২০১৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যখন লন্ডনের ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে যান, ব্রিটেনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন খুবই চাঞ্চল্যকর একটি কথা বলেন। তিনি বলেন, সেই দিন আর খুব বেশি দূরে নয়, যখন তাদের দেশ একজন ব্রিটিশ-ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী পাবে।
ক্যামেরনের এই বক্তব্যকে কিন্তু নিছকই পাগলের প্রলাপ হিসেবে উড়িয়ে দেওয়ার উপায় নেই। কেননা আজকের দিনে ব্রিটিশ সমাজব্যবস্থা থেকে শুরু করে রাজনীতিতে রয়েছে ভারতীয়দের তাৎপর্যবাহী উপস্থিতি। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, বর্তমানে ব্রিটেনের হাউজ অব কমনস এবং হাউজ অব লর্ডসের চল্লিশের অধিক সদস্য দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত।
তবে এরচেয়েও চোখ কপালে তোলার মতো একটি তথ্য হাজির করব এবার আপনাদের সামনে। আজ আমরা যে ঝাঁ চকচকে লন্ডন দেখতে পাই, যে শহর বিশ্বের বুকে সবচেয়ে অভিজাত শহরগুলোর একটি হিসেবে সর্বজনস্বীকৃত, সেটির উদ্ভব, বিকাশ ও উন্নয়নের পেছনেও কিন্তু রয়েছে ভারতীয়দেরই অপরিমেয় অবদান।
ব্রিটিশ ভারতীয় লেখক ড. অরূপ চ্যাটার্জি তার ‘ইন্ডিয়ানস ইন লন্ডন: ফ্রম দ্য বার্থ অব ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি টু ইন্ডিপেনডেন্ট ইন্ডিয়া’ বইয়ে উপস্থাপন করেছেন লন্ডন বিনির্মাণের নেপথ্যে ভারতীয়দের ভূমিকার চিত্র। পাঁচ শতক পিছিয়ে গিয়ে তিনি দেখিয়েছেন, কীভাবে লন্ডনের অধিকাংশ বাসভূমি, পরিবহন ব্যবস্থা, ডাক ব্যবস্থা, জাতীয় বীমাসহ আরও অনেক উন্নত পরিষেবা ও অবকাঠামো সৃষ্টি হয়েছে দক্ষিণ এশীয় ও ক্যারিবীয় অভিবাসীদের হাত ধরে।
চ্যাটার্জির বইয়ে চেষ্টা করা হয়েছে মধ্য-ষোড়শ শতকে লন্ডনে ভারতীয়দের উপস্থিতি শনাক্ত করার। সে সময়ে ব্রিটিশদের সমুদ্র অভিযানের অংশ হিসেবে দুর্ঘটনাক্রমে বেশ কয়েকজন ভারতীয় চলে আসে লন্ডনে। এর পরের কয়েক শতকে ভারতীয়রা শুধু লন্ডন শহরকে গড়ে তুলতেই কাজ করেনি, এমনকি ভারতে জাতীয়বাদী আন্দোলনকে কাঠামো প্রদানেও রেখেছে অসামান্য অবদান।
ষোড়শ থেকে উনবিংশ শতকের ভারতীয়
অষ্টাদশ শতকের লন্ডনে সিংহভাগ ভারতীয়ই ছিল লস্কর কিংবা সমুদ্র অভিযাত্রী। এদিকে ষোড়শ শতকের লন্ডনে ভারতীয়দের মধ্যে তিন-চতুর্থাংশ ছিল প্রাক-লস্কর বা দাসত্বের পর্যায়ে। তবে শেষোক্ত ব্যাপারটিকে অবশ্য সরাসরি দাসত্ব বলারও উপায় নেই। সেটি ছিল দাসত্ব ও পেশাদার শ্রমজীবীতার মাঝামাঝি কিছু। কারণ, ইংল্যান্ড কখনোই নিজেকে দাস-মালিকানার জাতি হিসেবে পরিচয় দিতে স্বস্তিবোধ করেনি। ফলে ইতিহাস ঘাঁটলে আমেরিকার চেয়ে ইংল্যান্ডে প্রাতিষ্ঠানিকৃত দাসত্বের চিত্র কমই দেখা যায়। তবে তারপরও, ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে লন্ডনে ভারতীয়দের যে অবস্থা ছিল, তাতে তাদেরকে আদতে দাস বলাই যায়।
আর ওই তিন-চতুর্থাংশের বাইরে অবশিষ্টরা ছিল অভিযাত্রী, কিংবা ইউরোপীয় অভিযাত্রীদের দাস। লন্ডনের ভারতীয়দের মধ্যে আবার অংশ ছিল ইংল্যান্ডের ধর্মপ্রচার মিশনেরও, যেটি সপ্তদশ শতকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিস্তারের প্রধান চাবিকাঠি হয়ে ওঠে। পঞ্চদশ শতকে কলম্বাস ও ভাস্কো দা গামার হাত ধরে যে সমুদ্রযাত্রার সূচনা ঘটে, সেটির সুবাদেই অনেক ভারতীয় প্রথম ব্রিটেনের মাটিতে পা রাখে।
এমন অনেক ভারতীয়ই এরপর আইরিশ নারী কিংবা ব্রিটেনের নিম্ন স্তরের নারীদের বিয়ে করে। যতদূর আন্দাজ করা যায়, সপ্তদশ শতকের ব্রিটেনে মোট ভারতীয়ের সংখ্যা ১,০০০-এর বেশি হবে না, কিন্তু উনবিংশ শতকের ব্রিটেনে সংখ্যা ১০,০০০ ছাড়িয়ে যায়। এর পেছনে একটি বড় কারণ হলো পলাশীর যুদ্ধ-পরবর্তী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণের পর দাসবৃত্তির জন্য ভারতীয়দের ব্রিটেনে যাওয়ার পরিমাণ হু হু করে বাড়তে থাকা।
সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকের লন্ডন এবং ভিক্টোরিয়ান লন্ডনে বসবাসরত ভারতীয়দের মধ্যে অনেকেই ছিল আয়া বা চাকর, যারা মূলত স্থানীয় ব্রিটিশদের ঘরের কাজ করত। উনবিংশ শতকে প্রতিষ্ঠিত আয়া’স হোম কিংবা লস্করদের কল্যাণার্থে আইন প্রণয়নের আগে লন্ডনের ভারতীয়দের ছিল একদমই নগণ্য পরিমাণ অধিকার। বাস্তবিকভাবে সকল ভারতীয় আয়া বা চাকরকেই নিজেদের সমগ্র জীবন সঁপে দিতে হতো তাদের মনিবদের হাতে। মনিবদের অনুমতি ছাড়া তারা ঘরের বাইরেও পা ফেলতে পারত না।
১৭২০-র দশকে জুলিয়ান নামের এক ভারতীয়কে টাইবার্নে ফাঁসিতে ঝোলা হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, সে তার মনিবের কাছ থেকে ৩০ গিনি চুরি করেছে। আসলে জুলিয়ান চেয়েছিল তার মনিবের কাছ থেকে পালিয়ে যেতে, যেমনটি অনেক ভারতীয় দাসই চেষ্টা করত। এই ভারতীয়রা সুন্দর ভবিষ্যতের প্রলোভনে কোম্পানির পাস নিয়ে লস্কর বা শর্তাধীন দাস হিসেবে লন্ডনে পাড়ি দিত। কিন্তু অচিরেই তাদের মোহভঙ্গ হতো। সাধারণত এমন দুর্ভাগ্যের শিকার ভারতীয়রা চেষ্টা করত তাদের লন্ডনের মনিবের বাড়ি থেকে পালিয়ে ভারতে ফিরে যেতে। কিন্তু যারা ধরা পড়ে যেত, তাদের জন্য অপেক্ষা করত কঠিন থেকে কঠিনতম শাস্তি। যেমন জুলিয়ানকে তার ভুলের দায় চোকাতে হয় নিজের জীবন দিয়ে।
এদিকে যারা জাহাজ বন্দর পর্যন্ত পৌঁছাতে পারত, ভারতে ফেরার টিকিট কাটতে তাদের প্রয়োজন পড়ত বিপুল অর্থ। এজন্য কেউ কেউ তাদের কাছে থেকে অতি মূল্যবান কোনো সম্পদ বিক্রি করে দিত। আর যাদের পক্ষে তা সম্ভব হতো না, তাদের অনেকে লন্ডনের রাস্তায় ধুঁকে ধুঁকে মরত। তবে অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে উনবিংশ শতকের শেষভাগে এসে। তখন অনেক লস্কর ও পালিয়ে আসা আয়া-চাকরই লন্ডনে ক্রমবিকাশমান ভারতীয় রন্ধনশিল্পে ভিড়ে যেতে থাকে।
ব্রিটিশরা ভারতীয়দের যে চোখে দেখত
১৫৫০ থেকে ১৭৫০-র দশক পর্যন্ত দুই শতকে ব্রিটিশরা ভারতীয়দেরকে রাস্তার কুকুর-বেড়ালের চেয়ে উন্নত কোনো প্রাণী হিসেবে গণ্য করেনি। অতি সামান্য অপরাধ কিংবা নিছক ভুলের দায়েও টাইবার্নে প্রায়ই ভারতীয়দের ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে দেওয়া হতো।
উনবিংশ শতকে উন্মোচিত হয় পিটার পোপের ব্যাপটিজমের (খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষাদানের উৎসব) কাহিনি, যা থেকে তৎকালে ভারতীয়দের অবস্থা আরো পরিষ্কার হয়। পিটার পোপ ছিলেন মূলত বাংলা থেকে লন্ডনে পাড়ি জমানো এক তরুণ। ১৬১৪ সালে তাকে ক্যাপটেন বেস্ট লন্ডনে নিয়ে যান, এবং তাকে তুলে দেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মাসুলিপত্নমের (বর্তমানে অন্ধ্র প্রদেশের মাছিলিপাত্নাম) ধর্মগুরু রেভারেন্ড প্যাট্রিক কোপল্যান্ডের হাতে। কোপল্যান্ড নির্দেশ দেন তাকে ধর্মান্তরের, যেন ভারতে ফিরে গিয়ে তিনিও অন্যান্য ভারতীয়দের ধর্ম পরিবর্তন করতে পারেন। সেই অনুযায়ী ১৬১৬ সালের ২২ ডিসেম্বর লন্ডনে ‘পিটার পোপ’ হিসেবে ওই বাঙালি তরুণকে জোরপূর্বক খ্রিস্টান বানিয়ে দেওয়া হয়।
বস্তুতঃ ষোড়শ শতকের গোড়া থেকেই লন্ডন একধরনের জনতাত্ত্বিক পটপরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যেতে শুরু করে। তখন শহরটির মোট জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ ছিল পূর্ব ইউরোপীয়, ডাচ, ফরাসি, জার্মান, লাতিন আমেরিকান, আফ্রিকান ও ভারতীয়। এই জনগোষ্ঠীরা মিলেই গড়ে তোলে শহরটির বণিক, ভবঘুরে, রুটিওয়ালা, কামার, বন্দুক-নির্মাতা, দর্জিসহ বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশাভিত্তিক সম্প্রদায়।
অষ্টাদশ শতকের শুরুর দিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আগ্রাসিভাবে লন্ডনের বাজারে ভারতীয় পণ্যের বিপণন শুরু করে। তারা হুক্কা থেকে শুরু করে পোর্সেলিনের বাসন, চীনামাটির বাসন প্রভৃতি বাজারজাত করতে থাকে। মুঘল ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কলকাতা হয়ে উঠে কোম্পানির হেডকোয়ার্টার, যার ফলে ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে লন্ডনবাসীর মিথস্ক্রিয়া ক্রমশ স্বাভাবিক পর্যায়ে চলে আসতে শুরু করে।
১৭৫০-এর দশক নাগাদ লন্ডনবাসী কর্তৃক ভারতীয়দের ‘দূর ছাই’ করার প্রবণতা কমতে থাকে। ওই সময়ই কর্ণাটকের যুদ্ধ, পলাশীর যুদ্ধ ও বক্সারের যুদ্ধের মাধ্যমে ব্রিটিশরা ভারতীয়দের উপর নিজেদের সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদ শুরু করে।
প্রথমদিকে তারা ছিল ব্যবসায়ী, এবং মুঘল ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্কে স্থাপন করতে পেরে তারা খুবই খুশি ছিল। কলকাতাকে তারা ‘ব্রিটিশ আবিষ্কার’ হিসেবেই দেখত। সেই ১৬৪০-এর দশক থেকেই যে পর্তুগিজ ও আর্মেনীয়দের হাত ধরে কলকাতার গোড়াপত্তন হয়, সে ইতিহাস অনেকটাই ধামাচাপা পড়ে যায় ব্রিটিশ ঐতিহাসিক আধিপত্যে।
১৭৬৪ সালের পর যখন বাংলার দিওয়ানি চলে আসে ব্রিটিশদের হাতে, কোম্পানির নবাবরা নিজেদেরকে ‘মুঘলদের চেয়েও বেশি মুঘল’ ভাবতে শুরু করে। যেহেতু তারা ভেবেছিল মুঘল সংস্কৃতিতে তারা ভারতীয়দের চেয়েও ভালোভাবে ধারণ করতে পারবে, তাই তারা নিজেদেরকে ভারতীয়দের চেয়ে জাতিগতভাবে শ্রেয়তরও ভাবতে থাকে।
ভারতবর্ষে ব্রিটিশদের যে মনোভাব ছিল ভারতীয়দের প্রতি, তা আছড়ে পড়তে থাকে লন্ডনেও। ফলে এবার আর ভারতীয়দের বেড়াল-কুকুর প্রতিপন্ন না করলেও, ভারতীয়দের উপর তাদের একপ্রকার ‘ঔপনিবেশিক শ্রেষ্ঠত্ব’-এর মনোভাব পরিলক্ষিত হতে থাকে।
এশিয়া মাইনর ও লিটল বেঙ্গল
১৭৮০-র দশক থেকেই লন্ডনের বেজওয়াটার, বেকার স্ট্রিট, সাউথ কেনসিংটন এবং হলবর্ন ভরে যেতে থাকে ভারতীয় অভিবাসীতে। লন্ডনের অন্যান্য অঞ্চলের অধিবাসীরা তাচ্ছিল্য করে এসব এলাকাকে ডাকতে শুরু করে ‘এশিয়া মাইনর’ ও ‘লিটল বেঙ্গল’ নামে। ১৭৯৯ সালে শ্রীরঙ্গপত্তমের যুদ্ধের পর অনেক ব্রিটনই ফিরে আসে লন্ডনে। হুক্কা টানা ও শব্দ করে খাবার খাওয়ার স্বভাবের কারণে লন্ডনিরা তাদের ডাকতে শুরু করে ‘নবাব’ বলে। এই ব্রিটিশ নবাবরা লন্ডনে এক নতুন বাংলা সৃষ্টির চেষ্টা শুরু করে।
এদিকে ভিক্টোরিয়ান যুগটা ব্রিটেন শুরুই করে ১৮৩৮ সালে আফগানিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ানোর ভুল সিদ্ধান্তের মাধ্যমে। আফিমকে কেন্দ্র করে ১৮৩৯ সালে তারা চীনের সঙ্গে যুদ্ধ বাঁধায়। এছাড়া ১৮৫৭ সালে ভারতবর্ষে সংঘটিত হয় সিপাহী বিদ্রোহ। সব মিলিয়ে পূর্বাঞ্চলে ব্রিটিশরা ব্যাপক সহিংসতা ও রক্তক্ষয়ের অভিজ্ঞতা লাভ করে। সেই অসহনীয় অভিজ্ঞতার ফলে পৃথিবীর পূর্বাঞ্চলের মানুষের প্রতি তাদের ঘৃণা-বিদ্বেষের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়, এবং ‘এশিয়া মাইনর’ বা ‘লিটন বেঙ্গল’ বলে উপহাস করা অঞ্চলগুলোর অভিবাসীদের প্রতি হিংসা ও অবজ্ঞাও বাড়তে থাকে।
এদিকে তথাকথিত ‘এশিয়া মাইনর’ থেকেই লন্ডনে প্রবেশ করতে থাকে আধুনিক ভারতীয়রা। রাজা রামমোহন রায়, দ্বারকানাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে বিভিন্ন ভারতীয় ব্যারিস্টার, সরকারি আমলা, কূটনীতিবিদ, শিক্ষার্থীসহ অনেকেই ভিড় জমাতে থাকে ভিক্টোরিয়ান লন্ডনে। এ শহরে তাদের উপস্থিতিই পক্ষান্তরে নির্ধারণ করে দেয়, ভারতে ব্রিটিশ শাসকদের নীতি কেমন হবে। তাই বলাই বাহুল্য, ১৮৪০ থেকে ১৯০০ সালের মধ্যে লন্ডনে আসা ভারতীয়দের অভিজ্ঞতাই ভারতের ব্রিটিশদের ভবিষ্যৎ তৈরি করে দেয়। এছাড়া স্বাধীন ভারতেও পড়ে সেটির প্রভাব।
লন্ডনে ভারতের জাতীয়তাবাদী নেতারা
১৮৮০ ও ১৮৯০-এর দশকে যখন গান্ধী ও জিন্নাহরা লন্ডনে পা রাখেন, ততদিনে ইতোমধ্যেই শহরটি পেয়ে গেছে রায়, ওয়াদিয়া ভ্রাতৃদ্বয়, ঠাকুর (সিনিয়র), কেশবচন্দ্র সেনসহ বিপুল সংখ্যক ভারতীয় ব্যারিস্টারম আমলাসহ অন্যান্য শ্রেণী-পেশার কৃতি মানুষদের সাহচর্য। যেমন ছিলেন দাদাভাই নওরোজি, মানচার্জি ভবনগরী, উমেশচন্দ্র ব্যানার্জি, রমেশচন্দ্র দত্ত প্রমুখ। ১৮৯২ সালে হাউজ অব কমনসের প্রথম ভারতীয় সদস্য হন লিবারাল পার্টির নওরোজি। বছর তিনেক বাদে কনজার্ভেটিভ প্রার্থী ভবনগরী দ্বিতীয় ভারতীয় হিসেবে হাউজে প্রবেশ করেন। তৃতীয় ছিলেন শাপুরজি সাকলাতওয়ালা, যিনি হাউজে প্রবেশ করেন ১৯২০-এর দশকের শুরুর দিকে।
এদিকে উনবিংশ শতক শেষের আগেই, লন্ডনে পৌঁছে যায় দুই সহস্রাধিক ভারতীয় শিক্ষার্থী। সেন্ট্রাল লন্ডনের দ্য ইনস অব কোর্ট ছিল গান্ধী, জিন্নাহদের মতো ভারতীয়দের পরিচিত গন্তব্য। ভিক্টোরিয়ান লন্ডন তাদের পূর্বসূরীদের চেয়ে ভারতকে অনেকটাই ভিন্নভাবে গ্রহণ করে, অনেক বেশি সম্মানও দেয়। ১৮৮৫ সালে ডেপ্টফোর্ডের প্রার্থী হিসেবে লালমোহন ঘোষের, কিংবা ১৮৯৫ সালে স্বামী বিবেকানন্দের বক্তৃতা লন্ডনবাসী যতটা উৎসাহের সঙ্গে শোনে, তাতে বোঝা যায় সময়ের এই পর্যায়ে এসে তারা কৃতি ভারতীয়দের শুধু সম্মানই করতে শুরু করেনি, ভারতীয় আদর্শ ও দৃষ্টিভঙ্গিকেও স্বতঃস্ফূর্তভাবে গ্রহণ করতে শিখেছে।
১৮৭৯ সালের পর এডউইন আর্নল্ডের ‘দ্য লাইট অব এশিয়া’ এবং এফ ম্যাক্স মুলারের ‘স্যাক্রেড বুকস অব দ্য ইস্ট’ (যেখানে উপনিষদও স্থান পেয়েছিল) লন্ডনসহ সমগ্র ব্রিটেনের অধিবাসীদের মধ্যে তুমুল সাড়া ফেলে দেয়, তাদেরকে উৎসাহী করে তোলে ভারতীয় দর্শন ও আধ্যাত্মিকতার ব্যাপারে। এদিকে ক্রয়ডনে ব্যানার্জির ‘খিদিরপুর’ নামের প্রাসাদোপম ম্যানশন, ইউনিভার্সিটি কলেজের বুদ্ধিজীবী মহলে দত্তের অ্যাকাডেমিক অবদান, ভারতীয় সম্পদের পাচার নিয়ে নওরোজির থিসিস লন্ডনের সামাজিক পরিমণ্ডলে ঝড় তোলে।
তাই গান্ধী বা জিন্নাহরা যখন ভিক্টোরিয়ান লন্ডনে গিয়ে ইংরেজ আদবকেতা, পোশাক-পরিচ্ছদ ও সংস্কৃতি অনুকরণ করছিলেন, তারা মূলত তাদের ভারতীয় পূর্বসূরীদের দেখানো পথেই হাঁটছিলেন। আর লন্ডনে গিয়ে অর্জিত এ ধরনের হাইব্রিড মানসিক গঠনের ফলেই তারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের আদর্শ থেকে সরে নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য গড়ে তুলতে পেরেছিলেন। আপাতদৃষ্টিতে লন্ডন তাদের মনকে উপনিবেশিত করেছিল বটে, কিন্তু তারা সেই ক্ষমতাও লন্ডনে গিয়ে অর্জন করেন, যার ফলে তারা নিজেদের মনকে তো বটেই, নিজেদের দেশকেও বিউপনিবেশিত করতে পেরেছিলেন।
এছাড়াও লন্ডনে পা রেখেছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, অ্যালান অক্টোভিয়ান হিউম, অ্যানি বেসান্ত, ভি কে মেনন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ আরও অনেক জাতীয়তাবাদী, যারা লন্ডন ও সমগ্র পশ্চিমা বিশ্বের সামনে আধুনিক ভারতীয় ভাবধারাকে উন্মোচিত করেন। তাদের সাহায্যেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্য একদম নতুন ও সত্যিকারের বিশ্বজনীন সভ্যতার স্বাদ লাভ করে।
তাই তো লন্ডনের আজকের লন্ডন হয়ে উঠার পেছনে ভারত থেকে পাচার করা অঢেল সম্পদের পাশাপাশি এসব সূক্ষ্ম ব্যাপারেরও রয়েছে অনস্বীকার্য ভূমিকা।
(দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে ড. অরূপ চ্যাটার্জির দেওয়া সাক্ষাৎকার অবলম্বনে)