আরও একটুখানি মনোবিজ্ঞান এবং সিগমুন্ড ফ্রয়েড

মনোজগতের রহস্যময়তা বলে বোঝানোর মতো নয়। সেইসব রহস্যময়তা যৌক্তিকভাবে, বিজ্ঞানসম্মতভাবে  ব্যাখ্যা করার জন্যই মনোবিজ্ঞান। আজকের মনোবিজ্ঞান যে এই পর্যায়ে এসেছে, তার পিছনে রয়েছে বেশ কিছু মানুষের অবদান। সিগমুন্ড ফ্রয়েড সেরকমই একজন, মনোবিজ্ঞান নিয়ে কথা বলতে গেলে যার নাম চলে আসে অবধারিতভাবে। তার বেশ কিছু মতবাদ রয়েছে মনস্তাত্ত্বিক কার্যকলাপ ব্যাখ্যা করার জন্য। সেই তত্ত্বগুলো নিয়ে বিতর্ক যতই থাকুক না কেন, ফ্রয়েড সব সময় প্রাসঙ্গিকই থাকবেন। আমি আগের পর্বে বেশ কিছু মনোবৈজ্ঞানিক এক্সপেরিমেন্ট নিয়ে লিখেছিলাম। এ পর্বেও থাকছে সেরকমই আরও কিছু এক্সপেরিমেন্ট। এর মানে মনোবিজ্ঞানের আরও কিছু রহস্যময় বিষয়, আমাদের মনোজগতের আরও কিছু অজানা অধ্যায় সম্পর্কে জানবো।

লিটল অ্যালবার্ট এক্সপেরিমেন্ট

এখন যে পরীক্ষার কথা বলবো সেটিকে পৃথিবীর অন্যতম অনৈতিক মনোবৈজ্ঞানিক এক্সপেরিমেন্ট হিসেবে ধরা হয়। সব বৈজ্ঞানিক এক্সপেরিমেন্টের পিছনেই উদ্দেশ্য মহৎ থাকে এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু কিভাবে এবং কাদেরকে ব্যবহার করে সেটি করা হচ্ছে সেটি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তা জন্ম দিতে পারে নানা বিতর্কের।

Image Credit: BBC

ভয়ের উৎপত্তি কোথায়? আমরা কেন কোনো নির্দিষ্ট কিছু দেখে ভয় পাই? জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়াটসন এবং রেয়নার ১৯২০ সালে এই পরীক্ষাটি করেন নয় মাস বয়সী অ্যালবার্টের উপর। তাদের উদ্দেশ্য ছিলো মানসিকভাবে স্বাভাবিক একটি শিশুকে কীভাবে নানা ধরনের ফোবিয়া গ্রাস করে তার কারণ অনুসন্ধান করা।

ওয়াটসন এবং রেয়নার ছোট্ট অ্যালবার্টের উপর এক্সপেরিমেন্ট শুরু করছেন; Image Credit: Wikimedia Commons

এরপর তারা বেশ কয়েকবার ধাতব শব্দ এবং একটি নিরীহ সাদা ইঁদুর এই দুইয়ের মিশেলে অ্যালবার্টকে ভয় পাইয়ে দেন। এরপর যে ব্যাপারটি ঘটলো তা মোটামুটি ভয়াবহ। নিরীহ সাদা ইঁদুরটি এরপর যতবারই অ্যালবার্টের সামনে আসলো, ততবারই সে ভয় পেয়ে কেঁদে উঠলো, যদিও এবার কোনো শব্দ ছিল না। শুধু তাই নয়, সে ইঁদুরের মতো দেখতে যেকোনো কিছুতেই ভীতি প্রদর্শন করতে লাগলো। তার মধ্যে ছিলো লোমশ কুকুর, সিলের চামড়ার কোট, এমনকি সান্টা ক্লজের লোমশ মুখোশ!

বলা হয়ে থাকে নয় মাস বয়সী অ্যালবার্ট তার মায়ের সাথে যে বিল্ডিংয়ে থাকতো, সেখানেই থাকতেন ওয়াটসন। তার মা জানতেন না যে, তার বাচ্চাকে একটি এক্সপেরিমেন্টে গিনিপিগের মতো ব্যবহার করা হচ্ছে। যখন তিনি জানতে পারেন, তখন তিনি কাউকে না জানিয়ে অ্যালবার্টকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যান। এটি তিনি করেন এক্সপেরিমেন্ট চলাকালীন সময়ের একেবারে শেষ পর্যায়ে যখন তারা অ্যালবার্টের পশুভীতি দূর করার চেষ্টা করছিলেন। এরপর অ্যালবার্টের আর কোনো খোঁজ তারা পাননি। ছোট অ্যালবার্ট হয়তো এই ভীতি নিয়েই শেষ পর্যন্ত বেঁচে ছিলো।

পরবর্তীতে ওয়াটসন তার এই গবেষণাটির উপরে বেশ কয়েকটি লেকচার দেন। একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ সাধারণত যেসব ফোবিয়াতে আক্রান্ত থাকেন, সেসবের সাথে ঘনিষ্ট যোগসূত্র থাকে তার শৈশবকালে ঘটে যাওয়া কোনো ভীতিকর ঘটনার যার প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী।

Selective Attention / Invisible Gorilla Experiment

এই এক্সপেরিমেন্টটি এর নামের মতোই চমকপ্রদ। নাম থেকে যা বোঝা  যাচ্ছে তা হলো এখানে অদৃশ্য গরিলাদের নিয়ে কিছু একটা করা হয়েছে। ব্যাপারটি ঠিক সেরকম কিছু নয়। এটি একটি বিখ্যাত গবেষণা যেটি মানুষের একাধিক কাজ একসাথে করার ধারণাকে বেশ বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে। ১৯৯৯ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিস্টোফার ক্যাব্রিস এবং ইলিনয়েস বিশ্ববিদ্যালয়ের ড্যানিয়েল সাইমন্স এই এক্সপেরিমেন্টটি করেন।

এই এক্সপেরিমেন্টে অংশগ্রহণকারীদেরকে একটি ভিডিও ক্লিপ দেখানো হয় যেখানে কিছু মানুষ দুটি দলে বিভক্ত হয়ে (সাদা এবং কালো টি-শার্ট পরিহিত) একে অপরকে একটি বাস্কেটবল পাস করছেন। তাদের কাজ ছিলো বাস্কেটবলটি ঠিক কতবার পাস হয়েছিলো সেই সংখ্যাটি গণনা করে বলা। ভিডিওটির গতি ছিলো স্বাভাবিক এবং গণনাকার্য খুব কঠিন নয় সেক্ষেত্রে। কিন্তু এই ভিডিও ক্লিপটির মধ্যে আরও একটি ব্যাপার ছিলো যা স্বাভাবিক অবস্থায় যে কারও চোখে ধরা পড়বে। তা হলো একটি লোক গরিলার মতো স্যুট পরে একেবারে বাস্কেটবল পাস করতে থাকা দলগুলোর মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন এবং পথিমধ্যে একদম মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েও ছিলেন। ভিডিওটি দেখা শেষ করার পর তাদের সবাইকে যখন জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে তারা অস্বাভাবিক কিছু দেখেছিলেন কিনা, তখন দেখা গেল ৫০ শতাংশ অংশগ্রহণকারীই গরিলাটিকে খেয়াল করেননি। ২২৮ জনের মধ্যে ১৯৪ জন সঠিকভাবে পাস সংখ্যা বলতে পেরেছিলো।

মাঝখানে গরিলার পোশাকে যিনি দাড়িয়ে আছেন ৫০% মানুষ তাকে খেয়ালই করেননি

বাস্কেটবলটি কতবার একজন থেকে আরেকজনে পাস হয়েছিলো এটা বের করতে বলটির প্রতি অনেক বেশি মনোযোগের দরকার হয় এতে কোনো সন্দেহ নেই। এটি প্রমাণ করে আমাদেরকে যখন তুলনামুলকভাবে একটু কঠিন কোনো কাজ করতে দেওয়া হয়, তখন আমরা একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের প্রতি এতই মনোযোগ দেই যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোও আমাদের চোখ এড়িয়ে যায়। একই সাথে একাধিক বিষয়ের উপর মনোযোগ দেওয়া আমাদের মস্তিষ্কের কাছে মোটামুটি অসম্ভব।

Pavlov’s Dog Experiment

কুকুর নিয়ে করা পাভলভের এই এক্সপেরিমেন্টটি এতই যুগান্তকারী যে তা মনোবিজ্ঞানে নতুন একটি শাখাই খুলে ফেলেছে। কোনো নিরপেক্ষ ঘটনাকে কীভাবে শর্তাধীন করা যায় তার উপায় নির্দেশ করেছে এই এক্সপেরিমেন্টটি। ১৯৮০ সালে রাশিয়ার সেইন্ট পিটার্সবার্গের মিলিটারি মেডিকেল একাডেমিতে এই গবেষণাটি সম্পন্ন করা হয়।

পাভলভ তার ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করছেন

কিছু জিনিস আছে যেগুলো একটি কুকুরকে কখনো শিখতে হয় না। যেমন- খাবার দেখলে লালা নিঃসরণ। খাবার দেখলে লালা নিঃসরণ হবে এটি কুকুরের পুরোপুরি নিরপেক্ষ এবং সহজাত প্রবৃত্তি। তিনি একটি কুকুরে সামনে এক গামলা খাবার রাখেন এবং তার লালার পরিমাণ বের করার ব্যাবস্থাও রাখেন। পুরোপুরি নিরপেক্ষ একটি ঘটনা হিসেবে তিনি একটি ঘন্টাও বাজান। অর্থাৎ তিনি বেশ কয়েকবার খাবার কুকুরটির সামনে রাখেন এবং একইসাথে ঘন্টাও বাজান।

একসময় তিনি লক্ষ্য করেন ঘন্টা বাজানোর সাথে সাথে কুকুরটির লালা নিঃসরণের পরিমানও বেড়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ কুকুরটি খাবারের সাথে আরও একটি সম্পূর্ণ আলাদা ঘটনার (এক্ষেত্রে ঘন্টার শব্দ) সমন্বয় সাধন করে ফেলেছে। এরপর কুকুরটি শুধু ঘন্টার শব্দ শুনেই লালা নিঃসরণ করতো। খাবারের লোভ দেখানোর প্রয়োজন হতো না।

যেকোনো প্রাণীর সহজাত কোনো প্রতিক্রিয়াকে কীভাবে অন্য কোনো কিছু দিয়ে প্রভাবিত করা যায় তা আমরা পাভলভের এই পরীক্ষণটির মাধ্যমে জানতে পারি। আমরা প্রথমেই যে এক্সপেরিমেন্টটির কথা জেনেছিলাম অর্থাৎ Little Albert Experiment তার সাথে এই এক্সপেরিমেন্টটির কি কোনো মিল খুজে পাওয়া যাচ্ছে? দুটোই আসলে নিরপেক্ষকে শর্তাধীন ঘটনায় রুপান্তর (Classical Conditioning) এর অনন্য উদাহরণ।

আমরা বেশ কিছু মনোবৈজ্ঞানিক এক্সপেরিমেন্ট নিয়ে কথা বললাম। এবার আমরা আমাদের মনোযোগ নিয়ে যাই সিগমুন্ড ফ্রয়েডের দিকে। তার মতবাদ এবং এক্সপেরিমেন্টগুলোর দিকে।

সিগমুন্ড ফ্রয়েড(Sigmund Freud) ছিলেন একজন অস্ট্রিয় মনস্তাত্ত্বিক এবং মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ। তাকে বলা হয় মনোসমীক্ষণ (Psychoanalysis) নামক মনোচিকিৎসা পদ্ধতির উদ্ভাবক। সেই সময়ে মন নিয়ে মানুষের ধারণা ছিল অনেক সীমিত। মনোবিজ্ঞান তখনো আলাদা শাখা হিসেবে গড়ে উঠতে পারেনি। মনকে বিচার করা হতো দর্শন শাস্ত্র দিয়ে। মনোবিজ্ঞান তখনও ছিলো দর্শনের একটি উপশাখা মাত্র। এমন একটি সময়ে ফ্রয়েডের আবির্ভাব ঘটে যিনি মনস্তাত্ত্বিক কার্যকলাপগুলোকে আরও নির্দিষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেন। যদিও সেগুলোর অধিকাংশই ছিল অনুমাননির্ভর।

সিগমুন্ড ফ্রয়েড

The Case of Anna O 

কেস অফ আনা ছিল সিগমুন্ড ফ্রয়েডের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া একটি ঘটনা। এটি আসলে ভবিষ্যৎ মনোবিজ্ঞানকেই যথেষ্ট প্রভাবিত করেছিলো।

আনা যার আসল নাম বার্থা প্যাপেনহেইম (Bertha Pappenheim) ছিলেন হিস্ট্রিয়ায় আক্রান্ত। কোনো রকম শারীরিক কারণ ছাড়াই প্যারালাইসিস, হ্যালুসিনেশন, কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলা ছিলো এই রোগের লক্ষণ। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো তার ডাক্তার জোসেফ ব্রোয়ের (Josef Breuer) তাকে সম্পূর্ণরুপে সারিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন শুধুমাত্র আনার ভুলে যাওয়া অতীতের কিছু ভয়ানক অভিজ্ঞতার কথা তাকে মনে করিয়ে দিয়ে।

Anna O (Bertha Pappenheim)

জোসেফ পরবর্তীতে তার বন্ধু ফ্রয়েডের সাথে এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। এই আলোচনা  ফ্রয়েডকে এতটাই প্রভাবিত করে যে পরবর্তীতে ১৮৯৫ সালে তিনি একটি বই লিখেন ‘Studies in Hysteria’ নামে যেখানে তিনি দাবি করেন যে শারীরিক উপসর্গগুলো আসলে মনের গভীরে প্রোথিত সাংঘর্ষিক অভিজ্ঞতাগুলোরই প্রতিরুপ। শরীরের সাথে মনের এই যোগাযোগ আর কেউ তখোনো করেননি।

এখান থেকেই তিনি মনের একটি মডেল দাঁড় করেন যেখানে মনকে ভাগ করা হয় তিনটি স্তরে। তার মতে মন হচ্ছে পানিতে ভাসমান একটি বরফখন্ডের মতো। আমরা জানি প্রায় ৯০ শতাংশ বরফ থাকবে পানির নিচে নিমজ্জিত। এই বিশাল অংশটিকে তিনি বলছেন অবচেতন মন এবং উপরের ১০% মাত্র সচেতন মন। আমাদের মানসিক প্রক্রিয়াগুলো হয় এই অবচেতন স্তরে।

ফ্রয়েডের দৃষ্টিতে মনের গঠন

এভাবে মূলত সিগমুন্ড ফ্রয়েডের শুরু হয়েছিলো। পরবর্তীতে তিনি মনের আরও বিস্তারিত বর্ণনা দেন। তিনি আরও অনেকগুলো মতবাদ দেন যেগুলোর ভিত্তি ছিলো যৌনতা। শুধুমাত্র যৌনতাকে অবলম্বন করে তিনি ব্যাখ্যা করতে চেয়েছিলেন মানুষের মনের সবকিছু। তার সেইসব মতবাদ কতটুকু বিজ্ঞানসম্মত, ফ্রয়েডিয়ানদের দাবি কতটুকু যৌক্তিক এসব নিয়ে পরে লিখবো। এখন শুধু ভূমিকাটুকু দিলাম।

 

References:

simplypsychology.org/Sigmund-Freud.html

en.wikipedia.org/wiki/Sigmund_Freud

onlinepsychologydegree.info/influential-psychological-experiments/

Related Articles

Exit mobile version