মিখিয়েল ডি রুইটার (পর্ব-২০): বিদায়ের সুর

[১৯ তম পর্ব পড়ুন]

১৬৭৫ সাল; ডি রুইটার তখনও মিলাজ্জোতে অবস্থান করছেন। ছোট ছোট দলে বহর ভাগ করে বিভিন্ন দিকে ফরাসি গতিবিধি পর্যবেক্ষণে পাঠাচ্ছিলেন তিনি। ডি হান এগারোটি জাহাজ নিয়ে তার বহরের সাথে একত্রিত হলেন, যার সাতটি ছিল যুদ্ধজাহাজ।

শত্রুর সন্ধানে

ডি রুইটার স্প্যানিশ অ্যাডমিরালকে জানালেন- তিনি মেসিনার প্রণালী বরাবর সিসিলির দক্ষিণ উপকূলে চক্কর মেরে আসতে চান। স্প্যানিশরা তখনও তাদের নৌবহর প্রস্তুত করতে পারেনি, ফলে ডি রুইটার একাই বেরিয়ে পড়লেন। তখন ১৬৭৫ সাল শেষ হয়ে নতুন বছরের সূচনা হয়েছে।

৪ঠা জানুয়ারি ডাচ বহর স্ট্রম্বোলি দ্বীপের পাশ দিয়ে যাবার সময় বিপরীত দিক থেকে আসা একটি ছোট জাহাজ তাকে জানালো অ্যালিকুইডি (Alicudi) দ্বীপের কাছে ৩০টির মতো ফরাসি জাহাজ দেখতে পেয়েছে সে। একইদিন নেপলসের ভাইসরয় বার্তা পাঠালেন- টাস্কানির উপকূলে ৩১টি ফরাসি জাহাজ দেখা গেছে বলে গর্গনা দ্বীপের অধিকর্তা খবর দিয়েছেন। সেদিন সন্ধ্যাবেলাতেই আরেক জায়গা থেকে খবর এলো- ২০টি ফরাসি জাহাজ দেখতে পাবার।

৫ জানুয়ারি কয়েকটি স্প্যানিশ রণতরী এসে যোগ দিল ডি রুইটারের সাথে। কিন্তু প্রচন্ড বাতাসে তারা বাধ্য হলো মিলাজ্জো ফিরে আসতে। ডি রুইটার এবার সিদ্ধান্ত নিলেন বাতাসের অনুকূলে পশ্চিমে যাত্রা করবার, সেদিকে লিপারি দ্বীপের কাছে ফরাসিদের আনাগোনার খবর আসছে। মেসিনার স্প্যানিশ শাসকের সাথে কথা বললেন তিনি। স্প্যানিশ শাসক জানালেন- স্প্যানিশ রণতরীকে ডি রুইটারের সাথে যাবার আদেশ তিনি দিয়ে দিয়েছেন। পালের্মো থেকে মন্টে সার্চিওর যুবরাজও তিনটি যুদ্ধজাহাজ নিয়ে যোগ দিতে পারেন। 

লিপারি ও পার্শ্ববর্তী দ্বীপসমূহে ফরাসি উপস্থিতির কথা ছড়িয়ে পড়ে; Image Source: Wikimedia Commons

৬ তারিখে লিপারি আর স্ট্রম্বোলি দ্বীপের মাঝে ফরাসিদের খুঁজতে এলেন ডি রুইটার। সাগর চষে ফেললেন তিনি ফরাসি জাহাজের সন্ধানে। মন্টে সার্চিও’র যুবরাজ একটি জাহাজ নিয়ে তার সাথে একত্রিত হন।

এদিকে মাস্তুলে বসে থাকা নাবিক জানালো উত্তরপশ্চিমে পাল দেখা যাচ্ছে। ডি রুইটার সারারাত জাহাজ চালিয়ে যাবার ফয়সালা করলেন। তখন ঘন কুয়াশা পড়ছে। তিনি জানিয়ে দিলেন সবাই যেন তার পতাকা অনুসরণ করে, আর কেউ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে যাতে মিলাজ্জো ফিরে যায়।

৭ জানুয়ারি অবশেষে দেখা পাওয়া গেল ফরাসি জাহাজের। ডি রুইটার ধাওয়া করলেন। স্প্যানিশ রণতরীও তার সহযাত্রী হল। ফরাসিরা চেষ্টা করছিল তাদের পালে যতটা সম্ভব বেশি বাতাস পাবার, কারণ ওয়েদার গেজ ডি রুইটারের পক্ষে ছিল।

স্ট্রম্বোলির সামনে ফরাসিদের মুখোমুখি হয় ডাচ-স্প্যানিশ নৌবহর; Image Source: catcoq.com

দুপুর বারোটার দিকে নিজের ১০টি দ্রুতগতির জাহাজ নিয়ে ডি রুইটার প্রায় তাদের নাগাল পেয়ে গেলেও আক্রমণের জন্য নিজের অবশিষ্ট বহরের অপেক্ষায় থাকতে বাধ্য হন। বিকাল তিনটার দিকে হামলার সংকেত দিলেও রণসজ্জা করতে করতে বেলা পড়ে গেল। শীতের সময় তখন, ফলে খুব দ্রুত নেমে আসছিল অন্ধকার। তাই ডি রুইটার সেদিন আর যুদ্ধ করতে পারলেন না। 

ব্যাটল অফ স্ট্রম্বোলি

৮ জানুয়ারি, ১৬৭৬; মন্থরভাবে স্যালিনা আর স্ট্রম্বোলি দ্বীপের মাঝের সাগরে ভাসছে ফরাসি আর ডাচ নৌবহর।

মেসিনার প্রণালীতে অবস্থান করছে ফরাসি আরেকটি বহর। কাজেই ডি রুইটার নিজের জাহজগুলো রেখেছেন একদম মেসিনা আর শত্রুদের মাঝ বরাবর। তার হাতে ১৮টি রণতরী, যার সবচেয়ে বড়গুলোর প্রতিটি বহন করছে মাত্র ৭০-৭৬টি কামান। বাকিগুলোতে ৩০-৫৪টি কামানই সম্বল। চারটি ফায়ারশিপও হিসেবে আনতে হবে।

ফরাসি বাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিখ্যাত অ্যাডমিরাল আব্রাহাম জুকে (Abraham Duquesne)। তার সাথে ২০-২৪টি যুদ্ধজাহাজ আর বেশ কয়েকটি ফায়ারশিপ। তাদের সবচেয়ে ছোট জাহাজও ডি রুইটারের সর্ববৃহৎ রণতরীর সমান। ফরাসি কামানের সংখ্যাও ডি রুইটারের থেকে অনেক বেশি। ৫০-৮০টি কামান রয়েছে তাদের প্রতিটি জাহাজে।

আব্রাহাম জুকে; Image Source: artuk.org

যুদ্ধ শুরুর আগে বাতাসের গতি পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল। ফলে ওয়েদার গেজ নিয়ে নেন জুকে। ডি রুইটার চাচ্ছিলেন যতটা সম্ভব বাতাসের অনুকূলে যাওয়া যায় সেই চেষ্টা করার জন্য। সম্মিলিত ঝটিকা আক্রমণে ফরাসি মধ্যভাগ ছিন্নবিচ্ছিন্ন করার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন তিনি। এই উদ্দেশ্যে ডি রুইটার ডাচ মধ্যভাগের দায়িত্ব নেন। রিয়ার অ্যাডমিরাল ভারশুর পেলেন ভ্যান, আর ডি হান রিয়ারের কমান্ড নিলেন।

জুকের নেতৃত্বে সারিবদ্ধভাবে এমন শৃঙ্খলার সাথে ফরাসিরা অগ্রসর হয় যে ডি রুইটার চমকে যান। সকাল দশটার দিকে ভারশুরের সাথে লড়াই বেধে যায় ফরাসি কমান্ডার হুমিয়েরের (Marquis Preuilli d’ Humières)। এদিকে ডি রুইটার ঠিকই খুঁজে বের করেছেন প্রতিপক্ষ জুকেকে। পাশ থেকে তোপ দাগলেন তিনি।

জুকেও বসে থাকলেন না। তিন ঘন্টা চলতে থাকল তুমুল গোলা বিনিময়। ডি রুইটার পড়ে রিপোর্টে লিখেছিলেন- তার জীবনে এটাই ছিল সবচেয়ে কঠিন সংঘর্ষ। ওদিকে রিয়ারে ডি হানকে ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছেন গ্যাবারেট। ফলে হান কিছুটা দূরে সরে গিয়েছিলেন মূল বহর থেকে। এই পরিস্থিতিতে ফরাসি মধ্যভাগে হামলা চালানোর ডি রুইটার পূর্বপরিকল্পনা বাতিল করতে বাধ্য হন।

স্ট্রম্বোলির নৌযুদ্ধ; Image Source: Wikimedia Commons

জুকে ডাচ অ্যাডমিরালের বিরুদ্ধে তিনটি ফায়ারশিপ প্রেরণ করেন। প্রত্যেকটিই ডুবিয়ে দেয়া হয়। বিকাল সাড়ে চারটার দিকে দুই পক্ষই রণেভঙ্গ দিল। ভারশুরসহ ডাচদের ৮০ জন নিহত আর ৬০ জন আহত তাদের একটি জাহাজ খারাপভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, পরদিন মেরামতের উদ্দেশ্যে টেনে নিয়ে যাবার সময় যা ডুবে যায়।

ফায়ারশিপ ব্যবহার করে দু’পক্ষই একে অপরের ক্ষতি করার চেষ্টা করে; Image Source: historynet.com

বিপরীতে, জুকের কয়েকজন অফিসারসহ ৪০০ লোক হতাহত হয়েছে, জুকে নিজেও কিছুটা আঘাত পেয়েছেন। ফরাসিদের একটি জাহাজও ডুবে গেছে। তবে সামরিক দিক থেকে এই লড়াই অমীমাংসিত। কৌশলগত দিক থেকেও কোনো পক্ষই সুবিধা আদায় করতে পারেনি। 

পরদিন বাতাস পড়ে গেলে কেউই সংঘাতে জড়াল না। জুকে এরপর সরে যেতে থাকেন। ১০ আর ১১ জানুয়ারি ডি রুইটার তার পিছু পিছু যান, কিন্তু ফরাসিরা লড়াই করল না। তবে তাদের সাথে আরো ২০টির মতো জাহাজ যোগ দেয়।

নেপলস

১২ জানুয়ারি সকালে ডি রুইটার অফিসারদের নিয়ে আলোচনায় বসলেন। সিদ্ধান্ত হলো- মেসিনার প্রণালী থেকে খোলা সাগরে ফরাসিদের টেনে এনে যুদ্ধ করবার। কিন্তু বিকালে স্প্যানিশদের সাথে বৈঠকে তারা এই মুহূর্তে সরাসরি সংঘাত এড়িয়ে যাবার পরামর্শ দেয়। স্প্যানিশ সহায়তা ছাড়া জুকের বড় বহরের মোকাবেলা করার সামর্থ্য ডাচদের ছিল না। ফলে টহল দিতে ডি রুইটার এগিয়ে গেলেন লিপারির দিকে।

চুক্তি অনুযায়ী ততদিনে স্পেনে ডি রুইটারের সময়সীমা শেষ হয়ে আসছিল। ফলে তিনি ১৮ জানুয়ারি মিলাজ্জোতে ফিরে আসেন। ভিলাফ্রাঙ্কা ডি রুইটারকে অনুরোধ করলেন আরো কিছুদিন এখানে থেকে যেতে।

কিন্তু এস্টেট জেনারেলদের কাছ থেকে বেধে দেয়া সময়সীমার বাইরে যাওয়া ডি রুইটারের পক্ষে সম্ভব ছিল না। ফলে সিসিলির ভাইসরয় তার কাছে আবেদন জানালেন যাবার পথে তিনি যেন অন্তত নেপলস হয়ে যান। সেখানে স্প্যানিশ প্রতিরক্ষা মজবুত করতে তার মতামত কাজে লাগবে। ডি রুইটার সম্মত হন। ২২ জানুয়ারি তিনি পাল তুললেন।

জুকে ততদিনে আরো জাহাজ যোগ করে শক্তিশালী হয়ে উঠেছেন। কিন্তু তিনিও অনর্থক কোনো সংঘর্ষে যেতে চাইছিলেন না। ফলে মেসিনাতে যাবার পথে যাতে কোনো শত্রুবহর না পড়ে তাই তিনি ঘুরপথ অবলম্বন করেন। পুরো সিসিলি ঘুরে তিনি মেসিনার দিকে এগিয়ে আসেন।

নেপলসের দিকে যাবার সময় ডি রুইটার গর্গনা দ্বীপের কাছে পাঁচটি ডাচ জাহাজের দেখা পান। এরা বহন করছিল প্রিন্স অব অরেঞ্জের নির্দেশ। তাকে জানানো হলো- স্পেনের সাথে ডি রুইটারের সহায়তার মেয়াদ আরো ছয় মাস বাড়ানোর কথা চলছে, কাজেই এই মুহূর্তে তার এই অঞ্চলেই থাকা জরুরি। পাশাপাশি আমস্টারডামের নৌ অধিদপ্তর থেকে তাকে পরামর্শ দেয়া হয়েছে প্রয়োজনীয় রসদপত্রের নেপলস থেকে সংগ্রহ করে নেয়ার।

ডি রুইটার নেপলসে এসে পৌঁছলে ভাইসরয় ভেলেজ (Marquis de los Velez) মহাসমারোহে তাকে আতিথ্য দেন। ডি রুইটার এই অবসরে তার কাছে হাঙ্গেরিয়ান যাজকদের ব্যাপারে আবার আবেদন করলেন। ততদিনে লিওপোল্ড তাদের ছেড়ে দিতে সম্মত হয়েছেন। ফলে ভিলাস ডি রুইটারকে জানান, যাজকদের মুক্তির ব্যাপারে বাধা নেই। ডাচ জাহাজের যাজক থিওডোর অবিলম্বে ২৩ জন বন্দিকে স্প্যানিশ জাহাজ থেকে নিয়ে এলেন। পরদিন হাসপাতাল থেকে পাওয়া গেল আরেকজন, অবশিষ্ট দুজনকে কয়েদখানা থেকে ছুটিয়ে আনা হলো।

যাজকদের ব্যাপার সমাধা করে ১৭ তারিখ নেপলস ছাড়ার তোড়জোড় শুরু করলেন ডি রুইটার। ততদিনে তার বর্ধিত মেয়াদের ব্যাপারে এস্টেট জেনারেলদের আদেশ চলে এসেছে। ২৩ তারিখ পালের্মোতে এসে জাহাজ পরিষ্কার আর মেরামতের কাজ চলল ১৪ মার্চ পর্যন্ত। এখানে স্প্যানিশ ভাইস অ্যাডমিরাল ডন ফ্রান্সিস্কো পেরেইরা ১৩টি রণতরী নিয়ে তার সাথে মিলিত হন।

পেরেইরার স্প্যানিশ বহর যোগ দেয় ডি রুইটারে সঙ্গে; Image Source: artuk.org

এস্টেট জেনারেলদের নির্দেশ মোতাবেক পেরেইরার হাতেই সম্মিলিত বহরের ভার ছেড়ে দিলেন ডি রুইটার। পেরেইরা যৌথ বহরের মধ্যভাগে অবস্থান নেন। ডি রুইটার ভ্যান আর ডি হান রিয়ারে রয়ে গেলেন। অন্যদিকে নেদারল্যান্ডসে এস্টেট জেনারেলরা ডি রুইটারের কাছ থেকে ডাচ বহরের অপ্রতুলতা আর নিম্নমান নিয়ে এতদিনে কিছুটা সচেতন হলেন। স্প্যানিশ সম্রাট দুই-তৃতীয়াংশ খরচ বহন করবেন- এই শর্তে ৬০ কামানের ছয়টি জাহাজ পাঠানোর পরিকল্পনা হলো।

পালের্মো থেকে ২০ মার্চ সম্মিলিত নৌ বহর মিলাজ্জো এসে পৌঁছে। ততদিনে মেসিনার প্রণালীতে জুকে শক্ত হয়ে বসেছেন। তীরেও ফরাসি সেনারা ঘাঁটি করেছে। ডি রুইটার আর স্প্যানিশ অ্যাডমিরাল বৈঠক করে ঠিক করলেন স্থল আর জল দু’দিক থেকেই ফরাসিদের উপর আক্রমণ শানানো হবে।

This is a Bengali language article about the intrepid Dutch Admiral, Michiel De Ruyter. The article describes the De Ruyter’s lie and achievements. Necessary references are mentioned below.

References

  1. Douglas, P. Michiel De Ruyter, Held van Nederland. New Netherland Institute.
  2. Grinnell-Milne, G.(1896). Life of Lieut.-Admiral de Ruyter. London: K. Paul, Trench, Trübner & Company.
  3. Curtler, W. T. (1967). Iron vs. gold : a study of the three Anglo-Dutch wars, 1652-1674. Master's Theses. Paper 262.
  4. Michiel Adriaanszoon De Ruyter. Encyclopedia Britannica.

Feature Image: sashacameron.com

Related Articles

Exit mobile version