প্রায় প্রতিটি স্বাধীন দেশের স্বাধীনতা অর্জনের পেছনে রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তথা আমেরিকার ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হয়নি। ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে নিজ ভূখণ্ড মুক্ত করতে দীর্ঘদিন যাবত সশস্ত্র আন্দোলন করেছিল আমেরিকানরা। ব্রিটিশ বিরোধী এই সংগ্রাম ইতিহাসে আমেরিকান বিপ্লব হিসেবে পরিচিত। আর এই বিপ্লবের নায়ক জর্জ ওয়াশিংটন। ১৭৯০ এর দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্বাধীনতা অর্জন করলেও এর নেপথ্যে ফ্রেঞ্চ-ইন্ডিয়ান সশস্ত্র যুদ্ধের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। মূলত জর্জ ওয়াশিংটনের উত্থান সেখান থেকেই।
আমেরিকান বিপ্লবে সফলতম কমান্ডিং জেনারেল হিসেবে সুখ্যাতি অর্জন করলেও ২২ বছর বয়সী ওয়াশিংটন ফ্রেঞ্চ-ইন্ডিয়া যুদ্ধের দায় কখনও এড়িয়ে যেতে পারেন না। ১৭৫৪ সালে শুরু হওয়া এই যুদ্ধ ১৭৬৩ সাল অবধি স্থায়ী হয়। উত্তর আমেরিকা অঞ্চলে গ্রেট ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের উপরিবেশ ছিল বহুকাল আগে থেকেই। ওহিও নদীর উপত্যকা ছাড়াও ইন্ডিয়ানা, কেন্টাকি, পেনসিলভানিয়া এবং পশ্চিম ভার্জিনিয়া জুড়ে বিরোধের জের ধরে সাম্রাজ্যবাদী দেশ দুটি আমেরিকা ভূখণ্ডে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। আর জর্জ ওয়াশিংটনের শহর ভার্জিনিয়া থেকে এই যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটে।
মূলত জর্জ ওয়াশিংটনসহ আরও কয়েকজন আমেরিকান কমান্ডারের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে এই যুদ্ধ সাত বছর ধরে চলমান ছিল। এতে করে দুই দেশের ইউরোপিয়ান মিত্র দেশসমূহ যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এতে করে সংঘাত আমেরিকা পেরিয়ে ইউরোপসহ এশিয়া এবং আফ্রিকান ঔপনিবেশিক অঞ্চলগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। আদিবাসী আমেরিকানরাও নিজেদের স্বার্থে মিত্র হিসেবে যুদ্ধের একপক্ষকে বেছে নিয়েছিল।
মূলত ফ্রেঞ্চ-ইন্ডিয়ান যুদ্ধে জর্জ ওয়াশিংটনের ভূমিকা, তার দায় এবং পরবর্তীতে এই যুদ্ধের শিক্ষা কীভাবে আমেরিকান বিপ্লবে ভূমিকা পালন করেছিল সে বিষয় নিয়েই আমাদের আজকের আলোচনা।
ওয়াশিংটনের উত্থান
দক্ষিণ পেনসিলভানিয়ায় সংঘাত শুরু হয় ১৭৫৪ খ্রিস্টাব্দের ২৮ মে। মূলত একদল ব্রিটিশ এবং মিংগো সৈন্যদল ফরাসি সেনাতের ঘাঁটি লক্ষ্য করে হামলা চালানোর মধ্য দিয়ে বিবাদ শুরু হয়। সে সময় ফরাসিদের ঘাঁটির নেতৃত্বে ছিলেন কমান্ডার জোসেফ কোলন ডি ভিলিয়ার্স। অন্যদিকে, এই অভিযানে ব্রিটিশদের নেতৃত্ব দেন ২২ বছর বয়সী জর্জ ওয়াশিংটন এবং মিংগো সেনাদের নেতৃত্বে ছিলেন তানাচারিসন, যাকে অর্ধ-রাজাও বলা হতো। ১৭৫০ এর দশকে ওহিও অঞ্চলে একাধিক ছোটখাট যুদ্ধ পরিচালনার অভিজ্ঞতা ছিল তার। সে হিসেবে ওয়াশিংটন ছিলেন একেবারেই অপরিপক্ব। আর অনভিজ্ঞতাই পরবর্তীতে তার বিপদ ডেকে এনেছিল।
মূলত ওহিও উপত্যকা যে শুধুমাত্র ফরাসি ও ব্রিটিশদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল তা কিন্তু না। এই অঞ্চলে বসতি স্থাপনের জন্য দীর্ঘদিন যাবত লড়াই করে যাচ্ছিল কয়েকটি আদিবাসী গোষ্ঠী। মিংগোরা ছিল সেসব আদিবাসীদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী। তারাও নিজেদের স্বার্থ আদায়ের জন্য ব্রিটিশদের বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করতো। ডর্টমাউথ কলেজের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক গর্ডন কলোওয়ের মতে, মিংগো রাজা তানাচারিসন খুব সহজেই অল্প বয়সী ওয়াশিংটনকে ফরাসিদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনায় প্ররোচিত করেন। ধূর্ত মিংগোরা চেয়েছিল ব্রিটিশদের দিয়ে ফরাসিদের পতন ঘটাতে।
জোসেফের ক্যাম্পে পৌঁছে ফরাসিদের লক্ষ্য করে গুলি চালায় ব্রিটিশ-মিংগো সেনারা। একে একে প্রায় প্রতিটি ফরাসি সৈন্যকে তারা হত্যা করেছিল সেদিন। এমনকি কমান্ডার ডি ভিলিয়ার্সও তাদের হাত থেকে রেহাই পাননি। এই ঘটনার পর নড়েচড়ে বসে দুই ঔপনিবেশিক দেশের শাসকরা। বিচার প্রক্রিয়ায় কে আগে গুলি চালিয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে একজন মিংগো যোদ্ধা ওয়াশিংটনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়। যদিও তিনি প্রথম গুলি চালিয়েছেন কি না সেটি প্রমাণ হয়নি।
কিন্তু ফরাসিরা দাবি করে, ডি ভিলিয়ার্সের সেনারা কূটনীতিক উদ্দেশ্যে সেখানে অবস্থান করছিল এবং তাদের কোনো সামরিক উদ্দেশ্য ছিল না। বরঞ্চ ওয়াশিংটন বিনা ঘোষণায় তাদের উপর হামলা করেন। কিন্তু ওয়াশিংটন তাদের দাবিকে শ্রেফ একটি নাটক উল্লেখ করে জানান, তিনি তার সৈন্যবাহিনীকে ফরাসি আগ্রাসন থেকে রক্ষা করতে গিয়েই হামলা চালিয়েছিলেন। অধ্যাপক গর্ডন কলোওয়েল মনে করেন, দু’পক্ষের পাল্টাপাল্টি অভিযোগের কারণে ২৮ মের ঘটনাটি দীর্ঘায়িত হয়েছিল।
ফরাসিদের পাল্টা হামলা
প্রথম দাঙ্গায় জর্জ ওয়াশিংটন হয়তো বা সামরিকভাবে জয়ী হয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তবে এটি কূটনীতিক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছিল। প্রথমত, তিনি এমন এক দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছিলেন যাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে কোনোভাবেই প্রস্তুত ছিল না ব্রিটিশরা। অন্যদিকে, এই ঘটনার পর ঔপনিবেশিক প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বিশ্বময় ফরাসিদের দারুণ প্রচারণা হয়েছিল। পরিপ্রেক্ষিতে ফরাসিরাও গোপনে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়।
২৮ মে’র হামলায় তিনি জোসেফ ডি ভিলিয়ার্সকে হত্যা করেছিলেন। এই কারণে তার ভাই লুইস কোলন ডি ভিলিয়ার্স প্রতিশোধ নিতে অস্ত্র হাতে নেন। তার নেতৃত্বে ন্যাসেসিটি দুর্গে অবস্থিত ওয়াশিংটনের ভার্জিনিয়া রেজিমেন্টে হামলার পরিকল্পনা করা হয়। জুলাইয়ের ৩ তারিখে ফরাসিরা আরও কয়েকটি আদিবাসী জাতির সেনাদের নিয়ে ভার্জিনিয়া রেজিমেন্টের নবনির্মিত দুর্গে হামলা চালায়। হুরন, ওডাওয়া এবং ইরোকোশরা নামক আদিবাসীরা নিজেদের স্বার্থে সে সময় ফরাসিদের সঙ্গে যোগদান করে।
ফরাসিদের হামলা প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হয় ভার্জিনিয়া রেজিমেন্টের সেনারা। সেই সাথে মিত্রশক্তি হিসেবে পরিচিত আদিবাসীদের কাছ থেকেও তেমন কোনো সাহায্য পায়নি ব্রিটিশ সেনারা। এই হামলার পর ওয়াশিংটন আত্মসমর্পণ করেন। যদিও শর্তসাপেক্ষে ধরা দেন তিনি। জোসেফ ডি ভিলিয়ার্সকে তিনি ফরাসি ভাষায় অজ্ঞ থাকার কারণে হত্যা করিয়েছিলেন বলে উল্লেখ করেন। সেই সাথে একে গুপ্তহত্যা হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য করেন।
ওয়াশিংটন ধরা দেয়ায় ফরাসিরা ব্যাপকভাবে নিজেদের প্রচারণা চালিয়েছিল। সে সময় একে সরাসরি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সশস্ত্রে যুদ্ধে জয় হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন ফরাসি শাসকরা। ওয়াশিংটনের এমন বিপর্যয়ের দিনে স্বয়ং ভার্জিনিয়ার লেফটেন্যান্ট গভর্নরও মুখ ফিরিয়ে নেন। রাজ্যের সঙ্গে অসহায় ওয়াশিংটনের এমন দূরত্বকে সহজভাবে নিতে পারেনি লন্ডনের কর্তারা। আর এই কারণেই জরুরি সিদ্ধান্ত মোতাবেক উত্তর আমেরিকায় ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি সংখ্যাক সেনা মোতায়েন করে ব্রিটিশরা।
মেজর জেনারেল এডওয়ার্ড ব্র্যাডকের নেতৃত্বে ১৭৫৫ সালের মে মাসে ওহিও নদীর উপত্যকায় ঘাঁটি গড়ে ব্রিটিশ বাহিনী। জেনারেল ব্র্যাডকের সঙ্গে জর্জ ওয়াশিংটনও ছিলেন সেখানে। ততদিনে অবশ্য ভার্জিনিয়া রেজিমেন্টের কর্নেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন তিনি। দুই মাসের যুদ্ধে ফরাসিদের বিপক্ষে পরাজিত হয় ব্র্যাডক বাহিনী। এটি মনোঙ্গাহেলার যুদ্ধ নামেই ইতিহাসে বিখ্যাত। পরবর্তীতে জর্জ ওয়াশিংটন আহত অবস্থায় ব্র্যাডককে নিয়ে পিছু হটেন। ফলশ্রুতিতে এবারও পরাজিত হন ওয়াশিংটন তথা ব্রিটিশরা।
পরাজয় থেকে ওয়াশিংটনের শিক্ষা
১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দে আনুষ্ঠানিক চুক্তির মধ্য দিয়ে ফ্রেঞ্চ-ইন্ডিয়া যুদ্ধের অবসান ঘটে। ফলশ্রুতিতে ওহিও নদী উপত্যকা ছাড়তে বাধ্য হয় তারা। কিন্তু এই যুদ্ধের পর ব্যক্তিগতভাবে খুশি ছিলেন না জর্জ ওয়াশিংটন! দীর্ঘ যুদ্ধে সরাসরি ভূমিকা পালন করেও কোনোপ্রকার রাজকীয় উপাধিতে ভূষিত হননি তিনি। সেকালে কলোনিয়াল সামরিক বাহিনীর জেনালের থেকেও ব্রিটিশ রাজপরিবার প্রদত্ত উপাধিগুলো ছিল সম্মানের।
তবে এই যুদ্ধের বিভিন্ন ধরনের পরিস্থিতি ওয়াশিংটনকে একজন অভিজ্ঞ জেনারেল হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিল। তিনি সৈনিকদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার ব্যাপারে সোচ্চার ছিলেন। আর এই প্রয়োজনগুলো মেটানোর জন্য রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সহায়তার উৎস খুঁজে বের করেন। এতে করে তার সঙ্গে বিভিন্ন অঞ্চলের আদিবাসী এবং প্রশাসকের সুসম্পর্ক তৈরি হয়ে। এছাড়াও ব্র্যাডকের সঙ্গে থেকে যুদ্ধ করার কারণে সামরিক শক্তি, রসদ ও সংগঠনের পাশাপাশি ব্রিটিশ যুদ্ধকৌশলসমূহ বেশ ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পেরেছিলেন ওয়াশিংটন।
ফ্রেঞ্চ-ইন্ডিয়া যুদ্ধের মধ্য দিয়ে তিনি আদিবাসীদের গুরুত্বও উপলব্ধি করেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আমেরিকান বিপ্লবের সময় তিনি এবং তার সেনাবাহিনী আদিবাসী আমেরিকানদের সঙ্গে চুক্তি করতে সক্ষম হন। আর এই পরিকল্পনা অনুযায়ী বিপ্লবটি সফলতা অর্জনের পাশাপাশি আমেরিকা থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিভক্ত হয়ে যায়। আর তখন অন্যান্য কলোনির শাসকরা নতুন দেশের জন্য এমন কাউকে খুঁজছিলেন যিনি কি না নতুন দেশ পরিচালনার পাশাপাশি সামরিক বাহিনী পরিচালনায় সমানভাবে দক্ষ। সৌভাগ্যবশত বিপ্লবের অন্যতম নায়ক জর্জ ওয়াশিংটনকে পেয়েও যান মার্কিনিরা। আর জর্জ ওয়াশিংটন স্বাধীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে নিজের অজান্তে যে যুদ্ধ বাঁধিয়েছেন সেটির সমাপ্তিও ঘোষণা করেন।