছু উদ্ধার করতে পারেননি। তবে আমার ভাগ্য ভাল এতবড় ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরও, তারা আমাকে গুলি করে মেরে ফেলেনি!
ডাউইর এমন বক্তব্যে রহস্য আরো পাকাপোক্ত হয়ে উঠলো। মানুষ হয়তো ধরেই নিয়েছিল পুরো কাকতালীয় ঘটনা।
আসল রহস্য উন্মোচন
ডাউইর বিবিসি সাক্ষাৎকারের পর প্রায় ৪ দশক এই ঘটনা কেবলই রহস্য হয়ে ছিল সবার কাছে। কিন্তু কীভাবে ডাউই এই সাংকেতিক নামগুলো পেয়েছিল, সেই রহস্য কিছুটা উন্মোচন করেছিলেন স্ট্রান্ড স্কুলের তৎকালীন শিক্ষার্থী রোনাল্ড ফ্রেঞ্চ। স্ট্রান্ড স্কুলের ঠিক পাশেই ছিল মার্কিন এবং ব্রিটিশ সেনাদের ঘাঁটি। সেখানে প্রায়ই ছাত্রদের সাথে সেনা সদস্যদের দেখা হতো, কখনো কথা হতো। সেনা সদস্যরাও কোমলমতি ছাত্রদের সামনে যুদ্ধ নিয়ে আলাপ করতে তেমন একটা গোপনীয়তা বজায় রাখতেন না। ঐ স্কুলের আরেক শিক্ষার্থী ব্রায়ান বেলফোর্ট সেই সময়ের কথা স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন,
সেনা সদস্যরা সেখানে খুব একাকিত্বে ভুগতো। তারা তাদের বাড়িতে নিজের সন্তান রেখে যুদ্ধে নেমেছিল। তাই আমরা মাঝে মাঝে তাদের সাথে গল্প করতাম, তারা কেউ কেউ আমাদেরকে চকলেটও দিয়েছিল।
১৯৮৪ সালে ডি ডের ৪০ বছর পূর্তির কিছুদিন পর রোনাল্ড ফ্রেঞ্চ স্বীকার করেন, ডাউই প্রায়ই তার ছাত্রদেরকে মেন্টাল ডিসিপ্লিন ক্লাসে শব্দজট ধাঁধার ফাঁকা ছক বা খালি ক্রসোয়ার্ড বক্সে শব্দ বসানোর কাজ দিতেন। ছাত্ররা ইচ্ছামতো শব্দ বসিয়ে পূরণ করলে, তিনি প্রতি শব্দের জন্য ধাঁধা বা ক্লু তৈরি করতেন। রোনাল্ড নিজেও ছিলেন এই দলে। সবচাইতে অবিশ্বাস্য ব্যাপার হচ্ছে এই কোড নামগুলো রোনাল্ডের হাত ধরেই ডাউইর মেন্টাল ডিসিপ্লিনারি ক্লাসে পূরণ করা ফাঁকা ক্রসওয়ার্ড বক্সে ঢুকে গিয়েছিল।
রোন্যাল্ড তার স্বীকারোক্তিতে বলেছিলেন, সেনা সদস্যদের আশেপাশে থাকতো বলে, তাদের সম্পর্কে অনেক কিছুই জানতো স্কুলের ছাত্ররা। রোন্যাল্ড সেনা সদস্যদের কথাবার্তা থেকে যখন যা জানতেন বা শিখতেন, তা ব্যক্তিগত নোটবুকে তুলে রাখতেন। উতাহ, ওমাহা এই দুই সাংকেতিক নামের সাথে অপারেশনের সাংকেতিক নাম যে ওভারলর্ড, তা তিনি সেনা সদস্যদের কথোপোকথন শুনে জানতে পেরেছিলেন। কিন্তু এগুলো ডাউইর মেন্টাল ডিসিপ্লিনারি ক্লাসের, শব্দজট বক্সে লিখলে যে পত্রিকার পাতায় চলে আসবে এবং যুদ্ধের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে তা তিনি কৈশোরে ছাত্রাবস্থায় বুঝতে পারেননি। রোনাল্ড আরো বলেন,
ডি ডের ঠিক পরদিন আমাদের প্রধান শিক্ষক লিওনার্ড ডাউইকে জিজ্ঞাসাবাদের পর, তিনি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। ক্রসওয়ার্ডের শব্দগুলোর উৎস জানতে চাইলে, ডাউইকে আমি আমার নোটবুক দেখিয়েছিলাম। ডাউই সাথে সাথে আমাকে ঐ নোটবুক পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিলেন। বাইবেলে হাত রেখে শপথ করিয়েছিলেন, এই নোটবুকের কথা যেন কেউ কখনো জানতে না পারে। যদিও আমার ঠিক মনে নেই কোন কোন সাংকেতিক নামগুলো আমার মাধ্যমে শব্দজটের মধ্যে ঢুকেছিল।
অনেকের বিশ্বাস সবগুলো সাংকেতিক নামই রোন্যাল্ডের মাধ্যমে শব্দজটের ধাঁধায় জায়গা করে নিয়েছিল। এরপর রোনাল্ডের পুত্র সাইমন এই ব্যাপারে মুখ খোলেন। তিনি বলেন,
আমার বাবার স্বীকারোক্তির পর, কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের কর্মকর্তারা আমার বাবাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলেন। কিন্তু অপারেশন নরম্যান্ডির কোড নামগুলো ফাঁস হয়ে যাওয়ার পরও যেহেতু কোনো অঘটন ঘটেনি। তাই তারা ব্যাপারটিকে আমার বাবার কৈশোর সময়কার নিরীহ উত্তেজনার কাজ হিসেবে বিবেচনা করে তাকে নির্দোষ হিসেবে ছেড়ে দিয়েছেন।
রোনাল্ডের স্বীকারোক্তি না হয় তাকে নির্দোষ প্রমাণ করেছে। কিন্তু সেই স্কুল শিক্ষক লিওনার্ড ডাউই সম্পর্কে একটি তথ্য দিয়ে লিখাটি শেষ করি। ১৯৪২ সালের ১৯ আগস্ট, মিত্রবাহিনী জার্মান নাৎসিদের রণকৌশল যাচাই করার জন্য একটি পরীক্ষামূলক আক্রমণ অভিযান চালিয়েছিলো। যে স্থানে এই অভিযান চালানো হয়েছিল সেই জায়গাটির নাম ডিপি (Dieppe)। জার্মানদের তোপের মুখে এই আক্রমণ পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছিল। এতটাই ব্যর্থ হয়েছিল যে, ব্রিটেনে ব্যর্থতার সমার্থক শব্দ হয়ে উঠেছিল ডিপি। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, ডিপি অভিযানের দুইদিন আগে, ১৭ আগস্টে দ্য টেলিগ্রাফের শব্দজট ধাঁধার একটি শব্দ ছিল Dieppe! যা কিনা ১৮ আগস্টের পত্রিকায় উত্তর হিসেবে ছাপা হয়েছিল। আরো রহস্যময় ব্যাপার হচ্ছে, এই শব্দজট ধাঁধার প্রণেতাও ছিলেন লিওনার্ড ডাউই!
ডাউইকে স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে সবাই খুব ভাল মানুষ হিসেবেই জানতেন। কিন্তু তার রাজনৈতিক মতাদর্শ সম্পর্কে কেউই তেমন কিছু জানতেনই না! কেউ কেউ মনে করেন, তিনি ব্যক্তিগতভাবে হিটলারকে কিছুটা পছন্দ করতেন! যেহেতু এখন আর যুদ্ধের দামামা নেই, ভয়ে আতংকিত হবার মতো কিছু নেই। তাই এইটুকু রহস্য না হয় রহস্য হয়েই থাকুক!