প্রুশিয়া থেকে জার্মানি (পর্ব-৪১): প্রথম স্লেশউইগ-হোলস্টেইন যুদ্ধ

রণপ্রস্তুতি

২৫ মার্চ, ১৮৪৮।

কোপেনহেগেন থেকে ড্যানিশ সেনাদলের যাত্রার আদেশ প্রেরিত হলো। ডেনমার্ক তখন পর্যন্ত সেনাবাহিনীর পুনর্গঠন পুরোপুরি শেষ করে উঠতে পারেনি, তবে তাদের নৌবাহিনী যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল। এদিকে আবার প্রুশিয়াসহ জার্মান রাজ্যগুলোর দুর্বলতা আছে।

কোপেনহেগেনের আদেশের মূল লক্ষ্য ছিল দক্ষিণ ডেনমার্কে কল্ডিং বন্দরের সেনাদের প্রস্তুত করা। কল্ডিং ফিওর্ডের (ফিওর্ড- দুধারে খাড়া পাহাড় বেষ্টিত সরু জলপথ) তীরবর্তী এই বন্দর কৌশলগত দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ। দ্বিতীয় আরেকটি আদেশ কয়েকদিন পরেই বাল্টিক সাগরের ড্যানিশ দ্বীপ আলসে এসে পৌঁছে। মূলত এই দুই স্থান থেকেই ড্যানিশ জাহাজ সেনাদের নিয়ে স্লেশউইগ-হোলস্টেইনের দিকে যাবার পরিকল্পনা ছিল। ড্যানিশ রাজা এমনকি প্রুশিয়ার হস্তক্ষেপও কামনা করেন যাতে শান্তিপূর্ণভাবে স্লেশউইগ-হোলস্টেইন প্রশ্ন সমাধান করা যায়। কিন্তু তার চাওয়া আর প্রুশিয়ানদের চাওয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং কোনো পক্ষই ছাড় দিতে রাজি ছিল না। ফলে ফ্রেডেরিক আলোচনার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।

ফিওর্ড; image source: fjords.com

রেন্সবোর্গের ঘটনা জানতে পেরে ডেনমার্ক দ্রুত পদক্ষেপ নেবার ফয়সালা করল। জার্মানি থেকে কোনো সহায়তা এসে পৌঁছানোর আগেই বিদ্রোহীদের দমন করে স্লেশউইগ অধিকার করবার সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বিদ্রোহীরাও বেশ বুঝতে পারছিল একার পক্ষে ড্যানিশদের ঠেকানো হবে অসম্ভব কঠিন। ফলে ২৮ মার্চেই তারা ফ্রাঙ্কফুর্টের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি’তে জার্মান কনফেডারেশনে স্লেশউইগের অন্তর্ভুক্তির অনুরোধ জানায়। প্রুশিয়ার রাজার কাছেও তারা সামরিক সাহায্যের আবেদনও করে। এপ্রিলের ২ তারিখ অ্যাসেম্বলিতে তুমুল করতালির মধ্যে স্লেশউইগ-হোলস্টেইনের সুরক্ষায় প্রুশিয়ার সেনাবাহিনীকে মাঠে নামানোর প্রস্তাব দেন ফ্রেডেরিক। দুই দিনের মাথায় তার প্রস্তাব নিরঙ্কুশভাবে পাশ হয়ে যায়। এপ্রিলের ৪ তারিখ কম্যান্ডার ক্রোনের নেতৃত্বে প্রুশিয়ান একটি বাহিনী হোলস্টেইনের দিকে এগিয়ে এলো। জার্মান কনফেডারেশন বাহিনীর প্রস্তুতি তখনো শেষ হয়নি।

ইত্যবসরে স্লেশউইগ-হোলস্টেইনের বিদ্রোহীদের বাহিনী রেন্সবোর্গ দুর্গকে মূল ঘাঁটি বানিয়ে অগ্রসর হলো উত্তরে। সেখানে জেনারেল ক্রোন একদল সেনা নিয়ে ফ্লিন্সবোর্গ ফিওর্ডের বভ গ্রামে শিবির করলেন। এখান দিয়ে ড্যানিশ সেনাদের আগমনের সম্ভাবনাই ছিল সবথেকে বেশি। তিনি অপেক্ষা করতে লাগলেন শত্রুদলের।

যুদ্ধের সূচনা

বভের পূর্বে ড্যানিশ সেনারা অবতরণ করে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহেই। তাদের সংখ্যাধিক্যে বিচলিত ক্রোন আশঙ্কা করলেন তিনি চারদিকে শত্রু দিয়ে ঘিরে যেতে পারেন। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে পিছিয়ে গিয়ে সুবিধাজনক কোনো জায়গাতে অবস্থান নেবার জন্য তার করা আবেদন মঞ্জুর হলো। কিন্তু ড্যানিশরা তাকে সেই সুযোগ দিল না। এপ্রিলে ৯ তারিখ সকালে তারা আক্রমণ করে বসে। তাদের বাম বাহু ক্রোনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। এটি ছিল একটি কৌশল। ড্যানিশ কমান্ডার চাইছিলেন এভাবে ক্রোনকে ব্যস্ত রেখে নিজেদের ডানবাহুর ইনফ্যান্ট্রি আর অশ্বারোহী সেনাদের দিয়ে বিদ্রোহীদের বেষ্টন করে নিকেশ করে ফেলার।

ক্রোনের উপর ড্যানিশ আক্রমণ; image source: davedoeshistory.com

পরিকল্পনা পুরোপুরি কাজে দিল না। ব্যাটল অফ বভে পরাস্ত হলেও ক্রোন বেশিরভাগ সৈন্য নিয়ে পিছিয়ে যেতে পারলেন। এদিকে দক্ষিণ দিক থেকে প্রুশিয়ান এবং জার্মান যৌথ বাহিনী এগিয়ে আসতে থাকে। সবাইকে একবারে মোকাবেলা করা সম্ভব না বুঝে ডেনমার্ক সময়ক্ষেপণের কৌশল ধরতে চাইল। তারা প্রুশিয়ার সাথে আবারো মিটমাট করার চেষ্টা করে। এই সময়ের ভিতরে নিজেদের সেনাশক্তি বৃদ্ধি এবং স্লেশউইগে ড্যানিশ অবস্থান শক্ত করার দিকে মনোযোগ দেয়। কিন্তু প্রুশিয়া এবারো তাদের ফিরিয়ে দিলে ১৮ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে ডেনমার্ক প্রুশিয়া এবং জার্মান কনফেডারেশনের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।   

জার্মান অগ্রাভিযান

স্লেশউইগ শহর, যাকে ঘিরে ডাচি গড়ে উঠেছে, তার পশ্চিমে ড্যানিশ সেনাক্যাম্প ছিল। সেনাক্যাম্পের অবস্থান বেশ শক্তিশালী। এর দক্ষিণে ড্যানিশদের দুর্গবেষ্টিত সুরক্ষিত ঘাঁটি ডেনভির্ক। জার্মান কনফেডারেশন বাহিনী এদিকেই আসছিল। ফলে ড্যানিশ সেনাদের দায়িত্ব দেয়া হয় তাদের থামানোর অথবা দেরি করিয়ে দেয়ার। পরিকল্পনা ছিল নিজেদের যতটা সম্ভব সুরক্ষিত রেখে ড্যানিশরা ধীরে ধীরে পিছিয়ে যাবে আলস দ্বীপ বরাবর। আলস এবং তার পার্শ্ববর্তী ফুনেন দ্বীপে অতিরিক্ত সেনা জমায়েত হচ্ছিল। শত্রুদের উপযুক্ত সময়ে সেদিকে টেনে নিয়ে দুই পাশ থেকে হামলা করা হবে।

কিন্তু বিধি বাম। ২৩ এপ্রিল প্রুশিয়ানদের একটি দল স্লেশউইগের কাছে ড্যানিশদের আক্রমণ করে। তুমুল যুদ্ধের পর ড্যানিশরা বাধ্য হয় উত্তরে সরে যেতে। পথিমধ্যে ফ্লিন্সবোর্গে অবস্থান করাকালে উত্তর দিক থেকে জার্মান যৌথ বাহিনী অতর্কিতে নিকটবর্তী ড্যানিশ চৌকিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তুমুল বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়, ফলে ড্যানিশ সেনারা দ্রুতই ফ্লিন্সবোর্গ ত্যাগ করল। হাই কমান্ড এবার বভ থেকেও সেনা সরিয়ে নিয়ে আলসে সবাইকে একত্রিত করল। মধ্য জাটল্যান্ডে কিছু অশ্বারোহী, আর্টিলারি আর ইনফ্যান্ট্রি রাখা হলো। এদের কনফেডারেশন সেনারা তাড়িয়ে নিয়ে যায় জাটল্যান্ডের পূর্ব উপকূলে সুনেভু (Sundeved) উপদ্বীপ অবধি। তারা আলসের নিকটবর্তী ডুবেল (Dybbøl) শহরের পাহাড়ে ঘাঁটি করে। প্রুশিয়ান আর স্লেশউইগ-হোলস্টেইন বাহিনী ওদিকে উত্তরদিক থেকে ডেনমার্কের দিকে এগিয়ে আসছিল।

জাটল্যান্ডের দ্বীপগুলো © NordNordWest

চারদিক থেকে চাপা খেয়ে ড্যানিশ কমান্ড নতুন পরিকল্পনা সাজাল। তাদের সুবিধা ছিল নৌবাহিনী। জাহাজের মাধ্যমে সহজেই বিভিন্ন জায়গায় সেনা আর অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করা সম্ভব ছিল। এমনকি ১৮৪৮ সালের বসন্তে ড্যানিশ নৌবহর উত্তর জার্মানির কয়েকটি বন্দরে অবরোধ পর্যন্ত জারি করে। তবে এই মুহূর্তে ড্যানিশ সমরবিদরা ঠিক করলেন কল্ডিং থেকে সেনারা ডেনমার্কের সীমানা বরাবর প্রতিরক্ষার কাজ করবে, আর আলস থেকে জাটল্যান্ডে প্রবেশ করা শত্রুদের পার্শ্বভাগে আক্রমণ করা হবে। তাদের লক্ষ্য ছিল সময় আদায় করে নেয়া, যাতে ড্যানিশ সেনাদলের পুনর্গঠন সম্পন্ন করে পূর্ণাঙ্গ ও শক্তিশালী বাহিনী দিয়ে শত্রুদের তছনছ করে দেয়া যায়।

এদিকে মে মাসের শুরুতে প্রুশিয়ানরা ড্যানিশদের সকল চেষ্টা খড়কুটোর মতো উড়িয়ে দিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে। জার্মান বন্দরে অবরোধের প্রতিশোধ হিসেবে তারা অধিকৃত অঞ্চলের ড্যানিশ বাসিন্দাদের উপর কর ধার্য করল। জার্মানদের হাতে ড্যানিশদের মার খাবার খবরে জার্মান ডায়েটে চলছিল জাতীয়তাবাদী আর লিবারেল শক্তির উল্লাস। 

অন্যান্য শক্তির হস্তক্ষেপ

রাশিয়াতে বসে জার নিকোলাস ফুঁসছিলেন। তিনি বিয়ে করেছিলেন ফ্রেডেরিকের বোন শার্লটকে। তার ভ্রাতৃস্থানীয় হয়ে ফ্রেডেরিক কী করে লিবারেলদের সাথে হাত মেলালেন! তিনি ভয় পাচ্ছিলেন ডেনমার্কে বিজয়ী হলে প্রুশিয়া ইউরোপে রাশিয়ান স্বার্থের ব্যাপারে হুমকি হয়ে ওঠে কিনা। নিকোলাস তাই হুমকি দিলেন, ডেনমার্ক থেকে সরে যাও, নাহলে আমি আসছি সৈন্যসামন্ত নিয়ে। স্বভাবতই প্রুশিয়া থমকে গেল। ডেনমার্কের সাথে লড়তে এসে রাশিয়ার সাথে মারামারি করার কথা তো ছিল না। ফলে তাদের সেনারা অগ্রাভিযান বন্ধ করে দেয়। জার্মান কম্যান্ডারদেরও পিছিয়ে আসতে বলা হলো।

ওদিকে রাশিয়ার কাণ্ডে ইংল্যান্ডে সৃষ্টি হলো চাঞ্চল্য। তবে কি স্লেশউইগ-হোলস্টেইন ঘিরে রাশিয়া বাল্টিকে নিজেদের পুতুল সরকার বসাতে চাইছে? ডেনমার্ক বাল্টিকের দিকের রাস্তা নিয়ন্ত্রণ করে বলে লন্ডনের উদ্বিগ্ন হবার যথেষ্ট কারণ ছিল। ফ্রান্সও ডেনমার্কের পক্ষ নেয়। সুইডেন আর নরওয়ের একদল সেনাও আলসে ড্যানিশদের সাথে যুক্ত হলো।

২৮ মে ড্যানিশরা আলস থেকে বেরিয়ে এলো, চকিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল ডুবেলে জার্মান অবস্থানের উপর। জার্মান বাহিনী পিছিয়ে গেলে ডুবেল আর তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল ধরে ড্যানিশ আধিপত্য কায়েম হয়। এখান থেকে স্লেশউইগে আক্রমণ করা সহজ হয়ে যায়। জুনের ৫ তারিখ জার্মান প্রতি-আক্রমণের চেষ্টাও ড্যানিশরা ব্যর্থ করে দেয়।

জার্মান আর ড্যানিশ সংঘর্ষ; image source: Wikimedia Commons

১৮৪৮ সালের অস্ত্রবিরতি

বহিঃশক্তির চাপে পড়ে প্রুশিয়া অস্ত্রবিরতিতে সম্মত হয়। আগস্টের ২৬ তারিখ সুইডেনের মাল্মো শহরে ডেনমার্কের সাথে পরের বছরের ২ এপ্রিল পর্যন্ত লড়াই বন্ধ রাখার চুক্তি হলো। এই সময়ের মধ্যে ইউরোপিয়ান শক্তিগুলো আলোচনার মাধ্যমে সংঘাত নিরসনের চেষ্টা করবে। শর্ত মোতাবেক স্লেশউইগ থেকে সব পক্ষের সশস্ত্র বাহিনী সরিয়ে নেয়া হলো, তবে আলসে ড্যানিশ ঘাঁটি থেকে যায়। স্লেশউইগ-হোলস্টেইনের শাসন পরিচালনা করতে ডেনমার্ক ও প্রুশিয়ার একটি যৌথ সরকার দায়িত্ব নেয়।  

প্রুশিয়ার অস্ত্রবিরতি স্বাক্ষরে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে লিবারেল আর জাতীয়তাবাদীরা বিশাল শোরগোল তুলল।কারণ প্রুশিয়া এই কাজ করেছিল ডায়েটের অনুমোদন ছাড়াই। ৫ সেপ্টেম্বর ভোটে উত্তেজিত সদস্যরা চুক্তি প্রত্যাখ্যান করে। কিন্তু আদতে প্রুশিয়াকে কোনো কাজে বাধ্য করার ক্ষমতা বা সামর্থ্য ডায়েটের ছিল না। কাজেই মাথা ঠাণ্ডা হলে ১৬ তারিখের দ্বিতীয় ভোটে তারা চুক্তি অনুমোদন করে নেয়। তবে জনতাকে বোঝানো যাচ্ছিল না। ফ্রাঙ্কফুর্টে দাঙ্গা বেধে যায় এবং দুজন লিবারেল ডেপুটি উত্তেজিত জনতার হাতে নিহত হন।   

ডেনমার্কের প্রতিক্রিয়া

চুক্তির শর্ত নিয়ে জার্মানির মতো ডেনমার্কও খুশি ছিল না। কাজেই অস্ত্রবিরতি প্রলম্বিত করবার কোনো চেষ্টা তারা করেনি। বরঞ্চ নিজেদের সামরিক শক্তি বাড়াতে থাকে। ১৮৪৮ সালের নতুন আইনে আগে যেসব লোক সামরিক বাহিনীতে জায়গা পেত না তাদের সেনা প্রশিক্ষণ নেবার বাধ্যবাধকতা জারি হয়। পরের বছরের বসন্তে সব ড্যানিশ পুরুষের বাধ্যতামুলক সামরিক দায়িত্ব পালনে ফরমান জারি হলো। তারা নতুন নতুন জাহাজও নৌবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করে। ড্যানিশ অবরোধে জার্মান রাষ্ট্রগুলোতে প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির সমস্যা দেখা দেয়। চেষ্টা করেও তারা ড্যানিশদের নৌশক্তিকে পরাজিত করতে পারল না।

১৮৪৯ সালের ঘটনাপ্রবাহ

দোসরা এপ্রিল যুদ্ধবিরতি ফুরোবার পরপরই কনফেডারেশন আর প্রুশিয়ান বাহিনী স্লেশউইগের দিকে যাত্রা করে। তাদের ঠেকাতে কিয়েলের উত্তরপূর্বে বাল্টিকের তীরবর্তী শহর একেনফোর্ডে ড্যানিশরা সমবেত হয়। এখানে স্থল ও জলপথে থেকে হামলার উদ্দেশ্য থাকলেও জার্মানদের আক্রমনে ড্যানিশরা পশ্চাদপসরণ করে। তাদের দুটি নতুন জাহাজ ডুবে যায়। এর ফলে জার্মানিতে যখন উল্লাস চলছিল, ডেনমার্কে তখন শোকের আবহ।

১৩ এপ্রিল কনফেডারেশন বাহিনী ডুবেলের দুই পাশে অবস্থান নেয়। ২০ এপ্রিল স্লেশউইগ-হোলস্টেইনের বিদ্রোহীরা হঠাৎ করে কল্ডিং আক্রমণ করে ড্যানিশদের পরাস্ত করে। কল্ডিং ব্যবহার করে তারা জাটল্যান্ডের ভেতরে ঢুকে পড়ে। তিন দিন পর কল্ডিং উদ্ধারে চালানো অভিযান ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলে জাটল্যান্ডের ড্যানিশ সেনারা আরো উত্তরে সরে গিয়ে ফ্রেডেরিসিয়া দুর্গে ঘাঁটি করে। বহিঃশক্তির চাপে আবারও জার্মান অগ্রাভিযান থেমে যায়। প্রুশিয়ানরা মধ্য জাটল্যান্ড, আর কনফেডারেশন বাহিনী স্লেশউইগে অলস সময় কাটাতে থাকে। কেবল স্লেশউইগ-হোলস্টেইনের সেনারা নতুন উদ্যমে ফ্রেডেরিসিয়া অবরোধ করে বসে।

ড্যানিশ সেনানায়কেরা চূড়ান্তভাবে এই লড়াই শেষ করতে চাইলেন। ত্রিমুখী পরিকল্পনা প্রণীত হলো। একদল সৈন্য প্রুশিয়ানদের টেনে নিয়ে যাবে জাটল্যান্ডের আরো ভেতরে, আর একদল ডুবেলের জার্মানদের আটকে রাখবে। বাকিরা ফ্রেডেরিসিয়াতে বিদ্রোহীদের ব্যস্ত রাখবে। ইত্যবসরে জাটল্যান্ড আর আশেপাশের এলাকা এবং ফুনেন দ্বীপ থেকে সাগরপথে সব সেনা ফ্রেডেরিকাতে নামানো হবে। তারপর বিদ্রোহীদের উপর হানা হবে মরণ আঘাত।

পরিকল্পনা প্রথমে ভালই ফল দিল। অনেক সেনা ফ্রেডেরিসিয়াতে জড়ো করা হয়। আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান ড্যানিশ কম্যান্ডার ৬ জুলাই অবরোধ ভাঙার জন্য স্লেশউইগ-হোলস্টেইন বাহিনীর উপর হামলা করে তাদের পরাজিত করেন। কিন্তু দু’পক্ষেই প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়, এবং ড্যানিশরা যেমন আশা করেছিল সেরকম করে শত্রুবাহিনী তারা ধ্বংস করে দিতে পারেনি। পিছিয়ে গেলেও বিদ্রোহীদের লড়াই করার সক্ষমতা নির্মূল হলো না। কয়েকদিন পর রাশিয়ানদের চাপে প্রুশিয়া আবারো যুদ্ধবিরতিতে বাধ্য হয়, যা বজায় ছিল ১৮৫০ সালের গ্রীষ্ম পর্যন্ত। এর ফাঁকে ফাঁকেই শান্তি আলোচনা চলতে থাকে। এর মধ্যে শর্ত মোতাবেক স্লেশউইগের কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকে ড্যানিশ-প্রুশিয়ান-ব্রিটিশ যৌথ কমিশন। শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার কথা বলে উত্তর স্লেশউইগে শিবির করে সুইডেন আর নরওয়ের সেনারা।

১৮৫০-৫১ সালের ঘটনাপ্রবাহ

শান্তি আলোচনা চলছিল অস্থিরতার মধ্য দিয়ে। জার্মানিতে ক্ষমতার স্বার্থে অস্ট্রিয়া প্রুশিয়া মুখোমুখি অবস্থানে। কাজেই দ্রুত স্লেশউইগ-হোলস্টেইন সমস্যা নিরসনে ফ্রেডেরিক প্রস্তাব দিলেন যুদ্ধের পূর্ববৎ অবস্থায় ফেরত যাওয়ার। ইংল্যান্ডের তরফ থেকে আলোচনায় অংশগ্রহণকারী লর্ড পামারস্টোন একে কোনো সমাধান বলে মনে করলেন না। এদিকে সমস্যার দীর্ঘসূত্রিতায় জার নিকোলাস প্রচন্ড বিরক্ত। ১৭৭৩ সালের জারস্কি সেলো (Treaty of Tsarskoye Selo) চুক্তিতে রাশিয়া স্লেশউইগকে ডেনমার্কের নিয়ন্ত্রণে রাখার অঙ্গীকার করেছিল। হোলস্টেইনও তাদের অন্তর্ভুক্ত হবে বলে নিকোলাস আশা প্রকাশ করেন। নাহলে তিনি বাধ্য হবেন লোকলস্কর নিয়ে ময়দানে নামতে। কাজেই ২ জুলাই বার্লিনে প্রুশিয়ার কথামত ১৮৪৮ সালের পূর্ববর্তী অবস্থাই মেনে নেয়া হল। এছাড়া ডেনমার্কে লিবারেল ক্ষমতা খর্ব করে পুনরায় নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ইউরোপিয়ান শক্তিগুলো সম্মত হয়। স্লেশউইগে বিদ্রোহীদের দমনের দায়িত্ব নেন ডেনমার্কের রাজা। আর হোলস্টেইনের বিদ্রোহীদের অস্ত্র সমর্পণে প্রুশিয়ান সাহায্য চাওয়া হলো। স্বাভাবিকভাবেই স্লেশউইগ-হোলস্টেইন এই চুক্তি প্রত্যাখ্যান করে।

জুলাই মাসের মাঝামাঝি স্লেশউইগ-হোলস্টেইন বাহিনী স্লেশউইগ শহরের দক্ষিণে ইডস্টেইডটে (Idstedt) অবস্থান নেয়। এখানে ২৪ জুলাই মধ্যরাতের পর থেকে ২৫ জুলাই পর্যন্ত ড্যানিশ বাহিনীর সাথে প্রচণ্ড সংঘর্ষ চলে (ব্যাটল অফ ইডস্টেইডট)। ভোররাতে আক্রমণ করে ড্যানিশরা বিদ্রোহীদের পেছনে ঠেলে দেয়। কিন্তু সকালে কুয়াশা আর বৃষ্টিতে তাদের আক্রমণ বাধাগ্রস্ত হলো।

ফাঁক পেয়ে বিদ্রোহীরা শহরের কাছে স্টক গ্রাম থেকে ড্যানিশদের উচ্ছেদ করে ইডস্টেইডটের দিকে এগিয়ে আসে। ডেনমার্কের সেনাদের পাল্টা আক্রমণে তারা পেছাতে বাধ্য হয়। একপর্যায়ে বিদ্রোহীরা যখন কামান নতুন অবস্থানে মোতায়েনে ব্যস্ত সেই সুযোগে ড্যানিশ ইনফ্যান্ট্রি তুমুল বেগে তাদের লাইনে চার্জ করে। প্রবল লড়াইতে অবশেষে বিদ্রোহীদের মধ্যভাগ ভেঙে পড়ল। কিন্তু এবারও ড্যানিশরা তাদের পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করতে সমর্থ হলো না, বরং সেই চেষ্টা করতে গিয়ে অশ্বারোহীরা ব্যর্থ হয়। বিদ্রোহীরা নিরাপদে পিছিয়ে যায়। ডেনমার্ক স্লেশউইগ শহর অধিকার করে নিল।

ব্যাটল অফ ইডস্টেইডট; image source: garderforeningerne.dk

প্রুশিয়ার সাথে ডেনমার্কের চুক্তির পর জার্মানি থেকেও বিদ্রোহীরা আর কোনো সাহায্য পাচ্ছিল না। ফলে তাদের মধ্যে নৈরাশ্য দেখা দেয়। সেপ্টেম্বর আর অক্টোবরে  মিসাণ্ড দুর্গ আর ফ্রিড্রিখস্টাডট শহরের আক্রমণেও তারা বিফল হলো। ব্যর্থ মনোরথে তারা রেন্সবোর্গ ফিরে যায়। সেখানে অভিযান চালানোর ইচ্ছা ডেনমার্কের ছিল না, কারণ এতে করে হোলস্টেইনে ঢুকতে হবে। তাহলে প্রুশিয়া আবার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে এবং তখন ইউরোপিয়ান শক্তিগুলোও ডেনমার্কের বিপক্ষে চলে যাবার সম্ভাবনা আছে। ফলে ১৮৫০-৫১ সালের শীতকাল ড্যানিশ সেনারা ডেনভির্কে কাটিয়ে দিল।

সমাপ্তি

ডেনমার্কে নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় পরাশক্তিগুলির চাপ ছিল। ফলে নবোদ্যমে বলীয়ান ড্যানিশ রাজা লিবারেল মন্ত্রীসভার বিরুদ্ধে লাগলেন। ১৮৫১ সালে তাদের বিদেয় করে দেয়া হয়, সেখানে রক্ষণশীল মন্ত্রীসভা দায়িত্ব নেয়। রাজার একচ্ছত্র ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে তারা কাজ শুরু করে।১৮৫১ ও ১৮৫২ সালের মধ্যে বেশ কয়েকটি চুক্তি সম্পাদিত হয়, যেখানে ডেনমার্কের জন্য একটি লিখিত সংবিধানের প্রতিশ্রুতি দেয়া হলো, যেখানে স্লেশউইগ-হোলস্টেইনের বিশেষ মর্যাদা অক্ষুন্ন থাকবে। স্লেশউইগ-হোলস্টেইনের আগের মত অনেকটা স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হিসেবেই রয়ে গেল।

চুক্তি অনুযায়ী স্লেশউইগ-হোলস্টেইন থেকে গেল ডেনমার্কেই; image source: etc.usf.edu

১৮৫২ সালে মে মাসে লন্ডন চুক্তি ড্যানিশ সিংহাসনেরও ফয়সালা করে। জার্মান বংশোদ্ভূত গ্লুক্সবর্গের প্রিন্স ক্রিশ্চিয়ান রাশিয়ার নেতৃত্বে পরাশক্তিগুলো কর্তৃক সপ্তম ফ্রেডেরিকের উত্তরাধিকারী মনোনীত হন। আলসের শহর অগাস্টেনবার্গের প্রিন্স ক্রিশ্চিয়ানেরও ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে ড্যানিশ সিংহাসনে দাবি ছিল। তার বংশ স্লেশউইগ-হোলস্টেইনের জার্মান অংশের বনেদি পরিবার। তিনি যাতে ক্রিশ্চিয়ানের সিংহাসন লাভে বাধা না দেন সেজন্য পরাশক্তিগুলি তার থেকে মুচলেকা আদায় করে। কিন্তু স্লেশউইগ-হোলস্টেইনের চূড়ান্ত মীমাংসা হলো না। ফলে নতুন আরেকটি সংঘাত ছিল অবশ্যম্ভাবী।

This is a Bengali language article about the rise and eventual downfall of Prussia and how it led to a unified Germany. Necessary references are mentioned below.

  1. Clark, C. M. (2007). Iron kingdom: The rise and downfall of Prussia, 1600-1947. London: Penguin Books.
  2. Adriansen, I. & Christensen, J. O. (2015) The First Schleswig War 1848 -1851: Prelude, Events and Consequences. Museum Sønderjylland – Sønderborg Slot and Tøjhusmuseet.

Feature image: sbg-sword-forum

Related Articles

Exit mobile version