জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে জড়িত বিধ্বংসী বন্যা, ঘূর্ণিঝড় এবং অন্যান্য পরিবেশ বিপর্যয় বাংলাদেশের প্রায় ১৯ লাখ শিশুর জীবন ও ভবিষ্যতকে হুমকির মুখে রেখেছে। শিশুদের উন্নতি ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনাকারী জাতিসংঘের বিশেষ সংস্থা ইউনিসেফ গত বছর এক প্রতিবেদনে এমন তথ্যই জানিয়েছে। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক হেনরিটা ফোরে বলছেন, “জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পরিবারগুলোর মাধ্যমে পরিবেশগত হুমকিকে আরও বৃদ্ধি করছে, তাদের সন্তানদের যথাযথভাবে বাসস্থান, খাদ্য, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো মৌলিক অধিকারগুলো অর্জনও সামর্থ্যের কাছে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।“
জলবায়ু পরিবর্তনের মতো সমস্যা পুরো পৃথিবীর সকলকে ভাবিয়ে তুললেও সেই তুলনায় এই সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টায় তেমন একটা গতি নেই। সচেতনতা যেমন এই সমস্যা থেকে উত্তরণে প্রধান নিয়ামক হতে পারে, সেই সচেতন করার কার্যক্রমেও ঢিলেঢালা ভাব প্রায় সব দেশেই। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কীভাবে ঝুঁকির মধ্যে পড়বে এবং সেটাকে শিশুদের উপযোগী করে তুলে ধরার ভাবনা থেকে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো তৈরি হয়েছে স্বল্পদৈর্ঘ্যের অ্যানিমেটেড চলচ্চিত্র ‘টুমরো‘।
কাজী জাহিন হাসান ও কাজী জিসান হাসানের গল্প, ভাবনা ও প্রযোজনায় ‘টুমরো’ পরিচালনা করেছেন মোহাম্মদ শিহাব উদ্দিন। বাংলাদেশের সাইকোর স্টুডিওতে নির্মিত এই স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রটি গত বছরের ২৯ নভেম্বর বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল দীপ্ত টিভিতে প্রচারিত হয়। এরপর গত ডিসেম্বরে ইউটিউবে প্রকাশিত হয় ‘টুমরো।
একটুখানি ‘টুমরো’
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের মতো নিচু ভূমির অঞ্চলগুলো কেমন ঝুঁকিতে আছে, ভবিষ্যতে কী অবস্থা হবে এবং এই সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায়- সবই বেশ পরিষ্কারভাবে তুলে ধরা হয়েছে ২৫ মিনিট ৫১ সেকেন্ডের ছোট্ট ‘টুমরো’তে। দৈর্ঘ্যের হিসেবে ছোট হলেও স্বল্পদৈর্ঘ্যের এই চলচ্চিত্র থেকে পরিবেশ বিষয়ক সমসাময়িক ইস্যুটিতে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা নেয়ার আছে।
ছোট্ট রাতুল এবং বাতাসের বুড়ো এই চলচ্চিত্রটির মূল ভূমিকায় ছিলেন। কক্সবাজারের বাসিন্দা রাতুল জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াল থাবার আশংকা থেকে একসময় শিশুদের নিয়ে এর বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান শত্রু জীবাশ্ম জ্বালানী ব্যবহার কমাতে তার এই উদ্যোগে টনক নড়ে বাংলাদেশ সরকারের। জীবাশ্ম জ্বালানীর উপর ট্যাক্স বসানোর সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। সেই ট্যাক্স থেকে পাওয়া অর্থ ব্যয় হয় ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার মানুষের কল্যাণে। বহু বছর পর এই দেশের সফলতা অনুকরণীয় হয়ে ওঠে বিশ্বমঞ্চে। এমন করেই এগোয় ‘টুমরো’র গল্প।
পেছনে ফেরা যাক
প্রায় ১৭৭ বছর আগের ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নির্মিত হয়েছে ‘টুমরো’। ব্রিটিশ লেখক চার্লস ডিকেন্স ১৮৪৩ সালে ‘অ্যা ক্রিসমাস ক্যারোল’ নামে একটি উপন্যাস লেখেন। ১৯৭১ সালে এই উপন্যাস নিয়ে অ্যানিমেশন শর্টফিল্ম বানান ব্রিটিশ-কানাডিয়ান অ্যানিমেটর রিচার্ড উইলিয়ামস। মূলত এই ছবিটি দেখেই ‘টুমরো’ বানানোর পরিকল্পনা মাথায় আসে কাজী জিসান হাসানের। জাতীয় দৈনিক প্রথম আলোয় এই চলচ্চিত্রটি নিয়ে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এমনটাই বলা হয়েছে।
২০১৫ সাল থেকেই নির্মাণের পরিকল্পনা শুরু হয় ‘টুমরো’র। পরবর্তী দেড় বছর কেটেছে চিত্রনাট্য তৈরির কাজে। চিত্রনাট্যকার আহমেদ খান হীরক বলছিলেন প্রথম দিককার কথা,
‘টুমরো’ লেখার প্রস্তাব যখন প্রথম আসে আমাদের কাছে আমরা বোঝার চেষ্টা করেছিলাম ফিল্মটির উদ্দেশ্য আসলে কী। আপাতদৃষ্টিতে এটি একটি সঠিক ধারণা হয়ে থাকে যে এর উদ্দেশ্য সচেতনতা তৈরিই তো হবে! কিন্তু হয় কি, কখনো কখনো কাজ করতে করতে বুঝি মূল উদ্দেশ্যকে গ্রাস করছে উপ-উদ্দেশ্যগুলো। অর্থনৈতিক সাফল্য কিংবা সুনাম অর্জন কিংবা উভয়ই অর্জন কোনোটাই খারাপ কিছু না। কিন্তু ‘টুমরো’র ক্ষেত্রে এই তিনটার একটা কারণও যদি মুখ্য হয়ে দাঁড়াত তাহলে ‘টুমরো’ আজকে যেখানে আছে সেখানে দাঁড়াতে পারত না।
২০১৭ সালের ২০ জুলাই সাইকোর স্টুডিওতে শুরু হয় ‘টুমরো’র নির্মাণকাজ। পরিচালক মোহাম্মদ শিহাব উদ্দিনের কাছ থেকে জানা গেল বিশাল এই নির্মাণযজ্ঞের গল্প। শুরুতে পাপেট শো-র মতো করে ডায়ালগ দেয়া টু-ডি এনিমেশনে এটি তৈরির কথা থাকলেও পরবর্তীতে পরিচালকের ইচ্ছায় থ্রিডি অ্যানিমেশনেই ‘টুমরো’ তৈরির সিদ্ধান্ত হয়। এরপর সময়ের সাথে স্বপ্ন মেলছিল ডানা। একটু একটু করে তৈরি হচ্ছিল ‘টুমরো’। দুই বছরের দীর্ঘ কর্মযজ্ঞে চ্যালেঞ্জও কম ছিল না। শিশুদের জন্য যেহেতু এই কাজ, তাই তাদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ার ব্যাপারটিও ছিল নির্মাতাদের ভাবনায়। সবকিছু বিবেচনায় রেখেই কাজ এগিয়েছে। ১৫ জনের ছোট দলটি গত বছরের জুলাই মাসে শেষ করে ‘টুমরো’ তৈরির কাজ।
‘টুমরো’র কারিগর
আগেই জানানো হয়েছে, স্বল্পদৈর্ঘ্যের এই চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেছেন মোহাম্মদ শিহাব উদ্দিন। তার সার্বিক নির্দেশনায় সাইকোর স্টুডিওতে ১৫ জনের একটি দল ‘টুমরো’ তৈরিতে কাজ করেছে। প্রযোজক কাজী জাহিন হাসান ও কাজী জিসান হাসানের গল্প-ভাবনাকে চিত্রনাট্যে রূপ দিয়েছেন আহমেদ খান হীরক ও নাসিমুল হাসান। ‘টুমরো’র অ্যানিমেটর ছিলেন দুজন- জামশেদ খান শোভন এবং আদনান আল সাজ্জাদ। রাতুল এবং বাতাসের বুড়ো- ‘টুমরো’র মূল এই দুই চরিত্রে কন্ঠ দিয়েছেন যথাক্রমে ইশান আবদুল্লাহ ও দীপক কুমার গোস্বামী।
দর্শক ভাবনা
টেলিভিশন কিংবা অনলাইন মাধ্যম- সব জায়গায় ভাবনার চেয়েও বেশি সাড়া ফেলেছে ‘টুমরো’। তবে এটা যে সম্পূর্ণ বাংলাদেশে তৈরি চলচ্চিত্র সেটা বিশ্বাস করতে বা বুঝতেই পারেননি বহু দর্শক- এর প্রমাণ পাওয়া গেল ইউটিউবে কমেন্ট সেকশনে। এখন পর্যন্ত ৬ লাখ ৯০ হাজারের বেশি মানুষ ইউটিউবে ‘টুমরো’ দেখেছে, তবে নির্মাতা শিহাবের মতে, এই সংখ্যাটা প্রথম ১০ দিনেই এক মিলিয়ন ছাড়িয়েছে। তার দল ‘টুমরো’ নিয়ে রীতিমতো অনলাইনে যুদ্ধ করছেন বলে জানালেন তিনি। কিছুদিন পর পরই বিভিন্ন নামে-বেনামে একাউন্ট থেকে এটি আপলোড দেয়ায় মূল একাউন্টের ভিউতে এর প্রভাব পড়েছে।
ইউটিউবে টুমরো দেখে মানুষের উচ্ছ্বাস আর ভালোলাগার গল্প বলছিলেন তিনি। বলছিলেন একজন বাবার কথা যিনি তার বাচ্চাকে ‘টুমরো’ দেখিয়েছেন। সেই বাচ্চাও এখন হতে চায় রাতুলের মতো। শিহাব উদ্দিন জানালেন, বহু মানুষ প্রথমে বুঝতেই পারেনি এমন অনবদ্য সৃষ্টির পেছনের মানুষেরা বাংলাদেশী। জানতে পেরে তারা আবেগাপ্লুত হয়েছেন। তিনি জানালেন, বিদেশী অনেকেই ‘টুমরো’ দেখে তাদের ভাষায় ডাবিং চেয়েছেন। শুধু সাধারণ দর্শক নয়, ‘টুমরো’কে প্রশংসায় ভাসিয়েছেন বিনোদন জগতের অনেক চেনা মুখ। এই তালিকায় আছেন আইরিশ চলচ্চিত্র পরিচালক টম মুরে, আমেরিকান চলচ্চিত্র পরিচালক-প্রযোজক গ্যারি গোল্ডম্যান, আমেরিকান এনিমেটর নাতে হোর্সফালসহ অসংখ্য পরিচিত মুখ।
‘টুমরো’র টুমরো
টুমরো দেশের বাইরের আন্তর্জাতিক কোনো চলচ্চিত্র উৎসবে গিয়েছে কি না জানতে চাওয়া হয়েছিল নির্মাতা শিহাব উদ্দিনের কাছে। জবাবে তিনি জানালেন, উৎসবে পাঠালে দেশের মানুষকে আরও কিছুদিন বঞ্চিত রাখতে হতো এটি দেখা থেকে, যেটি তারা করতে চাননি। তাই যত দ্রুত পেরেছেন উন্মুক্ত করে দিয়েছেন দর্শকদের জন্য।
দেশ থেকে দেশে ছড়িয়েছে ‘টুমরো’র দর্শকপ্রিয়তা। এখন নানা ভাষায় ডাবিং চলছে এই চলচ্চিত্রের। পরিচালক জানালেন, ইংরেজি, ফরাসি, ডাচ, ইন্দোনেশীয়সহ আরো কয়েকটি ভাষার ডামি ডাবিং করা হয়েছে। সেগুলো যাচাইবাছাই করে দেখা হচ্ছে এখন। এই চলমান প্রক্রিয়ায় সময় লাগবে। ইতিমধ্যেই ১০টি ভাষায় সাব টাইটেল যুক্ত করা হয়েছে। আরও ২টি ভাষায় সাবটাইটেল তৈরি হচ্ছে। এছাড়া আরও ১৩টি ভাষায় সাবটাইটেল তৈরির পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন তিনি।
‘টুমরো’র এই সাফল্যগাঁথা চলুক। জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বৈশ্বিক সমস্যা সমাধানে ছোট্ট এই প্রচেষ্টা ছাপ রাখুক নীতিনির্ধারকদের বড় পদক্ষেপে।