২০৬ খানা হাড় দিয়ে তৈরি নশ্বর মানব শরীরে রয়েছে নানা অঙ্গ। যন্ত্রের মতো কাজ করে চলেছে মানব দেহের সকল অঙ্গ যেন শারীরিক সকল প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার ব্যপারে দৃঢ় প্রত্যয়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। ভ্রূণ থেকে শুরু করে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার পূর্ব মুহূর্ত – এর মধ্যকার সময়কালটা নেহায়েত কম না। দীর্ঘদিনের যাত্রাপথে শরীরের সকল অঙ্গের ভারসাম্য রক্ষা কখনো কখনো কিছুটা ব্যাহত হয়। আর গোলটা তখনই বাঁধে। শরীরে দেখা দেয় নানা রকমের অসামঞ্জস্যতা এবং অসুখবিসুখ বাসা বাঁধতে শুরু করে।
বর্তমান যুগে রোগ-বালাইয়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে শরীরকে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য রয়েছে অনেক ধরনের ঔষধ- অ্যালোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি, আয়ুর্বেদি, ইউনানি, হার্বালসহ আরো বহু ধরনের চিকিৎসা ব্যবস্থা। আর সঠিক ঔষধ সেবনের মাধ্যমে মানুষ দ্রুত আরোগ্য লাভ করে থাকে।
জেনে খুব অবাক হবেন যে, ১৬০০-১৭০০ সালের দিকে ইউরোপীয় অঞ্চলে চিকিৎসা ব্যবস্থা এরকম ছিল না। তখনকার দিনে খুবই জনপ্রিয় এবং কার্যকরী পথ্য ছিল নরমাংস। মাথাব্যথা, গাঁটে ব্যথা, মৃগী রোগ, সর্দি-কাশি, আলসার সহ নানা অসুখের পথ্য হিসেবে ব্যবহৃত হতো মমি করা মৃতদেহের মাংস ও হাড়, মানুষের রক্ত, শরীরের চর্বি ও নানা অঙ্গসমূহ।
সমাজের সাধারণ মানুষ থেকে আরম্ভ করে রাজকীয় ব্যক্তিবর্গ, বিজ্ঞানী, ধর্মযাজকসহ অন্যান্য গণ্যমান্য ব্যক্তিরাও নরমাংসকে পথ্য হিসেবে গ্রহণ করতেন। ইউনিভার্সিটি অব ডারহাম এ কর্মরত অধ্যাপক রিচার্ড সাগ তার লেখা বই মমিস, ক্যানিবালস এন্ড ভ্যাম্পায়ার এ উল্লেখ করেছেন যে,
“ষোল থেকে সতেরো শতকে অর্থাৎ রেনেসাঁ যুগ থেকে শুরু করে ভিক্টোরিয়ান যুগ পর্যন্ত প্রায় বেশ কয়েক শতক যাবত ইউরোপে মানুষের হাড়, রক্ত ও চর্বি নানান ধরনের অসুখ যেমন মাথাব্যথা থেকে শুরু করে মৃগী রোগের মতো রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে এবং তা নিয়মিতভাবে সমাজের উঁচু স্তরের মানুষ যেমন রাজপরিবার, গবেষক ও ধর্মযাজকদের কাছে পথ্য হিসেবে সেবন করা হতো। যদিও সেই সময় কতিপয় ব্যক্তি এমন কাজের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছিলেন, এমনকি তা আমেরিকায় অশোভনীয় কাজের তালিকায় সদ্য যোগ হয়েছিল। সেই সময় হরহামেশা মিশরের পিরামিড থেকে মমি চুরি হতো, আইরিশদের বিভিন্ন কবরস্থান থেকে মৃত মানুষের মাথার খুলি চুরি যেত এবং গোরখোদকরা মৃত মানুষের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ চুরি করে বিক্রি করত।”
সেই সময়ে মানুষের বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে, এসব ভক্ষণে তারা আরোগ্য লাভ করবে। জেনে নেওয়া যাক, মানুষের কোন কোন অঙ্গ কী কী উদ্দেশ্যে তখনকার মানুষ পথ্য হিসেবে ভক্ষণ করতো।
১. মমি
প্রথমেই বলতে হয় মমি ভক্ষণের কথা। আমরা সকলেই জানি যে, প্রাচীন মিশরে মৃত্যুর পর গণ্যমান্য ব্যক্তিদের শরীর একটি বিশেষ প্রক্রিয়ায় সংরক্ষণ করা হতো যাতে বহুদিন পর্যন্ত তাদের শরীর অক্ষত থাকে। এক ধরনের ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে তারা এমনটা করতেন। এই বিশেষভাবে প্রক্রিয়াজাত শবদেহগুলোকেই মমি বলা হয়। মানুষের শরীরের ভেতরে কোথাও রক্তক্ষরণ হলে মমি থেকে মাংস সংগ্রহ করে তা পথ্য হিসেবে গ্রহণ করা হতো। শুধু তা-ই নয়, মমির খুলি সংগ্রহ করে তা গুঁড়ো করা হতো এবং মাথাব্যথার ঔষধ হিসেবে তা প্রদান করা হতো। মিশর এবং মধ্য ইউরোপে এর ব্যাপক প্রচলন ছিল।
সেই সময়ে প্রচুর মমি চুরি হতো এবং পরবর্তীতে সেগুলো পুড়িয়ে বা গুঁড়ো করে বিভিন্ন পথ্য বানানো হতো। হাড়ের গুঁড়ো আর্থ্রাইটিস রোগে বহুল ব্যবহৃত হতো। এসব সংগ্রহ করার পর পাঠিয়ে দেওয়া হতো কায়রো এবং আলেক্সান্দ্রিয়ার বিভিন্ন ব্যবসায়ীর কাছে যাদের কাজ ছিল পাঠানো পথ্যগুলো ইউরোপের সকল জায়গায় পৌঁছে দেওয়া।
১৫৪৯ সালে ফ্রান্সের রানী ক্যাথেরিন এবং ইতালির কয়েকজন চিকিৎসকসহ একটি দল বিশেষ ভ্রমণে ইউরোপে এসেছিলেন এবং বেশ কিছু পিরামিড ভেঙে মমি সংগ্রহ করে নিয়ে গিয়েছিলেন ভবিষ্যতে চিকিৎসা ক্ষেত্রে ব্যবহারের লক্ষ্যে। এখানেই শেষ নয়, রানী ক্যাথেরিনের শ্বশুর মশাই ফ্রান্সের রাজা প্রথম ফ্রান্সিস সবসময় কোমরে মমির হাড়ের গুঁড়োর একটি পুটলি রাখতেন যাতে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি তা সেবন করে সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন।
২. মানুষের শরীরের চর্বি
মানুষের শরীরের চর্বি দেহের বহির্ভাগের চিকিৎসায় ব্যবহার করা হতো। কোথাও কেটে গেলে বা আঘাত পেলে মানুষের শরীরের চর্বিতে একটি পট্টি চুবিয়ে ভিজিয়ে নিয়ে তা ক্ষতস্থানে লাগিয়ে দেওয়া হতো। এতে দ্রুত ক্ষত সেরে উঠতো। এছাড়াও গাঁটের বাতে এই চর্বি মালিশ করলে আরাম পাওয়া যেত।
৩. মাথার খুলি
মৃত মানুষের মাথার খুলি সংগ্রহ করে তা চূর্ণ-বিচূর্ণ করে পাউডার হিসেবে বিক্রি করা হতো। তাদের বিশ্বাস ছিল এই পাউডারকে চকোলেটের সাথে মিশিয়ে সেবন করলে কমে যাবে মাথাব্যথা।
৪. মৃত মানুষের মাথার খুলির উপর জন্মানো শৈবাল
মানুষ মারা গেলে ধীরে ধীরে তাতে পচন ধরতে থাকে এবং এক সময় তা ক্ষয় হতে হতে মাটির সাথে মিশে যায়। শবদেহ দাফন করার পর মাথার খুলিতে এক ধরনের শৈবাল জন্ম নেয় আর এই শৈবাল উসনিয়া নামে পরিচিত। এই শৈবাল চূর্ণ নাক দিয়ে রক্ত পড়া বন্ধ করতে ও মৃগী রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হতো। এই শৈবাল চূর্ণ রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে- এই বিশ্বাস থেকে তা ব্যবহার করা হতো।
৫. রক্ত মিশ্রিত মধু
সেই যুগে কিছু মানুষ স্বেচ্ছায় মধু পান করতেন। হ্যাঁ, আমৃত্যু তারা মধু ছাড়া আর কোনো কিছু খেতেন না এবং মৃত্যুর পর তাদের মধু মিশ্রিত শরীরের রক্ত বিভিন্ন জারে করে সংগ্রহ করে রাখা হতো। কারো হাড় ভেঙে গেলে তা পুনরায় জোড়া লাগানোর চিকিৎসায় এই রক্ত মিশ্রিত মধু প্রদান করা হতো।
৬. তাজা রক্ত
তাজা রক্ত পান করলে শরীরের বল বৃদ্ধি হবে- এমন ধারণা থেকে মানুষ তাজা রক্ত পান করতেন। ষোল শতকের প্যরাসেলসাস নামক একজন জার্মান- সুইস চিকিৎসক বিশ্বাস করতেন, তাজা রক্ত পান করা শরীরে জন্য খুব উপকারী। তরুণ যুবক-যুবতী, সদ্য ফাঁসি দেয়া বন্দীর রক্ত সংগ্রহ করে তা পান করা হতো বল বৃদ্ধির আশায়।
অনেক গরীব ব্যক্তি অর্থের বিনিময়ে ঔষধ বিক্রেতাদের কাছে তাদের রক্ত বিক্রি করতেন। রেনেসাঁ যুগেও রক্তপানের ব্যাপক জনপ্রিয়তা ছিল। সেই সময় রোমান সৈন্যরা শক্তি বৃদ্ধির আশায় নিহত গ্লাডিয়েটর সৈন্যদের রক্ত পান করত।
৭. কিং’স ড্রপ
শরীরের অভ্যন্তরীণ অঙ্গের রক্তক্ষরণ রোধে রাজা দ্বিতীয় চার্লস মানুষের মাথার খুলি চূর্ণ সুরার সাথে মিশিয়ে পান করতেন।
৮. হৃদপিন্ড চূর্ণ
মানুষের হৃদপিন্ড সংগ্রহ করে সেটাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে একধরনের পেস্ট বানানো হতো এবং মাথা ঘোরানোর রোগে তা পথ্য হিসেবে দেওয়া হতো। রোগীকে খালি পেটে সকালে এই হৃদপিন্ড চূর্ণ গ্রহণ করতে হতো।
৯. নারীর গর্ভের ফুল
নিয়মিত ঋতুস্রাব হওয়ার জন্য এবং মাসিক চলাকালীন অত্যধিক রক্তক্ষরণ কমানোর জন্য সদ্য বাচ্চা প্রসবকারী নারীর গর্ভের ফুল বা প্লাসেন্টা সেবনের পরামর্শ দেওয়া হতো। বর্তমান যুগে এমন চিকিৎসা ব্যবস্থার কথা শুনলে পেটের নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে আসার জোগাড় হয়। কিন্তু তখনকার দিনে এমন চিকিৎসা বা ঔষধের কথা চিকিৎসা শাস্ত্রের বইতে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা ছিল। ১৬৯০ সালে লন্ডনে পাওয়া ‘দ্য ট্রেজারি অব ড্রাগস আনলকড’ বইটিতে নরমাংসকে পথ্য হিসেবে ব্যবহারের উল্লেখ রয়েছে।
বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে এমন ধারা চিকিৎসা ব্যবস্থার ইতি ঘটানো হয়েছে। আঠারো শতকে এসে জোরালোভাবে এমন চিকিৎসা প্রথার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আঠারো শতকের পর থেকে সারাবিশ্বে এমন চিকিৎসা ব্যবস্থার কোনো ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়নি।
ফিচার ইমেজ: fee.org