২০১৮ সালের ইউএস ওপেন টেনিসের নারী এককের ফাইনালে সবাইকে অবাক করে মার্কিন তারকা সেরেনা উইলিয়ামসকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো শিরোপা জয় করেন জাপানের নাওমি ওসাকা। কিন্তু ফাইনালের এই অঘটনকে ছাপিয়ে আমেরিকাসহ সারা বিশ্বব্যাপী সমালোচনার ঝড় তোলে সেরেনা এবং ম্যাচ রেফারি কার্লোসের ম্যাচ চলাকালীন সময়ের বাদানুবাদ। ম্যাচ রেফারি সেরেনার বিরুদ্ধে আচরণবিধি ভঙ্গের অভিযোগ আনেন। অপরদিকে সেরেনা রেফারি কার্লোসের বিরুদ্ধে লিঙ্গবৈষম্য অভিযোগের তীর ছুঁড়ে দেন।
টেনিসের দুনিয়াকে দ্বিধাবিভক্ত করা এই ঘটনা প্রকৃতপক্ষে মার্কিন সমাজের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ঐতিহাসিক সত্যকে তুলে ধরেছে। বিংশ শতাব্দী কিংবা চলমান একবিংশ শতাব্দীতে সামরিক কিংবা অর্থনৈতিক দিক থেকে পৃথিবীতে শীর্ষস্থানীয় এই দেশটি “হিউম্যান রাইটস” সূচকে উপরের দিকে থাকলেও, প্রায়শই বহুজাতিক এই দেশে ঘটে যাচ্ছে বৈষম্যমূলক নানা ঘটনা। এক্ষেত্রে লিঙ্গ বা ধর্মীয় বিভাজনের চেয়ে বেশি ঘটছে বর্ণবৈষম্যের ঘটনা।
১৭৮৩ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পরবর্তী সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবথেকে বড় সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয় সাদা এবং কালো চামড়ার দ্বন্দ্ব। যদিও যুক্তরাষ্ট্রে সাংবিধানিকভাবে আফ্রিকান-আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গদের সমঅধিকারের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু সর্বক্ষেত্রে তারা ছিলেন সাদাদের চেয়ে পিছিয়ে। আমেরিকার অঙ্গরাজ্যগুলোতে, বিশেষ করে দক্ষিণে, দিনে দিনে প্রকট হয়ে উঠেছিল এই দ্বন্দ্ব। ফলে ধীরে ধীরে সুবিধাবঞ্চিত এই কালো মানুষেরাই সংঘবদ্ধ আন্দোলন শুরু করে, যা সমগ্র পৃথিবীজুড়ে পরিচিতি লাভ করে আমেরিকান সিভিল রাইট মুভমেন্ট হিসেবে।
১৯৫০ সালের পর তীব্রতর হতে থাকে এই আন্দোলন। কিন্তু শ্বেতাঙ্গদের বিরোধিতার কারণে প্রত্যাশিত সফলতার মুখ দেখতে পারছিল না এই আন্দোলন। অপ্রত্যাশিতভাবে, সেসময় আলাবামা অঙ্গরাজ্যের মন্টোগোমারি শহরে রোজা পার্কস নামের একজন কৃষ্ণাঙ্গ তরুণীর অসম সাহসিকতা ও দৃঢ়চেতা মনোভাব তৎকালীন আমেরিকান সমাজের বৈষম্যমূলক মানসিকতাকে প্রচণ্ড ধাক্কা দিয়েছিল। ইতিহাস বিখ্যাত এই ঘটনা ‘মন্টোগোমারি বাস বয়কট’ নামে পরিচিত।
ঘটনার প্রেক্ষাপট বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে আমেরিকাতে পাশ হওয়া জিম ক্রো আইনের দ্বারা। এই আইনানুসারে, নাগরিক সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে গায়ের রং একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে, যাতায়াতের ক্ষেত্রে বাসের মধ্যে সাদা এবং কালো চামড়ার মানুষদের জন্য আলাদা আসন বিন্যাস করা হয় এবং যথারীতি কালো চামড়ার মানুষদের জায়গা হয় পেছনের সারিতে।
বাসে যাতায়াতের ক্ষেত্রে একইরকম আরেকটি আইন পাশ করা হয় আলাবামা অঙ্গরাজ্যের মন্টোগোমারি শহরে, ১৯০০ সালে। প্রত্যক্ষভাবে বর্ণবৈষম্যকে প্ররোচিত না করলেও এর সবচেয়ে দুর্বল দিক ছিল বাসের চালকদের মাত্রাতিরিক্ত ক্ষমতা প্রদান। বাসের চালকরা ঠিক করে দিতো সংশ্লিষ্ট বাসের আসনবিন্যাস। যদিও মন্টগোমারি শহরের ৭৫% নিয়মিত বাসযাত্রী ছিল কৃষ্ণাঙ্গ, তথাপি বাসের সামনের আসনসমূহ বরাদ্দ ছিল সাদা চামড়ার মানুষদের জন্য। মুষ্টিমেয় পশ্চাৎসারির কিছু আসন রাখা হতো কালোদের জন্য। এমনকি, বাসে সাদাদের সংখ্যা বেশি হলে কালোদের জন্য বরাদ্দকৃত আসনের পরিমাণ আরো কমে যেত। এছাড়াও, ভাড়া প্রদানের ক্ষেত্রে কালো চামড়ার মানুষদের বাসের সামনের দরজা দিয়ে উঠে চালককে ভাড়া প্রদান করতে হতো এবং তারপর বাস থেকে নেমে পিছনের দরজা দিয়ে পুনরায় বাসে উঠতে হতো।
মন্টোগোমারির এমন প্রতিকূল পরিবেশে রোজা পার্কস তার শৈশবকাল অতিক্রম করেছিলেন। শৈশবের স্কুলবাসের এই দুর্বিসহ স্মৃতি স্মরণ করেই তিনি বলেছিলেন,
“সর্বপ্রথম বাসে যাতায়াতের মাধ্যমেই আমি বুঝতে পারি, পৃথিবী দু’ভাগে বিভক্ত: সাদাদের পৃথিবী আর কালোদের পৃথিবী। ”
ক্রমান্বয়ে, তরুণী রোজা পার্কস আমেরিকান সিভিল রাইট মুভমেন্টের সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন। তিনি ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য অ্যাডভান্সমেন্ট অফ কালার্ড পিপল (National Association for the Advancement of Colored People – NAACP) সংগঠনের সদস্য হিসেবে যোগদান করেন।
১৯৪৩ সাল। প্রহসনমূলক প্রচলিত বাস আইনের অপ্রত্যাশিত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন পার্কস। ঘটনার দিন যথারীতি বাসের ভাড়া প্রদান করা পার্কস পেছনের দিকের সিটে বসতে গেলে বাসের চালক তাকে বাঁধা প্রদান করেন। নিয়মানুসারে তাকে বাসের পেছনের দরজা দিয়ে উঠতে বলা হয়। তিনি চালকের কথামতো সামনের দরজা দিয়ে নেমে যান এবং পেছনের দরজার দিকে অগ্রসর হন। কিন্তু তাকে অবাক করে বাসের চালক তাকে ছাড়াই বাস নিয়ে চলে যান। ঘটনার আকস্মিকতায় স্তম্ভিত এবং বিব্রত হয়ে যান তিনি।
ঠিক বারো বছর পর, ১৯৫৫ সাল, ডিসেম্বর মাস। বাসায় ফেরার উদ্দেশ্যে কাজ শেষে সন্ধ্যায় যথারীতি টিকেট কেটে বাসে ওঠেন রোজা পার্কস। বসেন কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য নির্ধারিত আসনসমূহের সামনের সারিতে। কয়েক স্টপেজ পরেই শ্বেতাঙ্গদের জন্য সামনের সারির বরাদ্দকৃত আসন পরিপূর্ণ হয়ে যায় এবং কয়েকজন শ্বেতাঙ্গ যাত্রী দাঁড়িয়ে থাকেন। সেই মুহূর্তে বাসের চালক এগিয়ে এসে পার্কসসহ কয়েকজন কৃষ্ণাঙ্গকে তাদের আসন ছেড়ে দিতে বলেন দাঁড়িয়ে থাকা শ্বেতাঙ্গদের জন্য। ক্লান্ত রোজা বিস্ময়ের সাথে খেয়াল করলেন, কাকতলীয়ভাবে বাসের চালক সেই একই ব্যক্তি, যিনি বারো বছর আগে তাকে ছাড়াই বাস ছেড়ে দিয়েছিলেন। বাকি কৃষ্ণাঙ্গরা তৎক্ষণাৎ আসন ছেড়ে দিলেও তিনি এতে অস্বীকৃতি জানান। বাসের চালক, জেমস ব্লেক, রোসার বিরুদ্ধে আইনী পদক্ষেপ নেওয়ার হুমকি দেন। কিন্তু রোজা স্থিরচিত্তে সবকিছু উপেক্ষা করে যান। ফলশ্রুতিতে তৎক্ষণাৎ গ্রেফতার হন রোজা। তার বিরুদ্ধে আনা হয় মন্টোগোমারির নাগরিক আইন ভঙ্গের অভিযোগ।
NAACP’র শীর্ষস্থানীয় নেতৃত্বের প্রচেষ্টায় অতি দ্রুত জামিন পেলেও তাকে ১৪ ডলার জরিমানা করা হয়। NAACP’র সদস্যরা বুঝতে পারলেন, তাদের ঝিমিয়ে যাওয়া আন্দোলন নতুনভাবে জাগিয়ে তুলতে এটি উপযুক্ত সময়। ৪ ডিসেম্বর, সংগঠনের পক্ষ থেকে সম্মিলিতভাবে মন্টোগোমারি শহরের সকল কৃষ্ণাঙ্গদের পরেরদিন বাস বয়কটের আহ্বান জানানো হলো। অভূতপূর্ব সাড়া পাওয়া গেলো সারা শহরজুড়ে। অধিকাংশ কৃষ্ণাঙ্গ বাসের বদলে ট্যাক্সিক্যাব, ভাড়া করা গাড়ি কিংবা পায়ে হেঁটে যান নিজ নিজ কর্মস্থলে।
প্রাথমিক সাফল্যের পর, NAACP’র নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ তাদের দাবি না আদায় হওয়া পর্যন্ত বাস বয়কট চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তাদের মুখ্য দাবি ছিল মন্টোগোমারির বৈষম্যমূলক বাস আইন প্রত্যাহার। মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র, তৎকালীন তরুণ এবং পরবর্তীতে কৃষ্ণাঙ্গ অধিকার আদায় আন্দোলনের অবিসংবাদী নেতা পরোক্ষভাবে এই আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন।
ফলশ্রুতিতে, মন্টোগোমারি শহরে ইতিহাসের অন্যতম দীর্ঘস্থায়ী বাস বয়কট চলতে থাকে। সংঘবদ্ধ কৃষ্ণাঙ্গ সমাজ টানা ৩৮১ দিন ধরে চালিয়ে যায় এই বাস বয়কট। যেহেতু শহরের অধিকাংশ বাসযাত্রী ছিল এই কালো চামড়ার মানুষরা, ফলে ব্যাপক লোকসানের সম্মুখীন হয় বাস মালিক পক্ষ।
কিছুদিনের মধ্যেই শহরের কালো অধিবাসীরা তাদের প্রত্যাশিত প্রথম সাফল্য পেয়ে যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্টের সুপ্রিম কোর্ট “ব্রাউডার বনাম গেইল” মামলায় বৈষম্যমূলক বাস আইনকে অবৈধ ঘোষণা করে ঐতিহাসিক রায় প্রদান করে। ফলশ্রুতিতে, মন্টোগোমারিসহ সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রে প্রচলিত বাস আইনটি বাতিল ঘোষণা হয়।
কিন্তু, আশ্চর্জনকভাবে মামলার রায়ে বিচারকরা যে চারজন কৃষ্ণাঙ্গ নারীর ভূমিকার কথা উল্লেখ করেছেন, তাদের মধ্যে রোজা ছিলেন না, যদিও এই সাফল্যের পেছনে রোজার অবদানকে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়। মামলার অ্যাটর্নি ফ্রেড গ্রের মতে,
রোজার বিরুদ্ধে আলাবামা স্টেট কোর্টে চলমান মামলা প্রভাবিত হওয়ার আশংকায় সুপ্রিম কোর্ট তাদের রায়ে রোজার নাম উল্লেখ থেকে বিরত থাকে।
সাময়িক এই সাফল্যের পর রোজা পার্কস আন্দোলন থামিয়ে দেননি। বরং শহর পরিবর্তন করলেও নিজেকে যুক্ত রেখেছিলেন কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে। অনেক অসঙ্গতির বিরুদ্ধে লড়াই করে মৃত্যুর আগপর্যন্ত শারীরিক, মানসিক কিংবা আর্থিকভাবে সমর্থন দিয়ে গেছেন নতুন আমেরিকা গড়ে তোলার এই লড়াইয়ে। সমগ্র আমেরিকাজুড়ে তিনি একজন প্রতিবাদী, অদম্য নারীর প্রতীক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।
মহিয়সী এই নারী ২০০৫ সালের ২৪ অক্টোবর মৃত্যুবরণ করেন। তার শেষকৃত্যানুষ্ঠানে সমগ্র আমেরিকাজুড়ে অভূতপূর্ব শ্রদ্ধা জানানো হয়। একজন বেসামরিক ব্যক্তির প্রতি এই সম্মান মার্কিন ইতিহাসে বিরল। মন্টোগোমারির বাসসমূহের সামনের আসনগুলোতে কালো ফিতে পরানো হয় তার শেষকৃত্য শেষ না হওয়া পর্যন্ত। তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কন্ডোলিৎসা রাইস (যিনি একইসাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী) তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন,
রোজা পার্কসের আত্মত্যাগ ব্যতীত কোনোভাবেই আমি আজকের অবস্থানে আসতে পারতাম না।
মন্টোগোমারির বাস বয়কট আন্দোলনের পর ইতিমধ্যে ছ’দশক পার হয়ে গেছে। মন্থর গতিতে হলেও মার্কিন সমাজ ব্যবস্থায় এসেছে বিস্তর পরিবর্তন। অহংকারী, উদ্ধত বর্ণবৈষম্যে জর্জরিত মার্কিনীরা পরিণত হয়েছে সহিষ্ণু এক জাতিতে। কৃষ্ণাঙ্গরা লাভ করেছে তাদের ন্যায্য অধিকার। ইতিমধ্যে দশ বছর সার্থকভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের প্রথম আফ্রিকান-আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গ রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা।
মাঝে মাঝে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে মার্কিন সমাজে বিভিন্ন বর্ণের মানুষের এই সহাবস্থান। হোয়াইট সুপ্রিমেসি আন্দোলনকারীদের নেতিবাচক প্রচারণা, পুলিশ কর্তৃক কৃষ্ণাঙ্গ হত্যা কিংবা ইউএস টেনিস ফাইনালে সেরেনা উইলিয়ামসের বৈষম্যমূলক আচরণের সম্মুখীন হওয়া ইঙ্গিত করে সমাজের গভীরে লুকিয়ে থাকা এই সমস্যাকে। তথাপি, অধিকাংশ আমেরিকান জনগণ জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে একসাথে পথচলায় বিশ্বাসী। সাদা, কালো কিংবা বাদামি- গায়ের বর্ণের উপর ভিত্তি করে মানুষের মাঝে বিভাজনের ধারণাকে তারা মধ্যযুগীয় কুসংস্কার হিসেবে মনে করে। জাতি হিসেবে মার্কিনীদের এই উদারতা আর সহমর্মিতার পেছনে একজন রোজা পার্কসের অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।