করোনেশন স্টোন: সাদামাটা এক পাথরের রাজকীয় ইতিহাস

২০২২ সালের ৮ সেপ্টেম্বর রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে রাজা হয়ে যান তার বড় ছেলে চার্লস। তবে নিয়মানুযায়ী তার অভিষেকের তারিখ নির্ধারিত হয়েছে ২০২৩ সালের ৬ মে। সেদিন নানা আনুষ্ঠানিকতা শেষে তাকে ঘোষণা করে হবে তৃতীয় চার্লস হিসেবে। এর অন্যতম হলো সিংহাসনে বসিয়ে তাকে মুকুট পরিয়ে দেয়া। এই সিংহাসন সংরক্ষিত থাকে উইন্ডসর ক্যাসেলের সেন্ট জর্জের চ্যাপেলে। সেখানকার এক গাইড সু কিংয়ের মতে- এর থেকে প্রাচীন কোনো আসবাব ইংল্যান্ডে নেই। 

নামে সিংহাসন হলেও দেখতে কিন্তু খুব অসাধারণ কিছু নয় এটি। নানাকিছু খোদাই করে আর রত্ন বসিয়ে কিছুটা চাকচিক্য দেয়া হয়েছে এই চেয়ারকে। একে বলা হয় করোনেশন চেয়ার (Coronation Chair)। অনুষ্ঠান শুরুর আগে সভাস্থলে নিয়ে আসা হবে চেয়ার, বসিয়ে দেয়া হবে মাপমতো বানানো কাঠের এক প্ল্যাটফর্মের ওপর। আগ্রহীরা লক্ষ্য করলে হয়তো দেখতে পাবেন একটি পাথর, চেয়ার আর প্ল্যাটফর্মের মাঝের জায়গায়। এই পাথর স্কটল্যান্ড থেকে লুট করে এনেছিলেন রাজা প্রথম এডওয়ার্ড, যার নাম করোনেশন স্টোন।  

চেয়ারের নিচে রাখা করোনেশন স্টোন; Image Source: ancient-origins.net

করোনেশন স্টোন

করোনেশন স্টোন একেবারেই সাধারণ এক বেলেপাথর (sandstone)। অনেকটা স্যুটকেসের মতো আকৃতির হলদেটে এই পাথরের ওজন ১৫২ কেজি। নকশা বলতে কেবল খোদাই করা এক ক্রুশ। পাথরের দুই প্রান্তে লোহার রিং বসানো, সম্ভবত বহন করার সুবিধার্থে। 

করোনেশন স্টোন; Image Source: bbc.com

কিন্তু এই পাথর নিয়ে এত টানাটানি কেন? কারণ কিংবদন্তী আছে এই পাথর পবিত্র। এর আরেক নাম স্টোন অব স্কোন (Stone of Scone)। কারণ যুগের পর যুগ স্কটল্যান্ডের স্কোন শহরে স্কটিশ রাজাদের অভিষেকের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল এই পাথর। স্কটল্যান্ডের প্রচলিত গ্যালিক (Gaelic) ভাষায় এর তৃতীয়  নাম লিয়া ফেইল (Lia Fail)।  

কিংবদন্তী

ঠিক কী কারণে করোনেশন স্টোনকে পবিত্র মনে করা হয়? প্রচলিত এক ইহুদী  লোককথা অনুযায়ী, নবী জ্যাকব (ইসলামে হযরত ইয়াকুব আ.) বেথেল শহরে থাকার সময় এই পাথর বালিশ হিসেবে ব্যবহার করতেন। ইহুদিদের আরেক গল্পে বলা হয়- জেরুজালেমের পবিত্র মন্দিরে আর্ক অব দ্য কোভেন্যান্ট (ark of the covenant) রাখা হয়েছিল এই পাথরের ওপরেই।

প্রচলিত কিংবদন্তী অনুযায়ী- এই পাথর একসময় ছিল সিরিয়াতে। সেখান থেকে এক গ্রীক, গ্যাথেলাস (Gathelus) এটা সাথে করে নিয়ে যান মিশরে। তখন মুসা আ. ইহুদিদের নিয়ে মিশর ছাড়ার তোড়জোড় করছেন, যাকে বাইবেলে বলা হয় এক্সোডাস (Exodus)। গ্যাথেলাস তৎকালীন ফারাওয়ের মেয়ে স্কোটাকে বিয়ে করেন। কিন্তু মুসা আ.-কে ধাওয়া করতে গিয়ে লোহিত সাগরে সলিল সমাধি হয় ফারাও আর তার সেনাদলের। এরপর ভয়ে গ্যাথেলাস পালিয়ে যান, আশ্রয় নেন স্পেনে। তার কোনো এক উত্তরসূরি এই পাথর নিয়ে আয়ারল্যান্ডে চলে আসেন, হয়ে যান সেখানকার রাজা।

এক্সোডাসের সময় ফারাওয়ের মৃত্যু হলে গ্যাথেলাস নাকি পাথর নিয়ে পালিয়ে যান; Image Source: biblword.net

আয়ারল্যান্ডের পবিত্র টারা পাহাড়ের মাথায় স্থাপন করা হয় করোনেশন স্টোন। আয়ারল্যান্ডের রাজাদের অভিষেক হতো এখানেই। তখন থেকে পাথরের নাম হয়ে যায় লিয়া ফেইল, অর্থ কথা বলা পাথর (speaking stone)। প্রচলিত ছিল- যদি সিংহাসনের সত্যিকারের উত্তরাধিকারী পাথরের সামনে দাঁড়ায়, তাহলে সেটা শব্দ করে উঠবে, আর মিথ্যে দাবিদার হলে চুপ।  

আয়ারল্যান্ড থেকে স্কটল্যান্ড

ঠিক কীভাবে স্কটল্যান্ডে ঠাই হলো করোনেশন স্টোনের তার নির্ভরযোগ্য ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। কারো কারো মতে, স্কটল্যান্ডের বিখ্যাত এক শাসক, ফার্গাস মোর (Fergus Mor), ৫০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে এই পাথর নিয়ে আসেন। ফার্গাস মোর ছিলেন ডাল রিয়াটার (Dál Riata) রাজা। এই রাজ্য পশ্চিম স্কটল্যান্ড আর উত্তর-পূর্ব আয়ারল্যান্ড জুড়ে ছিল। স্কটিশ ঐতিহাসিক ডেভিড হিউম দাবি করেন- ফার্গাস ৪৯৮ খ্রিষ্টাব্দে তার রাজদরবার ডুনাদ (Dunnadd) শহর থেকে আর্গিলে (Argyll) সরিয়ে নেন, তখন এই পাথর নিয়ে আসেন আয়ারল্যান্ড থেকে। এরপর থেকে সেটা ব্যবহৃত হতে থাকে স্কটিশ রাজাদের অভিষেকে।

আরেক কিংবদন্তী অনুযায়ী মিশরীয় রাজকন্যা স্কোটা নিজেই এই পাথর নিয়ে এসেছিলেন স্কটল্যান্ডে। তবে ফার্গাস মোর বা স্কোটা কেউই ঐতিহাসিক চরিত্র হিসেবে প্রমাণিত নন। সাধারণ ধারণা হলো কেল্টিকরা যখন আয়ারল্যান্ড আক্রমণ করে তারাই এই পাথর  ছিনিয়ে নিয়ে স্কটল্যান্ড চলে আসে।  

পরবর্তী গন্তব্য ইংল্যান্ড

শতাব্দীর পর শতাব্দী স্কটিশ রাজাদের অভিষেকের শোভা বাড়িয়েছে করোনেশন স্টোন। জন ব্যালিয়ল ছিলেন এই তালিকায় সর্বশেষ। ১২৯২ সালের ৩০ নভেম্বর তিনি রাজা হন তৎকালীন ইংল্যান্ডের প্রথম এডওয়ার্ডের (Edward I) সমর্থনে। স্বাভাবিকভাবেই তার দরবারে ইংরেজ প্রভাব ছিল অনেক বেশি। ব্যালিয়ল এডওয়ার্ডের ক্রীড়নক এই ধারণা মজবুত হতে থাকে স্কটিশদের মাঝে। তাদের একদল বিদ্রোহ ঘোষণা করে বসে, হাত মেলায় ফ্রান্সের সাথে।

ইংল্যান্ড আর ফ্রান্সের তখন দা-কুমড়ো সম্পর্ক। এডওয়ার্ড ছুতো পেয়ে গেলেন। ১২৯৫ সালে এডওয়ার্ডের হাত থেকে মুক্তি পেতে ব্যালিয়ল ফ্রান্সের সাথে আনুষ্ঠানিক মিত্রতা করেন। এক বছর পরেই লোকলস্কর নিয়ে স্কটল্যান্ডে ঢুকে পড়লেন ইংল্যান্ডের রাজা। তার শক্তির সামনে ব্যাটল অব ডানবারে পরাস্ত হয় স্কটিশ বাহিনী, আত্মসমর্পণ করেন ব্যালিয়ল। 

ব্যাটল অব ডানবার; Image Source: historic-uk.com

এডওয়ার্ড স্কোন থেকে করোনেশন স্টোন বাজেয়াপ্ত করে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবিতে নিয়ে যান ১২৯৭ সালে। পাথর বসানোর জন্য করোনেশন চেয়ার আর প্ল্যাটফর্ম তার নির্দেশেই তৈরি হয়। দ্বিতীয় এডওয়ার্ডের অভিষেকে প্রথম চেয়ার আর প্ল্যাটফর্মের মাঝে বসানো হয় পাথর। এর মাধ্যমে বোঝানো হয়- ইংল্যান্ডের রাজা স্কটল্যান্ডের মুকুট পরিধান করছেন। এরপর থেকে যত রাজা-রানীর অভিষেক হয়েছে, সবার অনুষ্ঠানেই দেখা মেলে করোনেশন স্টোনের। 

স্কটিশ গল্পে বলা হয়- এডওয়ার্ড নাকি আসল পাথর পাননি। তিনি স্কোনের দিকে এগিয়ে আস্তে থাকলে সেখানকার মঠের সন্ন্যাসীরা লুকিয়ে ফেলেন করোনেশন স্টোন, সেই জায়গায় রেখে দেন স্থানীয় সাধারণ একটি পাথর। সেটা নিয়েই নাকি রাজা ফেরত এসেছিলেন। ভূতাত্ত্বিক বিশ্লেষণেও দেখা গেছে- এই পাথর স্কোনের আশেপাশেরই, কিংবদন্তীর সেই পাথরের মতো বেথেলের অঞ্চলের নয়। তবে গবেষকদের ব্যাখ্যা- যদি সেরকম কোনো পাথর থেকেও থাকে, সম্ভবত এডওয়ার্ডের অভিযানের বহু শতাব্দী আগেই তা হারিয়ে গিয়েছিল। তখনই স্থানীয় পাথর দিয়ে শূন্যস্থান পূর্ণ করা হয়। সুতরাং ঠিক সেই সময় সন্ন্যাসীদের পাথর লুকিয়ে ফেলার ঘটনা গালগপ্পো ছাড়া আর কিছু নয়।

আক্রমণের টার্গেট

১৯১৪ সালে সাফ্রাজেটস (suffragettes), যারা নারীদের ভোটাধিকারের দাবিতে আন্দোলন করছিলেন, তাদের একটি উগ্রপন্থী উপদল বোমা ফাটিয়ে করোনেশন চেয়ার ধ্বংস করে দিতে চেষ্টা করে। চেয়ারের কোণা ভেঙে গেলেও পাথর অক্ষত ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান বোমাবর্ষণ থেকে রক্ষা করতে করোনেশন স্টোন পুঁতে রাখা হয় ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবিতে, আর চেয়ার লুকোনো হয়েছিল গ্লসেস্টার ক্যাথেড্রালে। 

করোনেশন স্টোন স্কটল্যান্ডের স্বাধীন রাজাদের প্রতিনিধিত্ব করত, তাই স্কটিশ জাতীয়তাবাদীদের কাছে এর মূল্য অনেক। জাতীয়তাবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ গ্লাসগো ইউনিভার্সিটির চারজন ছাত্র ১৯৫০ সালের বড়দিনের আগের দিন জাওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবিতে ঢুকে পাথর চুরি করে। দু’ভাগে ভাগ করে গাড়ির পেছনে করে পাথর নিয়ে যাওয়া হয় স্কটল্যান্ডে। এরপর জোড়া লাগিয়ে স্কটল্যান্ডের জাতীয় পতাকায় মুড়ে রেখে দেয়া হয় ধ্বংসপ্রাপ্ত আর্বোথ অ্যাবির (Arbroath Abbey) বেদিতে, যেটা কিনা স্কটিশ স্বাধীনতাকামীদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান। চার মাস পর পাথর উদ্ধার করে ফিরিয়ে আনা হয় ইংল্যান্ডে, তবে নতুন করে রাজনৈতিক উত্তেজনা সৃষ্টি হবে ভেবে চোরদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ গঠন করা হয়নি। 

ধ্বংসপ্রাপ্ত আর্বোথ অ্যাবি; Image Source: adventuresaroundscotland.com

ঘুরে-ফিরে আবার স্কটল্যান্ডে

দ্বিতীয় এডওয়ার্ড নাকি রাজি ছিলেন শান্তিচুক্তির বিনিময়ে পাথর স্কটল্যান্ডকে ফেরত দিতে। কিন্তু ১৩২৮ খ্রিষ্টাব্দে তেমন এক প্রচেষ্টা ভেস্তে যায়। করোনেশন স্টোন ছাড়া অভিষিক্ত প্রথম স্কটিশ রাজা ছিলেন রবার্ট ব্রুস, ২৫ মার্চ ১৩০৬ সালে।

রবার্ট ব্রুস; Image Source: dailyrecord.co.uk

১৯৯৬ সালে ইংল্যান্ডের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জন মেজর স্কটল্যান্ডের কাছে পাথর ফেরত দেন। শর্ত ছিল- রাজা-রানীর অভিষেক হলে করোনেশন স্টোন ধার দিতে হবে। ৩০ নভেম্বর এডিনবার্গের রাস্তা দিয়ে নেয়ার সময় প্রায় ১০,০০০ মানুষ দাঁড়িয়ে ছিল এই পাথর একনজর দেখার জন্য। তখন থেকে এডিনবার্গ দুর্গের ক্রাউন রুমে কড়া পাহারায় থাকে রাজকীয় এই পাথর।

This is a Bengali language article about the history of the coronation stone. The stone is found below the coronation chair for UK monarchs. Necessary references have been hyperlinked and also mentioned below.
References
• Mason, J. (1873). The True History of the Coronation Stone of Scotland. Dublin University Magazine, 1833-1877; Dublin Vol. 82, Iss. 487: 38-50.
• Stone of Scone. Encyclopedia Britannica.
• Enfield, L. (2023). The disputed history of the Coronation Stone. BBC Travel.
• Klein, C. (2018). What is the Stone of Scone?
• Johnson, B. The Stone of Destiny
Feature Image: telegraph.co.uk

Related Articles

Exit mobile version