তিনি দাঁড়িয়েছিলেন প্রাচীন মিশরের কোনো এক বন্দর নগরীতে। নিচ দিয়ে বয়ে গেছে ভূমধ্যসাগর। আর তাতে ভেসে চলেছে নানা বাণিজ্যিক জাহাজ, বন্দরে এসে ভিড়েছে কয়েকটি। তিনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন এসব। নাম তার ‘হাপি’। বিস্তীর্ণ নদী আর উর্বরতার দেবতা তিনি। আর ঠিক তার পাশেই নীল নদের পশ্চিম মুখে একটি পাথরের বেদি। তাতে দাঁড়িয়ে ছিল লাল গ্রানাইটে নির্মিত এক দ্বাররক্ষী। পাহারা দিচ্ছিলো বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এক বন্দর নগরীকে।
হঠাৎ একদিন কেঁপে উঠলো পুরো পৃথিবী। কেঁপে উঠলো পুরো শহর। হাপির পায়ের নিচের মাটি কাঁপতে কাঁপতে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেলো। ভয়াবহ এক ভূমিকম্পে ছয় টন ওজনের হাপির মূর্তিটি হারিয়ে গেলো সমুদ্রগর্ভে। ধীরে ধীরে হাপির চারপাশের গোটা শহরটাও তলিয়ে গেলো পানির নিচে। ইতিহাসের কালগর্ভে হারিয়ে গেলো ঐতিহ্যবাহী এক বন্দর নগরী হেরাক্লিয়ন।
হেরাক্লিয়নের ইতিহাস
খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী থেকে অষ্টম শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে মিশরীয় নগরী হেরাক্লিয়ন ছিল ভূমধ্যসাগরে প্রবেশের অন্যতম প্রধান বন্দর। এটি ‘থনিস’ নামেও পরিচিত ছিল। মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া থেকে ২০ মাইল উত্তর-পশ্চিমে এই শহরের অবস্থান। সেই সময়ে অনেক জনপ্রিয় একটি বন্দর ছিল এটি। বন্দর ছাড়াও এটি মিশরীয় দেবতা ‘আমন’ এর সুবিশাল মন্দিরের জন্য বিখ্যাত ছিল। বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ এখানে আসতো দেবতা আমনের পূজা করতে।
খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীর কোনো এক সময় কোনো এক কারণে সমুদ্রে ডুবে যায় এই শহর, হারিয়ে যায় সমুদ্রের তলদেশে। ধারণা করা হয়, ভূমিকম্পের ফলেই এই শহরের পতন ঘটে। বহু বছর ধরে সমুদ্রের নিচে চাপা পড়া এই শহরের খোঁজ জানতো না কেউ। অনেকে মনে করতেন, হারিয়ে যাওয়া শহর আটলান্টিসের মতোই এটাও হয়তো কোনো এক রূপকথা, যার বাস্তবে কোনো অস্তিত্ব নেই। একসময় মানুষ ভুলেই গিয়েছিলো এই নগরীর কথা। যদিও বিখ্যাত গ্রীক ইতিহাসবিদ হোরাডোটাস, ডায়োডোরাস সহ আরো কয়েকজন ইতিহাসবিদ তাদের লেখায় এই শহরের কথা উল্লেখ করেছিলেন। পুরানো অনেক পুঁথিতেও ছিল এই শহরের বর্ণনা।
এরপর ২০০০ সালে ফারাসি প্রত্নতত্ত্ববিদ ফ্রাঙ্ক গুডি ও তার দল এই শহরের খোঁজ পান। সমুদ্রের তলদেশে প্রায় ১,২০০ বছরের জমে থাকা বালি ও তলানি সরিয়ে তিনি খুঁজে পান এই অমূল্য গুপ্তধন!
যেভাবে পাওয়া গেলো খোঁজ
মোটামুটি অপ্রত্যাশিতভাবে গুডি এই শহরের খোঁজ পান। ২০০০ সালে ইউরোপিয়ান ইনিস্টিটিউট ফর আন্ডারওয়াটার আর্কিওলজির উদ্যোগে ও মিশরীয় পুরাতত্ত্ব কাউন্সিলের সহায়তায় গঠন করা হয় একটি দল। দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন বিখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ ফ্রাঙ্ক গুডি। তারা মিশরের আবু কি’র উপসাগরে ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়নের একটি যুদ্ধ জাহাজের খোঁজ করছিলেন। হঠাৎ করেই গুডি মিশরীয় দেবতা হাপির মূর্তির কিছু অংশ খুজে পান, যা মিশরীয় বন্দরনগরী থনিস বা হেরাক্লিয়নের অংশ ছিল। ডুবে যাওয়া এই শহরটি ছিলো সমুদ্রের তীর থেকে ৬.৫ কিলোমিটার দূরে।
এরপর প্রায় তের বছর ধরে গুডি ও তার দল এই ডুবে যাওয়া শহরের খনন কাজ করেন। একে একে উদ্ধার করেন বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন।
যা যা খুঁজে পাওয়া গিয়েছিলো
গুডি সমুদ্রের নিচের পলিমাটি ও বালি সরিয়ে ডুবে যাওয়া শহরের বিভিন্ন জিনিস এবং মিশরীয় দেবতা আমন ও তার ছেলে খনসৌ এর মন্দিরের ভগ্নাংশ খুঁজে পান।
প্রায় ৬৪টিরও বেশি জাহাজের ধ্বংসাবশেষ ও ৭০০টি নোঙর খুঁজে পাওয়া যায় সেখানে। একস্থানে এতগুলো জাহাজের ধ্বংসাবশেষ থেকে বোঝা যায়, জায়গাটি ছিলো বিখ্যাত একটি বন্দর। প্রতিদিন বহু জাহাজ এসে ভিড়তো এখানে। এছাড়াও এখানে প্রচুর স্বর্ণমুদ্রা ও তামা এবং পাথরের বাটখারা খুঁজে পাওয়া যায়, যা প্রমাণ করে ব্যবসার জন্যও জায়গাটি ছিল প্রসিদ্ধ। সোনার তৈরি অনেক তৈজসপত্রও উদ্ধার করা হয় এখান থেকে।
উদ্ধারকাজের শুরুতে সমুদ্রের নিচের বালি ও পলিমাটির নিচে চাপা পড়ে থাকা বিশাল বিশাল ভাস্কর্যগুলো পানির উপরে তুলে আনা হয়। এরপর জাহাজে করে এগুলো নিয়ে যাওয়া হয় সমুদ্রতীরে।
সমুদ্রের নিচ থেকে তুলে আনা ভাস্কর্যগুলোর মধ্যে ছিল ২,০০০ বছরের পুরানো মিশরীয় দেবী আইসিস এর আদলে তৈরি তৃতীয় ক্লিওপেট্রার মূর্তি। এছাড়াও ছিল মিশরীয় দেবতা হাপি ও এক ফারাও এর মূর্তি।
আরো পাওয়া গিয়েছিলো গ্রীক ও মিশরীয় ভাষায় খোদাই করা পাথর ফলক ও প্রায় এক ডজনের মতো শবাধার। এসব শবাধারের মধ্যে ছিল দেবতা আমনের উদ্দেশ্যে বলি দেওয়া বিভিন্ন পশুর মমি। মমিগুলো খুবই সুন্দর অবস্থায় ছিলো যা অবাক করে তোলে প্রত্নতত্ত্ববিদদের।
স্লেটের পুঁথিগুলোও অক্ষত অবস্থায় ছিল। হাজার বছর সমুদ্রতলে চাপা পড়ে থাকার পরও নষ্ট হয়নি এসব জিনিস। তবে অনেক জিনিসই হয়তো হারিয়ে গেছে সমুদ্রের গভীরে, বালি ও পলিমাটির নিচে, যা হয়তো আর কখনো খুঁজে পাওয়া যাবে না।
হেরাক্লিয়নের কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
তৎকালীন সময়ে কন্সট্যান্টিনোপল, রোম এবং এথেন্স সহ বিভিন্ন এলাকায় যাতায়াত করার জন্য ভূমধ্যসাগর ব্যবহৃত হতো। আর নীল নদের পশ্চিম প্রবেশ মুখে অবস্থিত এই হেরাক্লিয়ন ছিলো সেই সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বন্দর। মিশরীয়দের কাছে হেরাক্লিয়ন পরিচিত থনিস নামে। গ্রীক ইতিহাসবিদ হোরাডোটাসের মতে খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে এই বন্দর নগরীতে গ্রীক দেবতা ও বীর হেরাক্লেস আসেন। তার সম্মানেই গ্রীকরা এই শহরের নাম দেয় ‘হেরাক্লিয়ন’। এছাড়াও তারা হেরাক্লেসকে উৎসর্গ করে তার নামে বিশাল এক মন্দির নির্মাণ করে, যার ফলে হেরাক্লিয়ন হয়ে উঠে এক ধর্মীয় তীর্থস্থান।
প্রতিবছর এই মন্দিরে মিশরীয় দেবতা ওসাইরিস এর পূজার অনুষ্ঠান হতো যা ‘ওসাইরিস এর রহস্যাদি’ নামে পরিচিত ছিল। এই মন্দিরের ছিল অলৌকিক রোগ আরোগ্য করার ক্ষমতা। বহু দূর দূরান্ত থেকে মানুষ এখানে আসতো তাদের রোগ মুক্তির আশায়। বহু তীর্থযাত্রীকে আকৃষ্ট করতো এই নগরী।
হোরাডটাস তার লেখায় আরো চমকপ্রদ একটি তথ্য উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, বিখ্যাত ট্রয়ের যুদ্ধের আগে নাকি ট্রয়ের হেলেন ও তার অপহরণকারী প্রেমিক প্যারিস এই শহরে আশ্রয় নিয়েছিলেন, কয়েকদিনের জন্য অবস্থান করেছিলেন। যদিও এর সঠিক কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
সমুদ্র তীরবর্তী শহরটি ছিল বেশ দৃষ্টিনন্দন। যাতায়াতের সুবিধার জন্য জলপথের পাশাপাশি অনেক কৃত্রিম খাল কাটা হয়েছিলো। ফলে শহরটিকে দেখতে অনেকটা দ্বীপের মতো মনে হতো। শহরের দ্বীপের মতো অংশগুলোতে ছিল বিভিন্ন মন্দির। হেরাক্লেসের মন্দিরের উত্তর দিকে ছিলো একটি বিশাল খাল যা পূর্ব-পশ্চিমে প্রবাহমান ছিল। পুরো বন্দর নগরীটি একসময় মানুষে পূর্ণ ছিল, ভরে থাকতো কোলাহলে। আজ সমুদ্রের তলে সেখানে বিরাজ করছে শুনশান নিরবতা।
হেরাক্লিয়ন কীভাবে ধ্বংস হয়েছিল তা এখনো রহস্যে ঢাকা। ফ্রাঙ্ক গুডির গবেষক দল মনে করেন, শহরটির বিশাল বিশাল মন্দির ও ভবনগুলোর নিচের ভূপৃষ্ঠ ছিলো নরম কাদা মাটি ও বেলে মাটি দিয়ে গঠিত। ফলে একটি বড়সড় ভূমিকম্পেই পুরো শহরটি দেবে যায় মাটির নিচে। প্রবেশ করে সমুদ্রগর্ভে। ধ্বংস হয়ে যায় বিখ্যাত এক বন্দর নগরী।