সিসিলির পূর্ব উপকূল, ১৬৭৬ খ্রিস্টাব্দ।
সিরাকিউজের দিক থেকে বেরিয়ে এল ডাচ জাহাজ, মুখ ঘোরালো নেদারল্যান্ডসের উদ্দেশ্যে। সপ্তাহখানেক আগেই এখানে ডাচ-স্প্যানিশ যৌথ বহরের সাথে সংঘর্ষ হয়েছে অ্যাডমিরাল জুকের অধীনে ফরাসি নৌবাহিনীর। উত্তেজনা এখনো শেষ হয়নি। কাজেই অনতিদূরে ফরাসি জাহাজের উপস্থিতি দুর্লভ নয়। কিন্তু কোনো ফরাসি জাহাজই শত্রু বহরের উপর গোলা ছুড়ল না। বরঞ্চ ফাঁকা গোলায় প্রকম্পিত হলো চারিদিক। সাধারণত কাউকে সম্মান জানাতেই এই রীতি পালিত হয়। ফরাসি জাহাজের অফিসার এবং নাবিকেরাও সামরিক কায়দায় স্যালুট জানাল শত্রু জাহাজকে।
নেদারল্যান্ডসে পৌঁছতে যেতে হলো ফরাসি বন্দর ঘেঁষে। সেখানেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। বন্দরে মোতায়েনকৃত সমস্ত কামান ফাঁকা গোলা ছুঁড়ে সম্মান জানাল প্রতিপক্ষকে। এই আদেশ দিয়েছেন ফরাসি সম্রাট স্বয়ং চতুর্দশ লুই। ডাচ জাহাজ যে বহন করছে ফরাসিদের পরম শত্রু, ডাচ নৌবাহিনীর সর্বাধিনায়ক, লেফটেন্যান্ট অ্যাডমিরাল মিখিয়েল ডি রুইটারের শবদেহ, বারে বারে যিনি পরাজিত করেছেন তৎকালীন পরাশক্তি ব্রিটিশ ও ফরাসি নৌবাহিনীকে, প্রায় একাই রুখে দিয়েছেন নেদারল্যান্ডস নিয়ে শত্রুদের ষড়যন্ত্র। প্রতিপক্ষ বটে, কিন্তু অকুতোভয় ডাচ অ্যাডমিরালকে সম্মান জানাতে কার্পণ্য করা তো ফরাসি রীতি নয়।
ডি রুইটারের কথা বলার আগে তার পূর্ব পর্যন্ত নেদারল্যান্ডসের ইতিহাসে একটু চোখ বুলিয়ে আসা জরুরি। এতে নেদারল্যান্ডসের সাথে তৎকালীন ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের শত্রুতা এবং নেদারল্যান্ডসের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কোন্দলের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে কিছুটা হলেও ধারণা পাওয়া যাবে। এই প্রেক্ষাপটেই ডি রুইটারের আবির্ভাব।
নেদারল্যান্ডস
নেদারল্যান্ডসের শাব্দিক অর্থ নিচু এলাকা। বর্তমান নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম এবং পার্শ্ববর্তী আরো কিছু দেশের অধিকাংশ এলাকাই বহু আগে ছিল জলমগ্ন। সেখানে পানি সেঁচে জমি পুনরুদ্ধার করে মানুষ বসতি স্থাপন করেছে প্রাচীন যুগ থেকেই।এসব এলাকাকে একত্র বলা হয় নিচু অঞ্চল বা লো কান্ট্রি। এই অঞ্চল জুড়ে বয়ে গেছে প্রচুর নদী-নালা, খাল-বিল; ফলে যেকোনো সময় পানির উচ্চতা বেড়ে বন্যার শঙ্কা থাকে। তাই পুরো লো কান্ট্রি জুড়ে তৈরি করা হয়েছিল বাঁধ, যাকে বলা হত ডাইক।
প্রাচীন যুগ
রোমান আমলে নেদারল্যান্ডস ছিল গলের অন্তর্ভুক্ত এলাকা। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে জুলিয়াস সিজার যখন চূড়ান্তভাবে গল বশীভূত করেন সেসময় উত্তর গলে বাস করত সেল্টিক এক জাতি। রোমানরা এদের বলত বেলজি। ৫৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সিজার বেলজিদের পরাজিত করেন। পরাজিত অনেক বেলজি পালিয়ে চলে যায় ব্রিটেনে, সেখানে অন্যান্য সেল্টিক গোত্রের সাথে মিলে প্রতিষ্ঠা করে নিজেদের রাজ্য।
গলের উত্তরের অংশ ছিল লো কান্ট্রি। এখানে থাকত জার্মান গোত্র বাটাভিয়ান আর ফ্রাইজিয়ানরা। বাটাভিয়ানরা বাস করত এখানকার দক্ষিণাঞ্চলে, যাকে আমরা বর্তমান নেদারল্যান্ডস বলে জানি। ফ্রাইজিয়ানদের বসবাস ছিল উত্তরের উপকূলবর্তী এলাকায় রাইন নদী থেকে এমস পর্যন্ত, একে বলা হত ফ্রাইজিয়া। এই দুই গোত্র খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকের শেষদিক থেকে রোমের সাথে মৈত্রীতে আবদ্ধ ছিল।
৫০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে ফ্রাইজিয়ানরা দুবার রোমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। রোমানরা এরপর তাদের সাম্রাজ্যের সীমান্ত হিসেবে রাইন নদীকে বেছে নেয়। রাইনের দক্ষিণ তীরে বহু দুর্গ নির্মাণ করা হয়। এখান থেকেই বাটাভিয়ান একটি বিদ্রোহ ৭০ খ্রিস্টাব্দে দমন করে রোমানরা। এরপর কয়েক শতাব্দী ফ্রাইজিয়া ছাড়া বাকি লো কান্ট্রি ছিল রোমান নিয়ন্ত্রণে। মোটামুটি ৩০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে অন্যান্য অনেক জার্মান জাতি এখানে অভিবাসন করতে থাকে, যাদের অন্যতম ছিল ফ্রাঙ্করা। ৪৪৫ খ্রিস্টাব্দে রোমানরা পুরোপুরি গল ছেড়ে চলে যায়, এবং এখানে ফ্রাঙ্করা শক্তিশালী হয়ে ওঠে। রোমের সাথে চুক্তি মোতাবেক তারা এই অঞ্চল বরাবর রোমান সীমান্ত রক্ষা করত। তবে রোমের মতো তারাও ফ্রাইজিয়াকে পদানত করতে ব্যর্থ হয়।
৪৮১-৫১১ খ্রিস্টাব্দ অবধি ফ্রাঙ্কদের রাজা ছিলেন ক্লভিস। তিনি বর্তমান ফ্রান্সের এলাকাজুড়ে পত্তন করেন ফ্রাঙ্কিশ সাম্রাজ্য। প্যারিস হল তার রাজধানী। উত্তর নেদারল্যান্ডস রয়ে গেল ফ্রাইজিয়ান নিয়ন্ত্রণে, দক্ষিণ নেদারল্যান্ডসে কায়েম হলো ফ্রাঙ্কিশ আধিপত্য। বাটাভিয়ান জাতি মিশে গেল ফ্রাঙ্ক আর ফ্রাইজিয়ানদের মধ্যে। বর্তমান ডাচ জাতি এদের থেকেই উদ্ভুত, তাদের সাথে যোগ হয়েছে স্যাক্সোন গোত্রীয় রক্তধারা।
ফ্রাঙ্করা বেলজিদের আবাসভূমিতে নতুন করে লোক অভিবাসন করায়। অষ্টম খ্রিস্টাব্দ থেকে এই অঞ্চল পরিচিত হয় ফ্ল্যান্ডার্স নামে। এখানকার অধিবাসীরা পরে পরিচিত হয় ফ্লেমিংস নামে, যাদের ভাষা ফ্লেমিশ। উত্তর বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস এবং ফ্রান্সের কিছু এলাকায় ফ্লেমিশ এখনও প্রধান ভাষা। অন্যদিকে ফ্রাঙ্করা রোমান সভ্যতা সংস্কৃতি গ্রহণ করে পূর্ববর্তী রোমান গলে ল্যাটিন প্রভাবিত ভাষাকে নিজেদের বলে মেনে নেয়। এই থেকে উৎপত্তি হয় ফরাসি ভাষার, যা ফ্রান্সের পাশাপাশি ফ্ল্যান্ডার্স ও বেলজিয়ামের দক্ষিণ অঞ্চলের মূল ভাষায় পরিণত হয়। ফ্রাইজিয়া ধীরে ধীরে চলে আসে নেদারল্যান্ডসের ভেতরে, তবে তাদের আলাদা ফ্রাইজিয়ান ভাষা রয়ে যায় নেদারল্যান্ডসের একটি সরকারি ভাষা হিসেবে।
মেরোভিঙ্গিয়ান এবং ক্যারোলিঙ্গিয়ান রাজবংশ
ক্লভিস প্রতিষ্ঠা করে যান মেরোভিঙ্গিয়ান রাজবংশ। তার বংশধরেরাই শাসন করতে থাকেন ফ্রাঙ্কিশ সাম্রাজ্য। তবে তাদের দুর্বলতার সুযোগে ষষ্ঠ শতকে সাম্রাজ্য দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায়। পশ্চিমে গড়ে ওঠে নিউস্ট্রিয়া, যা আজকের ফ্রান্সের পূর্বপুরুষ, আর পূর্বে অস্ট্রাশিয়া যার অন্তর্গত লো কান্ট্রি। ৬২২ খ্রিস্টাব্দ থেকে অস্ট্রাশিয়ার ক্ষমতা চলে যায় প্রথম পেপিনের হাতে। পেপিন প্রতিষ্ঠা করেন ক্যারোলিঙ্গিয়ান রাজবংশ। তার নাতি দ্বিতীয় পেপিন ৬৮৭ খ্রিস্টাব্দে নিউস্ট্রিয়ার বহু এলাকা দখল করে নেন, বাকি অংশ নিয়ে মেরোভিঙ্গিয়ান রাজা কোনোরকমে টিকে থাকেন।
দ্বিতীয় পেপিনের ছেলে চার্লস মার্টেল ছিলেন জাঁদরেল এক সেনানায়ক। মুসলমানরা স্পেনে পতাকা উড়িয়ে যখন পিরেনিজ পর্বত অতিক্রম করে ফ্রান্সে এসে পৌঁছে, তখন চার্লস মার্টেলই তাদের অগ্রযাত্রা ঠেকিয়ে দেন। তার কারণেই মুসলিমরা ফ্রান্সে সীমানা বিস্তৃত করতে পারেনি। তবে চার্লস মার্টেলের বড় বিজয় ছিল বহু শতাব্দী ধরে অপরাজেয় ফ্রাইজিয়া জয় করা। তিনি ফ্রাইজিয়ানদের ক্ষমতার কেন্দ্র উট্রেখট শহর ফ্রাঙ্কিশ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন।
চার্লস মার্টেলের ছেলে পেপিন দ্য শর্ট সর্বশেষ মেরোভিঙ্গিয়ান রাজাকে পরাজিত করে পুরো ফ্রাঙ্কিশ সাম্রাজ্যের সম্রাট হিসেবে অধিষ্ঠিত হলেন। তার ছেলে শার্লেম্যাগনে বাবার সাম্রাজ্য আরো বিস্তৃত করেন। ৮০০ শতাব্দীতে পোপ তাকে সম্রাটের খেতাব দেন। শার্লেম্যাগনের হাত ধরেই পুনরুজ্জীবিত হলো পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্য।
শার্লেম্যাগনে ফ্রাইজিয়ানদের চূড়ান্তভাবে পর্যুদস্ত করেন। লো কান্ট্রিতে বাস করা স্যাক্সনরাও তার হাতে পরাস্ত হয়। তিনি এখানে প্রশাসনিক ঢেলে ব্যবস্থা সাজানোর উদ্যোগ নেন। তার উত্তরাধিকারী ছেলে লুই মোটামুটি শান্তিপূর্ণভাবেই রাজকার্য চালান। মৃত্যুর সময় প্রথা অনুযায়ী লুই তিন ছেলের মধ্যে সাম্রাজ্য ভাগাভাগি করে দেন। কিন্তু পিতার মৃত্যুর পর তিন ছেলেই গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ল।
৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে ভার্দুনের চুক্তি তাদের বিবাদের অবসান ঘটায়। এক ছেলে চার্লস দ্য ব্যাল্ড পেলেন ফ্ল্যান্ডার্সসহ মধ্যযুগীয় ফ্রান্সের অংশ, লুই দ্য জার্মান পেলেন ফ্রাইজিয়া ব্যতিত রাইনের পূর্বাঞ্চল, আর তৃতীয়জন লথেয়ার ভাগে পান দুই ভাইয়ের মাঝখানের অংশ, মিডল কিংডম। মিডল কিংডমের অন্তর্গত ছিল লো কান্ট্রির অঞ্চল। ৯২৫ খ্রিস্টাব্দের দিকে এই এলাকা চলে যায় জার্মানদের হাতে, যাদের রাজা ছিলেন স্যাক্সোন গোত্রের হেনরি। তার ছেলে অটো দ্য গ্রেট প্রথম হলি রোমান এম্পেররের উপাধি ধারণ করলে জার্মানি হলি রোমান এম্পায়ারের অংশ হিসেবে পরিগণিত হয়।
মধ্যযুগ
দশম এবং একাদশ শতাব্দীতে ফ্রাইজিয়া ছাড়া লো কান্ট্রি ভেঙে যায় ছোট ছোট অঞ্চলে। এখানে শাসন করতেন কাউন্ট এবং ডিউকেরা। তাদের শাসনাধীন অঞ্চল পরিচিত ছিল প্রিন্সিপ্যালিটি বলে। ফ্ল্যান্ডার্স শাসন করতেন ফরাসি আশীর্বাদপুষ্ট কাউন্টেরা। অন্যান্য শাসক অনুগত ছিলেন হলি রোমান এম্পেররের প্রতি। তাদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ছিলেন হল্যান্ডের কাউন্ট এবং উট্রেখটের বিশপ। ১৩৮৪ সাল থেকে এই সমস্ত এলাকার নিয়ন্ত্রণ ধীরে ধীরে নিতে থাকেন ফ্রান্সের পূর্বদিকের বারগ্যান্ডি’র ডিউক। বৈবাহিক সম্পর্ক, কূটনৈতিক চাপ, সামরিক হুমকি ইত্যাদি উপায়ে বারগ্যান্ডির শাসকেরা অনেক এলাকা অধিকার করেন। তবে হল্যান্ডের উত্তরের প্রদেশগুলো তাদের হস্তগত হলো না।
বারগ্যান্ডিয়ানদের হাতে লো কান্ট্রির চেহারা পাল্টে যায়। কলকারখানা বসিয়ে তারা অর্থনীতির চাকা ঘুরিয়ে দেন। জ্ঞানবিজ্ঞান আর শিল্পকলার পৃষ্ঠপোষকতা করে তারা শিক্ষিত সংস্কৃতিমনা জাতি গড়ায় উৎসাহ দিলেন। বেলজিয়াম অঞ্চলে দৃশ্যমান উন্নতি পরিলক্ষিত হয়। ব্রাসেলসের রাজদরবার ইউরোপের অন্যতম জমকালো দরবারে পরিণত হলো।
বারগ্যান্ডিয়ানরা প্রশাসনিক কাঠামোও সুবিন্যস্ত করেন। তারা প্রতিটি প্রদেশ এবং শহরের সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য সর্বময় কর্তা হিসেবে নিয়োগ দেন এস্টেট জেনারেল। এই পদে অভিজাত এবং ধর্মযাজকদের আধিক্য ছিল। তবে তাদের জবাবদিহিতা ছিল বারগ্যান্ডির ডিউকের কাছে। এই উপায়ে বারগ্যান্ডিয়ান শাসক লো কান্ট্রির স্বাধীনচেতা শহরগুলোর উপর তার নিয়ন্ত্রণ সরাসরি জারি করেছিলেন। একে তারা নিজেদের অধিকারে নির্লজ্জ হস্তক্ষেপ মনে করত। ফলে শহরগুলো সুযোগ খুঁজতে থাকে তাদের আগের মর্যাদা ফিরে পাবার, যেখানে তাদের অভ্যন্তরীণ শাসনের স্বাধীনতা বজায় থাকবে।শহরগুলোর এস্টেট জেনারেলরাও তাই চাইছিলেন।
১৪৭৭ সালে বারগ্যান্ডিয়ান শাসক চার্লস দ্য বোল্ড যুদ্ধের ময়দানে নিহত হলে ক্ষমতায় বসেন তার ১৯ বছরের মেয়ে মেরি। এস্টেট জেনারেলরা এবার তাদের সুযোগ কাজে লাগান। রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ মেরিকে চাপ দিয়ে লো কান্ট্রির শহরগুলি নিজেদের পূর্ব মর্যাদা ফিরিয়ে দেবার আইনে (গ্রেট প্রিভিলেজ/Great Privilege) স্বাক্ষর করিয়ে নেয়। মেরির বিয়ের জন্য কয়েকজন পাত্রও ঠিক করে দেয় তারা। মেরি বেছে নেন অস্ট্রিয়ার রাজপুত্র ম্যাক্সিমিলিয়ানকে, হাবসবুর্গ উত্তরাধিকারী এবং হলি রোমান এম্পেরর তৃতীয় ফ্রেডেরিকের সন্তান। নেদারল্যান্ডসের দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা ফ্রান্স তাদের দোরগোড়ায় হাবসবুর্গ উপস্থিতি ভাল চোখে দেখলনা।মুলত মেরিকে বিয়ে করার পর থেকেই কয়েক শতাব্দীব্যাপী হাবসবুর্গ আর ফরাসী রাজাদের দ্বৈরথ আরম্ভ হয়।
হাবসবুর্গ প্রতিপত্তি
১৪৮২ সালে মেরির আকস্মিক মৃত্যুর পর প্রথমে ম্যাক্সিমিলিয়ান এবং পরে তার পুত্র ফিলিপ বারগ্যান্ডির ক্ষমতা নেন। তারা দুজনেই গ্রেট প্রিভিলেজ উপেক্ষা করে লো কান্ট্রির শহরগুলোর উপর নিজেদের অধিকার চাপিয়ে দিতে চাইলেন। ফলে শহরগুলোর মধ্যে অসন্তোষ দানা বেঁধে উঠছিল। এদিকে ফিলিপ কাস্টিলের স্প্যানিশ রাজকুমারিকে জোয়ানাকে বিয়ে করলে স্পেনের বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডও তার সাম্রাজ্যভুক্ত হয়ে যায়। তার ছেলে চার্লসের আয়ত্বে চলে আসে অস্ট্রিয়া ছাড়াও আজকের নেদারল্যান্ডস, স্পেন, দক্ষিণ ইতালি, সিসিলি, সার্ডিনিয়া, মিলান আর ব্রাজিলের পশ্চিমে আমেরিকার পুরো অংশ।
বলা হয়, চার্লসের বিশাল সাম্রাজ্যে নাকি কখনো সূর্য ডুবত না। তিনি ইতিহাসের অন্যতম একটি বৈশ্বিক একটি সাম্রাজ্যের পত্তন করেন। ১৫১৯ সালে পঞ্চম চার্লস হিসেবে তিনি হলি রোমান এম্পেরর নির্বাচিত হলে জার্মানিও তার হাতে চলে আসে। চার্লস ফ্রাইজিয়া, উট্রেখট আর হল্যান্ডের ডাচ প্রদেশগুলোও নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করতে সক্ষম হন। ফলে শার্লেম্যাগনের পর প্রথমবারের মতো লো কান্ট্রি একীভূত হয় একজন সম্রাটের হাতে। তবে চার্লস শাসন করতেন মূলত স্পেন থেকে, কদাচিৎ পা রাখতেন নেদারল্যান্ডসে।
বিশাল সাম্রাজ্যের ভার বইতে না পেরে একপর্যায়ে ভাই ফার্দিন্যান্ডের কাছে অস্ট্রিয়ার শাসনভার ছেড়ে দেন তিনি। ফার্দিন্যান্ডের হাত ধরে সূচনা হয় অস্ট্রিয়ান হাবসবুর্গ ধারার। চার্লস হলি রোমান এম্পেরর পদ ছেড়ে দিলে ফার্দিন্যান্ডই হন তার উত্তরসূরি।
হাবসবুর্গদের বিরুদ্ধে অসন্তোষ
১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে চার্লস ছেলে ফিলিপের হাতে স্পেন আর নেদারল্যান্ডস ছেড়ে দিলেন। বাবার মতো ফিলিপও খুব কমই নেদারল্যান্ডসে এসেছিলেন। ১৫৫৯ সালের পর এখানকার ভূখণ্ডে তার পা পড়েনি। তবে শক্তিশালী অর্থনীতির কারণে চার্লসের মতো ফিলিপের কাছেই লো কান্ট্রির গুরুত্ব ছিল। এখানকার উৎপাদিত পণ্য এবং অন্যান্য সম্পদ সম্রাটের কাজে ব্যয় হত।
তখন চলছে ইতিহাসে কুখ্যাত স্প্যানিশ ইনকুইজিশন। ক্যাথলিক স্পেনের সম্রাট ফিলিপের আদেশে নেদারল্যান্ডসে তার প্রতিনিধি এবং খালা মার্গারেট আর তার উপদেষ্টা গ্রেনভিল ইনকুইজিশন চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ধর্মদ্রোহী আখ্যা দিয়ে অনেক নিরীহ মানুষ হত্যা করা হচ্ছে, যারা ছিল মূলত প্রোটেস্ট্যান্ট ধারার। লো কান্ট্রির উপর অবিচ্ছিন্ন নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে বিভিন্ন অঞ্চলের সার্বভৌমত্ব প্রদানকারী গ্রেট প্রিভিলেজ আইনও তিনি বাতিল করেছেন। ফলে স্প্যানিশ সম্রাটের বিপক্ষে লো কান্ট্রিতে অসন্তোষ ছিল। এর সাথে যোগ হলো ইনকুইজিশনের অত্যাচার, শহরে স্প্যানিশ সেনাদলের উপস্থিতি আর অব্যাহতভাবে স্প্যানিশ শাসকদের এই অঞ্চলের রাজস্ব নিয়ে যাওয়া।
স্প্যানিশ শাসনের বিপক্ষে দানা বেধে ওঠা আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিলেন দুজন অভিজাত, কাউন্ট অফ এগমন্ট এবং উইলিয়াম অফ নাসাউ, প্রিন্স অফ অরেঞ্জ। উইলিয়ামকে ডাকা হতো উইলিয়াম দ্য সাইলেন্ট নামে। কেন এই খেতাব তা নিয়ে কয়েকটি তত্ত্ব আছে। প্রচলিত একটি গল্প হলো- ফ্রান্সের রাজা হেনরি একবার উইলিয়ামের সাথে আলোচনার সময় রাষ্ট্রীয় কিছু গোপন তথ্য বলে ফেলেছিলেন। কিন্তু উইলিয়াম পুরোটা সময় নিশ্চুপ ছিলেন, একবারও বলেননি এই তথ্য জানার অধিকার তার নেই। চার্লসের প্রতি তার আনুগত্যের কারণে তাকে হল্যান্ড প্রদেশের গভর্নর করেছিলেন ফিলিপ। এগমন্টকে করা হয়েছিল ফ্ল্যান্ডার্সের গভর্নর। ফিলিপ কি তখন জানতেন এরাই হয়ে দাঁড়াবে গলার কাঁটা!