মুসলিম, খ্রিস্টান ও ইহুদি- আব্রাহামিক এই তিনটি ধর্মেরই গুরুত্বপূর্ণ তীর্থস্থান শহরটি। প্রাচীন এই শহরটিকে ‘পবিত্র নগরী’ মানা হয়, কেননা এখানে তিন ধর্মেরই কিছু পবিত্র স্থান রয়েছে। হ্যাঁ, বলা হচ্ছে জেরুজালেমের কথাই।
ধর্মীয় তাৎপর্যের কারণেই এই শহরের ওপর কর্তৃত্ব বিস্তার করতে চেয়েছে তিন ধর্মের লোকেরাই। বিশেষত মুসলিম ও খ্রিস্টানদের মধ্যে এ শহর দখল করাকে কেন্দ্র করে সংঘটিত হয়েছে একাধিক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। যেগুলোকে অভিহিত করা হয় ‘ক্রুসেড’ নামে। আর সেই ক্রুসেডের ফলাফলে শহরের অধিকার হাতবদলও হয়েছে বেশ কয়েকবার।
মধ্যযুগের কথা, ১২১২ খ্রিস্টাব্দ। ইউরোপের বনেদী দুটি দেশ ফ্রান্স ও জার্মানিতে সৃষ্টি হলো অদ্ভুত এক আলোড়ন। হঠাৎ করেই সেখানকার দশ-বারো বছর বয়সী বাচ্চারা আঁটঘাট বেঁধে নেমে পড়ে জেরুজালেম দখলের অদ্ভুত স্বপ্ন নিয়ে।
ফ্রান্সের কথা দিয়েই শুরু করা যাক। দেশটির ক্লয়েস শহরে স্টিফেন নামের এক রাখাল মানুষের মাঝে উদ্ভট কিছু কথা প্রচার করতে শুরু করে। তার ভাষ্যমতে, ছদ্মবেশে যীশু একদিন তাকে দেখা দেন এবং এক পর্যায়ে একটি পত্র ধরিয়ে দিয়ে যান। কোনো কোনো সূত্রমতে, একজন সাধু তাকে পত্রটি দেন।
চিঠিতে বলা হয়েছিল যে, তাকে ঐশ্বরিকভাবে মনোনীত করা হয়েছে ক্রুসেডের জন্য। তাই তাকে সমগ্র ইউরোপ ভ্রমণ করে ক্রুসেডের জন্য অনুসারী সংগ্রহ করতে হবে এবং পর্যাপ্ত অনুসারী সংগ্রহ শেষ হলে তাকে ক্রুসেডের জন্য যাত্রা শুরু করতে হবে। তবে প্রাথমিকভাবে চিঠিটি রাজার কাছে পৌঁছাতে হবে, যাতে তিনি ক্রুসেডের জন্য উদ্যোগী হন এবং প্রয়োজনীয় সহায়তা দেন।
স্টিফেনের উদ্ভট কিন্তু চমকপ্রদ কথায় কিছু অনুসারীও জুটে যায় অল্প সময়ে। তার এই অনুসারীরা খুব বেশি বয়সের ছিল না, অনেকটা তার মতোই কিশোর বয়সী ছিল বেশিরভাগ। আর এদের নিয়েই একসময় সত্যিই সে রাজ দরবারে পৌঁছে যায় এবং রাজার সাথে দেখা করে।
রাজা ফিলিপ চতুর্থকে সেই ‘স্বপ্নে পাওয়া’ পত্রটি দেখানো হলো। স্টিফেনের আশা করেছিল রাজা তাকে ক্রুসেড পরিচালনার জন্য অনুমতি দেবেন। কিন্তু রাজা ফিলিপ আবেগতাড়িত শাসক ছিলেন না। তিনি নানাভাবে বুঝিয়েশুনিয়ে স্টিফেনকে তার অনুসারীসমেত বাড়ি ফিরে যেতে বলেন।
রাজার কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়েও স্টিফেন বিন্দুমাত্র হতাশ হয়নি। তার চোখে সে একজন ক্যারিশমাটিক নেতা, যে কিনা তার অগ্রজদের ব্যর্থতাকে কাটিয়ে জেরুজালেম পুনর্দখল করবে। তাই রাজার কাছ থেকে অপমানিত হয়ে ফিরে আসলেও তার উদ্যম বিন্দুমাত্র কমেনি।
এতো গেল ফ্রান্সের কথা। জার্মানির কোলোন শহরে স্টিফেনের মতো একজন বিস্ময়বালকের উত্থান ঘটে, নাম নিকোলাস। অনেক সূত্রানুযায়ী, নিকোলাসের উত্থানই প্রথমে ঘটেছিল। সে যা-ই হোক, এই নিকোলাসেরও দাবি ছিল যে, সে স্বপ্নের মাধ্যমে ক্রুসেড করার নির্দেশপ্রাপ্ত হয়েছে।
তার বাগ্মিতা, দৃঢ় নেতৃত্ব ও মানুষকে আকর্ষণ করার ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। তাই তার কথায় প্রচুর ছোট শিশু-কিশোর এসে জড়ো হয়। এদের সাথে সমাজের বয়স্ক নিম্নবর্গীয় পেশাজীবীরাও যোগ দেয় আস্তে আস্তে। লক্ষ্য সবার একটিই- জেরুজালেম পুনর্দখল।
একটি বিষয় পরিষ্কার করে নেওয়া ভালো। ক্রুসেড শুরু করতে অবশ্যই পোপের অনুমতি নিতে হয়। পোপের অনুমোদন ছাড়া কোনোভাবেই ক্রুসেড শুরু করা যায় না।
অথচ এই কিশোরদের জেরুজালেম দখলের যে পরিকল্পনা, তাতে পোপের অনুমোদন তো দূরে থাক, নিজ দেশের রাজার অনুমোদনও ছিল না। তাই অনেকেই কিশোরদের এই জেরুজালেম দখলের অভিযানকে ক্রুসেড বলতে নারাজ। তবে যেহেতু ধর্মীয় জোশে পরিচালিত ছিল, তাই অনেকে ‘ক্রুসেড’ তকমাটাই বহাল রাখেন।
ক্রুসেডের ভয়ংকর যুদ্ধে যেখানে সময়ের সেরা অস্ত্রগুলো ব্যবহার করা হয়, সেখানে এই কিশোরদের তেমন কিছুই ছিল না। তারা কিছু ক্রুশ এবং পতাকা নিয়ে অভিযান শুরু করেছিল। তাদের ধারণা ছিল, তাদের কথাবার্তায় প্রভাবিত হয়ে জেরুজালেমের মুসলমানেরা এমনিতেই ধর্মান্তরিত হয়ে যাবে; ফলে বিনা রক্তপাতে জেরুজালেম দখল করে নেবে তারা!
এইসব শিশুসুলভ চিন্তাভাবনা দিয়ে তো আর ক্রুসেড হয় না। কিন্তু তাদের আত্মবিশ্বাসের কোনো কমতি ছিল না। তাদের বিশ্বাস ছিল অলৌকিক কিছু হলেও জেরুজালেম তাদের হাতে আসবে।
অবশেষে স্টিফেনের নের্তৃত্বে ফ্রান্সের কিশোরের দল জেরুজালেমের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ইতালির জেনোয়াতে গিয়ে যাত্রাবিরতি দেয় তারা। ওদিকে স্থানীয় মানুষজন প্রথমে একসাথে এত শিশু-কিশোর দেখে ভড়কে গিয়েছিল।
পরে যখন জেনোয়াবাসী জানতে পারে, এই দল ক্রুসেডের জন্য বের হয়ে এসেছে, তখন তারা বেশ বিরক্ত হয়। কারণ তারা রক্তপাতে বিশেষ আগ্রহী ছিল না। তার মধ্যে ভাষাগত অমিলের কারণে কিশোরের দল বেশ বিপদে পড়ে। শেষ পর্যন্ত জেনোয়াবাসী তাদের আতিথেয়তা দেয়নি।
কিশোরেরা এবার অলৌকিক কিছুর আশায় অপেক্ষা করতে থাকে। বাইবেলে বর্ণিত ঘটনা অনুসারে, মোজেসের (মূসা নবী) লাঠির আঘাতে লোহিত সাগর ফেটে রাস্তা হয়ে গিয়েছিল। কিশোরেরা মনে করে তাদের ক্ষেত্রেও সেরকম কিছুই ঘটবে।
পরের দিন সকালে অনুসারীদের সাথে নিয়ে স্টিফেন সমুদ্র তীরে হাজির হয়। কিন্তু বাইবেলে বর্ণিত ঘটনার মতো অলৌকিক কিছুই ঘটল না। ফলে অনেক কিশোরই স্টিফেনের ওপর ক্ষেপে যায়। ক্ষিপ্ত বিদ্রোহীরা তাকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ হিসেবে আখ্যায়িত করে। অনেকে বাড়ির পথও ধরে। কিন্তু স্টিফেনের পাঁড় ভক্তদের সংখ্যা এতই বেশি ছিল যে, বিদ্রোহীরা তেমন পাত্তা পায়নি।
কিছু ইতিহাসবিদ বলেন, তারা পরবর্তীতে পোপ তৃতীয় ইনোসেন্টের কাছে গিয়েছিল। পোপ তাদের সাহসিকতার প্রশংসা করেছিলেন বটে, কিন্তু অপ্রাপ্তবয়স্ক হবার কারণে তাদেরকে ক্রুসেডের অনুমতি দেননি। স্বয়ং পোপের অনুমোদন না পেলেও তারা দমে যায়নি। জেরুজালেম দখলের স্বপ্ন তখনো তাড়া করে বেড়াচ্ছিল তাদের।
অপরদিকে নিকোলাসের নের্তৃত্বে জার্মান কিশোরের দল আল্পস পর্বতমালার ওপর দিয়ে জেরুজালেমের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। আল্পস পর্বতমালার দিয়ে ভ্রমণ করা কোনো সহজ কাজ ছিল না। দুর্গম যাত্রাপথেই অনেক কিশোর মারা যায়। অনেকে আবার বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়।
এরই মধ্যে ফ্রান্সের উপকূলীয় অঞ্চল মার্সেইলিতে পৌঁছায় জার্মান কিশোরের দল। এবার সাগর পাড়ি দেবার পালা। স্টিফেনের অনুসারীদের মতো তাদেরও বিশ্বাস ছিল অলৌকিক কিছু ঘটবে। কিন্তু বাস্তবে কিছুই হয়নি। সমুদ্র পাড়ি দিতে ব্যর্থ হয়ে অনেক কিশোর স্থানীয় কাজে জড়িয়ে পড়ে। অনেকে বাড়ি চলে আসার জন্য রওনা দেয়।
তবে জনশ্রুতি রয়েছে, তারা যখন সাগর পাড়ি দেয়ার জন্য অপেক্ষা করছিল, তখন তাদের সাথে দুজন ব্যবসায়ীর দেখা হয়। সেই দুজন ব্যবসায়ী তাদেকে জাহাজে করে সাগর পার করে দেয়ার প্রস্তাব দেয়। সুযোগের অপেক্ষায় থাকা কিশোরেরা সাগ্রহে তাদের প্রস্তাবে সমর্থন জানায়। কিন্তু তারা জানত না কী ভয়াবহ পরিণতি অপেক্ষা করছে তাদের জন্য!
সাতটি জাহাজে করে এই কিশোরদের সেই দুজন ব্যবসায়ী রওনা হয়। কিন্তু জাহাজ জেরুজালেমের দিকে যাচ্ছিল না। ঐ দুজন ব্যবসায়ী এবার আরব দাস-ব্যবসায়ীদের সাথে যোগাযোগ করে। তাদেরকে সুযোগ বুঝে বিক্রি করে দেওয়া হয় দাস হিসেবে।
বিক্রি করার পর আরব দাস-ব্যবসায়ীরা তাদের তিউনিসিয়ায় নিয়ে যায়। জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করা হয় তাদের। যারা মুসলমান হতে রাজি হয়নি, তাদের হত্যা করা হয়।
ইতিহাস বলে, যেসব কিশোর ক্রুসেডে গিয়েছিল তাদের খুব ছোট একটি অংশ ফিরে এসেছিল বাড়িতে, বাকিরা আর ফিরে আসেনি। তখনকার সমাজে ধর্মের আধিপত্য বাড়াবাড়ি রকমের থাকায় এসব উদ্ভট বিষয়ও অবলীলায় বিশ্বাস করেছিল অভিভাবকেরা। যারা খেসারত দিতে হয়েছিল সন্তানের প্রাণ দিয়ে। ইতিহাসে তাই এই ঘটনাকে ‘দ্য ওর্স্ট মিসগাইডেড ডিজাস্টার’ আখ্যা দেওয়া হয়।
ক্রনিকল্স অব ক্রুসেডস্ নামে একটি বইতে ক্রুসেডের ৫০ টি ঘটনার একটি হিসেবে ঠাঁই পেয়েছে চিলড্রেন্স ক্রুসেডও। মধ্যযুগে ইউরোপের আন্দোলন ও যুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে রচিত দ্য লেটার ক্রুসেডস, সেক্রেড ভায়োলেন্স সহ বিভিন্ন বইতে ঘটনাটি বর্ণিত হয়েছে।
তবু ক্রুসেড হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি না থাকায় ইতিহাসের পাতায় ঘটনাটির খুঁটিনাটি খুঁজতে ভালোই বেগ পেতে হয়। গবেষকদের গবেষণায় জনশ্রুতিও তাই হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ উপজীব্য। ফলে নানান ব্যাপারে রয়েছে ঐতিহাসিক মতপার্থক্য।
এই যেমন, কোনো কোনো ঐতিহাসিক মধ্যযুগীয় ইউরোপে এমন একটি ধর্মের ভাবাবেগপুষ্ট আন্দোলন হয়েছিল বলে মনে করলেও আলাদা করে স্টিফেন বা নিকোলাস চরিত্র দুটির পক্ষে ঐতিহাসিক প্রমাণ জোরালো বলে মনে করেন না। আবার পিটার রিডট্সের মতো অনেক গবেষক মনে করেন, শিশু-কিশোর নয়, বরং এই আন্দোলনের মুখ্য চরিত্র ছিল সমাজের কৃষকশ্রেণী বা নিম্নবর্গীয় পেশাজীবীরা!
ফলে, শুধু ক্রুসেড পরিচয় নিয়েই নয়, আক্ষরিকভাবে এটি ‘চিলড্রেন্স’ কিনা, সেটি নিয়েও আছে প্রশ্ন। কিন্তু এই ঘটনাটি প্রশ্নাতীতভাবে একটি ব্যাপার কিন্তু আমাদের সামনে নিয়ে আসে। তা হলো- সমাজের প্রান্তিক কোনো অংশের গুটিকতক মতমোড়লই যথেষ্ট বিশাল একটি জনসংখ্যাকে তাতিয়ে দিতে এবং এক্ষেত্রে তাদের তাদের অস্ত্র হলো অন্ধ মতাদর্শ! তবে শুধু আবেগের বশে তো আন্দোলন সফল হয় না, অপরিপক্ক পরিকল্পনা তাই বিপর্যয়ই ডেকে আনে।