১৯৮১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর। পাঞ্জাবের পটিয়ালা থেকে জলন্ধরের দিকে যাচ্ছিল একটি গাড়ি। গাড়িতে ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিখ্যাত নেতা ও পাঞ্জাবী কেশরী পত্রিকার সম্পাদক লালা জগৎ নারায়ণ। সব কিছুই ঠিকঠাক এগোচ্ছিল।
কিন্তু হঠাৎ বাধলো বিপত্তি। চলন্ত গাড়ির দু’পাশে দুটো মোটরসাইকেল থেকে গাড়ির পেছনের নামানো কাচের ফাঁক দিয়ে গুলি চললো। লালা জগৎ নারায়ণ লুটিয়ে পড়লেন।
ইতোপূর্বে পাঞ্জাবের রাজনীতিতে শিখ বনাম হিন্দু এবং পাঞ্জাবি বনাম হিন্দি ভাষার মেরুকরণ ছিলই। সে জায়গা থেকে পত্রিকাটির অবস্থান ছিল হিন্দির পক্ষে। আর্য সমাজ আন্দোলনের সমর্থক হওয়ায় লালা জগৎ নারায়ণের সাথে আদর্শিক বৈরিতাও ছিল জাতীয়তাবাদী শিখদের। ফলে লালা জগৎ নারায়ণের হত্যাকাণ্ডে অভিযোগের আঙুল উঠলো শিখ রাজনীতির দিকেই। মোটাদাগে, জার্নেইল সিং ভিন্ড্রাওয়ালের দিকে।
১৯৮৩ সালের ২৩ এপ্রিল পাঞ্জাবের প্রাদেশিক পুলিশের ডিআইজি অবতার সিং আটওয়াল স্বর্ণমন্দিরে প্রার্থনা করতে এসেছিলেন। গুরুদুয়ারার দরবার সাহিব থেকে ফেরার সময় সিঁড়িতে নামতেই পেছন থেকে গুলি চললো। অবতার সিং নিহত ও অন্য দুজন আহত হলেন। শুধু পাঞ্জাব নয়, কেঁপে উঠলো পুরো ভারত। আবারও অভিযোগের তীর জার্নেইল সিং ভিন্ড্রাওয়ালের দিকে।
অনেকের কাছে তিনি দেশদ্রোহী ও ধর্মান্ধ সন্ত্রাসী। কিন্তু অনেকের কাছেই তার মর্যাদা একজন সাধুপুরুষ এবং আধ্যাত্মিক গুরু হিসেবে। কিন্তু কে এই জার্নেইল সিং ভিন্ড্রাওয়ালে?
সরদার যোগিন্দর সিং ব্রার ও নিহাল কৌর-এর সন্তান জার্নেইল সিং ১৯৪৭ সালে পাঞ্জাবের মালোয়া এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। সরদার যোগিন্দর সিং এলাকায় প্রভাবশালী শিখ নেতা ছিলেন। রাজনৈতিক পরিস্থিতি তার ছেলের ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের পথ উন্মুক্ত করে দিচ্ছিল। ১৯৬৫ সালে পিতার সহায়তায় জার্নেইল সিং ধর্মীয় শিক্ষালয় দমদমি টাকশাল-এ ভর্তি হন। গুরুবচন সিং ছিলেন তার প্রধান।
এক বছরের কোর্স সমাপ্ত করে কৃষিকাজের জন্য গ্রামে ফিরে আসেন জার্নেইল। দমদমি টাকশালের পরবর্তী প্রধান করতার সিং শিক্ষার ভার নিয়েছিলেন। সেই করতার সিংই জার্নেইলকে তার স্থলাভিষিক্ত করে যান। ১৯৭৭ সালে ৩১ বছর বয়সে আনুষ্ঠানিকভাবে দমদম টাকশালের প্রধান হবার পর তার পরিচয় হয়ে দাঁড়ায় ‘জার্নেইল সিং ভিন্ড্রাওয়ালে’।
এরপর থেকে ভিন্ড্রাওয়ালে পুরোপুরি ধর্মীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হলেন। এই পরিচিতিই অল্প অল্প করে তার রাজনৈতিক ভবিষ্যতের খুঁটি মজবুত করছিল। সেই সাথে এগিয়ে দিচ্ছিল রক্তাক্ত সংঘর্ষ ও বিভেদের রাজনীতির দিকে।
মূলত ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৪ সাল তার প্রচার-প্রসারের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সময় ছিল। পাঞ্জাবে হিন্দু সংস্কৃতির আভিজাত্যের বিরোধিতা করে আলোচিত হয়েছিলেন তিনি।
শিখ তরুণদের একটি অংশের কাছে তিনি হয়েছিলেন দারুণ জনপ্রিয়। শিখ জাতির সশস্ত্র ঐতিহ্যের কথা বলে তাদের উদ্বুদ্ধ করতেন ভিন্ড্রাওয়ালে। তিনি ও তার অনুসারীরা কৃপাণ বহনের শিখ-ঐতিহ্যের দোহাই দিয়ে আগ্নেয়াস্ত্র বহন করতে লাগলেন। দশম গুরু গোবিন্দ সিংয়ের ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবে ভিন্ড্রাওয়ালে নিজে সূঁচালো তীর সাথে রাখতেন। এই আক্রমণাত্মক মানসিকতা সৃষ্টি করছিল ভয়ের পরিবেশ।
ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যে ‘আকালি দল’ নামে শিখদের একটি রাজনৈতিক দল তখন অত্যন্ত প্রভাবশালী। এই আকালি দলের বিরুদ্ধে ভিন্ড্রাওয়ালের জনপ্রিয়তাকেই কাজে লাগাতে চাইলো কংগ্রেস।
১৯৭৭ সালে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ভারতের সাধারণ নির্বাচনে পরাজিত হন। মোরারজী দেশাইয়ের নেতৃত্বে বিজয়ী হয় ‘জনতা এলায়েন্স’। ইন্দিরার পুত্র সঞ্জয় গান্ধী পাঞ্জাবে কংগ্রেসের রাজনৈতিক প্রভাবের ক্ষেত্র প্রসারিত করতে ভিন্ড্রাওয়ালের ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে অনুকূল মনে করলেন। এক্ষেত্রে মধ্যস্থতা করেছিলেন এককালের মুখ্যমন্ত্রী ও পরে রাষ্ট্রপতি- জ্ঞানী জৈল সিং।
১৯৭৪ সালের ১৩ এপ্রিল। পাঞ্জাবের অমৃতসরে ফৌজা সিং-এর নেতৃত্বে অখণ্ড কীর্তনী জাঠ ও দমদমি টাকশাল-এর শিখরা ‘সন্ত নিরঙ্কারী মিশন’ এর প্রভাব কমাতে সংঘর্ষে লিপ্ত হলো। ১৬ জন মানুষ রক্তাক্ত অবস্থায় ধুলোয় লুটিয়ে পড়লো।
এসব ঘটনার ফলে উগ্র শিখদের আশ্রয় হিসেবে দমদমি টাকশাল এবং জার্নেইল সিং ভিন্ড্রাওয়ালের প্রভাবও ক্রমশ বেড়েই চলছিল। তবে ১৯৭৯ সালে সমগ্র ভারতে গুরুদুয়ারা কমিটিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তার সমর্থিত প্রার্থীদের বেশিরভাগই পরাজিত হয়।
১৯৮১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর লালা জগৎ নারায়ণের হত্যাকাণ্ড জনমনে আতঙ্ক তৈরি করেছিল। নিজের পত্রিকার সম্পাদকীয়তে নিরঙ্কারী শিখদের পক্ষ নেওয়া ও উগ্রবাদের বিরুদ্ধে লেখার কারণে দমদমি টাকশালের রাগ তার ওপর আগে থেকেই ছিল। অখণ্ড কির্তনী জাঠ ও নিরঙ্কারী শিখ গোষ্ঠীর পরস্পরবিরোধী ঘাত-প্রতিঘাত তিনি খুব কাছে থেকে দেখেছিলেন।
তার হত্যাকাণ্ডে পাঞ্জাব পুলিশ সক্রিয় হলো। জার্নেইল সিং ভিন্ড্রাওয়ালের নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হলো। তিনি তখন হরিয়ানার কোনো এক গ্রামে অবস্থান করছিলেন। তৎকালীন কংগ্রেস কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জ্ঞানী জৈল সিংয়ের হস্তক্ষেপে হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী ভজনলাল বিষ্ণয় তাকে সাবধান করে দেন। পাঞ্জাব পুলিশ পৌঁছানোর আগেই হরিয়ানা পুলিশ জার্নেইলকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল।
সেসময় শিখবিরোধী কিছু লোক ভিন্ড্রাওয়ালের রেখে যাওয়া গাড়ি ও ধর্মীয় উপদেশ-লেখা কাগজ পুড়িয়ে ফেলে। এই ঘটনার ফলে বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির উপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন ভিন্ড্রাওয়ালে। পাঞ্জাবের মেহতা চকের গুরুদুয়ারায় তিনি স্থিত হলেন।
মেহতা চক গুরুদুয়ারায় গ্রেফতারি পরোয়ানা নিয়ে এলো পাঞ্জাব পুলিশ। ভিন্ড্রাওয়ালেকে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানানো হলো। অনুসারীদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবার শর্তে রাজিও হলেন তিনি। গ্রেফতারের পূর্বে সমবেত শিখদের উদ্দেশ্যে সরকার ও রাজনীতি বিষয়ে করণীয়ের কথা বলেন ভিন্ড্রাওয়ালে। তারপর শান্তভাবে পুলিশের সাথে এগিয়ে চললেন। তার গ্রেফতারের দৃশ্য দেখে উত্তেজিত শিখরা পুলিশের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হলো। নিহত হলো ১১ জন।
এই গ্রেফতারের পর যেন আরো উন্মত্ত হয়ে উঠলো ভিন্ড্রাওয়ালের অনুসারীরা। ১৯৮১ সালের ২০ সেপ্টেম্বর তাদের সশস্ত্র হামলায় ৪ জন নিরীহ হিন্দু নিহত হয়, আহত হয় ১২ জন। ২৫ সেপ্টেম্বর একটি মালবাহী রেলগাড়ি গন্তব্যে পৌঁছুতে বাধা দেওয়া হয়। এমনকি ২৯ সেপ্টেম্বর ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের একটি বিমানও হাইজ্যাক করা হয়! হাইজ্যাকের পর বিমানটিকে লাহোরে জরুরি অবতরণে বাধ্য করা হয়েছিল। সেই সাথে বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হলো অমৃতসর, ফরিদকোট ও গুরদাসপুরে।
রাজনীতির মোড় ঘুরিয়ে দিচ্ছিল এসব সহিংসতা। যে কংগ্রেস পাঞ্জাবে আকালি দলের সমর্থন কমানোর জন্য ভিন্ড্রাওয়ালেকে ব্যবহার করেছিল, সেই ভিন্ড্রাওয়ালেই কংগ্রেসের কাছে রীতিমতো ভারী ঠেকছিলেন। আকালি দল আগের বিরোধিতা ভুলে তাকে সমর্থন দেবার নীতি গ্রহণ করলো। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জ্ঞানী জৈল সিং লোকসভায় দাঁড়িয়ে জানালেন, ভিন্ড্রাওয়ালের বিরুদ্ধে লালা জগৎ নারায়ণের হত্যাকাণ্ডের কোনো অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
তখন পাঞ্জাবের আকালি দলের প্রধান ছিলেন হরচাঁদ সিং লোঙ্গোয়াল। পাঞ্জাব প্রদেশে আরো বেশি স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে তিনি ‘ধর্মযুদ্ধ মোর্চা’ গঠন করলেন। ভিন্ড্রাওয়ালে তাতে সমর্থন দিলেন। কেন্দ্রীয় সরকার শিখ সংগঠনগুলোর এ পদক্ষেপে বিচ্ছিন্নতাবাদের ছায়া দেখতে পেলো।
ধর্মযুদ্ধ মোর্চা গঠনের পর রাজনৈতিক সংঘর্ষ এক নতুন মাত্রা পেলো। পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী দরবারা সিংকে হত্যা করার চেষ্টা হয়। বিপরীতে, অক্টোবরের মধ্যে আকালি দলের প্রায় ২৫ হাজার কর্মীকে গ্রেফতার করলো পুলিশ। ১৯৮২ সালে ভারতে অনুষ্ঠিত এশিয়ান গেমস পণ্ড করার ঘোষণা দেওয়া হলে উত্তেজনা আরো বেড়ে যায়।
ক্রমান্বয়ে পাঞ্জাবের রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ ভিন্ড্রাওয়ালের হাতে চলে যাচ্ছিল। এমনকি স্বর্ণমন্দিরের নিয়ন্ত্রণও আকালি দলের হাত থেকে চলে গিয়েছিলো। আকালি দল সশস্ত্র হলেও শেষ অবধি ভিন্ড্রাওয়ালের সাথে পেরে ওঠেনি। ১৯৮২ সালে তার দল স্বর্ণমন্দিরের ভেতরে কার্যত নানক নিবাসের দখল নিয়ে নেয়। স্বর্ণমন্দির একরকম দুর্গ হয়ে উঠলো তাদের জন্য।
১৯৮৩ সালের ২৩ এপ্রিল ডিআইজি এ এস আটওয়াল খুন হন। হরচাঁদ সিং সরাসরি ভিন্ড্রাওয়ালেকে দায়ী করলেন। লোকসভায় তার গ্রেফতারের দাবি জোরালো হয়ে উঠলো।
অমৃতসর স্থান হিসেবে বেশ স্পর্শকাতর, অনেক নিরীহ মানুষের আবেগ এর সাথে জড়িত। তাই ইন্দিরা গান্ধীর সরকার সমঝোতাই করতে চাইলো। প্রভাবশালী নেতা নরসিংহ রাওকে এই উদ্দেশ্যে সেখানে প্রেরণ করে কংগ্রেস সরকার। কিন্তু ভিন্ড্রাওয়ালে ও তার অনুসারীদের আগ্রাসী ভূমিকার কারণে পরিস্থিতিও সমঝোতার অনুকূলে ছিল না, চলে গিয়েছিল নিয়ন্ত্রণের বাইরে। নিরীহ শিখরাও অস্ত্র ও ধর্মের যৌথ শক্তির মুখে অসহায় ছিল।
ফলে শক্তিপ্রয়োগ ছাড়া আপাতত সরকারের হাতে আর কোনো পথ ছিল না। সরকার সে পথেই গেলো।
১৯৮৪ সালের ১ জুন থেকে ৮ জুন ভারতীয় সেনাবাহিনী ‘অপারেশন ব্লু স্টার’ পরিচালনা করে। এর কমান্ডার ছিলেন লে. জেনারেল কুলদীপ সিং। প্রচুর রক্তপাত ও প্রাণক্ষয় হলো। পুরো পৃথিবীর নজর ছিল ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের দিকে। স্বর্ণমন্দিরকে রীতিমতো দুর্গ বানিয়ে রেখেও শেষ রক্ষা হলো না জার্নেইল সিং ভিন্ড্রাওয়ালের। তিনি তার দেহরক্ষীদের সাথেই নিহত হলেন।
স্বাধীনতার পর থেকেই ভারতে জাতিগত আত্মপরিচয়ের রাজনীতি শুরু হলেও ১৯৭০ এর দশকের শেষ দিকে এর তীব্রতা বেড়ে গিয়েছিল। এর থেকেই জন্ম নিয়েছিল কিছু সশস্ত্র আন্দোলন। শিখ নেতা জার্নেইল সিং ভিন্ড্রাওয়ালে তারই এক চরম উদাহরণ। উগ্র রাজনীতির প্রচারে তিনি যেমন অস্ত্রের ব্যবহার শুরু করেছিলেন, তেমনি অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমেই তার রাজনৈতিক অধ্যায়ের রক্তাক্ত পরিসমাপ্তি ঘটে।