১২ জুন, ১৯৬২; সকালবেলা রুটিনমাফিক সেল চেক করা শুরু করেছেন আলকাট্রাজ কারাগারের কারারক্ষীরা। বাকি সব কয়েদি ততক্ষণে ঘুম থেকে উঠে গেছে। কিন্তু জন অ্যাংলিন, ক্লারেন্স অ্যাংলিন আর ফ্রাঙ্ক মরিস তখনও ঘুমিয়ে। সেলের বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছে তাদের মাথা। কাথা মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে তারা। এভাবে কিছুক্ষণ পার হয়ে গেলে সেলের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল রক্ষীরা।
কিন্তু এ কী! সেলে তো বন্দীরা নেই। ওগুলো আসলে একেকটা প্লাস্টারের ডামি! হকচকিয়ে গেল সবাই। এখানেই শেষ নয়। তাদের সেলগুলোর নিচের দিকে থাকা ভেন্টিলেটরও ভাঙা। এর মানে পালিয়েছে তারা! যে কারাগার থেকে পালানো অসম্ভব বলে ধরে নেওয়া হতো, সেখান থেকেই পালিয়েছে একজন নয়, দুইজন নয়, তিন তিনজন বন্দী! সবাই স্তম্ভিত হয়ে যায়। বেজে ওঠে অ্যালার্ম। তাৎক্ষণিকভাবে পুরো আলকাট্রাজকে লকডাউন করা হয়। শুরু হয় তিন ফেরারির খোঁজ।
মজার ব্যাপার হলো, তাদেরকে আর কখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। তারা আদৌ পালাতে সক্ষম হয়েছিল সেই বিচ্ছিন্ন আলকাট্রাজ থেকে নাকি সানফ্রান্সিসকো বে-র হিমশীতল পানিতে তাদের সলিল সমাধি হয়েছিল তা ইতিহাসের অন্যতম রহস্য হিসেবে আজও বিদ্যমান। নানা রকম তত্ত্ব চালু আছে এই রহস্য নিয়ে। কেউ বলে তারা সফলভাবে পালিয়েছিল, আবার পরে উদ্ধার হওয়া জামা-কাপড় ও হাতে বানানো রেইনকোটের নৌকা যাতে তারা পালিয়েছিল তা সম্পূর্ণ বিপরীত কথা বলে।
দীর্ঘদিন পর সবাই যখন আলকাট্রাজ কাহিনীর কথা ভুলেই যেতে বসেছিল, তখন ২০১৩ সালের দিকের এক চিঠি সবাইকে নড়েচড়ে বসতে বাধ্য করে। তবে এই রহস্যের চূড়ান্ত সমাধান কিন্তু আজও হয়নি। রহস্য নিয়ে মাথা ঘামাবার আগে চলুন জেনে আসা যাক আলকাট্রাজের ঐতিহাসিক যাত্রা কীভাবে শুরু হলো, কেনই বা এটি এত বিখ্যাত।
আলকাট্রাজ – দ্য রক
আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ার সান ফ্রান্সিসকো বে-তে বেশ কয়েকটি দ্বীপ আছে। একপাশে ট্রেজার আইল্যান্ড, আরেকপাশে অ্যাঞ্জেল আইল্যান্ড। মাঝে অবস্থিত আলকাট্রাজ। ১৯০৯ সালে এখানে এক মিলিটারি প্রিজন গড়ে তোলা হয়, যার নাম দেওয়া হয় দ্বীপের নামেই। ১৯৩৪ সালে তা পরিণত হয় ফেডারেল প্রিজনে, নাম রাখা হয় আলকাট্রাজ ফেডারেল পেনিটেনশিয়ারি। সানফ্রান্সিসকো উপকূল থেকে প্রায় দেড় মাইল দূরে উপকূল থেকে একদমই বিচ্ছিন্নভাবে এই কয়েদখানা অবস্থিত।
তারপর ১৯৬৩ পর্যন্ত একই ছন্দে বন্দীদের আটক করার কাজটি করে গেছে এই আলোচিত কয়েদখানা। এই সময়ের মধ্যে এখানে সাজা ভোগ করতে এসেছিল কুখ্যাত আল কাপোন, পাখিমানব খ্যাত রবার্ট স্ট্রাউডের মতো অপরাধীরা।
সাধারণত সবচেয়ে বেয়াড়া কয়েদীদের এখানে আনা হতো। অন্যান্য কারাগারের যেসব কয়েদী কারাগারের নিয়মকানুন মেনে চলতে ব্যর্থ হতো অথবা পালানোর চেষ্টা করা কয়েদিদের শাস্তিস্বরুপ আলকাট্রাজে পাঠিয়ে দেওয়া হতো। কারণ? এখানকার বিচ্ছিন্নতা ও একঘেঁয়ে রুটিন যা যে কাউকেই ঠিক পথে চলতে বাধ্য করে। তাছাড়াও নিরাপত্তা ব্যবস্থা এতই কঠোর ছিল যে এখান থেকে পালানো অসম্ভব মনে করত সবাই। বলা হয়ে থাকে, এখানে সবকিছুই পরিশ্রম দিয়ে অর্জন করে নিতে হতো। এমনি এমনি কেউ কোনো সুবিধাই পেত না। সব মিলিয়ে খুবই কষ্টের ছিল জীবন। যখন কারারক্ষীরা মনে করতো অপরাধী বাধ্য ও অনুগত হয়েছে, তখনই মুক্তি মিলত এই একঘেঁয়ে জীবনের, অপরাধীকে পাঠানো হতো অন্য কোনো ভালো কয়েদখানায়।
আলকাট্রাজের আরেকনাম রক যেন এর কাঠিন্যকেই নির্দেশ করে। পুরো পৃথিবীর মধ্য এটি ছিল সবচেয়ে সুরক্ষিত জেল। এখান থেকে পালানোটা ছিল শুধু কঠিন না, প্রায় অসম্ভব। চারদিক ঘেরা সুউচ্চ দেয়াল, নিরাপত্তায় নিয়োজিত গার্ড কিংবা উপকূল থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা, সবকিছুই নির্দেশ করে এখানকার কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থাকে। তাছাড়াও আলকাট্রাজকে ঘিরে রয়েছে সানফ্রান্সিসকো বের হিমশীতল পানি, যেখানে আপনি মুহুর্তেই মারা যেতে পারেন। এর থেকেও বড় ব্যাপার হলো- এমনও অনেক সময় গিয়েছে যখন একজন বন্দীর জন্য তিনজন নিরাপত্তারক্ষীও নিয়োজিত ছিল। এতকিছুর পরেও ১৯৬২ সাল পর্যন্ত আলকাট্রাজ থেকে ১৪ বার পালানোর চেষ্টা হয়েছিল।
বলা বাহুল্য, সবক’টিই ছিল ব্যর্থ প্রচেষ্টা। ১৯৬২ সালের ১১ জুন যারা পালানোর চেষ্টা করছিল তারা ব্যতীত ধরা পড়েছিল সবাই। অ্যাংলিন ব্রাদার্স ও ফ্রাঙ্ক মরিস, তারা তিনজন ও তাদের কাহিনী তাই এখনও ঘুরে ফেরে মুখে মুখে।
পালানোর পরিকল্পনা
পালানোর পরিকল্পনাটা প্রথম এসেছিল ফ্রাঙ্ক মরিসের মাথা থেকে। তার ছিল প্রখর বুদ্ধি। মধ্য তিরিশে থাকা মরিসের অপরাধের তালিকা বেশ লম্বা এবং এর আগেও বহুবার সে জেল খেটেছে। তবে এবার সে ব্যাংক ডাকাতির কারণে ধরা পড়ে এবং আলকাট্রাজে আসে ১৯৬০ সালের জানুয়ারি মাসের দিকে।
জন ও ক্লারেন্স অ্যাংলিনও একই অভিযোগে অভিযুক্ত ছিল, ব্যাংক ডাকাতি। তিরিশের কোঠায় থাকা দুই ভাই আলকাট্রাজে আসার আগে আটলান্টার এক কারাগারে ছিল। সেখানেই তাদের সাথে মরিসের পরিচয়। পালানোর চেষ্টা করায় তাদের আলকাট্রাজে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
এই পরিকল্পনার চতুর্থ ব্যক্তি অ্যালেন ওয়েস্ট। বয়স ৩৩, অন্যদের মতোই কুখ্যাত অপরাধজীবন।
১৯৬১ সালের ডিসেম্বরের দিকে তারা একসাথ হয়। কারাগারে হঠাৎ একদিন একটা করাত পড়ে থাকতে দেখে তাদের মাথায় আসে পালানোর চিন্তা। তারা জানত কারাগারের স্টিলের বার কাটা সম্ভব নয়, কারণ তা খুব শক্ত। তাছাড়াও সামনের দিকে রয়েছে নিরাপত্তারক্ষীরা। তবে সেলের নিচের দিকে থাকা ভেন্টিলেটর ভেঙে পেছন দিককার পথ পেরিয়ে হয়তো পালানো সম্ভব। কারাগারের সেল ব্লক বি-এর ভেন্টিলেটরগুলো ভাঙা সহজ হবে, তাই তারা কারা কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করে তাদেরকে সেখানে স্থানান্তরিত করতে। কারা কর্তৃপক্ষ হয়তো অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী ছিল জেলের নিরাপত্তা নিয়ে, তাই তারা এই স্থানান্তরের অনুমতি দিয়ে দেয়।
আলকাট্রাজে সবাইকেই কোনো না কোনো কাজ করতে হতো। কেউ হয়তো ময়লা পরিষ্কারের কাজ করতো, কেউ বাসন মাজা, আবার কেউ বাগানের গাছগুলোর পরিচর্যা। চুল কামানোর সেলুনও ছিল সেখানে। আর দ্বীপের দক্ষিণ দিকে ছিল এক কারখানা, যেখানে রাবার ম্যাট, জুতা, রেইনকোটসহ নানা জিনিস তৈরি করা হতো। অবশ্যই সকল কাজ কারা কর্তৃপক্ষের অধীনে অল্প মজুরিতে হতো।
এই খাটাখাটনি করতে করতেই তারা পেয়ে যায় পালানোর জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। ওয়েস্ট ভালো নাপিত ছিল, আর তাই সে সেলুনে কাজ পেল। সেখান থেকেই সে ডামির জন্য চুল সংগ্রহ করতে থাকল গোপনে। রেইনকোট দিয়ে নৌকা বানানোর বুদ্ধিটা ছিল মরিসের। তাই তারা কারখানা থেকে অল্প অল্প করে রেইনকোট চুরি করতে থাকল। এভাবে তারা মোট ৫০টি রেইনকোট চুরি করে। তাছাড়াও ভেন্টিলেটর ভাঙার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও তারা সংগ্রহ করে চুরি করে।
১৯৬১ সালের ডিসেম্বর থেকে পরবর্তী ছ’মাসে তারা ধীরে ধীরে এগোতে থাকে। জেলের মাঠ থেকে পাওয়া করাত, ডাইনিং থেকে চুরি করা চামচ এবং একটি ভাঙা ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের মোটর থেকে ড্রিল মেশিন বানিয়ে সেগুলো দিয়ে প্রথমে ভেন্টিলেটর ভাঙা শুরু করে তারা।
কাজটি ছিল সময়সাপেক্ষ। কারণ একবারে খুব বেশি ভাঙা যেত না হাতে বানানো সেসব যন্ত্র দিয়ে, সাথে ছিল ড্রিলের শব্দে পাছে কেউ বুঝে ফেলে সেই ভয়। তাছাড়াও তা তাদের ঢেকে রাখতে হতো যাতে কেউ তা দেখে ফেলতে না পারে। প্রতিরাতে তারা একটু একটু করে ড্রিল চালাত, আর একটু একটু করে ভেন্টিলেটরের কংক্রিট আলগা হয়ে আসত। ড্রিল মেশিনের শব্দ ঢাকার জন্য মরিস জোর গলায় গান করত আর বাদ্যযন্ত্র বাজাত। দিনের বেলায় কার্ডবোর্ড, স্যুটকেস অথবা গিটার দিয়ে তারা ভেন্টিলেটরগুলো ঢেকে রাখত।
একইসাথে তারা ডামি বানাতে শুরু করে। প্লাস্টার, রং, মানুষের চুল দিয়ে নিখুঁতভাবে বানানো হয় ডামিগুলো। উদ্দেশ্য অবশ্যই কারা কর্তৃপক্ষের চোখ ফাঁকি দেওয়া।
ভেন্টিলেটর ভেঙে সেলের পেছনদিককার অংশে একটা ইউটিলিটি করিডোর যা সচরাচর নিরাপত্তারক্ষীদের নজরের বাইরে থাকে। করিডোর ধরে চলে আসা যায় সেল ব্লকের ওপরের অংশে। সেখান থেকেই ভেন্টিলেটর শ্যাফট বেয়ে উঠে গেলে আলকাট্রাজের ছাদ।
ভেন্টিলেটর ফুটো করা ও ডামি বানানোর পাশাপাশি তারা তিনজন সেল ব্লকের ওপরের ওই অংশে একটা ওয়ার্কশপ খুলে বসল। পাইপ ঠিক করবে তারা। যেহেতু জেলে সবাইকে নানা কাজ করতে হতো, তাই তারা এ কাজের অনুমতি পেল। সেই ওয়ার্কশপেই তারা দিনের পর দিন পালানোর আসল প্রস্তুতিগুলো নেয়। জড়ো করে পালানোর জন্য নানা জিনিসপাতি। ওখানে কী হচ্ছে কেউ যাতে বুঝতে না পারে সেজন্য তারা ওয়ার্কশপটি পর্দা দিয়ে ঢেকে দেয়। পর্দা দিলে ধুলোবালি বাইরে আসবে না, তাদের দেওয়া এহেন যুক্তি মোক্ষমই বলা চলে। কারারক্ষীরা ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি এসব কাজের আসল কারণ।
পালানোর জন্য সবচেয়ে দরকার যে জিনিসটার ছিল তা হলো একটা নৌকা। কারণ জেল থেকে বেরোতে পারলেও সানফ্রান্সিসকো বে-র দীর্ঘ জলরাশি পাড়ি দিতে হবে। চুরি করা রেইনকোট দিয়ে নৌকা বানানোর কাজটা তারা ওয়ার্কশপেই সারল। প্রথমে রেইনকোটগুলো জড়ো করে সেখানে থাকা স্টিম পাইপের মাধ্যমে জোড়া লাগানো। তারপর একটি কনসার্টিনা দিয়ে সেগুলো ফোলালো। ব্যস, হয়ে গেল হাতে বানানো নৌকা। নৌকা ভাসানোর জন্য বৈঠা দরকার। সংগ্রহ করা কাঠগুলো দিয়ে তা-ও বানিয়ে ফেলল তারা চারজন।
ছাদে উঠে কোন জায়গা দিয়ে নেমে সৈকতের কোন অংশ দিয়ে নৌকা ভাসালে কেউ দেখতে পাবে না তা-ও তারা রেকি করে রেখেছিল হাতে বানানো একটা পেরিস্কোপ দিয়ে, যা তারা সেই ওয়ার্কশপেই বানায়!
সব প্রস্তুতি শেষ। এবার আসল কাজটা করার পালা। চিন্তা-ভাবনা করে তারা ঠিক করল, ১১ জুনই হবে পালানোর জন্য সবচেয়ে ভালো দিন।
১১ তারিখ রাতে রুটিনমাফিক সেল চেক শেষ হয়েছে। সব বন্দী সেলের ভেতর, এবং অনেকেই হয়তো এরই মধ্যে ঘুমের রাজ্যে চলে গেছে। জন ও ক্লারেন্স অ্যাংলিন, ফ্রাংক মরিস ও অ্যালেন ওয়েস্ট, এই চারজনেরও ঘুমাবারই কথা এখন, কিন্তু তারা তা না করে শুরু করল পালানোর শেষ ধাপের বাস্তবায়ন।
প্রথমেই ভেন্টিলেটরে গা গলিয়ে দেওয়ার সহজ কাজ। সহজ কাজটা সহজভাবেই করল নিজ নিজ সেল থেকে বাকি তিনজন, অ্যালেন ওয়েস্ট কাজটা কঠিন করে আর বেরোতে পারল না ভেন্টিলেটর বেয়ে। অধৈর্য হয়ে শেষমেষ ওয়েস্টকে রেখেই রওয়ানা করল বাকি তিনজন ওপরের ওয়ার্কশপের দিকে।
পরিকল্পনা মতো অ্যাংলিন ভ্রাতৃদ্বয় ও মরিস সেল ব্লকের ওপরের ভেন্টিলেটর শ্যাফট বেয়ে চলে আসে ছাদে। সময় তখন প্রায় রাত দশটা। ঠিক এ সময়েই তারা শ্যাফটের ঢাকনাটা এক ধাক্কায় উপড়ে ফেলে ছাদে উঠে আসে। ঠিক একইসময়ে নিরাপত্তারক্ষীরা ঠাস করে কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দ শুনেছিল বটে, তবে পরে কোনো শব্দ না শোনায় আর গা করেনি।
তারা আগেই ঠিক করে রেখেছিল যত দ্রুত সম্ভব জেলের ব্লাইন্ড স্পটে পৌঁছাতে হবে। জায়গাটা দ্বীপের উত্তর-পূর্ব পাড়, যার পাশেই রয়েছে একটা পাওয়ার প্ল্যান্ট। এখান দিয়েই নৌকা ভাসাতে হবে, কারণ এখানে খানিকটা অন্ধকার, সার্চলাইটের আলো একটু কম আসে।
ছাদের সাথে থাকা রান্নাঘরের পাইপ বেয়ে তারা নিচে নেমে এলো। এখনও আরেকটা বাধা বাকি, জেলের কাঁটাতারের বেড়া। সেটিও খুব দ্রুততার সাথে পার করে ফেলল তিন ফেরারি।
এর সাথে সাথে তারা পৌঁছে গেল ব্লাইন্ড স্পটে , যেটা তাদের স্বাধীনতার চাবিকাঠি। ভাসিয়ে দিল তারা নৌকা, গন্তব্য সানফ্রান্সিসকো বে পার করে স্থলভাগ।
পালানোর পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ
শীঘ্রই তদন্ত করতে শুরু করল এফবিআই, ইউএস মার্শাল ও অন্যান্য তদন্ত সংস্থাগুলো। তারা সকল কারারক্ষীকে জেরা করল, সাথে অ্যালান ওয়েস্টকেও পাকড়াও করলো। পুরো সানফ্রান্সিসকো বে জুড়ে সার্চ টিম চষে বেড়াতে লাগল, কিন্তু তিন ফেরারির খোঁজ পাওয়া গেল না। এরই মাঝে অ্যালান ওয়েস্টকে একটু চাপ দিতেই বের হয়ে আসল ঘটনা।
অ্যালেন ওয়েস্ট পরিকল্পনার সবটাই জানায়। সে এ-ও দাবি করে যে পুরো পরিকল্পনাটা নাকি তারই ছিল!
ওয়েস্ট বলে, যখন সে ছাদে শেষমেষ পৌঁছেছিল ততক্ষণে বাকি সবাই রওয়ানা দিয়ে দিয়েছে। তাই সে আবার সেলে ফিরে আসে। তাদের পরিকল্পনাটা ছিল এরকম, হাতে বানানো নৌকায় প্রয়োজনীয় জিনিসপাতি সাথে নিয়ে তারা প্রথমে যাবে কাছে থাকা অ্যাঞ্জেল দ্বীপের দিকে। সেখানে কিছু সময় বিশ্রাম নিয়ে তারা ওই দ্বীপের বিপরীত দিক থেকে যাত্রা শুরু করবে মেরিন কাউন্টির দিকে। মেরিন কাউন্টি দ্বীপ থেকে বেশি দূরে না। সেখানে পৌঁছে তারা একটা গাড়ি ও কিছু কাপড় চুরি করে পালিয়ে যাবে।
পরিকল্পনার এই বিবরণ শুনে মেরিন কাউন্টিতে লোক লাগিয়ে দেওয়া হলো। কিন্তু পরবর্তী ১২ দিনের মধ্যে এরকম কোনো চুরির হদিস সেখানে পাওয়া যায়নি। তিন ফেরারিকেও কেউ দেখেনি। তারা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল!
এরই মাঝে পরের দুই সপ্তাহে এমন কিছু প্রমাণ পাওয়া যায় যা বলে তাদের যাত্রা সফল হয়নি। যেমন ১২ জুনে একটা হাতে বানানো বৈঠা পাওয়া যায় অ্যাঞ্জেল আইল্যান্ডের কাছে যা ওই তিনজনের বানানো বলে বোঝা যায়। ১৪ জুন আলকাট্রাজ ও অ্যাঞ্জেলের মাঝামাঝি রেইনকোটের বানানো কিছু ব্যাগ খুঁজে পাওয়া যায়। ব্যাগগুলোতে ছিল অ্যাংলিন পরিবারের ছবি ও হাতে লেখা চিঠি। ১৫ জুনে কাছের একটা সৈকতে পাওয়া যায় একটা লাইফভেস্ট যা তাদের বলে প্রমাণিত হয়। এমনকি ঘটনার দশ দিনের মাথায় আলকাট্রাজের খুবই কাছে তাদের আরেকটি ভেস্ট পাওয়া যায়। ছয় সপ্তাহ পর একটা লাশ ভাসতে দেখা যায় সানফ্রান্সিসকো বেতে, যদিও তা ওই তিনজনের কারো কি না তা বোঝা যায়নি।
পরীক্ষা করে জানা যায়, তারা যদি সানফ্রান্সিসকো বে-র হিমশীতল পানিতে ডুবে যেত তাহলে সর্বোচ্চ দুই ঘন্টা বাঁচতে পারত। তীব্র স্রোত ও ঠান্ডা পানির কারণে এর মধ্যে তাদের তীরে পৌঁছানোর সম্ভাবনা খুবই কম।
অ্যালেন ওয়েস্ট তার বাকি সাজা তিনটি আলাদা কারাগারে থেকে সম্পন্ন করে। যদিও ১৯৬৭ সালে ছাড়া পাবার পর মাত্র একবছর সে বাইরে ছিল। আবার সে নানা অভিযোগে গ্রেপ্তার হয় ও শেষমেষ ১৯৭৮ সালে তার মৃত্যু ঘটে।
এফবিআই ১৯৭৯ সালে তিনজনের হদিস না পেয়ে অমীমাংসিতভাবে তদন্ত বন্ধ করে দেয়। যদিও ইউএস মার্শাল তখনও হাল ছাড়েনি। তারা তদন্ত চালু রাখতে চায় ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ না পালানো তিনজন গ্রেপ্তার হচ্ছে, তাদের মৃত্যুর সঠিক প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে অথবা তাদের বয়স কমপক্ষে ৯৯ বছর হচ্ছে।
অতঃপর মুদ্রার উল্টোপিঠ
২০১০ সালে অ্যাংলিনদের এক ভাই রবার্ট দাবি করে, তার সাথে অ্যাংলিনদের যোগাযোগ ছিল ১৯৬৩ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত। একইভাবে ২০১২ সালে অ্যাংলিনদের এক বোন দাবি করে তারা জন অ্যাংলিনদের থেকে ফোনকল পেয়েছে। এমনকি তারা নাকি ক্রিসমাস কার্ডও পেয়েছে অ্যাংলিনদের থেকে। তাদেই ভাতিজা ডেভিড আরো অদ্ভুত একটা তথ্য সামনে নিয়ে আসে। তাদের দাদিমা নাকি প্রতিবছরই অ্যাংলিনদের স্বাক্ষরসহ গোলাপ ফুল পেত। কিন্তু এসব তথ্যের সত্যতা পায়নি এফবিআই কিংবা অন্য তদন্তকারী সংস্থাগুলো।
সবাই হয়তো এই জেল পালাবার ঘটনা ভুলেই যেত যদি না একটি চিঠি হঠাৎই পুলিশের কাছে না আসত। ২০১৩ সালের দিকে একদিন অনেকটা চমকপ্রদভাবে সানফ্রান্সিসকো পুলিশের কাছে একটি হাতে লেখা বেনামি চিঠি আসে। চিঠিতে এক ব্যক্তি নিজেকে জন অ্যাংলিন বলে দাবি করে বলে, সেই রাতে তারা সবাই পালাতে পেরেছিল!
আমার নাম জন অ্যাংলিন। আমি ১৯৬২ সালের জুন মাসে আমার ভাই ক্লারেন্স ও ফ্রাংক মরিসের সাথে আলকাট্রাজ থেকে পালাই। বর্তমানে আমার বয়স ৮৩ বছর এবং আমি খুব অসুস্থ। আমার ক্যান্সার হয়েছে। হ্যাঁ, আমরা সেদিন সফলভাবে পালিয়েছিলাম, তবে অক্ষতভাবে না।
চিঠিতে এটাও লেখা ছিল যে, তার দুই সাথী মরিস ও ক্লারেন্স যথাক্রমে ২০০৮ ও ২০১১ সালে মারা যায়।
যদি আপনারা কথা দিন আমাকে অল্প সময়ের জন্য জেলে নিয়ে চিকিৎসা দেবেন, তাহলেই একমাত্র ফিরতি চিঠি দিয়ে আমি আপনাদের আমার অবস্থান জানাব। এবং হ্যাঁ, চিঠিটা নিছক ঠাট্টা না, সিরিয়াস।
এরপর হঠাৎই ২০১৫ সালে একটি ছবি ছড়িয়ে পড়ে। ছবিটি নাকি অ্যাংলিন ভাইদের! এক ব্যক্তি বলে সে এই ছবি ব্রাজিলের একটি ফার্মে তুলেছিল পালানোর কয়েক বছর পর।
চিঠি কিংবা ছবি- কোনোটারই সত্যতা পাওয়া যায়নি। তদন্ত সংস্থাগুলো মনে করে এগুলো ভাওতাবাজি।
আলকাট্রাজের পরিণতি
১৯৬৩ সালে প্রায় ৩০ বছর চলার পর আলকাট্রাজ বন্ধ হয়ে যায়। না, জেল পালাবার এ ঘটনার কারণে নয়, বরং উচ্চ খরচের কারণে। প্রকৃতপক্ষে এই ঘটনার অনেক আগে থেকেই তা বন্ধের চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছিল। আলকাট্রাজ নিকটবর্তী উপকূল থেকে প্রায় মাইলখানেক দূরে থাকায় খাবার, পানি থেকে শুরু করে সবকিছুই নৌকায় করে আনতে হতো। এতে প্রতিদিন বিশাল একটা খরচ হতো যা অন্য কোনো কারাগার থেকে অন্তত তিনগুণ বেশি।
পরিত্যক্ত হয়ে যায় আলকাট্রাজ। তবে কালক্রমে আমেরিকা সরকার উদ্যোগ নেয় জায়গাটি সংরক্ষণ করার। বর্তমানে তাই একে একটা পর্যটন স্থান হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। বহু মানুষ প্রতিনিয়ত এখানে বেড়াতে আসেন। এমনকি প্রতি বছর এখানে ‘এস্কেপ ফ্রম আলকাট্রাজ’ নামক একটা অদ্ভূত প্রতিযোগিতাও আয়োজন করা হয়ে থাকে। নানা রকমের মানুষ সেখানে অংশ নেন। তাদেরকে সাঁতরে পাড়ে এসে প্রমাণ করতে হয় যে আলকাট্রাজ থেকে পালানো সম্ভব। প্রতিযোগিতার উদ্দেশ্যেও সেটাই দেখানো।
সিনেমার পর্দায় আলকাট্রাজ পলায়ন
জেল পালাবার এই রোমাঞ্চকর কাহিনী শুধু বাস্তবেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। হয়েছে সেলুলয়েডের ফিতায় বন্দী। ১৯৭৯ সালে যে বছর এফবিআই হাল ছেড়ে দিয়ে কেস স্থগিত করে দেয়, সে বছরেই এ কাহিনী নিয়ে তৈরি হয় সিনেমা, নাম এস্কেপ ফ্রম আলকাট্রাজ। সেই সিনেমায় আবার অভিনয় করেন কিংবদন্তি অভিনেতা ক্লিন্ট ইস্টউড।
আসলেই তো আলকাট্রাজের এই আখ্যান সিনেমার মতো। একটুখানি বাস্তব, আর অনেকটা রহস্য।