রুয়ান্ডা গণহত্যা: মানবতার এক কলঙ্কিত অধ্যায়

১৯৯৪ সালের এপ্রিল এবং জুনের মাঝামাঝি ১০০ দিনের ব্যবধানে প্রাণ হারিয়েছিলো রুয়ান্ডার প্রায় ৮ লাখ নাগরিক। গণহত্যার স্বীকার হওয়া বেশিরভাগ লোকই ছিলো সংখ্যালঘু তুতসি। আর গণহত্যা পরিচালনাকারীরা ছিলো হুতু। যদিও রুয়ান্ডাতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছিলো নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার, কিন্তু তারপরও এত অল্প সময়ের ব্যবধানে এই বিশাল সংখ্যক মানুষকে হত্যা করার কথা চিন্তা করাও ছিলো কল্পনাতীত।

এভাবেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলো অগণিত লাশ; ছবিসূত্র: emaze.com

এই গণহত্যা কেন সংঘটিত হয়েছিলো সেটির প্রধান কারণ জানতে হলে আমাদেরকে ফিরে যেতে হবে আরো ৭৮ বছর আগে। ১৯১৬ সালে বেলজিয়াম সেনাবাহিনী দখল করে নেয় পূর্ব আফ্রিকার এই ছোট সবুজ দেশটিকে। জাতিগতভাবে রুয়ান্ডাতে সংখ্যাগুরু হুতু এবং সংখ্যালঘু তুতসি এই দুই সম্প্রদায়ের লোক বাস করতো। চালচলন এবং আচার-আচরণের দিকে থেকে দুই সম্প্রদায়ের লোকই একইরকম ছিলো। তারা একই ভাষায় কথা বলতো, একই এলাকায় থাকতো; কিন্তু দেখতেই কেবল কিছুটা ভিন্ন ছিলো। তুতসিরা ছিলো হুতুদের চেয়ে কিছুটা লম্বা এবং চিকন গড়নের। প্রচলিত আছে, তুতসিদের আদি বাসস্থান হচ্ছে ইথিওপিয়াতে, সেখান থেকে তাদের আদি পুরুষরা রুয়ান্ডাতে পাড়ি জমায়। এই নিয়ে দুই সম্প্রদায়ের মাঝে অনেক আগে থেকেই দ্বন্দ্ব বিদ্যমান ছিলো।

ছবিতে দুজন তুতসি এবং হুতু পাশাপাশি; ছবিসূত্র: The New York Times

বেলজিয়াম ক্ষমতা দখলের পর প্রশাসনিক কাজ চালাতো বেলজিয়ামের কর্মকর্তারাই। তারা এসে রুয়ান্ডার নাগরিকদেরকে সম্প্রদায়ের উপর ভিত্তি করে দু’রকম পরিচয়পত্র দেওয়ার নিয়ম প্রচলন করে। এতে তুতসি এবং হুতুদের মাঝে ভেদাভেদ তৈরি হয়। যেখানে তাদের একমাত্র পরিচয় হওয়ার কথা ছিলো রুয়ান্ডার নাগরিক, সেখানে তারা এখন আনুষ্ঠানিকভাবে হুতু এবং তুতসি দুই গোত্রে বিভক্ত হয়ে গেল। বেলজিয়ানরা তুতসিদেরকে হুতুদের চেয়ে বেশি প্রাধান্য দিতো এবং বেশি যোগ্যতা সম্পন্ন মনে করতো। স্বাভাবিকভাবেই তুতসিরাও এই বিষয়টিকে স্বাগত জানিয়েছিলো, কারণ তারা বেশি সুযোগ সুবিধা পেতো।

বেলজিয়ানদের নিজেদের অনুকূলে পেয়ে পরের ২০ বছরে শিক্ষা এবং চাকরির ক্ষেত্রে তুতসিরা হুতুদের চেয়ে অনেক এগিয়ে যায়। এতে বৈষম্যের স্বীকার হুতু সম্প্রদায়ের মাঝে ধীরে ধীরে ক্ষোভ জমতে থাকে। ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৯৫৯ সালে। সে বছর হুতু এবং তুতসিদের মাঝে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় প্রাণ হারায় প্রায় ২০,০০০ তুতসি এবং অনেকেই প্রতিবেশী দেশ বুরুন্ডি, তানজানিয়া এবং উগান্ডাতে পালিয়ে যায়। ১৯৬২ সালে বেলজিয়ান সরকার ক্ষমতাচ্যুত হলে নিজেদের স্বাধীনতা ফিরে পায় রুয়ান্ডা। স্বাধীনতা পাওয়ার পর পরেই হুতুরা তাদের হারিয়ে ফেলা ক্ষমতা আবার ফিরে পায়।

১৯৭৩ সালে ৩য় প্রেসিডেন্ট হিসেবে রুয়ান্ডার দায়িত্ব গ্রহণ করেন হুতু সম্প্রদায়ের নেতা একনায়ক জুভেনাল হাবিয়ারিমানা। তার শাসনামলের শেষের দিকে রুয়ান্ডার অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই শোচনীয় হয়ে যায়। ফলে সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয়তা হারান এই একনায়ক। একই সময়ে কাগামের (বর্তমান রুয়ান্ডার প্রেসিডেন্ট) নেতৃত্বে উগান্ডাতে পালিয়ে যাওয়া তুতসিরা রুয়ান্ডান প্যাট্রিয়টিক ফ্রন্ট (RPF) নামে একটি সশস্ত্র বিদ্রোহী দল গঠন করে। এদের সাথে যোগ দিয়েছিলো রুয়ান্ডাতে বসবাসকারী কিছু মডারেট হুতু। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হাবিয়ারিমানাকে ক্ষমতাচ্যুত করে পালিয়ে যাওয়া তুতসিদেরকে আবার নিজেদের দেশে ফিরিয়ে নিয়ে আসাই এই ফ্রন্টের উদ্দেশ্য ছিলো।

হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত ধারালো অস্ত্র; ছবিসূত্র: chikaforafrica.wordpress.com

এই সুযোগটিকে কাজে লাগিয়ে প্রেসিডেন্ট হাবিয়ারিমানা হুতু সম্প্রদায়ের সব নেতাকে নিজের ছায়াতলে নিয়ে আসেন এবং রুয়ান্ডাতে অবস্থানকারী তুতসিরা RPF কে সাহায্য করছে এমন অভিযোগ করেন। ১৯৯৩ সালে সরকারি বাহিনী এবং বিদ্রোহীদের কয়েক দফা আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণের পর প্রেসিডেন্ট এবং RPF-র মাঝে একটি শান্তি চুক্তি হয়, কিন্তু বাস্তবে অস্থিরতা থামেনি।

এই অস্থিরতা গণহত্যায় রূপ নেয় যেদিন প্রেসিডেন্ট হাবিয়ারিমানাকে বহনকারী প্লেনটিকে কিগালি এয়ারপোর্টের উপর থেকে মিসাইল ছুঁড়ে ভূপাতিত করা হয়। ১৯৯৮ সালের ৬ এপ্রিল তৎকালীন রুয়ান্ডার প্রেসিডেন্ট ছাড়াও ভূপাতিত হওয়া ওই প্লেনে ছিলেন প্রতিবেশি দেশ বুরুন্ডির প্রেসিডেন্ট এবং বেশ কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা।

প্রেসিডেন্ট হত্যার পর নিজেদের নেতার মৃত্যুর খবর শুনে রাগে ফুঁসতে থাকে হুতু সম্প্রদায়ের লোকজন। স্বাভাকিভাবেই এই গুপ্তহত্যার দায় গিয়ে পড়ে RPF এবং তাদের নেতা কাগামের উপরে। প্রেসিডেন্ট হত্যার পরপরই শুরু হয় ধ্বংসলীলা। যদিও তখনো প্রমাণিত ছিলো না কে হত্যা করেছে প্রেসিডেন্টকে, কিন্তু সেটি দমিয়ে রাখতে পারেনি প্রেসিডেন্টের অনুগত সেনাবাহিনীকে। রাজধানী কিগালিতে কয়েক ঘণ্টা পরেই একে একে বিপক্ষ সব রাজনৈতিক নেতা এবং সাধারণ তুতসিদেরকে হত্যা করতে শুরু করে প্রেসিডেন্ট সমর্থক হুতু বাহিনী। অল্প কিছু সময়ের মাঝেই ‘হুতু পাওয়ার রেডিও’র মাধ্যমে হুতুদেরকে সব তুতসিদেরকে মারার নির্দেশ দেয়া হয়। কয়েক ঘণ্টায় এই খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে শুরু হয় গণহত্যা। এই গণহত্যায় অংশ নিয়েছিলো সরকারি বাহিনী, হুতু রাজনৈতিক নেতা, এমনকি সাধারণ ব্যবসায়ী সহ ৩০,০০০ সদস্যের এক বিশাল বাহিনী। পরবর্তীতে সরকারি সেনাবাহিনী সংগঠিত হয়ে তুতসি অধুষ্যিত এলাকাগুলোতে চাপাতি এবং বন্দুক নিয়ে হামলা চালায়। কুপিয়ে এবং গুলি করে মারা হয় লাখ লাখ তুতসিকে, বাদ যায়নি চার্চে আশ্রয় নেয়া রিফিউজিরাও।

মৃত্যুশয্যায় অগণিত লাশের পাশে শুয়ে নিজের বাচ্চাকে দুধ খাওয়াচ্ছেন মা; ছবিসূত্র: Reuters

প্রেসিডেনশিয়াল গার্ড এবং আনঅফিশিয়াল মিলিশিয়া গ্রুপের প্ররোচনায় অনেক সাধারণ মানুষও এই গণহত্যায় অংশ নিয়েছিলো। অনেক হুতুকে ভয়ভীতি দেখিয়ে তাদের প্রতিবেশীদেরকে হত্যা করতে বাধ্য করা হয়। গণহত্যায় অংশ নেওয়ার জন্য অনেকভাবে প্ররোচনা দেওয়া হয় তাদেরকে। এমনকি হত্যার জন্য তাদেরকে খাদ্য এবং টাকাসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধাও দেয়া হয়। অনেককে বলা হয়েছিলো যে, তারা তুতসিদেরকে মেরে তাদের বাড়িঘরও দখল করে পারবে। ক্ষমতায় থাকা হুতুদের উদ্দেশ্য ছিলো তুতসি সম্প্রদায়কে চিরতরে রুয়ান্ডা থেকে মুছে ফেলা। তাই তারা বাদ দেয়নি শিশু এবং নারীদেরকেও।

জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী তখন রুয়ান্ডাতে থাকলেও হুতু মিলিশিয়ারা ১০ সৈন্যকে হত্যা করলে সব সৈনিককে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেয় জাতিসংঘ। ফলে নিজ দেশের মাটিতে কার্যত একা হয়ে পড়ে তুতসি সম্প্রদায়ের লোকজন। অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট হত্যার পরপরেই RPF নতুন উদ্যমে সরকারি বাহিনীর উপর হামলা করা শুরু করে এবং উগান্ডা সীমান্ত থেকে আস্তে আস্তে রুয়ান্ডার দিকে এগোতে থাকে।

পরিশেষে, জুলাই মাসে RPF রুয়ান্ডার রাজধানী কিগালি দখল করে নেয়। হুতুরা যখন বুঝতে পারে তুতসি বিদ্রোহীরা যুদ্ধ জিতে নিয়েছে, তখন প্রায় ২০ লাখ হুতু পালিয়ে যায় পার্শ্ববতী দেশ রিপাবলিক অব কঙ্গোতে। অবশেষে অবসান হয় এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের। কিন্তু ততদিনে পৃথিবীর বুক ছেড়ে চলে গেছে ৮ লাখ তাজা প্রাণ।

রুয়ান্ডা সীমান্তে একটি রিফিউজি ক্যাম্পে হুতু সম্প্রদায়ের লোকজন; ছবিসূত্র: Resuters

যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর হুতু এবং তুতসি সম্প্রদায় মিলিতভাবে সরকার গঠন করে। হুতুদের পক্ষ থেকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন বিজিমুংগু। তুতসিদের নেতা কাগামেকে নিয়োগ দেয়া হয় ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে। কিন্তু পরবর্তীতে এই দুজনের মাঝে বনিবনা না হওয়ায় প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন কাগামে। বিজিমুংগুর বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা উসকে দেয়ার অভিযোগ আনা হয়। যুদ্ধ শেষ হলেও কঙ্গোতে পালিয়ে যাওয়া হুতু বিদ্রোহীদের সাথে যুদ্ধে পরে প্রাণ হারায় আরো প্রায় ৫০ লাখ লোক। বর্তমানে তুতসি সরকার হুতুদেরকে সমূলে নিশ্চিহ্ন করার হুমকি দিয়ে আসছে। অন্যদিকে যুদ্ধে জয়লাভ করার পরেও তুতসি বিদ্রোহীরা এখনো অস্ত্র ছাড়েনি। তাদের বক্তব্য, সুযোগ পেলেই হুতুরা আবার তাদেরকে বিতাড়িত করার জন্য হামলা করবে।

এভাবেই গণকবর দেয়া হয় শত শত মানুষকে; ছবিসূত্র: democracynow.org

যেই প্রেসিডেন্ট হত্যাকাণ্ডের জন্য এত লোক প্রাণ হারালো, সেই হত্যাকাণ্ডের সুরাহা এখনো হয়নি। কে বা কারা দায়ী এর পেছনে, সেটি উদঘাটন করা এখনো সম্ভব হয়নি। হত্যাকাণ্ডের সাথে সাথে হুতু নিয়ন্ত্রিত রেডিও ‘হুতু পাওয়ার’ দাবি করে, RPF নেতা কাগামের নির্দেশেই এই আক্রমণ হয়েছে। অন্যদিকে RPF দায়ী করে প্রেসিডেন্টের দলের মিলিশিয়ারা চক্রান্ত করে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, যাতে করে তারা তুতসিদেরকে হত্যা করতে পারে। এভাবেই একে অপরের উপর দোষ চাপাতে থাকে দুই সম্প্রদায়।

ভূপাতিত হওয়া প্লেনটিতে একজন ফ্রান্সের নাগরিক থাকায় ফ্রান্সের সরকার একটি অনুসন্ধান চালায় এবং ২০০৬ সালে এই মামলার রায়ে কাগামেকে এই হত্যার জন্য দায়ী করা হয়। ফ্রান্স সরকার গণহত্যার পেছনে নিজেদের দায় এড়ানোর জন্য এরকম রায় দিয়েছে বলে পাল্টা অভিযোগ করেন কাগামে। ২০১২ সালের জানুয়ারিতে আরেকটি রায়ে ফ্রান্সের দুই তদন্তকারী এবং দুজন বিচারক কাগামেকে নির্দোষ বলে রায় প্রকাশ করে। তাদের মতে কাগামের নিয়ন্ত্রিত মিলিটারি বেস থেকে এত দূরে মিসাইল নিক্ষেপ করা সম্ভব ছিলো না। রায় যা-ই হোক, কাগামের খুব কাছে ছিলো এরকম অনেক লোকই এই হত্যাকাণ্ড কাগামের নির্দেশেই হয়েছে বলে বিবৃতি দিয়েছে বিভিন্ন সময়ে। এদের মাঝে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতে নিযুক্ত রুয়ান্ডার অ্যাম্বাসেডর সহ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাবেক সেক্রেটারিও আছেন।

ফিচার ছবিসূত্র: Fanny Schertzer

Related Articles

Exit mobile version