১৯৮৯ সালে চিরচেনা বার্মাকে নতুন করে ‘মায়ানমার’ নামে অভিহিত করা হলো। রেঙ্গুনের নামও হয়ে গেল ‘ইয়াঙ্গুন’। অবশ্য বার্মিজ ভাষায় আগে থেকেই ‘মায়ানমার’ (Myanmar or Mranma Prañ) নামটি বার্মায় প্রচলিত ছিল। আনুষ্ঠানিক ও দাপ্তরিক বিভিন্ন লিখিত কাজে দেশটিকে ‘মায়ানমার’ নামেই ডাকা হত, আর ‘বার্মা’ হলো ‘মায়ানমার’ শব্দের অপভ্রংশ বা কথ্য/চলিত রূপ। বার্মা নামের সাথে ‘বামার’ গোত্রের নামের মিল থাকায়, আর বার্মা জুড়ে ১৩৫টি স্বীকৃত নৃগোষ্ঠী থাকায়, সবার সমর্থন অর্জন করতে জান্তা সরকার বার্মার বদলে মায়ানমার নাম প্রচলনে আগ্রহী হয় বলে অনেকের ধারণা। আবার অনেকের মতে, দেশের নামসহ বিভিন্ন শহরের নাম পরিবর্তনের মাধ্যমে তারা দেশটির ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ইতিহাস থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। ২০০৫ সালে রেঙ্গুন (বর্তমানে ইয়াঙ্গুন) থেকে রাজধানীও স্থানান্তরের কাজ শুরু হয়। প্রথমে পিন্মানা (Pyinmana) ও পরে ২০০৬ সালে নাইপেদোতে (Naypyidaw) মায়ানমারের নতুন রাজধানী স্থাপিত হয়।
যা-ই হোক, বার্মার ব্যাপারে কমন তিনটি ন্যারেটিভ বিশ্ববাজারে চালু আছে। এক, সামরিক জান্তাদের কারণে বার্মা যেহেতু একটি ‘ক্লোজড কান্ট্রি’তে পরিণত হয়েছিল, তাই সারা বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। দুই, অং সাং সুকি যেহেতু বছরের পর বছর নিজ গৃহে অবরুদ্ধ ছিলেন, তাই মুক্তি পেয়ে এবার তিনি বার্মায় গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে যা করার সব করবেন। তিন, দীর্ঘদিনের সামরিকতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথে এসব ছোটখাট জাতিগত সংঘাত তো হতেই পারে।
সমস্যা হলো, এই ন্যারেটিভ তিনটির সবকয’টিই ভুল এবং লোক দেখানো। তবে এই বিষয়ে আমরা পরে বিস্তারিত আলোচনা করব। তার আগে চলুন আধুনিক বার্মার অবস্থাটা জেনে নেয়া যাক।
১৯৯০ সালের নির্বাচন ও অং সাং সুকির নোবেল লাভ
‘৮৮ র গণঅভ্যুত্থানের কারণে এমনিতেই জান্তা সরকার আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ছিল। তার উপর অং সাং সুকির উত্থান আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করছিল বারবার। অতএব সেই ১৯৬০ সালের পর প্রথমবারের মতো গত ২৭ মে ১৯৯০ সালে বহুদলীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। ১৯৯০ সালের এই সাধারণ নির্বাচনের কথা মাথায় রেখেই ১৯৮৮ সালে ক্ষমতাসীন বার্মা সোশ্যালিস্ট প্রোগ্রাম পার্টি নাম বদলে ন্যাশনাল ইউনিটি পার্টি হয়ে গেল। সেই সাথে অং সাং সুকির নেতৃত্বে ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসি (এনএলডি) এর জন্ম হয়। এই নির্বাচনে অং সাং সুকির এনএলডি জয় লাভ করলেও আসলে লাভ তেমন হলো না। কারণ ‘সংসদীয় গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করা’ না, বরং এই নির্বাচনের উদ্দেশ্যই ছিল নতুন সংবিধান প্রণয়নের জন্য একটি কমিটি গঠন! তাই সামরিক জান্তা এই ফলাফলকে আদৌ পাত্তা না দিয়ে সুকিকে গৃহবন্দী করে রেখে ‘স্টেট পিস এন্ড ডেভেলপমেন্ট কাউন্সিল’ এর মাধ্যমে দেশ চালাতে লাগল।
আধুনিক বার্মার প্রতিষ্ঠাতা অং সান কন্যা অং সান সুকি ১৯৪৫ সালের ১৯শে জুন রেঙ্গুনের (বর্তমান ইয়াঙ্গুন) হামওয়ে সাউং নামক একটি ছোট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। সুকির মা খিন চি ছিলেন নবগঠিত বার্মা রাষ্ট্রের একজন গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। ১৯৬৪ সালে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় ও ১৯৬৮-তে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক অর্জন করার পর তিনি জাতিসংঘে তিন বছর কাজ করেন। ১৯৭২ সালে মাইকেল অ্যারিসকে বিয়ে করেন এবং তাদের দুই ছেলে হয়। ১৯৮৮-র গণআন্দোলনের সময় সুকি সবার নজর কাড়েন এবং ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসির (এনএলডি) সাধারণ সম্পাদক হন। এই ডামাডোলের মাঝেই ১৯৯১ সালে অং সাং সুকি পেয়ে গেলেন শান্তিতে নোবেল পুরস্কার!
স্যাফরন রেভ্যুলুশন
নতুন সংবিধান প্রণয়নের কথা মাথায় রেখে ১৯৯৩ সালে জান্তা সরকার রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর প্রভাব অক্ষুন্ন রেখে সংসদ গঠনের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু ১৯৯৫ সালে এনএলডি ‘ওয়াক আউট’ করলে সেই প্রচেষ্টা ভেস্তে যায়। অবশ্য নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকেই ককাং, ওয়া, কাচিন আর কারেনসহ বিভিন্ন বার্মিজ ইন্সার্জেন্টরা সামরিক জান্তাকে তটস্থ করে রাখে। জেনারেল খিনের চেষ্টায় এদের অনেকেই শান্ত হলেও কারেন বিদ্রোহীরা কোনোভাবেই সমঝোতায় রাজি হচ্ছিল না। অতএব ১৯৯৫ সালে ততমদো যুদ্ধ করে কারেন ঘাঁটি দখল করে নেয়। এভাবেই সারা বার্মা জুড়ে জান্তা সরকারের নিপীড়ন চলতেই থাকল।
গণতন্ত্রের প্রতি বার্মিজ জান্তা সরকারের অনীহা দেখে ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘ বার্মার উপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে, আর ইউরোপিয়ান ইউনিয়নও একই কাজ করে ২০০০ সালে। ২০০০ সালে অং সান সুকি ফের গৃহবন্দী হলেন, যা ২০০২ সালে তুলে নেয়া হয়। ২০০৩ সালে তার গাড়িবহরে হামলা চালায় দুস্কৃতিকারীরা। এই ফাঁকে জান্তা সরকার সুকির এনএলডি পার্টির উপর চড়াও হয় আরেক দফা। ২০০৩ সালের আগস্ট মাসে জান্তা সরকার সাত ধাপের একটি ‘রোড ম্যাপ টু ডেমোক্র্যাসি’ ঘোষণা করে, যদিও কবে নাগাদ এই রোড ম্যাপ বাস্তবায়ন হবে সে ব্যাপারে কিছু বলা হলো না।
২০০৫ সালে এনএলডিসহ অন্যান্য বড় রাজনৈতিক দলগুলোকে বাইরে রেখে ছোট ছোট কিছু দলকে সাথে নিয়ে জান্তা সরকার আরেকবার সংবিধান সংশোধনের চেষ্টা করে। একইসাথে রেঙ্গুন থেকে রাজধানী সরানোর কাজও শুরু হয়। অবশেষে ২৭ মার্চ ২০০৬ তারিখে ‘নাইপেদো’ বার্মার নতুন রাজধানী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল। ২০০৬ সালের নভেম্বর মাসে আইএলও ঘোষণা দিল যে, তারা ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অফ জাস্টিসে মায়ানমারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে যাচ্ছে। আইএলওর মতে, জান্তা সরকার আট লক্ষ বার্মিজ নাগরিককে নিজেদের স্বার্থে জোর করে কাজ করাচ্ছে।
২০০৭ সালে তেলের দামের উপর জান্তা সরকার ভর্তুকি তুলে নিলে বার্মা ফের বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠল। বৌদ্ধ ভিক্ষুরাও এতে যোগ দিলে ইতিহাসে তা ‘স্যাফরন রেভুলুশন’ নামে খ্যাতি পায়। জান্তা সরকার যথারীতি সামরিক কায়দায় গুম খুন করে এই বিক্ষোভ দমাতে চেষ্টা করে এবং ব্যর্থ হয়। ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঘোষণা আসে গণভোটের, যা অনুষ্ঠিত হবে ২০১০ সালে।
নার্গিস তান্ডব এবং স্টেট কাউন্সেলর সুকি
২০০৮ সালের ৩ মে ঘূর্ণিঝড় ‘নার্গিস’ বার্মায় আঘাত হানে। প্রলয়ংকারী এই ঘূর্ণিঝড়ে পুরো বার্মা তছনছ হয়ে যায়। প্রায় এক লাখ ত্রিশ হাজার লোক প্রাণ হারায় আর দশ বিলিয়ন ডলারের ক্ষয়ক্ষতি হয়। কিন্তু জান্তা সরকার কোনোপ্রকার আন্তর্জাতিক ত্রাণ দেশে ঢুকতে দিতে অস্বীকৃতি জানায়, যা জাতিসংঘ ‘নজিরবিহীন’ বলে আখ্যায়িত করে। এরপরই মূলত জান্তা সরকার আন্তর্জাতিক সহানুভূতি হারিয়ে ফেলে। চাপের মুখে ২০১০ সালে তারা অং সান সুকিকে মুক্ত করতে এবং তার সাথে আলোচনায় বসতে বাধ্য হয়। উৎসাহ দিতে ১ ডিসেম্বর ২০১১ সালে হিলারি ক্লিনটন বার্মা সফরে আসেন। তার এক বছর পর আসেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা।
জান্তা সরকার আইন সংশোধন করলে ২০১২ সালের উপ নির্বাচনে সুকির এনএলডি পার্টি অংশ নেয় এবং ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জয় লাভ করে। আর ৮ নভেম্বর ২০১৫ সালের সাধারণ নির্বাচনেও এনএলডি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করে। কিন্তু সংবিধান অনুযায়ী ব্রিটিশ স্বামী ও দুই সন্তানের কারণে এবং সামরিক চাকরির অভিজ্ঞতা না থাকার কারণে সুকির পক্ষে প্রেসিডেন্ট হবার কোনো সুযোগ ছিল না। কিন্তু নবগঠিত সরকারে সুকির ক্ষমতা অটুট রাখতে তার জন্য স্টেট কাউন্সেলর অফ মায়ানমার পদটি সৃষ্টি করা হলো। নতুন সংসদের প্রথম অধিবেশন বসে ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ তারিখে। আর মায়ানমারের নবম প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ পেলেন থিন কিও, যিনি মায়ানমারের প্রথম অসামরিক প্রেসিডেন্টও বটে।
ক্লিঞ্জিং অপারেশন
এদিকে সর্বশেষ রোহিঙ্গা উচ্ছেদ অভিযান শুরু হয়ে গিয়েছিল ২০১৬ সালের শেষভাগে। ‘ক্লিঞ্জিং অপারেশন’ নামে পরিচিত এই অভিযানে অংশ নেয় মায়ানমার সেনাবাহিনী (ততমদো) এবং পুলিশ। ১৯৪৭ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে রোহিঙ্গাদের সমূলে উচ্ছেদ করার নীলনকশার চূড়ান্ত ধাপ হিসেবে উত্তর-পশ্চিম রাখাইনে বার্মিজ বৌদ্ধ উগ্রবাদীদের সহযোগে এই নৃশংস অভিযান পরিচালিত হয়েছিল। অমানবিক এই অভিযানের বিরুদ্ধে সারা বিশ্ব নিন্দা জানালেও মায়ানমার সরকার যথারীতি এসব তথ্য-প্রমাণকে ‘অতিরঞ্জন’ বলে অস্বীকার করে। এসময় ততমদোর নৃশংসতা রোধে শান্তিতে নোবেল জয়ী নেত্রী অং সান সুকির নির্বিকার ভূমিকাও সারাবিশ্বে প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে এই অভিযানের তীব্রতা দারুণভাবে বৃদ্ধি পায়। প্রায় দশ হাজার রোহিঙ্গাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় যেন বাকিরা আতংকিত হয়ে পালানো শুরু করে। সেই সাথে বৌদ্ধ উগ্রবাদীদের সাথে নিয়ে ততমদো আর পুলিশ মিলে ব্যাপক লুটপাট ও গণধর্ষণ শুরু করে। ৩৯২টি রোহিঙ্গা গ্রাম আগুনে পুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়। বার্তা সংস্থা রয়টারের দুই সাংবাদিক এসব সংবাদ প্রচারের চেষ্টা করলে তাদের কারাগারে পাঠানো হয় এবং ৭ বছরের জেল হয়। জাতিসংঘসহ বিশ্বের সকল মানবাধিকার সংস্থা ও গণমাধ্যম একে ‘অ্যা টেক্সটবুক একজাম্পল অফ এথনিক ক্লিঞ্জিং’ এবং ‘জেনোসাইড’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে ধিক্কার জানায়। এই নিষ্ঠুর অভিযানের ফলে প্রাণের ভয়ে প্রায় সাত লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়। রোহিঙ্গাদের এমন দুঃসময়ে নোবেল জয়ী নেত্রী সুকির নীরবতায় আরো একবার সারাবিশ্বে নিন্দার ঝড় ওঠে।
২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে মায়ানমার সরকার বাংলাদেশ সরকারকে আশ্বাস দেয় যে, দুই মাসের ভেতর রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফিরিয়ে নেয়া হবে। যা-ই হোক, ২০১৮ সালের মার্চ মাসে প্রেসিডেন্ট থিন কিওকে সরিয়ে দেয়া হয় এবং অং সাং সুকির পুতুল প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ পান উইন মিন্ট। ২০১৮ সালের আগষ্ট মাসে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগে ততমদো জেনারেলদের বিচারের দাবি জানায়। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে রোহিঙ্গা গণহত্যায় যোগসাজশ আছে সন্দেহে কানাডা সরকার অং সাং সুকির সম্মানসূচক কানাডীয় নাগরিকত্ব বাতিল করে। মায়ানমার সরকার রোহিঙ্গা গণহত্যার সকল চিহ্ন সরিয়ে ফেলতে রাত-দিন চেষ্টা করে যাচ্ছে। সম্প্রতি ২০১৯ সালের ২১ জুন মায়ানমার সরকারের নির্দেশে সারা রাখাইনে ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়।
আধুনিক বার্মাকে জানুন
অং সান সুকির সরকার কী লুকাতে চাইছে আর কেনই বা লুকাতে চাইছে তা আমরা পরের পর্বে জানব। তার আগে চলুন জেনে নেয়া যাক আধুনিক মায়ানমার সম্পর্কে।
মায়ানমারের অফিশিয়াল নাম রিপাবলিক অফ দ্য ইউনিয়ন অফ মায়ানমার। রাজধানী নাইপেদো, সরকারি ভাষা বর্মী আর মুদ্রার নাম কিয়াত। দেশটিতে সামরিক বাহিনী সমর্থিত গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা বিদ্যমান। বর্তমান (২০১৯) রাষ্ট্রপতি থেইন কিয়াও এবং উপরাষ্ট্রপতি সাই মাউক খাম। তবে সর্বময় ক্ষমতা স্টেট কাউন্সেলর অং সান সুকির হাতে, এই পদটি প্রধানমন্ত্রীর সমমানের। দেশটি ২০১২ সালের ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্ট অনুযায়ী ১৭৬টি দেশের মধ্যে দুর্নীতিতে ১৭১তম।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই দেশটির পশ্চিমে আছে ভারতের মিজোরাম, মনিপুর, নাগাল্যান্ড ও অরুণাচল প্রদেশ এবং বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগ। পূর্বে থাইল্যান্ড ও লাওস, এবং উত্তর ও উত্তর-পূর্বে আছে চীন। বঙ্গোপসাগর ও আন্দামান সাগরের পাশে মায়ানমারের আছে প্রায় ১,২০০ মাইল দীর্ঘ উপকূল। দেশটির মোট আয়তন ৬,৭৬,৫৭৪ বর্গ কি.মি. আর জনসংখ্যা প্রায় ৫৪ মিলিয়ন (২০১৭ আদমশুমারি অনুযায়ী)। কমনওয়েলথভুক্ত দেশ না হলেও ১৯৯৭ সাল থেকে দেশটি আসিয়ানের সদস্য।
ভূমি
ইরাবতি আর সিতং নদীর মোহনায় মায়ানমার দেখতে অনেকটা লেজওয়ালা ঘুড়ির মতো। উত্তর থেকে মায়ানমারের দৈর্ঘ্য প্রায় ২,০৫০ কি.মি. আর প্রস্থে ৯৩০ কি.মি.। গ্রামপ্রধান এই দেশটিকে পাঁচটি অঞ্চলে ভাগ করা যায়। উত্তরের পার্বত্য অঞ্চল, যেখানে কাচিন স্টেটে অবস্থিত মাউন্ট হাকাবো দেশের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ, পশ্চিমা পার্বত্য অঞ্চল, পূর্বের উপত্যকা অঞ্চল, দেশের মধ্যভাগের বেসিন ও নিম্নাঞ্চল, এবং উপকূলীয় সমভূমি। দেশের অর্ধেকের বেশি এলাকা বনজঙ্গলে ভরা। উত্তরে হেংদুয়ান পর্বতমালা চীন থেকে বার্মাকে আলাদা করেছে। ইরাবতি বার্মার দীর্ঘতম নদী (২,১৭০ কি. মি. দীর্ঘ)। এছাড়াও সালউইন আর সিতাং দেশটির অন্যতম নদী।
নৃগোষ্ঠীদের ভিত্তিতে প্রশাসনিকভাবে মায়ানমার সাতটি প্রদেশ বা বিভাগে বিভক্ত (চিন, কাচিন, কায়িন বা কারেন, কায়াহ, মন, রাখাইন বা আরাকান, এবং শান)।
জলবায়ু
মায়ানমারের উপর দিয়ে মৌসুমি বায়ু বয়ে গেলেও উত্তরের পার্বত্যাঞ্চলে বছরে দুই মাস তুষারপাত হয়। ঋতু মূলত তিনটি- অক্টোবরের শেষভাগ থেকে মধ্য ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত শীতকাল, মধ্য ফেব্রুয়ারি থেকে মধ্য মে পর্যন্ত গ্রীষ্মকাল, আর বাকি সময় বর্ষা।
মানুষ
মায়ানমারে ১৩৫টি ধর্ম-বর্ণ-গোত্রের লোক বাস করে। বার্মানরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। কারেনরা মোট জনসংখ্যার দশ ভাগের এক ভাগ। ছাড়াও আছে কায়া, শান, মন, নাগা, চিন, কাচিন ইত্যাদি গোষ্ঠি বা গোত্র। তবে মুসলমান হবার কারণে রোহিঙ্গাদের অস্তিত্ব অস্বীকার করা হয়ে থাকে। বার্মার বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির পরিসংখ্যান নিম্নরূপ:
মায়ানমারের জনসংখ্যার ৬৮% বামার, ১০% শান, ৭% কাইন, এবং ৪% রাখাইন। এছাড়াও আছে মন, কাচিন, কারেন, চিন, রোহিঙ্গা, অ্যাংলো ইন্ডিয়ান, গুর্খা, নেপালি এবং অ্যাংলো বার্মিজসহ অন্যান্য সংখ্যা লঘু গোষ্ঠী। সামরিক জান্তা বার্মানাইজেশন নীতি অনুসরণ করে ধীরে ধীরে সংখ্যা লঘুদের নিজস্বতাকে হরণ করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। জান্তাদের অত্যাচারে দেশছাড়া হয়ে বহু বার্মিজ থাইল্যান্ড, ভারত, বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার শরণার্থী শিবিরগুলোতে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। ঐতিহাসিকভাবে মায়ানমারে শিক্ষার হার বেশ উঁচু। বিশ্ববিদ্যালয় আছে ১০০টির উপর। যদিও ১৯৮৫ সালে জাতিসংঘে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেতে শিক্ষার হার ৭৯% এর বদলে ১৯% দেখিয়েছিল। রাষ্ট্রীয় ধর্ম বলে কিছু না থাকলেও দেশটির ৮৫% এর বেশি মানুষ বৌদ্ধ (Theravada Buddhism) ধর্মাবলম্বী। এছাড়াও মুসলমান, হিন্দু ও খ্রিস্টানরাও আছে, তবে সরকারি চাকরিতে তাদের সুযোগ পাওয়ার উদাহরণ বিরল।
অর্থনীতি
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে বিচ্ছিন্নতা ও আভ্যন্তরীণ অব্যবস্থাপনার কারণে মায়ানমার দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম দরিদ্র দেশ। অনুন্নত অবকাঠামো আর যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণেও দেশটি পিছিয়ে আছে। ২০১২ সাল পর্যন্ত পশ্চিমা বিশ্বের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা বহাল ছিল। তবে সম্প্রতি ভারত ও চীন মায়ানমারে বিপুল বিনিয়োগ করতে শুরু করেছে। কৃষিনির্ভর অর্থনীতির মায়ানমার চাল রপ্তানীকারক দেশ। এছাড়াও বিশ্বের ২য় বৃহত্তম গাঁজা ও হিরোইন উৎপাদক। বিশ্বের ৯০% রুবি পাথর এখানে পাওয়া যায়। সাথে আছে স্যাফায়ার, জেড পাথর আর মুক্তা। মান্দালয়ের উত্তরে মগক এলাকায় পাওয়া যায় কবুতর রক্ত লাল রুবি আর নীল স্যাফায়ার পাথর। এছাড়াও কাঠ-বেতের আসবাবপত্রও রপ্তানী হয়।
অর্থনীতির সবক্ষেত্রে সামরিক বাহিনীর সিনিয়র অফিসারদের অবাধ নিয়ন্ত্রণ বিদ্যমান। সম্ভবত সে কারণেই সাধারণ জনগণের জীবনযাত্রার মান করুণ হলেও সামরিক অফিসারদের প্রাচুর্য চোখে পড়ার মতোই। সেই সাথে আছে বিদ্রোহীদের কঠোরভাবে দমনের জন্য সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়নের নামে কোটি কোটি টাকার সমরাস্ত্র কেনবার লালসা!
সশস্ত্রবাহিনী
মায়ানমার সশস্ত্রবাহিনীকে ততমদো (Tatmadaw) বলা হয়ে থাকে। সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর প্রায় ৮ লাখ ৮৮ হাজার সেনা সমৃদ্ধ ততমদো বিশ্বের ১২তম বৃহত্তম সেনাবাহিনী। একসময় ৪০ ডলার সমমানের কিয়াত আর এক বস্তা চাল বা এক ক্যান পেট্রোলের বিনিময়ে শিশুদের কিনে নিয়ে সৈনিক হিসেবে ততমদোতে ভর্তি করা হত। তবে বর্তমান ততমদোর বাজেট সম্পর্কে কোনো পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায় না। রাশিয়া, ইউক্রেন, চীন, ভারত ও পাকিস্তান থেকে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ সমরাস্ত্র ক্রয় করে ততমদোকে আরো শক্তিশালী করা হচ্ছে। পিন ও লিন (Pyin Oo Lwin) এর সন্নিকটে রাশিয়ার সহায়তায় দেশটি নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টর নির্মাণ করছে। এছাড়াও ২০১০ সালে উইকিলিক্স থেকে পাওয়া তথ্যমতে, তারা উত্তর কোরিয়ার সহায়তায় ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য মিসাইল কারখানা নির্মাণ করছে বলে ধারণা করা হয়।
অভ্যন্তরীন কোন্দল নিরসনে ও বিরোধীদের দমাতে ততমদো সদা তৎপর ও অগ্রণী ভূমিকা রেখে থাকে। রাষ্ট্রযন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ পদসমূহ ততমদো জেনারেলরাই অলংকৃত করে থাকেন। কাউন্টার ইন্সার্জেন্সি অপারেশনে সুদক্ষ ততমদো রোহিঙ্গা নিধনে ও নিশ্চিহ্নকরণে ধর্ষণসহ নানা ধরনের অমানবিক পদ্ধতি উদ্ভাবন ও প্রয়োগে ব্যাপক পারদর্শীতার পরিচয় দিয়েছে এবং বেশ কয়েকজন ততমদো জেনারেল বর্তমানে এথনিক ক্লিঞ্জিংয়ের দায়ে আন্তর্জাতিকভাবে অভিযুক্ত।
এই সিরিজের পূর্ববর্তী পর্ব
১) রোহিঙ্গা রঙ্গ ১: বার্মিজ ইতিহাস পাঠ
২) রোহিঙ্গা রঙ্গ ২: ইউনিয়ন অব বার্মার স্বাধীনতা এবং গৃহযুদ্ধ কাতরতা (১৮২২-১৯৮৮)
এই সিরিজের পরবর্তী পর্ব
রোহিঙ্গা রঙ্গ ৪: রোহিঙ্গা নিধন – ১৯৪২ সাল থেকে শুরু এক এথনিক ক্লিঞ্জিং