মাতৃভূমির জন্য আত্মত্যাগের কাহিনী এ দেশে বিরল নয়। যুগে যুগে ক্ষণজন্মা বীরেরা শত্রুর হাত থেকে নিজের রক্তের বিনিময়ে দেশমাতৃকাকে মুক্ত করেছে বারবার, জীবনের মায়া ভুলে দেশের মানুষের কথা ভেবেছে হাজার হাজার তরুণ। এ মিছিলে নারী-পুরুষের অংশীদারত্ব ছিল কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। দেশের জন্য সর্বস্ব ত্যাগের মহিমায় আজো যে নারীরা মানুষের মনে অমর হয়ে আছেন, তাদের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত মুখগুলোর একটি হল প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার।
১৯১১ সালের ৫ই মে, বর্তমান চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলার ধলাঘাট গ্রামের এক বাড়িতে জন্ম নিল এক মানবশিশু, পরিবারের দ্বিতীয় সন্তান। প্রতিবেশী মেয়েদের তিনবার উলুধ্বনিতে বোঝা গেল, সদ্য জন্ম নেওয়া শিশুটি একটি মেয়ে। সেই সময়ে মেয়েরা নিজেদের সামাজিক ও পারিবারিক অস্থানের কথা ভেবেই হয়তো পৃথিবীর এই নতুন অতিথিকে খুশি মনে অভিনন্দন জানাতে পারেনি। তার উপর যখন দেখা গেল, মেয়ের গায়ের রং কালো, তখন তার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলেন আত্মীয়স্বজনরা।
ভারতবর্ষে আজো মানুষের গায়ের রং যে তার ভবিষ্যতের কিছু ব্যাপার নিয়ন্ত্রণ করে থাকে, তার ব্যতিক্রম সে সময়েও ছিল না। সবাই যখন এরকম এক মেয়েকে নিয়ে হা-হুতাশ করছে, তখন মা তার নাম রাখলেন ‘রানী’। বললেন, “আমার এই কালো মেয়েই একদিন তোমাদের মুখ আলো করবে”। মায়ের ভবিষ্যদ্বাণী যে সত্যি সত্যিই ফলে যাবে, একথা সেদিনের মানুষগুলো ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি। সেদিনের এই ছোট্ট মেয়েটি আর কেউ নন, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম চেনা মুখ প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার।
প্রীতিলতার প্রথম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল ডা. খাস্তগীর সরকারি বালিকা বিদ্যালয়। পড়াশোনায় ভালো হওয়ায় প্রীতিলতা ছিলেন শিক্ষকদের প্রিয়। বিশেষ করে তার ইতিহাসের শিক্ষিকা ঊষাদির সাথে তার ছিল খুব ভাল সম্পর্ক। এই ঊষাদিই একদিন প্রীতিলতাকে ‘ঝাঁসির রাণী লক্ষ্ণীবাই’ নামের একটি বই পড়তে দেন। বইটি প্রীতিলতা ও তার খুব ঘনিষ্ঠ একজন বন্ধু কল্পনা দত্তের মনোজগতকে দারুণভাবে আলোড়িত করে, ছোটবেলা থেকে লালিত বিজ্ঞানী হওয়ার স্বপ্নের স্থানে জায়গা করে নেয় বিপ্লবী হওয়ার স্বপ্ন! ঠিক এরকম সময়ে ঘটে যায় একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। পরবর্তী সময়ে যা তার স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দিতে আরেক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছে।
১৯২৩ এর ১৩ই ডিসেম্বর চট্টগ্রামের টাইগার পাস নামক জায়গায় মাস্টারদা সূর্য সেনের বিপ্লবী দলের সদস্যরা সরকারি কর্মচারীদের বেতনের জন্য নিয়ে যাওয়া ১৭,০০০ টাকা ছিনতাই করে নেয়। এর কিছুদিনের মধ্যেই বিপ্লবীদের গোপন আস্তানায় পুলিশের অতর্কিত হামলায় গ্রেফতার হন সূর্যসেন ও অম্বিকা চক্রবর্তী। তাদের বিরুদ্ধে আনা হয় রেলওয়ে ডাকাতির মামলা। এই ঘটনার পরের বছরেই বেঙ্গল অর্ডিন্যান্স নামক এক জরুরি আইনে বিনা কারণে বিপ্লবী সদস্যদের আটক করা শুরু হয়। বাজেয়াপ্ত করা হয় বিপ্লবীদের প্রকাশনাসমূহ।
এরকম সময়ে একদিন প্রীতিলতাদের বাড়িতে আসেন তার এক দাদা। পূর্ণেন্দু দস্তিদার, বিপ্লবী দলের একজন কর্মী। তিনি সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত কিছু বই প্রীতিলতার কাছে গোপনে রেখে গেলে কৌতূহলবশত প্রীতিলতা বইগুলো খুলে দেখে এবং একে একে পড়ে ফেলে ‘বাঘা যতীন’, ‘দেশের কথা’, ‘ক্ষুদিরাম’ আর ‘কানাইলাল’। সেই বয়সেই বইগুলো প্রীতিলতার চিন্তাজগতে যথেষ্ট প্রভাব ফেলে। তখন তিনি সবে দশম শ্রেণির ছাত্রী। তখন থেকেই তিনি দেশের কাজে অংশগ্রহণের কথা ভাবতে শুরু করেন।
কিছুদিন পর তার সেই বিপ্লবী দাদা পূর্ণেন্দু দস্তিদার তাদের বাড়ি এলে প্রীতিলতা জানান তার ইচ্ছার কথা। জানান যে তিনিও বিপ্লবী হতে চান। কিন্তু তখন পর্যন্ত দলে কোনো নারী সদস্য নেওয়া হতো না। ফলে, প্রীতিলতারও যোগ দেওয়া হলো না বিপ্লবী দলে। তিনি কিছুটা মনোক্ষুণ্ণ হয়ে ভাবতে থাকেন,
“দেশ তো আমারও, তাহলে আমি কেন দেশের জন্য কাজ করতে পারব না?”
এরপর অবশ্য বেশিদিন প্রীতিলতাকে অপেক্ষা করতে হয়নি, কিছুদিন পরেই লেটারমার্ক সহ ম্যাট্রিক পাশ করে ঢাকায় ইডেন কলেজে পড়তে যাওয়ায় বিপ্লবী দলে যোগদানের একটা সম্ভাবনার দ্বার জন্য খুলে যায় তার জন্য। ঢাকায় সেসময় ‘শ্রীসংঘ’ নামে একটি বিপ্লবী দল ছিল। আর ‘দীপালি সংঘ’ নামে ছিল শ্রীসংঘের একটি নারী শাখা। এই শাখার নেত্রী ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএ লীলা নাগ। ‘দীপালি সংঘ’ মূলত শ্রীসংঘের নেতৃত্বে গোপনে মেয়ে বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তুলত। ইডেনে পড়ার সময় দৃঢ় মনোবল ও দেশের প্রতি ভালোবাসা দেখে তারই এক শিক্ষিকা তাকে দীপালি সংঘের সদস্য হওয়ার কথা বলেন এবং গ্রীষ্মের ছুটিতে বাড়ি যাওয়ার সময় তাকে সংঘের সদস্য হওয়ার জন্য একটা ফর্ম দেন।
বাড়ি ফেরার পর প্রীতিলতা ফর্মটি তার বিপ্লবী দাদাকে দেখালে দাদা সেটি নিয়ে সূর্য সেনের সাথে দেখা করেন। ততদিনে বেঙ্গল অর্ডিন্যান্সের বিনা বিচারে আটকে থাকা নেতারা একে একে মুক্ত হয়ে ফিরে আসছেন। দীপালি সংঘের ফর্মটি দেখে সূর্য সেন বিপ্লবে মেয়েদের অংশগ্রহণের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে আলোচনা করে প্রীতিলতাকে গোপনে দলের অন্তর্ভুক্ত করেন এবং বলেন, প্রীতিলতা চাইলেই দীপালি সংঘের সদস্য হতে পারবেন। এবার ঢাকায় ফিরে দীপালি সংঘে যোগ দিয়ে ছোরাখেলা, লাঠিখেলা প্রভৃতি বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিতে থাকেন প্রীতিলতা। পরবর্তী সময়ে এ ব্যাপারে তিনি লিখেছিলেন,
“আইনে পড়ার জন্য ঢাকায় দু’বছর থাকার সময় আমি নিজেকে মহান মাস্টারদার একজন উপযুক্ত কমরেড হিসাবে নিজেকে গড়ে তোলার চেষ্টা চালিয়েছি।”
১৯২৯ সালে আইএতে মেয়েদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে বৃত্তি নিয়ে কলকাতায় বেথুন কলেজে পড়তে যান প্রীতিলতা। একই বছরে মে মাসে সূর্য সেন ও তার সহোযোগিরা চট্টগ্রাম জেলা কংগ্রেস জেলা সম্মেলন, যুব সম্মেলন, ছাত্র সম্মেলনের আয়োজন করেন। কিন্তু তখন পর্যন্ত কোনো নারী সম্মেলনের কথা তারা চিন্তা করেননি। কিন্তু প্রীতিলতার সেই দাদা, পূর্ণেন্দু দস্তিদারের প্রবল আগ্রহে সূর্য সেন শেষ পর্যন্ত নারী সম্মেলন আয়োজনে সায় দেন। সেইবার মহিলা কংগ্রেস নেত্রী লতিকা বোসের সভাপতিত্বে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকা থেকে প্রীতিলতা ও কল্পনা দত্ত এসে যোগ দেন সম্মেলনে। এই সম্মেলনে সূর্য সেনের সাথে দেখা করার ও বিপ্লবী দলে যোগদানের প্রবল ইচ্ছা থাকা সত্বেও প্রীতিলতাদের সেদিন তার সাথে দেখা হয় না।
বেথুন কলেজে পড়ার সময় প্রীতিলতা জানতে পারেন, রামকৃষ্ণ বিশ্বাস, চট্টগ্রামের আরেক বিপ্লবীর কথা। যিনি তখন ফাঁসির আসামী হিসেবে জেলে আছেন। তার কথা শোনার পর থেকে প্রীতিলতা অস্থির হয়ে ওঠেন, তার সাথে দেখা করার জন্য। কিন্তু কোনো বিপ্লবীর সাথে সরাসরি এভাবে দেখা করা ছিল বিপজ্জনক। তাই শেষমেশ আরতি ছদ্মনামে রামকৃষ্ণের দূরসম্পর্কের বোনের পরিচয় নিয়ে প্রীতিলতা তার সাথে দেখা করতে যান। এরপর যতদিন রামকৃষ্ণ বেঁচে ছিলেন, ততদিনে অনেকবার গেছেন প্রীতিলতা তার সাথে দেখা করতে।
অধীর আগ্রহে তিনি শুনেছেন রামকৃষ্ণের জীবনের রোমাঞ্চকর সব অভিযানের কথা, দেশমাতৃকার স্বাধীনতার জন্য নেওয়া সাহসী ও ভয়ংকর সব পদক্ষেপের কথা। যত শুনেছেন, ততই এই মানুষটির প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত হয়েছে। এই শ্রদ্ধা কখন যে ভালোবাসার দিকে মোড় নিয়েছে, তা টের পাননি নিজেও। ওদিকে রামকৃষ্ণেরও তৎকালীন নারী সমাজের মাঝে ব্যতিক্রম এই মেয়েটিকে দেখে, তার দৃঢ় মনোবল, দেশপ্রেম দেখে কখন যেন ভালো লেগে গেছে। দুজনই জানেন, এই ভালোবাসার কোনো পরিণতি নেই। দুজনের মাঝে আছে জেলের গরাদ আর মৃত্যুর দেয়াল। তবু্ও তারা নিঃশব্দে বরণ করে নিয়েছেন একে অপরের এই মৌন ভালোবাসাকে!
রামকৃষ্ণের সাথে দেখা হওয়ার দিনগুলোর মধ্যেই প্রীতিলতা এবং কল্পনা দত্ত বেশ কয়েকবার কলকাতা থেকে চট্টগ্রামে ফেরার পথে লুকিয়ে বোমার খোল নিয়ে গেছেন। পৌঁছে দিয়েছেন চট্টগ্রামের বিপ্লবীদের কাছে। সবার সাথে বোমা বানিয়েছেন। বিপজ্জনক কাজ বলে মাস্টারদা তাকে অনেকবার নিষেধ করেছেন, কিন্তু প্রীতিলতা নিষেধ শোনেননি। তিনি বলেছেন, “ওরা পারলে আমিও পারব।” বোমার গান-কটন কেনার জন্য গায়ের সামান্য গয়নাটুকুও তিনি তুলে দিয়েছেন বিপ্লবীদের হাতে।
১৯৩০ সালের ১৮ই এপ্রিল চট্টগ্রামের বিপ্লবীদের পূর্বপরিকল্পিত আক্রমণে ধ্বংস হয় অস্ত্রাগার, টেলিফোন অফিস, পুলিশলাইন। এই অভিযান ‘যুব বিদ্রোহ’ নামেও পরিচিত ছিল। প্রীতিলতা পত্রিকায় দেখেন এ খবর। এই ঘটনায় একইসাথে মাস্টারদা আর তার দলের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেন, আবার সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে না পারায় কিছুটা বেদনাহতও হন।
১৯৩২ সালে বিএ পরীক্ষার পর বাড়ি এসে প্রীতিলতা দেখেন, বাবার চাকরি নেই। এমতাবস্থায় তাকেই পরিবারের হাল ধরতে হয়। নন্দনকানন উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকার চাকরি পান তিনি। নিজের কাজ নিয়ে ভালোই সময় কেটে যাচ্ছিল তার, কিন্তু সবসময় মাথায় ছিল মাস্টারদার সাথে সাক্ষাতের চিন্তা। এদিকে চট্টগ্রামে থাকা কল্পনা দত্তের সাথে অনেক আগেই মাস্টারদার সাক্ষাৎ হলে কল্পনা তাকে প্রীতিলতার আগ্রহের কথা বলেন। সব শুনে মাস্টারদাও তার সাথে দেখা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিছুদিনের মধ্যেই তাদের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা হয়। এ ঘটনা প্রসঙ্গে মাস্টারদা পরে লিখেছিলেন,
“তার চোখেমুখে একটা আনন্দের আভাস দেখলাম। এতদূর পথ হেঁটে এসেছে, তার জন্য তার চেহারায় ক্লান্তির কোনো চিহ্নই লক্ষ্য করলাম না। যে আনন্দের আভা তার চোখে মুখে দেখলাম, তার মধ্যে আতিশয্য নেই, ফিকলনেস নেই, সিনসিয়ারিটি শ্রদ্ধার ভাব তার মধ্যে ফুটে উঠেছে। একজন উচ্চশিক্ষিত কালচারড লেডি একটি পর্ণকুটিরের মধ্যে আমার সামনে এসে আমাকে প্রণাম করে উঠে বিনীতভাবে আমার দিকে দাঁড়িয়ে রইল, মাথায় হাত দিয়ে নীরবে তাকে আশীর্বাদ করলাম।”
সেদিন তাদের মধ্যে অনেক সময় ধরে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা চলেছিল। যুব বিদ্রোহের পর দুই বছর পেরিয়ে গেছে। এর মধ্যে অনেক বিপ্লবী আটক হয়েছেন। অনেকে নিহতও হয়েছেন। এই সময়ের মধ্যে বিদ্রোহের অনেক পরিকল্পনা থাকা সত্ত্বেও বিপ্লবীরা নতুন কোনো সাফল্য অর্জন করতে পারেননি। সব পরিকল্পনা পরিচালনা করছিলেন মূলত সূর্য সেন ও নির্মল সেন। এই দুই নেতা তখন বিভিন্ন গোপন আস্তানায় দিন পার করছেন। এরকমই একটা গোপন আস্তানা ছিল ধলাঘাটে সাবিত্রী দেবীর বাড়ি, বিপ্লবীদের কাছে ‘সাবিত্রী মাসির বাড়ি’। বিপ্লবী কর্মীরা এখানে বসে নিজেদের মধ্যে আলোচনা, লেখালেখি, পড়াশোনা ইত্যাদি করতেন।
এখানে অবস্থানকালে ১৯৩২ সালের ১২ জুন, মাস্টারদা লোক পাঠিয়ে প্রীতিলতাকে বাড়ি থেকে আনার ব্যবস্থা করেন। সেদিন সাবিত্রী মাসির বাড়িতে আরো ছিলেন নির্মল সেন ও অপূর্ব সেন (ভোলা)। কিছুদিন আগেই ইংরেজ সরকার মাস্টারদা এবং নির্মল সেনকে জীবিত অথবা মৃত ধরিয়ে দিতে পারলে ১০,০০০ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেন। প্রীতিলতা সাবিত্রী মাসির বাড়িতে আসার পর অনেক কথাবার্তা শেষে তারা দু’জন যখন নিচে রান্নাঘরে খেতে বসেছেন, ঠিক সেই সময় বাড়িতে মাস্টারদা আর নির্মল সেনের উপস্থিতির গোপন খবর পেয়ে কাছের ক্যাম্পের অফিসার ইন চার্জ ক্যাপ্টেন ক্যামেরন দলবল নিয়ে আক্রমণ করেন।
এতে পুলিশের সাথে বিপ্লবীদের ছোটখাটো একটা সংঘর্ষ হয়। ফলস্বরূপ ক্যাপ্টেন ক্যামেরন এবং নির্মল সেন গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। ওদিকে বাড়ির পেছন দিক দিয়ে মাস্টারদা, প্রীতিলতা আর অপূর্ব সেন পালানোর চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের উপর গুলিবর্ষণ করে। গুলিতে মারা যান অপূর্ব সেন। মাস্টারদা আর প্রীতিলতা সেই অন্ধকার রাতে কচুরিপানা ভর্তি পুকুরে সাঁতার কেটে, কর্দমাক্ত পথ পাড়ি দিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন।
ওদিকে সেই রাতের মধ্যেই ক্যাপ্টেন ক্যামেরনের সাথে থাকা পুলিশের আই.এস মনোরঞ্জন বোস ক্যাম্পে ফিরে গিয়ে আরো সৈন্য আর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সাবিত্রী মাসির বাড়িতে ফিরে এসে বাড়িটিকে ধ্বংস করে দেয় এবং পরদিন সকাল বেলা বিপ্লবীদের আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগে সাবিত্রী দেবী ও তার ছেলেমেয়েকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়।
ধ্বংস করার আগে বাড়ি তল্লাশি করে গোপন কাগজপত্র, ছবির সাথে প্রীতিলতার একটি ছবিও খুঁজে পায় পুলিশ। এতে করে বিপ্লবী দলের সাথে প্রীতিলতার যোগাযোগ বুঝে যায় তারা। এরকম অবস্থায় মাস্টারদা প্রীতিলতাকে আত্মগোপন করার পরামর্শ দিলে ৫ জুলাই বীরেশ্বর রায় এবং মনিলাল দত্তের সাথে আত্মগোপন করেন প্রীতিলতা। ১৩ জুলাই আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তার অন্তর্ধান ও বেঙ্গল পুলিশের অনুসন্ধানের খবর।
চট্টগ্রাম শহরের উত্তরে ছিল ইংরেজদের প্রমোদকেন্দ্র পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব। ১৯৩০ সালেই এই ক্লাব আক্রমণের পরিকল্পনা থাকলেও তা করা হয়নি। কিন্তু তার প্রায় দুই বছর পর সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়। পাহাড়তলীর ওই ক্লাবটি সবসময় পুলিশি পাহারায় থাকত। ইংরেজ নর-নারী ছাড়া আর কারোর প্রবেশে অনুমতি সেখানে ছিল না। ক্লাবের বাইরে একটি ফলকে ইংরেজিতে লেখা ছিল,
“কুকুর ও ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ।”
আত্মগোপনরত বিপ্লবীরা বারবার এই ক্লাব আক্রমণের ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। শেষে তরুণ বিপ্লবী শৈলেশ্বর চক্রবর্তীর নেতৃত্বে একদল বিপ্লবীকে ক্লাব আক্রমণের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তাদের আক্রমণ ব্যর্থ হয়। এর কিছুদিন পরই ব্যর্থতার গ্লানি সহ্য করতে না পেরে শৈলেশ্বর চক্রবর্তী আত্মহত্যা করেন। আক্রমণের প্রথম ব্যর্থতার পর দলের নেতা নতুনভাবে কাজটির ছক সাজানোর চিন্তা করেন। নতুন একটা দল পাঠাবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন মাস্টারদা, আর সেই দলের নেত্রী করবেন একটি মেয়েকে। আর সেই মেয়েটি ছিলেন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন,
“বাংলার বীর যুবকের আজ অভাব নাই। বালেশ্বর থেকে জালালাবাদ কালারপুল পর্যন্ত এদের দীপ্ত অভিযানে দেশের মাটি বারেবারে বীর যুবকের রক্তে সিক্ত হয়েছে। কিন্তু বাংলার ঘরে ঘরে মায়ের জাতিও যে শক্তির খেলায় মেতেছে, ইতিহাসে সে অধ্যায় রচিত হোক এই-ই আমি চাই। ইংরেজ জানুক, বিশ্বজগৎ জানুক, এ দেশের মেয়েরাও মুক্তিযুদ্ধে পিছনে নেই।”
মাস্টারদা প্রীতিলতাকে জানিয়ে দিলেন, ১৯৩২ সালের ২৪ শে সেপ্টেম্বর রাতে পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের নেত্রী তিনি। প্রীতিলতার মনে তখন উত্তেজনার ঝড়। পূর্বে বহুবার তিনি চেয়েছেন, এরকম কোনো অভিযানে যোগ দিতে। এতদিনে তার সে সুযোগ এসেছে। কিন্তু সশস্ত্র অভিযানের কোনো অভিজ্ঞতা তার নেই। তবে আছে আদর্শের প্রতি নিষ্ঠা, দেশের জন্য আত্মত্যাগের কঠিন সংকল্প।
মূল ঘটনার পূর্বে কিছুদিন কাট্টলীর সাগরপাড়ে প্রীতিলতা ও তার সঙ্গীদের অস্ত্রচালনা প্রশিক্ষণ চলে। অভিজ্ঞ নেতারা সবরকমভাবে তাদের তৈরি করতে থাকেন। আস্তে আস্তে বহুপ্রতীক্ষিত দিনটি চলে আসে। প্রীতিলতা মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে থাকেন, দেশের মানুষের উদ্দেশে লিখে তার এই মরণখেলায় অংশ নেওয়া কথা।
ক্লাব আক্রমণে ক্লাবের একজন বাবুর্চির সহায়তার কথা উল্লেখযোগ্য। এ ব্যাপারে বিপ্লবী দলের সাথে কিছুদিন ধরেই তার যোগাযোগ ছিল। বিদেশীদের কাছ থেকে পাওয়া বাজে ও অপমানজনক আচরণের কারণে সেও ক্ষিপ্ত ছিল ওদের উপর, তাই খুব সহজেই রাজি হয়ে যায় সাহায্যের প্রস্তাবে। ঠিক হয়, তার সংকেত দেখে বিপ্লবীরা আক্রমণ শুরু করবে। প্রীতিলতা ও তার সাতজন সহযোদ্ধা সামরিক পোশাক আর অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সূর্য সেনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যাত্রা শুরু করেন ইউরোপিয়ান ক্লাবে দিকে।
পূর্বনির্ধারিত স্থানে পজিশন নেওয়ার পর বাবুর্চির সংকেতে অপারেশন শুরু করেন প্রীতিলতা ও তার দল। ক্লাবের বাইরে পাহারায় থাকা পুলিশেরা আক্রমণ হওয়ার সময়েই পালিয়ে যায়। গুলি ও বোমা ছুঁড়ে বেশ কিছু মানুষকে হতাহত করেন বিপ্লবীরা। ভেতরে থাকা আহত ইংরেজরাও এদিক ওদিক পালিয়ে যায়। খুব অল্প সময়েই সব ঠিকমতো শেষ হয়ে গেলে দলবল নিয়ে প্রীতিলতা ফেরার পথে পা বাড়ান।
যুদ্ধের নিয়ম হচ্ছে, কোনো অপারেশনে যাওয়ার সময় নেতা দলের সামনে থেকে নেতৃত্ব দেবেন, আর ফেরার সময় দল থাকবে আগে আর নেতা থাকবে সবার পেছনে। সামরিক নিয়ম অনুসারে দলের সবাইকে আগে পাঠিয়ে পেছন পেছন হেঁটে আসতে থাকেন প্রীতিলতা। ফেরার রাস্তার পাশেই ছিলো একটা নালা। ক্লাব আক্রমণের সময় সেখান থেকে পালিয়ে আসা এক ইংরেজ লুকিয়ে ছিল সেই নালার মধ্যে।
এর আগে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার আক্রমণের পর থেকেই ইংরেজরা সবসময় সাথে কোনো না কোনো অস্ত্র রাখত। নালায় আত্মগোপনরত ওই ইংরেজ সাহেবের কাছেও ছিল একটা রিভলবার জাতীয় অস্ত্র। নালার ভেতর শুয়েই এক বিপ্লবীকে খুব কাছ দিয়ে হেঁটে যেতে দেখে রিভালবার থেকে গুলি ছোঁড়ে ওই ইংরেজ। গুলি এসে লাগে প্রীতিলতার বুকে, সাথে সাথেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। ঠিক সেই মুহূর্তের মধ্যেই তিনি ঠিক করে ফেলেন নিজের শেষ কর্তব্য।
এরকম কোনো অভিযানে অনেকসময় সৈনিকদের সাথে পটাসিয়াম সায়ানাইড (তীব্র বিষ) দিয়ে দেওয়া হয়। যদি এমন পরিস্থিতি আসে, যখন সে শত্রুর কাছ ধরা পড়ে যাচ্ছে- তখন তার কাজ হচ্ছে, নিজের কাছে থাকা অস্ত্রের সাহায্যে আত্মহত্যা করা। যদি তা সম্ভব না হয়, তাহলে ওই পটাসিয়াম সায়ানাইড খেয়ে ফেলা। অত্যাচারে মুখে দলের কোনো গোপন তথ্য যাতে বলে না ফেলে, তাই এই ব্যবস্থা। অর্থাৎ, আহত অবস্থায় শত্রুর হাতে ধরা না পড়ে আত্মহত্যা করা। প্রীতিলতাও সেই মুহূর্তে পালাবার কোনো উপায় না দেখে পটাসিয়াম সায়ানাইডটা মুখের মধ্যে ঢেলে দেন, জীবিত ধরা পড়ার ভয়ে। আর তার কিছুক্ষণের মধ্যেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন ভারববর্ষের ইতিহাসের এক বীরকন্যা।
এই ঘটনার পর কলকাতা ইংরেজি সাপ্তাহিক ইংলিশম্যান পত্রিকায় প্রকাশিত এই অভিযানের বিবরণে বলা হয় প্রায় ৫৩ জন ইংরেজ নরনারীর হতাহতের কথা। প্রীতিলতার অসম সাহসিকতার প্রশংসাও করা হয়েছিল এই পত্রিকায়, যদিও পরে ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশনের প্রবল প্রতিবাদ করায় সাপ্তাহিকটির পরবর্তী সংখ্যায় এ ব্যাপারে দুঃখ প্রকাশ করে।
প্রীতিলতার মৃত্যু নিয়ে বেশ কিছু মতবিরোধ রয়ে গেছে, কিন্তু তাতে তার বীরত্ব কিছুমাত্র কমে যায়নি। বরং যুগে যুগে মানুষের মনে তার বীরত্বের গল্প নতুন করে স্থান পেয়েছে, অনুপ্রাণিত করেছে হাজার হাজার দেশপ্রেমিককে। আর আজো তাই এই উপমহাদেশে সকল শ্রেণির মানুষ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে এক অদম্য প্রীতিলতাকে।