আগস্টের সকালটা শুরু হয়েছিল অন্য দিনগুলোর মতোই, কিন্তু প্রথম প্রহর পেরোনোর আগেই পাল্টে গেল সবকিছু। প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে একটি শহর পরিণত হলো পুরোপুরি ধ্বংসস্তুপে, নতুন এক আতঙ্কের সাথে পরিচয় হলো পৃথিবীর। দু’লাইন পড়েই পাঠক হয়তো বুঝে ফেলেছেন, বলা হচ্ছে ৬ আগস্ট, ১৯৪৫ সালের জাপানের হিরোশিমা শহরে পারমাণবিক বোমা হামলার কথা। মে মাসেই ইউরোপে যুদ্ধ জিতে যাওয়া আমেরিকা তখনো লড়ছিল জাপানের বিরুদ্ধে, অনেকটা একাই। জাপানকে পরাস্ত করতে শেষ অস্ত্র হিসেবে আমেরিকা পৃথিবীকে পরিচয় করিয়ে দেয় পারমাণবিক বোমার সাথে। চোখের পলকে ধ্বংস হয়ে যায় হিরোশিমা শহরের প্রায় অর্ধেক, মারা যায় প্রায় ৯০ হাজার মানুষ। এছাড়াও তেজস্ক্রিয়তার কারণে পরবর্তীতে মারা যান আরো অনেকেই। আর যারা মারা যাননি, তারা বেঁচে থাকেন এক অভিশপ্ত জীবন নিয়ে। আসলেই কি প্রয়োজন ছিল এরকম ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর? এ প্রশ্নের উত্তর পেতে চলুন ফিরে দেখা যাক অনেকটা পেছনে।
১৯৩৯ সাল থেকে ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠলেও আমেরিকা শুরু থেকেই ছিল নিরপেক্ষ। আমেরিকার জনগণও ছিল যুদ্ধের বিপক্ষে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং এর পরে ত্রিশের দশকের অর্থনৈতিক মন্দার কারণে জনগণ এবং সরকার কেউই বাইরের যুদ্ধে জড়াতে চায়নি। তবে সরাসরি না জড়ালেও আমেরিকা ব্রিটিশদের বিভিন্ন রসদ দিয়ে সাহায্য করছিল। কিন্তু সবকিছু পাল্টে যায় ১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর সকালে। শত শত জাপানি যুদ্ধবিমান আমেরিকার রাডার ফাঁকি দিয়ে যেন ভোজবাজির মতো উড়ে এসে হামলা করে হাওয়াইতে আমেরিকার প্রশান্ত মহাসাগর ফ্লিটের প্রধান বন্দর ‘পার্ল হারবারে’। ৭টি ব্যাটলশিপসহ ২০টি যুদ্ধজাহাজ এবং ৩০০টি বিমান হারায় আমেরিকা, প্রায় ২,০০০ সেনা এবং নাবিক মারা যায় জাপানের অতর্কিত আক্রমণে।
সেদিনই আমেরিকান সরকার যুদ্ধ ঘোষণা করে জাপানের বিরুদ্ধে, তিনদিন পরে জাপানের মিত্র জার্মানি এবং ইতালি যুদ্ধ ঘোষণা করে আমেরিকার বিরুদ্ধে। তবে আজকের লেখা মূলত জাপানকে নিয়েই। জাপানের উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা ছিল পুরো প্রশান্ত মহাসাগরের সকল এলাকা দখল করা আর এর জন্য তাদের একমাত্র প্রতিপক্ষ ছিল আমেরিকা। জাপানের লক্ষ্য ছিল আমেরিকার প্রশান্ত মহাসাগরের ফ্লিটকে পার্ল হারবারের একেবারে ধ্বংস করে দেয়া। কিন্তু ভাগ্য সেদিন ছিল আমেরিকার পক্ষে, ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলেও আমেরিকার এয়ারক্র্যাফট ক্যারিয়ারগুলো সেদিন পার্ল হারবারে ছিল না। ফলে তারা বেঁচে যায় এই আক্রমণ থেকে। আর এই বেঁচে যাওয়া ক্যারিয়ারগুলোই পরবর্তীতে প্রশান্ত মহাসাগরে রচনা করে জাপানের ধ্বংসের কিংবা আমেরিকার পরাশক্তি হবার সূচনার।
পরের চারটি বছর আমেরিকা এগোতে থাকে তাদের পশ্চিমে জাপানের দিকে। প্রশান্ত মহাসাগরের ছোট ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ দ্বীপগুলো নিয়ে চলে দীর্ঘ লড়াই। এসব দ্বীপের বেশিরভাগই ছিল জঙ্গলে ভরা। ফলে দু’পক্ষেরই প্রচুর হতাহত হতে থাকে। জাপানের মূল ভূখন্ডে আমেরিকা হামলা বিমান হামলা চালালেও সেগুলো জাপানের মনোবল ভাঙতে পারেনি। উল্টো জাপানিদের আরো খেপিয়ে দেয় যুদ্ধজয়ের জন্য।
প্রথম দিকে জাপানের নৌবাহিনী আমেরিকার নৌবাহিনীর চেয়ে সংখ্যায় প্রায় দ্বিগুণ হলেও আমেরিকার নৌবাহিনীর জাহাজগুলো ছিল আধুনিক যন্ত্র এবং অস্ত্রে সজ্জিত। এছাড়া প্রশান্ত মহাসাগরে বেশিরভাগ নৌযুদ্ধ আসলে ছিল দুই দেশের ক্যারিয়ারের যুদ্ধ বিমানগুলোর মধ্যে। চীনের সাথে দীর্ঘদিন যুদ্ধের ফলে জাপানের বেশিরভাগ সেরা পাইলট হয় মারা গিয়েছিল, নয়তো আহত হয়ে পড়ে ছিল। ফলে কম প্রশিক্ষিত জাপানি পাইলটরা আমেরিকার অভিজ্ঞ পাইলটদের সাথে পেরে ওঠেনি সহজে। এছাড়া ১৯৪৩ সালের দিকে আমেরিকান বিমানগুলো রাতের অন্ধকারেও আক্রমণ শুরু করে। ফলে জাপানিদের পরাজয় সময়ের ব্যাপার হয়ে পড়ে।
জাপান পরাজিত হবার পথে থাকলেও তারা ছিল প্রচন্ড একরোখা, জেদি এবং তারা কোনো অবস্থাতেই আত্মসমর্পণ করবে না বলে পণ করেছিল। ১৯৪৪ সালের ১৫ জুন আমেরিকা জাপানের সাইপান দ্বীপে আক্রমণ চালায়, প্রথমে নৌবাহিনীর আর্টিলারি দিয়ে, এরপর মেরিন সেনাদের দিয়ে। প্রায় দু’দিন যুদ্ধের পর আমেরিকার সেনারা সাইপানের মূল ভূখন্ড দখল করে। একইসাথে সাইপানে জাপানের নৌবাহিনী তিনটি ক্যারিয়ার হারায়। ফলে সাইপানে জাপানের কোন আশা থাকে না। জেতার আশা নেই বোঝার পরেই শুরু হয় জাপানিদের আত্মহত্যা। জাপানি সেনারা আমেরিকানদের উপর আত্মঘাতী আক্রমণ করতে থাকে, অনেকে আত্মহত্যা করে আগেই। তবে সবচেয়ে বেদনাদায়ক হলো সাইপানের প্রায় ২৫ হাজার সাধারণ জনগণের আত্মহত্যা।
জাপানিদের আত্মহত্যা কিংবা আত্মঘাতী হামলা বেড়ে যায় সময়ের সাথে সাথে। প্রতিটি পরাজয়ের পরই আত্মহত্যা করে জাপানিরা, সেনা এবং সাধারণ জনগণ সবাই। প্রশিক্ষিত পাইলট না থাকায় তরুণদের নিয়ে তারা তৈরি করে ‘কামিকাজে’ স্কোয়াড, যাদের কাজ ছিল প্লেন নিয়ে আমেরিকান নৌবাহিনীর জাহাজে আত্মঘাতী আক্রমণ করা। এভাবে আমেরিকান জাহাজের খুব বেশি ক্ষতি করতে না পারলেও প্রচুর হতাহত হচ্ছিল আমেরিকান নাবিকরা। একই সাথে পরাজিত জাপানী সেনারা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে আত্মঘাতী আক্রমণ চালাচ্ছিল আমেরিকান সেনাদের ওপর।
সাইপান আমেরিকানদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল আকাশপথে বি-২৯ বিমান দিয়ে আক্রমণের জন্য। সাইপান থেকে জাপানে ভারি বোমারু বিমান দিয়ে আক্রমণ করা যায় সহজে, প্লেন এবং পাইলট হারানোর সম্ভাবনাও থাকে কম। সাইপানের পর আমেরিকানদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ইয়ো জিমা। জাপানে মূল ভূখন্ডের সবচেয়ে কাছে এই দ্বীপটি। ফলে জাপানও প্রাণপণ চেষ্টা করে এ দ্বীপটি রক্ষা করার। ১৯৪৫ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি আকাশ, পানি এবং ভূমি তিন দিক দিয়ে আক্রমণ শুরু করে আমেরিকা। ৩৬ দিন যুদ্ধের পর সফল হয় আমেরিকা। কিন্তু তাদের হারাতে হয় প্রায় ৭ হাজার সেনা, আহত হয় প্রায় ২০ হাজার সেনা। বরাবরের মতো আত্মসমর্পণ না করার জেদে মৃত্যু পর্যন্ত যুদ্ধ করে কিংবা আত্মহত্যা করে মারা যায় প্রায় ২০ হাজার জাপানি সেনা। মাত্র ২১৬ জন জাপানিকে জীবিত অবস্থায় আটক করা সম্ভব হয়েছিল। ইয়ো জিমা দখলের পর মেরিন সেনাদের পতাকা উড়ানোর একটি দৃশ্য আজও বিখ্যাত হয়ে রয়েছে।
জাপানে বি-২৯ বিমান হামলা করে অনেক শহর ধ্বংস করে ফেললেও জাপান কোনো অবস্থাতেই আত্মসমর্পণ করছিল না। ফলে আমেরিকাকে যুদ্ধ জিততে হলে জাপানের মূল ভূখন্ডে আক্রমণ চালাতেই হতো। অন্যদিকে ইউরোপে জার্মানি মে মাসে আত্মসমর্পণ করলে আমেরিকা আশঙ্কা করছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন জাপান আক্রমণ করবে। ফলে আমেরিকা একদিকে দ্রুত যুদ্ধ জাপান দখল করতে চাচ্ছিল। কিন্তু ইয়ো জিমার যুদ্ধের ভয়াবহতার পর সরাসরি আক্রমণের ব্যাপারেও দ্বিধান্বিত ছিল।
জাপানের নৌবাহিনীর প্রায় কিছুই অবশিষ্ট ছিল না ১৯৪৫ সালের জুলাই মাসে। অল্প কিছু সাবমেরিন, ডেস্ট্রয়ার আর ট্রেনিং ক্যারিয়ার ছিল তাদের। এগুলো দিয়ে যুদ্ধ জেতা তো দূরের কথা, আমেরিকার বিশাল নৌবাহিনীর সামনে দাঁড়ানোই সম্ভব ছিল না তাদের পক্ষে। আমেরিকা প্রায় প্রতি রাতেই তাদের বি-২৯ বিমান দিয়ে জাপানি শহরের উপর বোমা হামলা করছিল। ফলে জাপানের পরাজয় ছিল সময়ের ব্যাপার। কিন্তু আমেরিকা জাপানিদের পরাজিত করার জন্য যে পথ বেছে নিয়েছিল তা আজ পর্যন্ত বিতর্কিত।
আমেরিকার হিরোশিমার হামলার পেছনে অনেকে পার্ল হারবারের প্রতিশোধের কথা বললেও এর পেছনে ছিল রাজনৈতিক কারণ। পরপর দুটো বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেন ছিল পড়তির দিকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পতন ঘটে দুই পরাশক্তির: অস্ট্রো-হাঙ্গেরি এবং অটোমান সাম্রাজ্যের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিপর্যস্ত ইউরোপেও কেউ ছিল না পরাশক্তি হবার। অন্যদিকে যুদ্ধকালীন শিল্প বিপ্লবে আমেরিকা তখন নতুন পরাশক্তি, সাথে রয়েছে নতুন আবিষ্কার করা পারমাণবিক শক্তি। ইউরোপে পরাশক্তি হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিপক্ষ হয়ে যেতে পারে। সুতরাং তাদেরকে দেখানোর জন্য আমেরিকাকে অভাবনীয় কিছু করতে হতো।
এছাড়াও শেষের দিকে যুদ্ধগুলোতে জাপানিদের জেদি মনোভাব এবং আত্মঘাতী হামলার কারণে প্রচুর আমেরিকান সেনা মারা যেতে থাকলে সেনাদের মনোবল ভেঙে যেতে পারে বলে ভয় পাচ্ছিল সরকার এবং হাই কমান্ড। দেশের জনগণও এতো বেশি মৃত্যু দেখতে দেখতে যুদ্ধবিরোধী হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু আমেরিকান সরকার জাপানকে সোভিয়েতদের হাতে কোনোমতেই ছাড়তে রাজি ছিল না। ফলে আমেরিকা তাদের শক্তির প্রদর্শন করার জন্য চোখের পলকে কেড়ে নেয় হাজার হাজার প্রাণ।
মজার ব্যাপার, জাপান সরকারের ভেতরে অনেকেই ছিল যারা আত্মসমর্পণ করে যুদ্ধ শেষের পক্ষে ছিল। কিন্তু জাপানের সম্রাট কোনো অবস্থাতেই আত্মসমর্পণ করতে রাজি ছিলেন না। শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করার পক্ষে ছিলেন তিনি। জাপানের সে সময়ের নৌমন্ত্রী ছিলেন মিতসুমাসা ইউনাই, যিনি ছিলেন যুদ্ধ শেষ করার পক্ষে। তিনি আমেরিকার এই হামলাকে বলেন ‘স্বর্গ থেকে উপহার’। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন জাপান সরকার সবাই মারা যাওয়া না পর্যন্ত যুদ্ধ থামাবে না, সেদিক থেকে এই হামলায় হয়তো কম মানুষই মারা গিয়েছে।
৬ আগস্ট হিরোশিমায় পারমাণবিক হামলার পরেও জাপান সরকার আত্মসমর্পণ করেনি। ফলে তিনদিন পরে আমেরিকা নাগাসাকিতে দ্বিতীয় পারমাণবিক বোমা হামলা করে। তবে নাগাসাকির হামলা জাপানকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করেছিল বলে মনে হয় না। কেননা, জাপানের সুপ্রিম কাউন্সিলের মিটিং বসে ৯ আগস্ট সকালে, নাগাসাকি হামলার আগেই এবং সেটি ছিল সম্পূর্ণ গোপন একটি মিটিং। বিকেলের আগে তারা নাগাসাকির খবরই পাননি এবং তার আগেই খুব সম্ভবত তারা আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন।
আমেরিকানরা দাবি করে জাপানকে ভয় পাইয়ে দিতেই তারা হিরোশিমায় হামলা করেছিল। কিন্তু ভয় দেখানোর জন্য যেকোনো মরুভূমি বা জনবিরল এলাকায় শক্তি প্রদর্শন করা সম্ভব ছিল। আবার শেষের দিকের যুদ্ধগুলোর ভয়াবহতাকেও অনেকে ঢাল হিসেবে দাঁড় করায়। সোভিয়ের ইউনিয়নকে পরোক্ষ ভয় দেখানোরও ব্যাপার ছিল আমেরিকার মাথায়। জাপান সরকার আত্মসমর্পণ করতে রাজি হলেও জাপানের সেনাবাহিনীর একটি অংশ এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার চেষ্টা করেছিল। ফলে জাপানের একগুঁয়েমি, সোভিয়েতদের প্রভাব বিস্তারের ভয় কিংবা আমেরিকার নিজেদের পরাশক্তি হিসেবে প্রকাশের দুর্দমনীয় ইচ্ছা- এর যেকোনোটিই কিংবা প্রতিটিই হয়তো প্রভাব ফেলেছিল ইতিহাসের নারকীয় এই হামলায়।