পৃথিবীর ইতিহাসে নানা জাতিগোষ্ঠীর ভাগ্যে কখনো কখনো নেমে এসেছে অন্ধকার সময়। সে সময়ের অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা আর কলহ গ্রাস করেছে পুরো জাতিগোষ্ঠীকে। তেমনই এক অন্ধকার সময় নেমে এসেছিল বাংলা অঞ্চলের বুকেও। ইতিহাসে সেই সময়টিকে বলা হয় মাৎস্যন্যায়ের যুগ। আজকের লেখায় আমরা ফিরে তাকাবো ইতিহাসের সেই সময়টির দিকে।
মাৎস্যন্যায় আসলে কী?
সংস্কৃত শব্দ মাৎস্যন্যায়-এর আক্ষরিক অর্থ দাঁড়ায় ‘মাছের ন্যায়’। মাছেদের জগতে বড় মাছ কর্তৃক সাবাড় হয় ছোট ছোট মাছ। দুর্বল নিমেষেই হয়ে যায় সবলের গ্রাস। মাছেদের জগতে যদিও বা এটাই নিয়ম, কিন্তু মানবসমাজে তা ঘোরতর অন্যায়। মাৎস্যন্যায় শব্দ দ্বারা সেই সময়, রাষ্ট্র বা সমাজ ব্যবস্থার অবস্থাকে নির্দেশ করা হয় যখন, মাছদের জগতের মতো ছোটরা বড়দের হাতে, দুর্বলরা সবলদের হাতে, কিংবা ক্ষমতাহীনরা শোষিত হয় ক্ষমতাবানদের হাতে। অরাজকতা আর বিশৃঙ্খলা গ্রাস করে পুরো সমাজ কিংবা রাষ্ট্রকে। সমাজ থেকে লোপাট হয়ে যায় স্বাভাবিক নিয়ম কিংবা সমতা।
ডা. নীহাররঞ্জন গুপ্তের ভাষায়—
“দেশময় উচ্ছৃঙ্খল-বিশৃঙ্খল শক্তির উন্মত্ততা; এমন যখন হয় দেশের অবস্থা, প্রাচীন অর্থশাস্ত্রে তাহাকেই বলে মাৎস্যন্যায়, অর্থাৎ বৃহৎ মৎস্য কর্তৃক ক্ষুদ্র মৎস্য গ্রাসের যে ন্যায় বা যুক্তি, সেই ন্যায়ের অপ্রতিহত রাজত্ব।”
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে এ সময় সম্পর্কে বলা হয়েছে, যখন বিচারের অভাবে ক্ষমতাবান দুর্বলকে গ্রাস করে, যেমন বড় মাছ সাবাড় করে ছোট মাছকে, এমন অবস্থাকে বলা যায় মাৎস্যন্যায়।
সময়কাল
প্রাচীন বাংলার ইতিহাসকে মোটামুটি তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম ভাগে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে গুপ্ত শাসন পর্যন্ত, দ্বিতীয় ভাগে গুপ্ত-উত্তর কাল থেকে শশাঙ্কের শাসনামল পর্যন্ত এবং তৃতীয় ভাগে শশাঙ্ক পরবর্তী বিশৃঙ্খলার যুগ থেকে পাল ও সেন শাসনামল। মাৎস্যন্যায়ের সময়টি ছিল তৃতীয় ভাগের শুরুর দিকে। মোটামুটিভাবে ৬৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৭৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যকার প্রায় একশো বছর।
৬০৬ খ্রিস্টাব্দের দিকে শশাঙ্ক গৌড়ে স্বাধীন, সার্বভৌম রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হয়েছিলেন। তাকেই আখ্যা দেওয়া হয় বাংলা অঞ্চলের প্রথম স্বাধীন নরপতি হিসেবে। পরবর্তী গুপ্ত শাসকদের কাছ থেকে তিনি গৌড় রাজ্য দখল করে কর্ণসুবর্ণে তার রাজধানী স্থাপন করেছিলেন। শশাঙ্ক গৌড়ের সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হয়ে গৌড়ের সীমা বৃদ্ধি করেছিলেন মগধ ও উড়িষ্যার উত্তরাঞ্চল পর্যন্ত।
আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্প গ্রন্থের বিবরণ অনুযায়ী, ৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুর আগে শশাঙ্ক রাজ্য শাসন করেছিলেন প্রায় সতেরো বছর। তিনি ছিলেন একজন শক্তিশালী নৃপতি এবং তার সময়ে রাজনৈতিক শৃঙ্খলাও বজায় ছিল। তার হাত ধরেই উত্তর ভারতীয় রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করে গৌড়। কিন্তু তার মৃত্যুর যোগ্য উত্তরসুরীর অভাবসহ নানা কারণে বাংলার আকাশে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। শুরু হয় এক অভাবনীয় বিশৃঙ্খলার যুগ ‘মাৎস্যন্যায়’।
সে সময় বাংলার অবস্থা
মাৎস্যন্যায় চলাকালীন সময়ের প্রকৃত চিত্র সম্পর্কে তথ্যসূত্রের অপ্রতুলতা ও সীমাবদ্ধতার জন্য খুব বেশি জানা সম্ভব হয় না। শশাঙ্কের মৃত্যুর পর চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় এসেছিলেন। তার বিবরণ অনুযায়ী এ অঞ্চলে পাঁচটি রাজ্যের কথা জানা যায়। তখনো মাৎস্যন্যায় যুগ শুরু হয়নি। বৌদ্ধগ্রন্থ আর্যমঞ্জুশ্রীকল্পে উল্লেখিত বিবরণ অনুযায়ী শশাঙ্কের মৃত্যুর পর, গৌড়ের অন্তর্বিদ্রোহ ও অরাজকতায় ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যাওয়ার বিষয়ে বলা আছে।
তবে ইতিহাসের অপ্রতুলতার মধ্যেও এ বিষয়টি স্পষ্ট যে, সে সময়টাতে কোনো শক্তিশালী কিংবা স্থায়ী কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থা না থাকায় ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বণিক যে যার মতো করে প্রভাব বিস্তার, জবরদখল কিংবা নিজের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করতে উঠেপড়ে লেগেছিল। অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে, উত্তর ভারতীয় অঞ্চলে যেকোনো বিশৃঙ্খলা বা অনিয়মকে গৌড়তন্ত্র বলে ব্যঙ্গ করা হতো।
শশাঙ্কের মৃত্যুর পর শশাঙ্কপুত্র মানবদেব তার পিতার সাম্রাজ্য রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। তার রাজত্বের বয়স ছিল এক বছরেরও কম। এ অবস্থায় হর্ষবর্ধন ও তার মিত্র কামরুপরাজ ভাস্করবর্মা গৌড় তথা বাংলা অঞ্চলের অংশবিশেষের দখল নিয়ে তাকে নিজ রাজ্যভুক্ত করেছিলেন।
হর্ষবর্ধন ৬৪৭ খ্রিস্টাব্দের দিকে মৃত্যুবরণ করেন। বাংলা অঞ্চলে এরপর জয়নাগ নামক একজন রাজা ৬৫০ খ্রিস্টাব্দের দিকে গৌড় জয় করে কিছুকাল শাসন করেছিলেন বলে জানা যায়। জয়নাগের পর এ অঞ্চলের অনিশ্চয়তা আরো গভীর হয়।
এমনিতেই অভ্যন্তরীণ গোলযোগে টালমাটাল, তার ওপর এ সময়টাতেই আবার উত্তর বাংলা অঞ্চলে তিব্বতীয় আক্রমণ চলতে থাকে। তিব্বতীয় রাজা ওয়াং হিউয়ান সে এবং সং সান গেম্পো একাধিকবার বাংলা অঞ্চলে অভিযান পরিচালনা করেছিলেন বলে জানা যায়। তিব্বতীয়রা ছাড়াও আরো বেশ কিছু শক্তি তখন এই অঞ্চলে হানা দিয়েছিল। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে কনৌজের রাজা যশোবর্মন। তবে বেশিদিন তার শাসন টেকেনি। কাশ্মীরের রাজা ললিতাদিত্য তাকে পরাজিত করেন।
কাশ্মীরী ঐতিহাসিক কলহনের রজতরঙ্গিনী গ্রন্থের বিবরণ অনুযায়ী, ললিতাদিত্য গৌড়ের পাঁচজন রাজাকে পরাজিত করেছিলেন। যা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মতপার্থক্য থাকলেও অনুমান করা যায়, এই অঞ্চলটি কতটা খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে বিভক্ত ছিল। তিব্বতের বৌদ্ধ ধর্মগুরু ও ঐতিহাসিক লামা তারানাথ লিখেছেন,
“কী ক্ষত্রীয়, কী ব্রাক্ষণ, কী কায়স্থ- সবাই নিজেদের ঘরে নিজেরাই রাজা হয়ে বসেছিল এবং সম্ভব হলে প্রতিবেশিরও। পুরো দেশ শাসনের জন্য আর কোন রাজা অবশিষ্ট ছিল না!”
গোপালের আবির্ভাব
বাংলা অঞ্চলে যখন এরকম দুর্দশা, দীর্ঘ সময় রাজনৈতিক গোলযোগ ও রাজনৈতিক শূন্যতার সুযোগে বিশৃঙ্খলা যখন চরমে, তখন সময়ের প্রয়োজনেই একটি পরিবর্তন হয়ে পড়ে অবশ্যম্ভাবী। সিংহাসনে আসেন গোপাল নামীয় একজন। ইতিহাসে তার পিতার নাম বপ্যট আর পিতামহের নাম দয়িতবিঞ্চু। কিন্তু ঠিক কীভাবে গোপাল শাসকের মঞ্চে এলেন, তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে ভালোরকম মতপার্থক্য আছে। রয়েছে নানা কিংবদন্তি।
কেউ কেউ মনে করেন জনগণ কর্তৃক রাজা নির্বাচিত হয়েছিলেন গোপাল, আর কেউ কেউ মনে করেন তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে জনগণের পক্ষে কাউকে রাজা নির্বাচিত করা কোনোমতেই সম্ভব ছিল না। তবে পাল শাসনামলের খালিমপুর তাম্রশাসনের শ্লোক অনুযায়ী জানা যায় ‘প্রকৃতিপুঞ্জ’ কর্তৃক নির্বাচিত হয়েছিলেন গোপাল। অনেক ঐতিহাসিকই প্রকৃতিপুঞ্জ বলতে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি বা কিংবা গোপালের অনুগামীদের বিষয়ে ইঙ্গিত করা হয়েছে বলে মনে করে থাকেন। তৎকালীন অবস্থার প্রেক্ষিতে এই মতকেই অধিকতর যুক্তিসংগত হিসেবে ধরা যায়।
মাৎস্যন্যায়ের সমাপ্তি ও পাল বংশের প্রতিষ্ঠা
রাজা গোপালের হাত ধরে প্রতিষ্ঠা লাভ করে পাল বংশ। গোপাল একটি অনিশ্চিত রাজনৈতিক অবস্থায় তার দৃঢ় ভূমিকা রাখতে সমর্থ হয়েছিলেন। যার ফলে বাংলা অঞ্চল দীর্ঘ রাজনৈতিক অরাজকতা থেকে মুক্ত হয়। তিনি ঠিক কত বছর রাজত্ব করেছিলেন, তা নিয়ে মতপার্থক্য আছে। লামা তারানাথের মতে তিনি প্রায় ৪৫ বছর রাজ্য শাসন করেছিলেন এবং ৭৯৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তবে রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে তার রাজ্যশাসনের সময় ছিল ২০ থেকে ৩০ বছর এবং তিনি পরলোকগমন করে ৭৭০ খ্রিস্টাব্দে।
তবে যা-ই হোক, পাল বংশকে একটি শক্তিশালী ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়ে যেতে সমর্থ হয়েছিলেন গোপাল। তার মৃত্যুর পর তার পুত্র ধর্মপাল পাল বংশকে নিয়ে যান অনন্য উচ্চতায়। পাল বংশের ইতিহাসে গোপালের পুত্র ধর্মপালকেই বলা হয় সর্বশ্রেষ্ঠ নৃপতি। পাল শাসন প্রতিষ্ঠার পর এই অঞ্চলের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার অবসান হয় এবং শক্তিশালী ও স্থায়ী শাসন ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। ফলত, পাল বংশের শাসন টিকেছিল প্রায় চারশো বছর।