ভালবাসা দিবসের হারিয়ে যাওয়া প্রথাগুলো

ভালোবাসা দিবস চলে গিয়েছে। কিন্তু ভালোবাসা দিবসের পাগলামিগুলো এখনো যায়নি আমাদের দৈনন্দিন জীবন থেকে। এই রেশ থেকে যাবে আগামী বছরের ভালোবাসা দিবস পর্যন্ত। কেবল আজ কিংবা কাল নয়, অতীতেও ভালোবাসা দিবস এবং ভালোবাসাকে নিয়ে হাস্যকর এবং এমন অনেক কাজ করেছেন যেটা দীর্ঘসময়ের প্রেক্ষিতে হয়ে গিয়েছে প্রথা। আবার সময়ের তাগিদেই হারিয়ে গিয়েছে সময়ের গর্ভে। চলুন, আজ জেনে আসি ভালোবাসা দিবসে আর ভালোবাসাকে নিয়ে অতীতে হারিয়ে যাওয়া এমন কিছু প্রথার কথা।

ভিনেগার ভ্যালেন্টাইন

ভিনেগার ভ্যালেন্টাইন কার্ডের একটি; Source: Kottke

১৮৪০ থেকে ১৮৮০’র মধ্যকার সময়, হুট করেই ভিনেগার কার্ড নামে একধরনের কার্ড অনেক বেশি জনপ্রয় হয়ে যায় তখন। এই কার্ডগুলো ভালোবাসা দিবসকে সামনে রেখে কার্ড কোম্পানিগুলোই তৈরি করছিল। একদিকে ভালোবাসা দিবস উপলক্ষ্যে প্রিয়জনকে দেওয়ার জন্য ভালোবাসাপূর্ণ বার্তা, আর অন্যদিকে তিতকুটে কথায় ভরা ভিনেগার ভ্যালেন্টাইন কার্ড। ভিনেগার ভ্যালেন্টাইন কার্ডের মধ্যে তীর্যক কথা, শারীরিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে খোঁচা মারা সহ আরো নিম্নমানের কথা লেখা থাকতো যাতে সেটা পড়লে গ্রাহক অপমানিত বোধ করে। গ্রাহক নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে কার্ড গ্রহণ করে নিজেই অপমানিত হতো ভিনেগার কার্ডের মাধ্যমে।

জামার হাতায় হৃদয় চিহ্ন

শার্টের হাতায় ছোট্ট করে একটা লাভ বা হৃদয় আকৃতির লাল রঙের চিহ্ন- কেমন হবে এই ভালোবাসা দিবসে এমন কোনো শার্ট বা জামা পরলে? নিশ্চয়ই অনেক বেশি হাস্যকর আইডিয়া মনে হচ্ছে ব্যাপারটিকে। কিন্তু বাস্তবে একটা সময় ভালোবাসা দিবস উপলক্ষ্যে এই ব্যাপারটি চালু হয়েছিল।

জামার হাতায় ছোট্ট হৃদয়চিহ্ন ছিল খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার; Source: Republic TV

কবে থেকে এই নিয়ম চালু হল? মোট দুটো ধারণা আছে। প্রথম ধারণা অনুসারে, মধ্যযুগে এক রোমান অনুষ্ঠানে প্রথম এমন কিছু শুরু হয়। পরবর্তীতে শাসক দ্বিতীয় ক্লডিয়াস পুরুষদের মধ্যে সৈনিক মনোভাব তৈরির উদ্দেশ্যে এই প্রথাটি বন্ধ করে দেন। অন্যরা অবশ্য এই হাতায় ভালোবাসার চিহ্ন বুনে নেওয়ার ব্যাপারটি শেক্সপিয়রের ‘ওথেলো’ থেকে এসেছে বলে মনে করেন।

এসকর্ট কার্ড বা চাটুকারিতাপূর্ণ চিঠি

এখন নাহয় সরাসরি কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভালোবাসার মানুষকে জানিয়ে দেওয়া যাচ্ছে নিজের অনুভূতিকে। কিন্তু একটা সময় ব্যাপারটি এত সহজ ছিল না। ভেবে দেখুন নিজের বাবা-মা কিংবা দাদা-দাদীর কথা। কেবল আমাদের এই উপমহাদেশেই নয়, পশ্চিমা জগতে, আমেরিকার মতো স্থানেও একটা সময় সরাসরি ছেলে এবং মেয়ে কথা বলতে সামাজিকভাবে বাধার মুখোমুখি হত। ফলে, ছেলেরা দ্বারস্থ হতো এসকর্ট কিংবা ফ্লার্ট কার্ডের। যেটাকে এক কথায় ভালোবাসার আহ্বান জানানোর উপায় বলেই বেছে নিত তারা। এই কার্ডগুলোতে ছোট্ট করে নিজেদের মনের কথা লিখে মেয়েদের হাতে পৌঁছে দিত তারা। আর মেয়েরা সেটাকে লুকিয়ে দেখে সম্ভব হলে উত্তরটাও দিয়ে ফেলতো। আর হ্যাঁ, সেটাও লুকিয়েই!

লাভার’স আইজ বা প্রেমিকের চোখ

আংটিতে ব্যবহৃত লাভার’স আইজ;Source: Pinterest

ভাবুন তো একবার, আপনার গলায় আপনার প্রেমিক কিংবা প্রেমিকার চেহারা সম্বলিত লকেট। কী হবে যদি বাড়ির মানুষ কিংবা পরিচিত কেউ দেখে ফেলে? এই সমস্যা থেকে মুক্তির জন্য সহজ উপায় হিসেবে তৈরি করা হয়েছিল লাভার’স আইজ। একটু ধনী ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেই এমনটা করা সম্ভব ছিল তখন। পাথর এবং নানা কারুকার্যসম্বলিত একটি খোদাইয়ের ভেতরে আঁকা থাকতো প্রেমিক কিংবা প্রেমিকের চোখ। এতে সবাই নিজের ভালোবাসার মানুষটির স্মৃতি নিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারতো সবার সামনে।

কয়েক মিলিমিটার থেকে কয়েক সেন্টিমিটার পর্যন্ত হতো এই চোখ। হাতির দাতের উপরে জলরং দিয়ে তৈরি করা হত চোখগুলো। কেবল লকেট নয়, আংটি, ব্রোচ ইত্যাদি সবখানে সংযুক্ত করা হতো চোখগুলো। ১৮ শতকে তৎকালীন প্রিন্স অব ওয়েলস, পরবর্তীতে যিনি ষষ্ঠ জর্জ হয়েছিলেন, মারিয়া নামক একজন বিধবা নারীকে ভালোবেসে ফেলেন তিনি। মারিয়া ছিলেন ক্যাথোলিক। তার দুই স্বামী মারা যায়। ফলে রাজাকে এই সম্পর্কে মানাতে যথেষ্ট কষ্ট হয়।

প্রথমে মারিয়া রাজী হননি। পরবর্তীতে তিনি রাজী হলেও সমস্যার কারণে ইউরোপে চলে যান তিনি প্রিন্স অব ওয়েলসকে ছেড়ে। জর্জ তখন নিজের চোখের একটি আকৃতি উপহার হিসেবে মারিয়াকে পাঠান আর বিয়ের প্রস্তাব দেন। মারিয়া অবশেষে রাজী হন বিয়েতে। সেই শুরু। এরপর থেকেই লাভার’স আইজ বিখ্যাত হয়ে পড়ে সবখানে। বর্তমানে অবশ্য এই চল আর নেই। পুরো পৃথিবীতে বর্তমানে প্রায় ১,০০০টি লাভার’স আইজ টিকে আছে।

ভালোবাসা দিবসের কুসংস্কার

ভালোবাসা নিয়ে কেবল ছেলেরাই নয়, মেয়েরাও যথেষ্ট পাগলামি করেছে একটা সময়, যার চিহ্নগুলো এখন হয়তো আমাদের সামনে নেই, তবে ইতিহাসে টিকে গিয়েছে সবসময়ের জন্য। নিজেদের ভালোবাসার মানুষ কিংবা স্বামী কেমন হবে সেটা জানার জন্য আগ্রহ ছিল মেয়েদের সবসময়েই। আর তাই নানারকম কুসংস্কার পুষে রাখতো তারা ভবিষ্যৎ জানতে। পাখীদের মাধ্যমে সেটা জানার চেষ্টা করতো তারা। বিশেষ করে রোমান এবং গ্রীক নারীদের জন্য এ সংক্রান্ত কুসংস্কার ছিল অতি স্বাভাবিক ব্যাপার।

কুসংস্কার অনুসারে, কোনো নারী ভালোবাসা দিবসের সকালবেলা সর্বপ্রথম যে পাখীটিকে দেখবে, তার স্বামীর সম্পদ, চেহারা এবং সবকিছু নির্ভর করবে সেই পাখীটির উপরেই। কেবল রোম কিংবা গ্রীসেই নয়, ১৭ শতকের দিকে ব্রিটেনেও এমন অনেক কুসংস্কার পোষণ করতেন নারীরা। সেই কুসংস্কারের মধ্যে ছিল বালিশে গোলাপের পানি ছিটানো থেকে শুরু করে রাতের বেলা কবরস্থানে যাওয়ার মতো ব্যাপারগুলো। সত্যিই কি সেগুলোতে কোনো লাভ হত? হোক কিংবা না হোক, কুসংস্কারগুলোকে কিন্তু মনেপ্রাণেই বিশ্বাস করতো তারা।

ভালোবাসা এবং পাখি? হ্যাঁ, কুসংস্কার আছে এই ব্যাপারেও; Source: ThoughtCo

আপেল যখন ভালোবাসার প্রতীক

১৯৭৫ সালে অস্ট্রিয়ান লেখক বেঞ্জামিন ব্রোডি নিজের লেখায় জানান, অস্ট্রিয়ায় ভালোবাসা দিবসে পালিত হাস্যকর এবং খুবই অদ্ভুত একটি প্রথার কথা। এই প্রথা অনুসারে, মেয়েরা এক টুকরো আপেল নিজেদের বগলতলায় রাখবে। তার অনেকটা সময় পর সেটি নিজের পছন্দের ছেলেকে দেবে। ছেলেটি আপেলের টুকরো খেয়েছে নাকি খায়নি তার উপরেই নির্ভর করতো আদৌ মেয়েটি তার ভালোবাসা পেল নাকি পায়নি। যদিও এটি অস্ট্রিয়ার সবজায়গায় নিয়ম হিসেবে ছিল না। গ্রামের দিকেই এমন রীতি দেখতে পাওয়া যায়।

ভালোবাসার চামচ

ভালোবাসার প্রতীক যে চামচ; Source: Tools Are For Women Too! – Blogspot

ভালোবাসার চামচ উপহার দেওয়ার প্রথা প্রথম শুরু হয় ১৬ শতকে। সেই সময় ওয়েলসে পছন্দের মানুষকে ভালোবাসা দিবসে চামচ উপহার দিত পুরুষেরা। তবে কেবল ওয়েলসেই নয়, ধীরে ধীরে পুরো ইউরোপে এই প্রথা ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে যেমন ফুলের তোড়া উপহার দেওয়া হয়, ঠিক তেমনি সেসময় নারীদের চামচের তোড়া উপহার দিত পুরুষেরা।

কাঠের চামচগুলোতে থাকতো অসম্ভব সুন্দর কারুকার্য। পছন্দের মানুষটি চামচ গ্রহণ করলেই সম্পর্কের শুরু হতো। পরবর্তীতে সেই সম্পর্ক বিয়ে পর্যন্ত গড়ালে অনেক সময় চামচ স্মৃতি হিসেবে ঝোলানো হতো দেয়ালে। শুনতে হয়তো একটু অদ্ভুত মনে হচ্ছে, তবে সত্য বলতে গেলে, গোলাপ কিংবা চামচ যেটাই উপহার হোক না কেন, সেটি ভালোবাসারই প্রতীক হয়ে থাকে!

Related Articles

Exit mobile version