ভাস্কো দা গামা: ইতিহাসের উজ্জ্বল তারকা, নাকি বর্বর বণিক?

ভাস্কো দা গামা নামটা আমরা সকলেই প্রথম পড়ে এসেছি সেই ছোটবেলার বইতে। মনে পড়ে? প্রথম ইউরোপীয়, যিনি কিনা জাহাজে করে সেই কয়েকশ বছর আগে এই উপমহাদেশে এসেছিলেন, তার আগে কেউ আসেননি। এটুকু সবার জানা থাকলেও তার কালো দিকটা কম মানুষই জানেন। আজকে তার কীর্তিকলাপই আমাদের গল্প।

ভাস্কো দা গামা যেদিন কালিকট বন্দরে এসে নামেন, সেদিন ছিল ১৪৯৮ সালের ২০ মে, ৫১৯ বছর আগের কথা। কিন্তু আমরা শুরু করব আরো পেছন থেকে, ভাস্কোর জন্ম থেকে।

শিল্পীর তুলিতে ভাস্কো দা গামা; Image Source: Wikimedia

তিনি কবে জন্মেছিলেন সেটা নিশ্চিত না, কেউ বলেন ১৪৬০, কেউ বলেন ১৪৬৯ সাল। তবে জন্মটা হয়েছিল পর্তুগালের দক্ষিণ-পশ্চিমে, সাগরের পাড়ের কাছেই সিনেস শহরে। কাছেই ছিল এক চার্চ, যার ঘণ্টাধ্বনি শুনতে পাওয়া যেত প্রতিনিয়ত। তার বাবা ছিলেন এস্তেভাও দা গামা, তিনি ছিলেন একজন নাইট যোদ্ধা। অর্ডার অফ সান্তিয়াগো মিলিটারির উঁচু পদেই ছিলেন। সিনেসের খাজনা আদায়কারীর কাজ নিয়েছিলেন তিনি, তবে তার আগে ১৪৭৮ সাল পর্যন্ত ছিলেন সিভিল গভর্নর।

এস্তেভাও বিয়ে করেন সম্ভ্রান্ত ইংলিশ বংশোদ্ভূত মেয়ে জোয়াও-কে। তাদের পাঁচ ছেলে হয়েছিল, আর তার মধ্যে তৃতীয় ছিলেন ভাস্কো। এক বোনও ছিল তার, তেরেসা।

ভাস্কোর নিজের বাড়ির সামনে এখন তার ভাস্কর্য; Image Source: Wikimedia

খুব বেশি জানা যায় না ভাস্কোর প্রাথমিক জীবন নিয়ে। ইভোরা শহরে পড়ালেখা করেন তিনি, ওখানেই গণিত আর জাহাজ চালনার দিকনির্দেশনা অধ্যয়ন করেন।

১৪৮০ সালের দিকে ভাস্কো তার বাবার মতোই অর্ডার অফ সান্তিয়াগো-তে যোগ দেন, অর্থাৎ তারা ছিলেন সান্তিয়াগোদের সেনা। সান্তিয়াগোর মাস্টার ছিলেন প্রিন্স জন, তিনি ১৪৮১ সালেই পর্তুগালের রাজা হয়ে যান। তখন আর দা গামা-দের ঠেকায় কে। ১৪৯২ সালে রাজা ভাস্কো দা গামাকে পাঠালেন এক মিশনে, ফ্রেঞ্চ জাহাজ দখল করতে হবে। কাজটা এত নৈপুণ্যের সাথে করলেন তিনি, যে দা গামার সুনাম ছড়িয়ে পড়ল।

তখনকার দিনে আফ্রিকার সাথে মসলার ব্যবসা চলতো বটে, কিন্তু ভারতবর্ষের সাথে না। হবে কীভাবে, তখনো কেউ ওখান থেকে পাড়ই দেননি ভারতে। রাজা জানতেন ওদিকের ভূমির খবর গুপ্তচর মারফত। এই অজানা ভূমির উদ্দেশ্যে পাড়ি জমাবার জন্য বিশ্বস্ত আর চৌকশ লোক দরকার।

১৪৯৭ সালের ৮ জুলাই ভাস্কো দা গামা ১৭০ ক্রু নিয়ে পর্তুগালের লিজবন থেকে যাত্রা করলেন, ছিল চারটা জাহাজ। তারা আফ্রিকা হয়ে ঘুরে ইন্ডিয়ার দিকে আসতে লাগলেন। জাহাজে ছিলেন তুখোড় সব দিকনির্দেশক। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার, মাত্র ৫৫ জন ফিরে আসতে পারে, দুটো জাহাজ হারাতে হয়। এই চার জাহাজের নাম ছিল সাও গাব্রিয়েল, সাও রাফায়েল, বেরিও আর… আরেকটার নাম অজানা, ওটা ছিল গুদাম জাহাজ।

লিজবন থেকে রওনা দিচ্ছেন ভাস্কো দা গামা; Image Source: www.oshermaps.org

তার জাহাজগুলো কেপ ভার্দে, মোজাম্বিক, মোম্বাসা (কেনিয়া), মালিন্দি এগুলো পেরিয়ে অবশেষে ভারতবর্ষের কাছে এলো। প্রায় এক বছর ভ্রমণ শেষে জাহাজ ভিড়ল কালিকটের কাছাকাছি কাপ্পাড়ুতে। কালিকটের রাজা ছিল সামুদিরি। তবে তিনি প্রধান রাজধানীতে ছিলেন না তখন, ছিলেন দ্বিতীয় রাজধানীতে। কিন্তু বিদেশী নৌবহর এসেছে শুনে তিনি ফিরে আসলেন। আগত বিদেশীদের ৩,০০০ নায়েরের উপস্থিতিতে রাজকীয় সম্মাননা দেয়া হয়। দা গামা রাজাকে উপহার দিলেন, উজ্জ্বল লাল কাপড়ের চারটি জোব্বা, ছয়টি টুপি, চার ধরণের প্রবাল, বারটি আলমাসার, সাতটি পিতলের পাত্রসহ একটি বাক্স, এক সিন্দুক চিনি, দুই ব্যারেল (পিপা) তেল এবং এক পিপা মধু। কিন্তু এগুলো খুব তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে নিলেন রাজা, মোটেও আকৃষ্ট হননি। সোনা রূপা নেই- এ কেমন কথা!

কালিকটের রাজার সাথে ভাস্কো; Image Source: www.columbia.edu

ভাস্কো দা গামা ভারতে ব্যবসায় করার জন্য অনুমতি চাইলেন। কিন্তু রাজা প্রত্যাখ্যান করলেন। বললেন, এখানে ব্যবসা করতে হলে অন্যদের মতো সোনা দিয়ে খাজনা দিতে হবে।

কালিকটে ভিড়ছে জাহাজ; Painting Corutesy: Allan Stewart 

এটা শুনে ভাস্কো মনঃক্ষুণ্ণ হন। এক্ষেত্রে তিনি এক কাজ করে বসলেন, যেটা আমরা ইতিহাস বইতে পড়িনি। তিনি সাথে করে জোর করে তিনজন নায়ের আর ১৬ জন জেলেকে ধরে নিয়ে গেলেন! তবে যা-ই হোক, ভাস্কো যখন দেশে ফেরেন, তখন তিনি ৬০ গুণ লাভ করে ফিরেছিলেন!

১৪৯৮ সালের ২৯ অগাস্ট ভাস্কো কালিকট বন্দর থেকে স্বদেশ এর জন্য রওনা দেন। কিন্তু পথে যে তাদের অজ্ঞাত মৌসুমি বায়ুর বিভীষিকার মুখোমুখি হতে হবে, তা তারা জানতেন না। ২৩ দিনের পথ তাদের যেতে হলো ১৩২ দিনে! ১৪৯৯ সালের জানুয়ারির ২ তারিখ তিনি আফ্রিকার মোগাদিশুতে এসে স্থলের দেখা পান। সেখানে তখন চার পাঁচতলা বাড়ি, প্রাসাদ, আর মিনারওয়ালা মসজিদ ছিল!

যে রুটে চলেছিল ভাস্কোর জাহাজগুলো [প্রথম যাত্রা]; Image Source: Wikimedia

৬ তারিখ তিনি এলেন মালিন্দিতে, ততদিনে অর্ধেক ক্রু মারা গিয়েছে, আর বাকিরা স্কার্ভি রোগে আক্রান্ত। এত কম লোক দিয়ে তাদের তিনটা জাহাজ চালানো অসম্ভব ছিল। তাই সাও রাফায়েল জাহাজটা ডুবিয়ে দিতে বলা হলো। আর ওখানের ক্রুদের বাকি দু জাহাজে ভাগ করে দেয়া হলো।

১৪৯৯ সালের ১০ জুলাই, বেরিও জাহাজ এসে পর্তুগালের লিজবনে পৌঁছায়। কিন্তু তখন ভাস্কোর ভাই পাউলো অনেক অসুস্থ হয়ে পড়েন। তারা দুজন কিছুদিন সান্তিয়াগো দ্বীপে থাকেন। কিন্তু অন্য জাহাজ যত দিনে এসে পৌঁছে (আগস্ট) ততদিনে ভাই পাউলো মারা গেলেন।

ভাইকে সমাহিত করে ভাস্কো ২৯ অগাস্ট লিজবনে যান। দা গামাকে বীরের মতো স্বাগত জানানো হয়, রাজকীয় অনুষ্ঠানের দ্বারা বরণ করা হয়। ডিসেম্বর মাসে রাজা সেই সিনেস শহরটা দা গামাকে জায়গীর হিসেবে দিয়ে দেন। যদিও সেটা নিয়ে তাকে ঝামেলা পোহাতে হয়েছিল।

১৫০২ সালে পর্তুগাল থেকে ৪র্থ বহর রওনা দেয়। সেখানে অংশ নিতে ভাস্কো পত্র দেন। এ বহরের উদ্দেশ্য ছিল, কালিকটের রাজার উপর প্রতিশোধ নেয়া আর পর্তুগিজরা যে শর্ত দেবে সেই মাফিক আত্মসমর্পণ করানো। ১৫টা জাহাজ আর ৮০০ লোক অস্ত্র নিয়ে রওনা দেয়। পেছনে আসে আরো ৫টি জাহাজ, যাতে ছিলেন ভাস্কোর চাচাত ভাই।

১৫০২ সালের অক্টোবরে তাদের বিশাল নৌবহর ভারতে পৌঁছল। সেখানে “মিরি” নামে এক জাহাজ আসছিল মক্কা থেকে, হজ্জযাত্রীতে পরিপূর্ণ। সেই জাহাজে আক্রমণ চালিয়ে দা গামা সকল যাত্রীকে পানিতে ডুবিয়ে হত্যা করেন, তার আগে তাদের জ্বালিয়ে দেন। জাহাজে ছিল চারশ যাত্রী, যেখানে ৫০ জনই মহিলা, ছিলেন মিসরের রাষ্ট্রদূত। মহিলাগুলো তাদের বাচ্চাদের ধরে প্রাণভিক্ষা চাইছিল, কিন্তু দা গামা দেখেন তাদের গায়ে সোনার অলংকার। সবাই নিজেদের মুক্তিপণ দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু দা গামা সেটা না শুনে তাদের মেরে ফেলেন।

দা গামার শর্ত মেনে নিতে রাজি হলেন কালিকটের রাজা। কিন্তু দা গামা শহর থেকে সকল মুসলিমকে বের করে দেবার দাবি জানালে কালিকটের হিন্দু রাজা সেই দাবি খারিজ করেন। ফলে পর্তুগিজ জাহাজগুলো টানা দুদিন গোলাবর্ষণ করে শহরে। শহরের অনেক ক্ষয় ক্ষতি হয়।

দা গামা কিছু ভারতীয় জাহাজ আটকে সেখানের ক্রুদের হাত কান নাক এগুলো কেটে দেন, সেই অবস্থায় রাজার কাছে পাঠান তাদের। রাজা তখন একজন ব্রাহ্মণকে পাঠালেন তার কাছে, কিন্তু দা গামা বললেন এই লোক গুপ্তচর। তখন ব্রাহ্মণের ঠোঁট কেটে দেয়া হলো। কান কেটে দিয়ে সেখানে সেলাই করে কুকুরের থেকে কেটে নেয়া কান লাগিয়ে দেয়া হলো। এরপর ভাস্কো তাকে পাঠিয়ে দিলেন রাজার কাছে।

কালিকটের রাজা পর্তুগিজ শর্ত মানতে চাইলেন না। এমনকি তিনি ভাড়া করলেন শক্তিশালী অস্ত্রবাহী নৌবহর। তবে দা গামা জিতে যান। জাহাজ বোঝাই করে তিনি মসলা আর অন্য জিনিসপাতি নিয়ে গেলেন।

কালিকটের এখানেই প্রথম নেমেছিলেন ভাস্কো দা গামা; Image Source: Wikimedia

পরের দু’দশক নীরব জীবন কাটালেন দা গামা। ১৫২৪ সালে তৃতীয় জন ভাস্কো দা গামাকে ভাইসরয় উপাধি দেন। এপ্রিলে তিনি আবার ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। এবার এসেই পর্তুগিজ অধ্যুষিত ভারতে নিজের পছন্দের লোকদের বসিয়ে দিলেন ক্ষমতায়, তিনি নিজেই ছিলেন অনেক ক্ষমতাবান। কিন্তু এখানে আসামাত্রই তার ম্যালেরিয়া হলো।

তিন মাস বাদে ১৫২৪ সালের ক্রিসমাসের আগেরদিন তিনি কোচিন শহরে মারা যান ম্যালেরিয়ার কারণে। ওখানেই এক চার্চে তার দেহ সমাহিত করা হয়, কিন্তু ১৫৩৯ সালে তা পর্তুগালে ফিরিয়ে নেয়া হয়। সোনা আর অলংকারে মণ্ডিত করে তা দৃষ্টিনন্দন করে রাখা হয়, এখনো তাই আছে। তিনি আর তার স্ত্রী ক্যাটেরিনার ৬ ছেলে আর এক মেয়ে ছিল।

ভাস্কো দা গামার স্বাক্ষর; Image Source: Narrative and Critical History of America, Volume 2 by Justin Winsor ed.

২০১৬ সালের মার্চে ওমানের কাছে সাগরের তল থেকে ভাস্কোর ডুবে যাওয়া এক জাহাজ উদ্ধার করা হয়েছিল, নাম ছিল এসমেরালদা।

পর্তুগালের ভাস্কো দা গামাকে ইতিহাস মনে রাখে ইউরোপীয়দের ভারতে আসার পথ সুগম করার পথপ্রদর্শক হিসেবে। কিন্তু তার আগমন ভারতবর্ষের জন্য আদৌ সুখকর ছিল না। তবে ইতিহাস বইগুলো তার ভারত ‘আবিষ্কার’-কেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখে, যে কারণে ভারতবর্ষে তার করে যাওয়া বর্বরতা খুব কম মানুষই জানে, যদি ইতিহাসপ্রিয় না হয়ে থাকে।

শিল্পীর তুলিতে তরুণ ভাস্কো দা গামা; Painting Courtesy: António Manuel da Fonseca

This article is in Bangla language. It's about the Portuguese explorer Vasco Da Gama. 

Featured Image: tonysblog.info

Source:

  1. Diffie, Bailey W. and George D. Winius, Foundations of the Portuguese Empire, 1415–1580, p.176
  2. Nigel, Cliff (September 2011). Holy War: How Vasco da Gama’s Epic Voyages Turned the Tide in a Centuries-Old Clash of Civilizations. Harper
  3. Modern History Sourcebook: Vasco da Gama: Round Africa to India, 1497–1498 CE, fordham.edu, Retrieved 27 June 2007.
  4. Vasco da Gama Arrives in India 1498 at the Wayback Machine (archived 18 January 2004) Dana Thompson, Felicity Ruiz, Michelle Mejiak; 15 December 1998. Retrieved 8 July 2006.
  5. The Last Crusade: The Epic Voyages of Vasco Da Gama by Nigel Cliff

Related Articles

Exit mobile version