চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাস চমকপ্রদ নানা আবিষ্কার এবং ঘটনায় পরিপূর্ণ। অতীতের জ্ঞানচর্চার প্রভাবেই কিন্তু আজকের দিনে রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে অভূতপূর্ব উন্নতি আমরা দেখতে পাচ্ছি। আমরা ইতিহাসের সেসব ঘটনার কথাই এই সিরিজে তুলে আনার চেষ্টা করব, যা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে চিকিৎসাবিজ্ঞানকে আজকের অবস্থানে নিয়ে এসেছে। উল্লেখ্য, সবক্ষেত্রে ঘটনাগুলো হয়তো ইতিবাচক নয়, তবে মোটাদাগে তাদের প্রভাবে মানুষের জন্য কল্যাণকর পরিবর্তন সাধিত হয়েছে।
আমাদের গল্পের সূচনার জন্য বেছে নিয়েছি এমন এক বিষয়, যা সবসময় গুরুত্বপূর্ণ থাকলেও করোনাক্রান্ত পৃথিবীতে নতুন করে চারদিকে উচ্চারিত হয়েছে। আপনারা হয়তো অনেকেই আন্দাজ করতে পারছেন কীসের কথা বলা হচ্ছে, ভ্যাক্সিনেশন বা টিকাদান। করোনা অতিমারি থেকে চূড়ান্ত মুক্তির অন্যতম পথ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে বিপুল জনগোষ্ঠীকে করোনার ভ্যাক্সিন বা টিকা প্রদান। বৈজ্ঞানিকভাবে ভ্যাক্সিনেশনকে প্রতিষ্ঠা করার কাহিনীর জন্য আমাদের ফিরে যেতে হবে কয়েক শতাব্দী আগের ইংল্যান্ডে, যেখানে এডওয়ার্ড জেনার প্রথম গুটিবসন্তের বিরুদ্ধে ভ্যাক্সিনেশনের সাফল্য বিজ্ঞানীদের সামনে তুলে ধরেন। তাকে এজন্য রোগ প্রতিরোধবিদ্যার জনক (father of immunology) বা ভ্যাক্সিনবিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠাতা (founder of vaccinology) নামেও অভিহিত করা হয়।
গুটিবসন্ত/স্মলপক্স
ছোটবেলায় চিকেন পক্স আমাদের অনেকেরই হয়েছে। নামে স্মল বা ছোট হলেও চিকেন পক্সের বড়ভাই স্মলপক্সের দেখা এখন আর পৃথিবীতে পাওয়া যায় না। এই রোগ পৃথিবী থেকে নির্মূল করা হয়েছে এডওয়ার্ড জেনারের কাজের সূত্র ধরেই। সর্বশেষ প্রাকৃতিকভাবে সংক্রমিত গুটিবসন্তে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারানোর ঘটনা ঘটেছে প্রায় ৪২ বছর আগে, যখন ইংল্যান্ডের ৪০ বছর বয়স্ক জ্যানেট পার্কার এই রোগে প্রাণ হারান। অথচ এককালে এই গুটিবসন্ত ছিল মানুষের যম, এর মহামারী প্লেগের মতই কেড়ে নিত বহু প্রাণ। আমাদের উপমহাদেশেও গ্রামের পর গ্রাম একসময় উজাড় হত গুটিবসন্তের মড়কে। এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি, এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রাম হয়ে গুটিবসন্তের ঢেউ আছড়ে পড়ত মৃত্যুর থাবা নিয়ে।
গুটিবসন্তের ইতিহাস
স্মলপক্স বা গুটিবসন্ত ঠিক কবে মানুষের শরীরে দেখা দিয়েছিল তা বলা দুষ্কর। বিশেষজ্ঞদের অনেকেই বিশ্বাস করেন আজ থেকে প্রায় ১০,০০০ বছর আগে উত্তর-পূর্ব এশিয়ায় যখন প্রথম কৃষিভিত্তিক সমাজব্যবস্থার সূচনা হয়, তখন এই রোগের আবির্ভাব। বলা হয়, সেখান থেকে প্রাচীন মিশরীয় বণিকেরা বাণিজ্যপথ ধরে সুপ্রাচীন ভারতে গুটিবসন্ত নিয়ে আসে। ধন্বন্তরির সংস্কৃত লেখায় গুটিবসন্তের মতো রোগের বর্ণনা পাওয়া যায়। প্রাচীন ভারতীয় পুরানে কাকুরানি নামে এক দেবতারও সন্ধান পাওয়া যায় যে কি না এই রোগের প্রতিনিধিত্ব করত।একই রোগ চীনে ১১২২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকেই ছিল বলে জানা যায়, সেখানে এর নাম ছিল টাই-টো (tai-tou)।
প্রাচীন মিশরেও এই রোগ ছিল বলে প্রমান আছে। ১১৫৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মারা যাওয়া ফারাও পঞ্চম রামসেসের মমিকৃত শরীর ও মাথা পরীক্ষা করে এলিয়ট স্মিথ, রাফার এবং ওয়ারেন ডসনের মতো খ্যাতনামা বিশেষজ্ঞরা মত দিয়েছিলেন তার গুটিবসন্ত হয়েছিল। ৫৬৯ খ্রিস্টাব্দে আবিসিনিয়া থেকে মক্কা আক্রমণ করতে আসা খ্রিস্টান নৃপতি আব্রাহার সেনাদলেও গুটিবসন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল বলে অনেক ঐতিহাসিক দাবি করেন।
মূলত পঞ্চম থেকে সপ্তম শতকের মধ্যে ইউরোপে ছড়িয়ে যায় গুটিবসন্ত। অনেকে মুরদের দ্বারা ৭১০ সালে স্পেন বিজয়ের পর তাদের মাধ্যমে ইউরোপে এই রোগের আগমনের দাবি করলেও ম্যাকভেইলসহ বহু বিশেষজ্ঞ বলে থাকেন ইউরোপে আসলে এর আগে থেকেই গুটিবসন্তের প্রাদুর্ভাব ছিল। ম্যাকেভেইল ৬৭৫ খ্রিস্টাব্দে আয়ারল্যান্ডে বল্গ্যাখ নামে এক স্থানীয় রোগের দিকে আঙুল তুলে একেই গুটিবসন্ত বলে ধারণা করেন। ১০৮ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যে সংঘটিত প্লেগ অফ অ্যান্টোনাইন সম্ভবত গুটিবসন্তের মহামারী, যা কেড়ে নেয় প্রায় ৭ মিলিয়ন প্রাণ। মধ্যযুগেও ইউরোপে বারে বারেই এই রোগ আঘাত হানে। ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে সুইজারল্যান্ডের কিছু এলাকাতেও মহামারী আকারে এই রকম রোগের খোঁজ মেলে।
পর্তুগিজ আর স্প্যানিশ উপনিবেশ বিস্তারের সাথে সাথে ১৫০৭ সাল থেকে গুটিবসন্ত ছড়িয়ে যায় উত্তর আমেরিকা আর ওয়েস্ট ইন্ডিজে। স্থানীয় অনেক জাতি নির্মূল হয়ে যায়। ১৫২০ সালে স্প্যানিশ দখলদারেরা মেক্সিকোতে বহন করে নেয় এই রোগ, মারা যায় প্রায় ৩১ মিলিয়ন। ইনকা আর অ্যাজটেকদের নিশ্চিহ্ন হবার পেছনে গুটিবসন্তেরও ভূমিকা ছিল। এদিকে আফ্রিকা থেকে দলে দলে দাস বিক্রি করা হচ্ছিল আমেরিকাসহ ইউরোপের অন্যান্য জায়গায়। আফ্রিকাতে গুটিবসন্ত খুব সাধারণ একটি ব্যাপার ছিল, ফলে দাসদের থেকেও এই রোগ সংক্রমিত হতে থাকে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইউরোপে গুটিবসন্তের জন্য মারা যায় চার লাখের বেশি মানুষ।
জীবাণু যুদ্ধের হাতিয়ার হিসেবেও গুটিবসন্তের চিন্তা মানুষের মাথায় এসেছিল সেই অষ্টাদশ শতকে। ১৭৫৪ সাল থেকে আরম্ভ হওয়া ফ্রেঞ্চ-ইন্ডিয়ান যুদ্ধে ফরাসি আর ইন্ডিয়ান সম্মিলিত বাহিনীর বিপক্ষে প্রথমে ব্রিটিশ আর মিত্র আমেরিকান মিলিশিয়ারা বেশ বিপাকে পড়ে গিয়েছিল। তখন ব্রিটিশ এক কম্যান্ডার লর্ড অ্যামহার্স্ট গুটিবসন্ত রোগীদের ব্যবহৃত কম্বল ইন্ডিয়ানদের মধ্যে ছুঁড়ে দেয়ার পরিকল্পনা দিয়েছিলেন, তবে যতটুকু জানা যায় তার এই ঘৃণ্য প্রস্তাব অনুমোদিত হয়নি।
নামকরণ
মজার ব্যাপার হলো, প্রাচীন রোম এবং গ্রীসের কোনো লেখায় গুটিবসন্তের বর্ণনা নেই। ফলে মনে করা হয় সেখানে তারা কখনো এই রোগের শিকার হয়নি। ফলে ল্যাটিনে গুটিবসন্তের জন্য কোনো শব্দ নেই। গুটিবসন্তের মোটামুটি বিশদ এবং সঠিক বিবরণ লিপিবদ্ধ করেন বাগদাদের চিকিৎসক মুহাম্মদ ইবনে জাকারিয়া আল রাজি (মৃত্যু ৯২৩/৯৩০ খ্রিস্টাব্দ)। তার মতে, এই রোগ থেকে সেরে ওঠার হার অত্যন্ত কম। ৫৬৯ খ্রিস্টাব্দে সুইজারল্যান্ডের অ্যাভেঞ্চেসের বিশপ মারিয়াস ভ্যারিওলা শব্দ ব্যবহার করেন, যাকে অনেকে গুটিবসন্ত বলে থাকেন। তবে মারিয়াস সম্ভবত রোগের লক্ষণ বোঝাতে এই শব্দ ব্যবহার করেছিলেন, রোগ বোঝাতে নয়। ল্যাটিন ভ্যারিয়াস (varius) বা ভ্যারাস (varus) থেকে এই শব্দ উদ্ভুত, যেখানে ভ্যারিয়াস মানে চামড়ায় দাগ আর ভ্যারাস মানে ফোঁড়া।
কন্সট্যানটিনাস আফ্রিকানাস (জীবনকাল ১০২০-৮৭ খ্রিস্টাব্দ) সর্বপ্রথম আল রাজির বর্ণনার সাথে সঙ্গতি রেখে ভ্যারিওলা’কে রোগের নাম হিসেবে ব্যবহার করেন। একেই আমরা বাংলায় গুটিবসন্ত বলে জানি। ইংরেজি স্মলপক্স এসেছে পক্কা (pocca) শব্দ থেকে, যা রোগীদের শরীরে ছোট ছোট থলির মতো ফোঁড়া বোঝাতে ব্যবহৃত হত। পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষার্ধে সিফিলিস বা গ্রেটপক্স (great pockes) থেকে ভিন্ন করার জন্য গুটিবসন্তকে স্মলপক্স (small pockes) আখ্যা দেয়া শুরু হয়।
ইনঅকুলেশন /ভ্যারিওলেশন (Inoculation/ variolation)
ভ্যাক্সিন আবিষ্কারের আগে গুটিবসন্ত ঠেকানোর একমাত্র পন্থা ছিল ইনঅকুলেশন। ভ্যাক্সিনেশনের সাথে এর পার্থক্য হচ্ছে ইনুঅকুলেশনে আক্রান্ত রোগীর পুঁজ থেকে রস নিয়ে তা সুস্থ ব্যক্তির চামড়ার নিচে প্রবেশ করানো হয়। দেখা যেত এরা পরবর্তীতে গুটিবসন্তের হাত থেকে বেঁচে যাচ্ছেন। ভ্যাক্সিনের ক্ষেত্রে এমন জীবাণু শরীরে প্রবেশ করানো হয় যার রোগ সৃষ্টির ক্ষমতাই নেই, অন্যদিকে ইনুঅকুলেশনে পূর্ণ শক্তির জীবাণুকেই রক্তে ঢুকিয়ে দেয়া হত। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এই প্রক্রিয়াতে ঝুঁকি অনেক বেশি।
চীনে বহু আগে থেকেই এই পদ্ধতি প্রচলিত ছিল। সেখানে নাক দিয়ে ইনঅকুলেশন করার কথা শোনা যায়। ১৬৭০ খ্রিস্টাব্দে এই খবর অটোমান সাম্রাজ্যে এসে পৌঁছে। ইউরোপে তখনও অন্ধকারে। তবে ১৭০০ সালের ৫ জানুয়ারির এক চিঠিতে জোসেফ লিস্টার চীনে দেখা ইনুঅকুলেশনের কথা লিখে পাঠান লন্ডনের বিখ্যাত রয়্যাল সোসাইটির সদস্য মার্টিন লিস্টারের কাছে। ১৭০৬ সালে এডওয়ার্ড টেরি তুরস্কে থাকাকালীন অভিজ্ঞতা থেকে ইনুঅকুলেশনের বর্ণনা দেন।১৭১৩/১৪ সালে সুইডিশ রাজা দ্বাদশ চার্লসের রাজকীয় চিকিৎসক টিমনি তুরস্কে থাকাকালীন ইনুঅকুলেশনের এক বিশদ বিবরণ রাজা বরাবর পেশ করেন। রয়্যাল সোসাইটিও এক কপি পেল। এই সময় তাদের মধ্যে ইনঅকুলেশন নিয়ে প্রচুর বিতর্ক হতে থাকে।
১৭১৫ সালে ব্রিটিশ অভিজাত লেডি মন্ট্যাগু (Mary Wortley Montagu) গুটিবসন্তে আক্রান্ত হন। সেরে উঠলেও তার মুখ বিকৃত হয়ে যায়, তার ভাইও মারা যান এই রোগে। ১৭১৭-তে মন্ট্যাগুর স্বামী তুরস্কে ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত হন। এখানে গুটিবসন্তের বিরুদ্ধে ইনুঅকুলেশনের সফলতা দেখে মন্ট্যাগু ১৭১৮ সালের মার্চে তাদের চিকিৎসক চার্লস মেইটল্যান্ডকে বাধ্য করেন মন্ট্যাগু দম্পতির ৫ বছরের ছেলের উপরে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করতে। ১৭২১ সালের এপ্রিলে লন্ডনে ফিরে এলে মেইটল্যান্ড রাজকিয় চিকিৎসকদের সামনে মন্ট্যাগুর ৪ বছরের মেয়েকেও ইনুঅকুলেট করেন। তাকে রাজকীয় অনুমতি দেয়া হলো এই পদ্ধতি নিয়ে পরীক্ষা চালানোর জন্য। মেইটল্যান্ড পরীক্ষার জন্য ছয়জন বন্দিকে বেছে নেন, যাদের উপর প্রয়োগ সফল হয়। এরপর অনাথ বাচ্চাদের গিনিপিগ বানিয়েও মেইটল্যান্ড সফলতা পান। ১৭২২ সালের ১৭ এপ্রিল মেইটল্যান্ড প্রিন্সেস অফ ওয়েলসের দুই কন্যার উপর ইনঅকুলেশন প্রয়োগ করেন। তবে এরপরেও চিকিৎসকেরা সকলে এর পক্ষে ছিলেন না, অনেকেই ভীষণভাবে এর বিরোধিতা করতে থাকেন।
এদিকে আটলান্টিকের অপর পাড়ে উত্তর আমেরিকাতেও গুটিবসন্ত বিভীষিকা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এখানে বোস্টন শহরে বাস করতেন এক যাজক, কটন ম্যাথার। তার অধীনস্থ এক আফ্রিকান দাসের নাম দিয়েছিলেন তিনি ওনিসমাস (Onesimus)। ওনিসমাস তাকে জানালো গুটিবসন্ত রোখার এক মোক্ষম দাওয়াইয়ের কথা, যা সে নিজে পেয়েছে। তার দেশের মানুষ রোগীর পুঁজের রস নিয়ে চামড়ার উপর কোনো ক্ষতস্থানে ঘষে নেয়, তাহলে আর গুটিবসন্ত হয় না। ম্যাথার যখন এই পদ্ধতি প্রয়োগ করতে চাইলেন তখন বোস্টনের চিকিৎসক জ্যাবডিয়েল (Zabdiel Boylston) ছাড়া আর কাউকে তার পক্ষে পেলেন না।
আফ্রিকান এক দাসের কথা বিশ্বাস করায় তাদের নানারকম নিপীড়নের শিকার হতে হয়। অবশেষে ১৭২১ সালে গুটিবসন্ত মহামারীর সময় জ্যাবডিয়েল তার ছেলে, অধীনস্থ দাসসহ প্রায় ২৪২ জন লোককে ইনুঅকুলেট করেন। তাদের মধ্যে মাত্র ছয়জন মারা যায় গুটিবসন্তে। পরিসংখ্যানে দেখা গেল ইনঅকুলেশন করা হয়েছে এমন ব্যক্তিদের ৪০ জনে মারা গেছেন একজন, আর না করাদের থেকে প্রতি সাতজনে একজন।
১৭৫০ সালের পর থেকে ইংল্যান্ডে ইনঅকুলেশন ব্যাপকভাবে প্রয়োগের চেষ্টা শুরু হলো। ১৭৫২-৬৮ সালের মধ্যে বছরে সর্বোচ্চ ১,০০০ জনকে ইনঅকুলেট করার রেকর্ড পাওয়া যায়। অভিজাতবর্গ থেকে শুরু করে অনেক রাজারাজড়াও ইনঅকুলেশন গ্রহণ করেন। এই তালিকায় ছিলেন হাবসবুর্গ সম্রাজ্ঞী মারিয়া থেরেসা, ফরাসি সম্রাট ষোড়শ লুই, প্রুশিয়ার রাজা দ্বিতীয় ফ্রেডেরিক প্রমুখ। ফ্রেডেরিক এমনকি তার সৈনিকদের জন্যও ইনঅকুলেশনের ব্যবস্থা করেন। আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে ব্রিটিশদের মোকাবেলা করতে গিয়ে জর্জ ওয়াশিংটন একবার গুটিবসন্তের ধাক্কায় কাবু হয়ে পড়েছিলেন। ফলে তিনিও তার সেনাদের জন্য ইনকুলেশন বাধ্যতামূলক করে দেন।
২-৩% মানুষের ক্ষেত্রে ইনঅকুলেশন ব্যর্থ হলেও মোটাদাগে বাকিরা ভালই ছিল, তবে গুটিবসন্তের মৃত্যুহারের উপর লক্ষ্যণীয় কোনো প্রভাব দেখা যাচ্ছিল না। তাই প্রয়োজন হয়ে পড়ে আরো ভাল কোনো বিকল্পের।
বেঞ্জামিন জেটসি
বেঞ্জামিন জেটসি ইংল্যান্ডের ডর্সেট কাউন্টি এলাকার একজন খামারি। ছেলে দুই বছরের বেঞ্জামিন ও তিন বছরের রবার্ট এবং স্ত্রীকে নিয়ে তার সুখের সংসার। ১৭৭৪ সালে চারদিকে গুটিবসন্ত ছড়িয়ে পড়লে পরিবারের চিন্তায় জেটসি অস্থির হয়ে ওঠেন। যুবাবয়সে জেটসি কাউপক্স বা গোবসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়েছিল। গোবসন্ত অনেকটা গুটিবসন্তের মতোই, তবে তুলনামূলকভাবে দুর্বল এই রোগ মানুষের জন্য সাধারণত প্রাণঘাতী নয়। এই রোগ গরুর থেকে মানুষের মাঝে সংক্রমিত হত।
সেই সময় অনেক মহিলা দুধ দোয়ানো আর বিক্রির কাজ করত যাদের বলা হত মিল্কমেইড (Milkmaid)। জেটসি তার খামারের দুই মিল্কমেইডের কথা জানত যারা গোবসন্ত থেকে সেরে ওঠার পর গুটিবসন্ত আক্রান্ত আত্মীয়দের সেবা করেছে নিজেরা সংক্রমিত না হয়েই। জেটসির প্রতিবেশী খামারি এলফোর্ডের গরুগুলো তখন গোবসন্তে আক্রান্ত। জেটসি সেখানে গিয়ে উপস্থিত হলো। গরুর ক্ষত থেকে জীবাণু সংগ্রহ করে সূচের মাধ্যমে তা প্রবেশ করালো নিজ সন্তান আর স্ত্রীর দেহে। গোবসন্তের মতো চামড়াতে কিছু লক্ষণ ছাড়া আর কোনো সমস্যা তাদের হলো না, গুটিবসন্ত থেকেও তারা বেঁচে গেলেন।
জেটসির এই কাণ্ড প্রথম প্রকাশ পায় ১৮০২/০৩ সালের দিকে রেভারেন্ড ডক্টর বেল নামে এক চিকিৎসকের লেখায়। ১৮০৪ সালে পিয়ার্সন নামে আরেক চিকিৎসক তার লেখাতেও জেটসির কথা উল্লেখ করেন। ততদিনে এডওয়ার্ড জেনার গুটিবসন্তের ভ্যাক্সিনেশনের কাজ অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছেন। পিয়ার্সনের সাথে ব্যক্তিগত রেষারেষির জেরে তিনি জেটসির কৃতিত্ব স্বীকারই করতে চাননি। পরে ১৮০৫ সালের দিকে জেটসিকে সম্মাননা প্রদান করা হলেও ইতিহাসে জেনারের নামই বড় আকারে লেখা হয়, জেটসি চলে যান ফুটনোটে। তবে এটাও সত্য যে জেটসি তার সফলতার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি দাঁড় করাতে কাজ করেননি, এবং জনগণের কল্যাণেও একে ব্যবহার করেননি। ফলে জেনারের প্রাপ্ত সম্মান অনর্থক নয়।
এডওয়ার্ড জেনার
১৭৫৭ সাল; গ্লস্টারশায়ারে এডওয়ার্ড জেনার নামে আট বছরের এক ছেলেকে ইনঅকুলেশনের করা হয়। হালকা গুটিবসন্তে আক্রান্ত হলেও শীঘ্রই সেরে উঠল ছেলেটি। সে ছিল বার্কলে অঞ্চলের যাজক স্টিফেন জেনারের সন্তান। ১৭৪৯ সালের ১৭ মে তার জন্ম। দুর্ভাগ্যজনকভাবে জন্মের পাঁচ বছরের মাথায় জেনার এতিম হন। এরপর বড় ভাইয়ের সাথে থেকে স্কুল চালিয়ে যান কিছুদিন। ১৩ বছরে বয়সে স্কুল ত্যাগ করে ব্রিস্টলের সডবুরিতে ড্যানিয়েল লুডলো নামে এক চিকিৎসকের ফার্মেসিতে কাজ নেন। জনশ্রুতি আছে- এখানে কাজ করার সময়েই এক মিল্কমেইডকে তিনি বলতে শোনেন যে তার কখনো গুটিবসন্ত হবে না, কারণ তিনি ইতোমধ্যে গোবসন্ত থেকে সেরে উঠেছেন।
চিকিৎসক হবার বাসনায় জেনার ১৭৬৪ সাল থেকে জর্জ হারউইক নামে এক স্থানীয় শল্যচিকিৎসকের অধীনে ইন্টার্নশিপ শুরু করলেন। ইন্টার্নশিপ শেষ করে ২১ বছরের জেনার পাড়ি জমালেন লন্ডন, ইতিহাসে বিখ্যাত চিকিৎসক জন হান্টারের ছাত্রত্ব গ্রহণ করে। হান্টার শুধু চিকিৎসকই ছিলেন না, বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখাতেও ছিল তার সাবলিল পদচারণা। জেনারের মধ্যেও তিনি সেই আগ্রহ ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন। এতটাই যে সুবিখ্যাত পরিব্রাজক ক্যাপ্টেন কুক যখন তার অভিযান শেষে ফিরে আসেন, তার বহন করা অনেক নমুনা শ্রেণীবিভাগ করেন এই জেনারই। তবে ১৭৭২ সালে দ্বিতীয় অভিযানে কুকের সঙ্গী হবার আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে তিনি পরের বছর জন্মস্থান বার্কলেতে ফিরে আসেন, শুরু করেন প্র্যাকটিস। ১৭৮৮ সালে রয়্যাল কলেজের ফেলোশিপ অর্জন করেন জেনার। ১৭৮৮ সালে বিবাহিতদের খাতায় নাম তোলেন ক্যাথেরিন কিংস্কটকে বিয়ে করে। চার বছর পর চিকিৎসকদের বহুল কাঙ্ক্ষিত এমডি ডিগ্রিও পেয়ে যান।
১৭৮০ সাল থেকেই জেনার গোবসন্ত আর গুটিবসন্তের সম্পর্ক নিয়ে ভাবছিলেন। ১৭৮৯ সালে গ্লস্টারশায়ারে প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় পিগপক্সের, যা ছিল অনেকটা শুকরের গোবসন্ত। তৎকালীন গ্লস্টার মেডিক্যাল সোসাইটির সদস্য হিসবে জেনারও এই রোগ নিয়ে অনুসন্ধানে যুক্ত ছিলেন। তখন তার ঘরে দশ মাসের সন্তান। একদিন তিনি দেখতে পেলেন তার সন্তানের পরিচর্যাকারী নার্সও পিগপক্সে সংক্রমিত হয়েছে। জেনার তার ক্ষত থেকে উপাদান সংগ্রহ করে নিজ সন্তান এবং প্রতিবেশী পরিবারের দুই নারী কর্মচারীর দেহে প্রবেশ করান। ১৭৯০ সালের জানুয়ারিতে তিনি তার সন্তান ও নার্সের শরীরে গুটিবসন্তের জীবাণু ঢুকিয়ে পরীক্ষা করলেন, তারা কেউই আক্রান্ত হলো না। জেনার গ্লস্টারের মেডিক্যাল সোসাইটিকে তার পরীক্ষার ফলাফল লিখে জানালেও খুব বেশি হইচই হয়নি।
সারা নেমস ও জেমস ফিপস
১৭৯৬ সালে নিজের অভিজ্ঞতা নিয়ে জেনার একটি প্রবন্ধ লিখে রয়্যাল সোসাইটির কাছে প্রেরণ করলেন। এখানে উল্লেখ ছিল জেমস ফিপসকে নিয়ে তার গবেষণার কথা।
১৭৯৬ সালে জেনার দেখা পান সারা নেমস নামে এক মিল্কমেইডের। তখন চারদিকে গুটিবসন্তের প্রকোপ। কিন্তু সারা সম্পূর্ণ অক্ষত, কেবল তার হাতে গোবসন্তের কিছু ক্ষত দেখা যাচ্ছে। জেনার ১৪ মে তার ক্ষতস্থান থেকে পুঁজ সংগ্রহ করেন, যেখান ছিল গোবসন্তের জীবাণু। সেটি প্রবেশ করালেন ৮ বছর বয়সী জেমস ফিপসের দেহে। আজকের দিনে হলে এই কাজ তিনি করতেই পারতেন না। করলে জেল-জরিমানা থেকে শুরু করে মেডিক্যাল লাইসেন্স পর্যন্ত বাতিল হয়ে যেত। তবে তখন তো এত নিয়মকানুন ছিল না। ফলে নির্বিঘ্নে জেনার ফিপসকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন।
সপ্তম দিনে ছেলেটি কিছুটা ব্যথা অনুভব করল, অষ্টম-নবম দিনে জ্বর ও ক্ষুধামন্দা দেখা দিল। তবে দশম দিন থেকেই ফিপস সুস্থ বোধ করতে লাগল। সাত সপ্তাহ পর জুলাই মাসে জেনার ফিপসকে গুটিবসন্তের জীবাণু দিলেন, কিছুই হলো না। কেবল এই একটি সফল পরীক্ষার উপর ভিত্তি করেই জেনার দাবি করে বসেন গোবসন্তের দ্বারা গুটিবসন্তের প্রতিরোধ সম্ভব। অনুমিতভাবেই রয়্যাল সোসাইটি তার ফলাফল আমলে নেয়নি।
গুটিবসন্ত প্রতিরোধে জেনারের প্রচেষ্টা
১৭৯৮ সালে নিজের সঞ্চিত সমস্ত জ্ঞান ব্যয় করে জেনার রচনা করলেন তার বিখ্যাত গ্রন্থ, “An Inquiry into the Causes and Effects of the Variolae Vaccinae, a disease discovered in some of the western counties of England, particularly Gloucestershire and Known by the Name of Cow Pox”। গরুর ল্যাটিন নাম ভ্যাক্কা (vacca), গোবসন্তকে বলা হত ভ্যাক্সিনিয়া (vaccinia)। দুয়ে মিলে জেনার তার গুটিবসন্ত প্রতিরোধ পদ্ধতির নাম দিলেন ভ্যাক্সিনেশন।
ইনঅকুলেশনের থেকে এর পার্থক্য এই যে ইনঅকুলেশনে সরাসরি গুটিবসন্তের জীবাণুর ব্যবহার করা হয়, সেখানে ভ্যাক্সিনেশনে দেয়া হয় গোবসন্তের জীবাণু যা মানবদেহে তুলনামূলকভাবে দুর্বল রোগ সৃষ্টি করে। ১৭৯৮ সালের বইয়ে তিনি ভ্যাক্সিনেশনের সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। এই বই তিন ভাগে ভাগ করা ছিল। প্রথম ভাগে জেনার দাবি করেন গোবসন্ত ঘোড়া থেকে গরুতে আসে, যা তার জীবদ্দশাতেই ভুল প্রমাণিত হয়। দ্বিতীয় ভাগের ভ্যাক্সিনেশনের স্বপক্ষে যুক্তির অবতারণা করেন, আর সর্বশেষ ভাগের বিষয়বস্তু ছিল গুটিবসন্ত নিয়ে সুদীর্ঘ আলোচনা। জেনারের বই কিন্তু বেস্টসেলার হয়নি, বরং চিকিৎসক সমাজের অনেকেই তাকে ভুলভাল বকার কথা বলে তুলোধুনো করতে থাকেন।
জেনার খুঁজে খুঁজে আরো ১৮টি ঘটনা তুলে আনেন, যেখানে গোবসন্তে আক্রান্ত ব্যক্তি পরবর্তীতে গুটিবসন্ত থেকে বেঁচে যান। ১৭৯৮ সালের মার্চে জেনার পাঁচ বছর বয়সী জন বেকারের উপর তার পদ্ধতি প্রয়োগ করেন। এজন্য উপাদান সংগ্রহ করা হয় থমাস ভিরগো নামে তার এক চাকরের থেকে, যে কিনা গোবসন্তে আক্রান্ত হয়েছিল। বেকারের কথা জেনার পরবর্তী বইয়ে (১৭৯৯) বিবৃত করেছেন।
প্রথম বই প্রকাশের পর জেনার ভ্যাক্সিনের মালামাল নিয়ে চলে যান লন্ডনে। মনে আশা- খুঁজে বের করবেন স্বেচ্ছাসেবক যারা তাকে পরীক্ষা চালানোর অনুমতি দেবে। তিন মাস বসে থেকে একজন স্বেচ্ছাসেবকও তিনি জোগাড় করতে পারলেন না। তিনি ফিরে এলেও অন্য কিছু চিকিৎসকের চেষ্টায় ভ্যাক্সিনেশনের হার বাড়তে থাকে।
শল্যচিকিৎসক হেনরি ক্লাইনকে জেনার তার মালামালের কিছু অংশ দিয়ে গিয়েছিলেন, তা ব্যবহার করে ক্লাইন অনেক মানুষকে ভ্যাক্সিন দেন। ১৭৯৯ সালে পিয়ার্সন আর উডভিল নামে তৎকালীন নামকরা চিকিৎসকেরা নিজেদের রোগীদের ভ্যাক্সিনেশনে উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। এর মধ্যে জেনার জাতীয়ভাবে একটি জরিপ করে ভ্যাক্সিনেশনের পক্ষে আরো কিছু প্রমাণ হাজির করলেন। বিতর্ক, কিছু ব্যর্থতা আর অনেক বাধা সত্ত্বেও জেনারের পদ্ধতি ছড়িয়ে পড়ে ইংল্যান্ডের আনাচেকানাচে, সেখান থেকে ১৮০০ সালে পৌঁছে গেল ইউরোপেও। সেই বছরই উডভিল তার হাসপাতালে ২,০০০ লোকের উপর সফলভাবে ভ্যাক্সিনেশন প্রয়োগ করেন। পরের বছর আরেকটি বইয়ে জেনার দাবি করলেন ইংল্যান্ডে অন্তত এক লাখ লোক গুটিবসন্তের ভ্যাক্সিন পেয়েছে।
গুটিবসন্তের পেছনে ছুটতে গিয়ে জেনার তার প্র্যাকটিস জলাঞ্জলি দিয়েছিলেন। ফলে সংসারে টানাপোড়েন ছিল। কাজেই জেনার এবার তার কাজ থেকে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতে চাইলেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি ১৮০২ সালে লন্ডনে আসেন। দেনদরবার করার পর ব্রিটিশ পার্লামেন্ট তাকে ১০,০০০ পাউন্ড বরাদ্দ করে, পাঁচ বছর পর দেয় আরো ২০,০০০ পাউন্ড। তার বিরুদ্ধাচরণকারীদের চেষ্টা সত্ত্বেও ক্রমেই ভ্যাক্সিনেশন ইনঅকুলেশনের থেকে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, এবং ১৮৪০ সাল নাগাদ আইন করে ইনঅকুলেশন বন্ধ করে দেয়া হলো।
জেনার অর্থ ছাড়াও বিভিন্ন সম্মাননা লাভ করেন। ফরাসি জাতীয় ইন্সটিটিউট তাকে তাদের সদস্য করে নেয়। ১৮০৩ সালের আগস্টে লন্ডন শহর আলাদা করে তাকে সম্মাননা প্রদান করে। ডাবলিন আর এডিনবার্গও লন্ডনকে অনুসরণ করল। ১৮০৩ সালেই হার্ভার্ড তাকে একটি ডিপ্লোমা প্রদান করে, আর ১৮১৩ সালে অক্সফোর্ড থেকে তিনি প্রাপ্ত হন মেডিসিনে সম্মানসূচক ডক্টরেট। কদাচিৎ কাউকে এই সম্মান দেয়া হত। কখনো নাইটহুড না পেলেও ১৮২১ সালে তিনি রাজা জর্জের রাজকীয় চিকিৎসকদের একজন হিসেবে নিযুক্ত হন। তার বন্ধুরা মিলে ১৮০৩ সালের ৩রা ফেব্রুয়ারি বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য জেনারকে প্রেসিডেন্ট করে জেনারিয়ান ইন্সটিটিউশন প্রতিষ্ঠা করেন, যার প্রধান পৃষ্ঠপোষক হলেন ইংল্যান্ডের রানী। রাজার সম্মতি নিয়ে একে রাজকীয় জেনারিয়ান সোসাইটি নামকরণ করা হলেও খুব বেশি দিন এটি টেকেনি।
বয়সের সাথে সাথে জেনার নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে বার্কলেতে চলে যান। সেখানে বিনা পয়সায় গরীবদের ভ্যাক্সিনেশনের কার্যক্রম চালাচ্ছিলেন তিনি অনেক আগে থেকেই। ভ্যাক্সিনেশনের পক্ষে-বিপক্ষে তুমুল তর্ক-বিতর্ক থেকেও পুরোপুরি নিজেকে প্রত্যাহার করে নেন তিনি। ১৮২৩ সালের ২৬ জানুয়ারি জেনার নিজ বাড়িতে স্ট্রোক করে মারা যান, তাকে সমাধিস্থ করা হয় বার্কলের চার্চে।
জেনারের অবদান
একটি কথাতেই গুটিবসন্ত নির্মূলে জেনারের প্রভাব পরিষ্কার হয়ে যাবে। একমাত্র ভ্যাক্সিনেশন ছাড়া গুটিবসন্ত নিয়ন্ত্রণের কার্যকরী কোনো ঔষধ আজ পর্যন্ত আমাদের হাতে নেই। কেবল বিংশ শতাব্দীতেই ৩০০ মিলিয়ন মানুষ তাই মারা গেছে গুটিবসন্তে। একমাত্র ভ্যাক্সিনেশনের সর্বব্যাপী সফল প্রয়োগের মাধ্যমেই সম্ভব হয়েছে এই রোগ নির্মূল করা। তবে এজন্য লেগে গেছে ২০০ বছর। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ৮ মে, ১৯৮০ সালে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছে পৃথিবী থেকে গুটিবসন্তের বিদায় নেয়ার। তবে সরকারিভাবে দুটি পরীক্ষাগারে এখনও এই জীবাণুর নমুনা সংরক্ষিত আছে, একটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোলে’র (সিডিসি) আটলান্টার গবেষণাগারে, আরেকটি রাশিয়ার কল্টসোভে রাষ্ট্রীয় পরীক্ষাগারে।
বেঞ্জামিন জেটসি হয়তো প্রথম সফলভাবে ভ্যাক্সিনেশন করেছিলেন, কিন্তু একে তথ্য-উপাত্তের উপর দাঁড় করিয়ে জনগণের ব্যবহারোপযোগী করে তুলেছিলেন এডওয়ার্ড জেনার। যার ফলে সম্ভব হয়েছে গুটিবসন্ত থেকে মুক্তি। তবে এ কথা মনে রাখতে হবে যে গুটিবসন্তের বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্যের কারণেই একে ভ্যাক্সিনেশনের মাধ্যমে নির্মূল করা গিয়েছে, যা অন্যান্য রোগের ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে অত্যন্ত কঠিন।