ইন্দোচীন তখন ফ্রান্সের ঔপনিবেশিক সরকারের দখলে চলে গিয়েছে। আধুনিক সময়ে যে দেশগুলো কম্বোডিয়া, লাওস ও ভিয়েতনাম নামে পরিচিত– এগুলো একসময় ‘ইন্দোচীন’ নামে ফ্রান্সের ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে শাসিত হয়েছিল। ঐতিহাসিকভাবেই এই অঞ্চলগুলোতে আধুনিকতার ছোঁয়া ছিল না, তাই ফ্রান্সের প্রশাসনিক কর্মকর্তারা যখন ইন্দোচীন অঞ্চলে পা রাখেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই তারা বিস্মিত হননি। কারণ ‘উপনিবেশ মানেই অনুন্নত ও কৃষিনির্ভর অঞ্চল’– এই ধারণা তখন প্রচলিত ছিল ইউরোপে, আর ইন্দোচীন অঞ্চল এই ধারণাকেই আরও সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিল ফরাসি কর্মকর্তাদের সামনে। যা-ই হোক, ফরাসি কর্মকর্তারা চিন্তা করলেন ইন্দোচীনের রাজধানী হিসেবে ভিয়েতনামের হ্যানয় শহরকে গড়ে তোলা হবে ফরাসি আভিজাত্যের মোড়কে। পুরো হ্যানয় শহরকে নিজেদের মতো গড়ে নেয়া না গেলেও অন্তত শহরের যে অংশে ফরাসি কর্মকর্তারা বাস করেন, সেটাতে যেন ফরাসি স্থাপত্যবিদ্যার ছাপ থাকে– সেভাবেই পরিকল্পনা করা হয়েছিল।
১৮৯৭ সালে পল ডুমার নামক এক স্বনামধন্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে ইন্দোচীনের গভর্নর-জেনারেল হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। তার আগের গভর্নর জেনারেলরা হ্যানয়ের উন্নয়ন নিয়ে ভেবেছিলেন বটে, কিছু কাজও করেছিলেন, কিন্তু কেউই পল ডুমারের মতো বড় পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারেননি। ইন্দোচীন অঞ্চলকে ফরাসি বিনিয়োগের উপযুক্ত করে গড়ে তোলার জন্য তিনি সবধরনের চেষ্টা চালিয়েছিলেন। তার কারণে মূলত অনুন্নত ইন্দোচীনে ফরাসি শিল্পপণ্যের ব্যাপক চাহিদা সৃষ্টি হয়েছিল, যেটি ফরাসি অর্থনীতি সম্প্রসারণে রেখেছিল গুরুত্বপূর্ণ অবদান। তবে হ্যানয় শহরকে নিয়ে ব্যাপক পরিকল্পনা ও সে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য ইতিহাস তাকে বেশি মনে রাখবে। তার সময়েই হ্যানয়কে একটি আধুনিক শহর হিসেবে তৈরি করার জন্য যা নির্মাণ করা দরকার, সবকিছু করা হয়েছিল। পরিবর্তন শুরু হয়েছিল ঘর থেকে, ফরাসি কর্মকর্তাদের বসবাসের জন্য আধুনিক সুবিধাসম্বলিত বাসভবন তৈরি করা হয়। এছাড়া মেডিকেল কলেজ, বিখ্যাত পল ডুমার ব্রিজ (তার নামানুসার) ও প্রতিবছর প্রদর্শনী আয়োজন করার জন্য রাজকীয় প্রাসাদ তৈরি করেন তিনি।
পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার অংশ হিসেবে যে ভূগর্ভস্থ বিশালাকার পাইপের মাধ্যমে বর্জ্য নিষ্কাশন করা যায়– এই ধারণা পুরোপুরি অপরিচিত ছিল ইন্দোচীনে। তখন সমস্ত মানববর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলে দেয়া হতো। পল ডুমার নগর-পরিকল্পনার সময় পুরো হ্যানয়জুড়ে বিশাল ভূগর্ভস্থ পাইপ বসানোর পরিকল্পনা করেন, এবং পরবর্তীতে যখন তিনি যখন ইন্দোচীন ছেড়ে স্বদেশে গমন করেন, তখন দেখা যায় পুরো হ্যানয় শহরে মাটির নিচে প্রায় সতেরো কিলোমিটার জায়গাজুড়ে পাইপ স্থাপন করা হয়েছে। ভিয়েতনামে এটি ছিল প্রথমবারের মতো ভূগর্ভস্থ পয়ঃনিষ্কাশনব্যবস্থা স্থাপনের ঘটনা।
ফরাসি কর্মকর্তাদের বসবাসের জন্য যেসব ভবন তৈরি করা হয়েছিল, সেগুলোতে আধুনিক টয়লেট স্থাপন করা হয় (যেগুলো ফ্রান্সে প্রচলিত ছিল) এবং এটি ছিল স্থানীয় জনগণ ও ফরাসিদের পার্থক্য করার জন্য একটি বড় বিষয়। স্থানীয় হ্যানয়বাসীর জন্য ফরাসি প্রশাসন খুব বেশি পদক্ষেপ নেয়নি। কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! ভূগর্ভস্থ পাইপ থেকে হাজার হাজার ইঁদুর বের হয়ে এসে যখন ফরাসিদের জীবন অতিষ্ঠ করে দিয়েছিল, তখন স্থানীয় জনগণের কাছেই হাত পাততে হয়েছিল ফরাসিদের।
ভূগর্ভস্থ পাইপের মাধ্যমে পয়ঃনিষ্কাশনব্যবস্থা স্থাপন করার আগেই হ্যানয় শহরে ইঁদুরের উৎপাত ছিল। কিন্তু তখন এত বেশি পরিমাণে ছিল না যাতে করে মানুষের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে যায়। হ্যানয়ের স্থানীয় জনগণের সবার বাড়িতেই ইঁদুর এসে খাদ্যশস্য খেয়ে যেত, কাপড়চোপড় ও অন্যান্য জিনিসপত্র কাটত, তবে তা ছিল সহনীয় পর্যায়ে। ইঁদুরের উৎপাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য হ্যানয়বাসী বিভিন্ন ফাঁদ পেতে রাখত, যেগুলো কাজেও দিত। ইঁদুরের উৎপাত ছিল হ্যানয়বাসীর প্রাত্যহিক জীবনেরই অংশ। একেবারে সমস্ত কার্যক্রম বন্ধ করে ইঁদুরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু ফরাসিরা হ্যানয় শহরে এসেই এমন এক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিল যে, সমস্ত প্রশাসনিক কার্যক্রম করতে বাধ্য তো হয়েছিলই, রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল ইঁদুরের বিরুদ্ধে। কীভাবে ফরাসিদের উন্নয়ন কার্যক্রম ইঁদুরের সংখ্যা বাড়িয়ে দিল বহুগুণ কিংবা এত ইঁদুরের ধ্বংসলীলা থেকে বাঁচতে ফরাসি ঔপনিবেশিক সরকার কী পদক্ষেপ নিয়েছিল– সেগুলো জানা যাক এবার।
আগেই বলা হয়েছে, পল ডুমার যখন ইন্দোচীন অঞ্চলের গভর্নর-জেনারেলের পদ ছেড়ে স্বদেশে ফিরে যান, তখন পুরো হ্যানয় শহরজুড়ে সতের কিলোমিটারব্যাপী ভূগর্ভস্থ পাইপ স্থাপন করা হয়েছিল। মূলত ইঁদুরের সংখ্যা আশংকাজনকভাবে বেড়ে যাওয়ার পেছনে এটিই ছিল মূল কারণ। ভূগর্ভস্থ পাইপগুলোতে মানববর্জ্য ও অন্যান্য ময়লা থাকার কারণে ইঁদুরেরা হ্যানয়ের ঘরবাড়ি ছেড়ে সেই পাইপে আশ্রয় নেয়, যেহেতু এখানে খাবারের কোনো অভাব ছিল না।
অল্প সময়ের মধ্যেই ব্যাপকহারে প্রজননের কারণে ইঁদুরের সংখ্যা বেড়ে কয়েকগুণ হয়ে যায়। ইঁদুরের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণে একসময়ে দেখা যায়, পাইপ দিয়ে যে পরিমাণ বর্জ্যপদার্থ আসছে, তার তুলনায় ইঁদুরের সংখ্যা অনেক বেশি। ফলে খাবারের সংকট দেখা দেয় এবং অসংখ্য ইঁদুর পাইপ থেকে বাইরে বেরিয়ে আসতে শুরু করে। ভূগর্ভস্থ পাইপগুলোর সাথে ফরাসি কর্মকর্তাদের বাসভবনের ছিল প্রত্যক্ষ সংযোগ। প্রতিটি ফরাসি ভবনের সাথে ভূগর্ভস্থ লাইনের সংযোগ ছিল পাইপের মাধ্যমে এবং সেই পাইপ দিয়েই শত শত ইঁদুর বেরিয়ে আসতে শুরু করে।
ফরাসি বাসভবনগুলোতে টয়লেটের কমোড দিয়ে এসে যখন শত শত ইঁদুর পুরো বাসায় ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে, তখন সেটি ছিল ছিল ফরাসি কর্মকর্তা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য ভীতিকর অভিজ্ঞতা। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ আকার ধারণ করে যে, ফরাসি ঔপনিবেশিক সরকার প্রশাসনিক কার্যক্রমে ইস্তফা দিয়ে নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে। ইঁদুরের তান্ডবে ঘরবাড়ির বিভিন্ন জিনিসপত্র নষ্ট হয়ে যায়, খাবারের সংকট দেখা দেয় এবং সবচেয়ে বড় সমস্যা তথা মহামারী দেখা দেয়। হ্যানয়ে ফরাসিরা একটি মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠিত করে এবং সেখানকার একজন গবেষক প্রমাণ করেন যে, ভূগর্ভস্থ পাইপ থেকে উঠে আসা ইঁদুর থেকেই মানুষের শরীরে বুবোনিক প্লেগের ভাইরাস প্রবেশ করেছে। ইঁদুরের উৎপাতের এই ঘটনা থেকে যে মহামারী শুরু হয়েছিল, তাতে প্রায় তিনশো মানুষ মারা যায় হ্যানয়ে, যাদের বেশিরভাগই ছিল স্থানীয় ভিয়েতনামি।
এবার ফরাসি ঔপনিবেশিক সরকার চিন্তা করতে শুরু করে কীভাবে ইঁদুরের উৎপাত থেকে বাঁচা যায়। প্রথমদিকে পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের হাতে ইঁদুর নিধনের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সংখ্যায় ইঁদুর এত বেশি হয়ে গিয়েছিল যে, তারা কুলিয়ে উঠতে পারছিল না। এবার ফরাসি সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, স্থানীয় ভিয়েতনামিদের মধ্যে যারা ইঁদুর নিধন কার্যক্রমে অংশ নেবে, তাদের প্রতিটি ইঁদুরের বিনিময়ে এক সেন্ট করে পারিশ্রমিক দেয়া হবে। ফরাসি সরকারের পক্ষ থেকে এমন ঘোষণা আসার পর দলে দলে স্থানীয় দরিদ্র হ্যানয়বাসী ইঁদুর নিধনের মাধ্যমে অর্থ কামানোর জন্য আত্মনিয়োগ করে। রাতের বেলা ভূগর্ভস্থ পাইপগুলোতে প্রবেশ করতেন তারা এবং ইঁদুর ধরার পর সেগুলোর লেজ কেটে সরকারের প্রতিনিধির কাছে জমা দিতেন।
একসময় দেখা যায়, তারা ইঁদুর হত্যা না করে শুধু লেজ কেটে নিয়ে আসছেন। পরবর্তীতে শহরে লেজকাটা ইঁদুরের উৎপাত দেখা যায়। শুধু তা-ই নয়, কিছুদিন পর ফরাসি কর্মকর্তারা আবিষ্কার করেন যে, হ্যানয় শহর থেকে কিছুটা দূরে ইঁদুরের ফার্ম তৈরি করা হয়েছে। সেই ফার্ম থেকে ইঁদুরের লেজ সংগ্রহ করে সরকারি পারিশ্রমিক নেয়া হচ্ছিল!
শেষ পর্যন্ত ইঁদুরদের বিরুদ্ধে পেরে ওঠেনি হ্যানয়বাসী। লাখ লাখ ইঁদুর দখল করে নিয়েছিল পুরো শহর। ইঁদুরের মতো ছোট একটি প্রাণীকে রুখে দিতে ব্যর্থ হয়েছিল মানুষের সমস্ত আয়োজন। ইতিহাসে এই ঘটনা স্থান পেয়েছে ‘দ্য গ্রেট হ্যানয় র্যাট হান্ট’ হিসেবে। প্রায় একশো বছর বিশ্ববাসীর কাছে এই ঘটনা অজানা ছিল। একজন গবেষকের কাছে সেই সময়ের কিছু সরকারি ফাইল আসার পরই তিনি এই ঘটনা তুলে ধরেন। আধুনিক সময়ে বিভিন্ন শহরের স্থানীয় সরকার মশা কিংবা বেওয়ারিশ কুকুরের বিরুদ্ধে এই ধরনের পদক্ষেপ নিলেও সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে ইঁদুরের বিরুদ্ধে এই অভিযান ছিল একেবারে অভিনব।