আজকের দিনে পুরো পৃথিবীকে মোবাইল বা কম্পিউটারের স্ক্রিনে দেখে ফেলাটা কতই না সহজ। এমনকি গুগল ম্যাপ বা এ জাতীয় কিছু সফটওয়্যার বা ওয়েবসাইটের সাহায্যে আমরা গোটা পৃথিবীর যেকোনো স্থানকে মুহূর্তের মধ্যে খুঁজে বের করে সেখানকার ছবি দেখে নিতে পারি। আমাদের সমৃদ্ধ তথ্যভান্ডারে পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি বর্গ ইঞ্চির তথ্য রয়েছে, ফলে কোথাও না গিয়েও সেই স্থানে ভার্চুয়ালভাবে ভ্রমণ করে আসতে পারি আমরা।
কিন্তু আজ থেকে একশো বছর পূর্বেও এত সুবিধা মানুষের ছিল না। ছিল না মোবাইল-কম্পিউটার প্রযুক্তি, সহজলভ্য ক্যামেরা, স্যাটেলাইট, উন্নতমানের বিমান বা জাহাজ এবং আরো যা যা ‘ছিল না’, তার তালিকাটি অনেক বড়। তখনও পৃথিবীর উপরিতলের প্রতিটি স্থান মানুষের জ্ঞানের পরিধির ভেতর আসেনি। পৃথিবীর ভেতরে থাকা সেসব অনাবিষ্কৃত জগতকে যুগে যুগে যারা আবিষ্কার করেছিলেন, মানুষের জানাশোনার পরিধিকে আরো বিস্তৃত করেছিলেন, তাদের অনেকের কথাই আমরা জানি না।
আবার যাদের কথা জানি, তাদেরকে শ্রদ্ধাভরে স্থান দেওয়া হয়েছে ইতিহাসের পাতায়। কিন্তু, এমন কিছু হতভাগা মহান অভিযাত্রীও রয়েছেন, যাদের গুরুত্বপূর্ণ অবদানের কথা জানার পরও বিভিন্ন কারণে ইতিহাস তাদেরকে মনে রাখেনি। ইতিহাসের পাতায় তাদের নাম লেখার পরও তা মুছে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। এমনই একজন ভুলে যাওয়া ইতালীয় অভিযাত্রী উমবের্তো নবিলে। আজ আমরা তার কথাই জানবো।
শুরুর কথা: এমুন্ডসেন ও এয়ারশিপ নর্গ
উমবের্তো নবিলের কথা জানার আগে ইতিহাসের আরও কিছু পাতায় চোখ বোলাতে হবে। এক্ষেত্রে প্রথমেই আসবে নরওয়েজিয়ান অভিযাত্রী রোয়াল্ড এমুন্ডসেনের কথা। উল্লেখ্য, রোয়াল্ড এমুন্ডসেনই সর্বপ্রথম অভিযাত্রী হিসেবে দক্ষিণ মেরুতে পা রাখেন। তবে এটুকুতেই তিনি থেমে যাননি, পরবর্তী লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করেন তার বাড়ির পাশের উত্তর মেরুকে। যদিও উত্তর মেরুতে প্রথমে তার পা পড়েনি, তবুও তিনি অন্যভাবে উত্তর মেরুকে আবিষ্কার করতে চেয়েছিলেন। আর এজন্য তিনি বেছে নিয়েছিলেন আকাশপথকে। কারণ, উত্তর মেরুতে মানুষের পা পড়লেও এর বিস্তীর্ণ ও বেশিরভাগ অঞ্চল সম্পর্কেই পৃথিবীবাসী তখনো সম্পূর্ণ অন্ধকারে।
যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে, সেটা ১৯২৫ সাল। তৎকালে বিমান-প্রযুক্তি ছিল নিতান্তই শিশু অবস্থায়। তবে সেসময়ে উড়োজাহাজ হিসেবে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতো এয়ার-বেলুন। এ লেখাতে উড়োজাহাজ বলতে এয়ার-বেলুনকেই বোঝানো হবে। আকাশপথে উত্তর মেরুতে অভিযান চালানোর জন্য এমুন্ডসেনের অনেক কিছু দরকার ছিল, যা তখন নরওয়েতে ছিল না। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় ছিল যে জিনিসটি, সেটি হলো একটি উড়োজাহাজ। সেসময়ে সবচেয়ে ভালোমানের উড়োজাহাজ তৈরিকারক দেশ হিসেবে ইতালির নাম ছিল একদম প্রথম সারিতে।
১৯২৫ সালের ১লা সেপ্টেম্বর এমুন্ডসেন তৎকালীন ফ্যাসিস্ট ইতালির সর্বোচ্চ নেতা বেনিতো মুসোলিনির সাথে এক চুক্তিতে আবদ্ধ হন। এটি ছিল ইতালীয়-নরওয়েজিয়ান-মার্কিন যৌথ চুক্তি এবং এর লক্ষ্য ছিল প্রথমবারের মতো আকাশপথে উত্তর মেরু জয় করা। সেখানকার অনাবিষ্কৃত কিছু অঞ্চল আবিষ্কার করা এবং উত্তর মেরুর উপর দিয়ে উড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কায় পৌঁছানো।
চুক্তির শর্তানুসারে, ইতালির রাষ্ট্রীয় উড়োজাহাজ নির্মাতা সংস্থা একটি উড়োজাহাজ বানিয়ে দেবে। ইতালির পক্ষ থেকে পৃথিবীর সবচেয়ে উত্তরের স্থায়ী ভূখন্ড নরওয়ের ভালবার্ডে একটি হ্যাংগার (যেখানে বিমান বা উড়োজাহাজ রাখা হয়) এবং উড়োজাহাজটি বেঁধে রাখার জন্য মাস্তুল নির্মাণ করে দেওয়া হবে।
তবে এ চুক্তি করার সময় এমুন্ডসেন ইতালির সরকারের কাছে আরো দুটি অতিরিক্ত দাবি করলেন। এক, অভিযানের জন্য পাঁচজন ইতালিয় ক্রু প্রয়োজন হবে। দুই, গোটা মিশন পরিচালনা করার জন্য একজন ইতালিয় পাইলট লাগবে। তবে যেকোনো পাইলট হলে চলবে না, পাইলটের নাম হতে হবে অবশ্যই ‘উমবের্তো নবিলে’।
কিংস বে আর্কটিক হ্যাংগার: সময়ের চেয়ে অগ্রগামী এক স্থাপনা
গাড়ি রাখার জন্য যেমন গ্যারেজ বা পার্কিং লট এর প্রয়োজন, তেমনি উড়োজাহাজ রাখার জন্য প্রয়োজন হয় হ্যাংগারের। যেহেতু লক্ষ্য উত্তর মেরু, তাই যথাসম্ভব উত্তর মেরুর কাছাকাছি হওয়া চাই সেই হ্যাংগারের অবস্থান, যেন অভিযানের জন্য প্রয়োজনীয় সকল ধরনের রসদ ও সামগ্রী সেখানে সমবেত করে, সকল প্রকার প্রস্তুতি নিয়ে চূড়ান্ত অভিযান চালানো যায়।
হ্যাংগার নির্মাণ প্রকল্পটির প্রধান প্রকৌশলী জো হোভার ছিলেন নরওয়েজিয়ান। এমন একটি বড় কাঠামো নির্মাণের জন্য উপযুক্ত ও বড়সড় একটি জায়গা খুঁজে বের করতে তার প্রায় এক সপ্তাহ সময় লেগে গিয়েছিল।
১৯২৫ সালের অক্টোবরের ১৭ তারিখ যখন হ্যাংগারটির কাজ শুরু হয়, পরিবেশের তাপমাত্রা ততক্ষণে -২০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডেরও নিচে নেমে গেছে। ২৩ অক্টোবরের মধ্যে দুটি জাহাজ এসে প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্র সরবরাহ করে গেলো; সকল নির্মাণসামগ্রী এবং ৩২ জন কর্মীর প্রায় দুই মাসের রসদ। কেননা সামনের দিনগুলোতে তাপমাত্রা আরো কমে যাবে এবং চারপাশের সমুদ্র বরফে আচ্ছাদিত হয়ে জাহাজ চলাচলের অনুপযোগী হয়ে উঠবে; তখন আর কোনোকিছু সরবরাহ করা সম্ভব হবে না।
ভালবার্ডের যে স্থানটিকে নির্ধারণ করা হয়েছিল, তার নাম কিংস বে। এটি পৃথিবীর সর্বউত্তরে অবস্থিত স্থায়ী ভূখন্ড। এর উত্তরে উত্তর মেরুর ভাসমান বরফের বিশাল বিশাল খন্ড রয়েছে, যেগুলোকে স্থায়ী ভূখন্ড বলা চলে না। হ্যাংগারটির মূল কাঠামোটি কাঠ দিয়ে বানানো হয়। কেননা, এটিকে স্থায়ী কোনো কাঠামো হিসেবে বানানো হয়নি এবং নির্মাণ খরচ সীমিত রাখতে কাঠ ব্যবহার করা হয়েছে।
১১০ মিটার দীর্ঘ, ৩৪ মিটার প্রশস্ত এবং ৩০ মিটার উঁচু এ স্থাপনাটিকে বর্তমানকালের প্রকৌশলীরাও এক অনন্য স্থাপনা বলে স্বীকার করেন। কেননা, যে ধরনের প্রতিকূলতার মধ্যে এটি বানানো হয়েছিল, তা সত্যিই আশ্চর্যজনক। এটি বানাতে যতগুলো কাঠের টুকরা ব্যবহার করা হয়েছে, সেগুলো একটার পর একটা সাজিয়ে রাখলে প্রায় ২৭ কি.মি. লম্বা হবে।
যারা নরওয়ের ভূ-প্রকৃতি ও আবহাওয়া সম্পর্কে সামান্যও জানেন, তারা হয়তো শুনেছেন, নরওয়েকে ‘নিশীথ সূর্যের দেশ’ বলা হয়। এর অর্থ হলো, সেখানে বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে (সাধারণত ২০ এপ্রিল-২২ আগস্ট পর্যন্ত) টানা কয়েকমাস দিন-রাত চব্বিশ ঘন্টাই আকাশে সূর্য থাকে। আবার বিপরীত চিত্রটাও সত্য, বছরের অন্য সময়ে টানা কয়েকমাস টানা সূর্যের দেখা মেলে না।
হ্যাংগারের নির্মাণকাজ চলাকালীন ১৯২৫ সালের ২৬ অক্টোবর শেষবারের মতো সূর্য অস্ত গিয়েছিল। এরপর শুরু হলো দীর্ঘস্থায়ী সেই রাত, যে রাত স্থায়ী হবে কয়েকমাস। এই হিমশীতল এই আবহাওয়াতে কর্মীরা হাড়ভাঙা খাটুনি খেটেছেন। সূর্যের আলোর অনুপস্থিতিতে করতে হয়েছে কাজ, সেইসাথে তুষারপাত ও ঝড়ঝাপ্টার ঝামেলা তো ছিলই। এছাড়া তুষারপাতের ফলে পিচ্ছিল হয়ে যাওয়া ভূমিতে এবং হ্যাংগারের পিচ্ছিল হয়ে যাওয়া কাঠামো বেয়ে উপরে উঠে করতে হয়েছিল কাজ।
সীমাহীন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেও শেষপর্যন্ত ঠিকসময়েই হ্যাংগারটির নির্মাণকাজ সম্পন্ন করা হয়েছিল; যা স্থাপত্য ও প্রকৌশলের ইতিহাসে আজও অনুপ্রেরণা হয়ে আছে।
উমবের্তো নবিলে
ইতালিতে জন্মগ্রহণ করা উমবের্তো নবিলে প্রাথমিক জীবনে ছিলেন একজন তড়িৎ প্রকৌশলী। পরবর্তীতে এরোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর দিকে ঝুঁকে পড়েন এবং এ সংক্রান্ত কয়েকটি কোর্স সম্পন্ন করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে তিনি ইতালীয় বিমানবাহিনীতে যোগ দেন, তবে পাইলট বা যোদ্ধা হিসেবে নয়, প্রকৌশলী-অফিসার হিসেবে।
যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে তিনি কয়েকজন সহযোগীকে সাথে নিয়ে একটি উড়োজাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান তৈরি করেন এবং একইসাথে নেপলস বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার কাজও করতেন। উল্লেখ্য, তখনো সামরিক অফিসার হিসেবে তার পদমর্যাদা ছিল। তিনি সামরিক ও বেসামরিক কাজে ব্যবহারের জন্য উড়োজাহাজের নকশা নিয়ে গবেষণা করতে থাকেন।
তার নকশাকৃত প্রথম উড়োজাহাজটি ইতালির সামরিক বাহিনী কিছুদিন ব্যবহার করার পর ১৯২১ সালে সেটি মার্কিন সামরিক বাহিনীর কাছে বিক্রি করা হয়। তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে বছরখানেক পর সেটি দুর্ঘটনার শিকার হলে বেশ কয়েকজন মানুষ মারা যায়। অবশ্য এর ফলে নবিলের ক্যারিয়ারে কোনো ক্ষতিকর প্রভাব পড়েনি। তবে মোটামুটি সেই সময় থেকেই নবিলের জীবনে অন্যান্য কিছু সমস্যা দানা বাঁধতে শুরু করেছিল। তিনি একজন সফল ইঞ্জিনিয়ার, পাশাপাশি তার সামরিক পদমর্যাদাও রয়েছে এবং সবচেয়ে বড় কথা হলো দিনদিন তার পরিচিতি বৃদ্ধি পাচ্ছিল এবং একজন দক্ষ পাইলট হিসেবে তিনি ইতোমধ্যে নাম কুড়িয়ে ফেলেছেন।
তদুপরি তার একটি উড়োজাহাজ-নির্মাতা প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। আর এমন পরিস্থিতিতে মানুষের শত্রুর অভাব হয় না। যদিও তার অনিষ্ট-কামনাকারীর সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছিল, তবুও এরা সরাসরি তার কোনো ক্ষতি করতে পারেনি। এদের তালিকায় রয়েছে ইতালীয় সামরিক কর্মকর্তা, তার ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বী এবং ঈর্ষাপরায়ণ কিছু প্রকৌশলী।
বিভিন্ন বাধা বিপত্তি পেরিয়ে কাজ করে যান নবিলে। এমুন্ডসেনের উত্তর মেরু অভিযানের জন্য যে উড়োজাহাজটি প্রয়োজন ছিল, সেটি নবিলেই তৈরি করেন এবং পরবর্তীতে এমুন্ডসেনের বিশেষ অনুরোধে তিনিই এর পাইলটের দায়িত্ব নেন এবং মিশন পরিচালনা করেন।
এমুন্ডসেন-এলসউওর্থ-নবিলে এক্সপেডিশন
‘এক্সপেডিশন’ (Expedition) শব্দটির অর্থ সহজ বাংলায় বলা যায়, কোনোকিছু আবিষ্কার বা জয়ের উদ্দেশ্যে অভিযাত্রা। এই অভিযানের নামকরণ করা হয়েছিল রোয়াল্ড এমুন্ডসেন, লিংকন এলসউওর্থ এবং উমবের্তো নবিলের নামানুসারে। এদের মধ্যে নবিলে ও এমুন্ডসেনের কথা ইতোমধ্যে বলা হয়েছে, আর এলসউওর্থ হচ্ছেন একজন মার্কিন ধন্যাঢ্য অভিযাত্রী, যিনি এই অভিযানের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক।
মিশনের জন্য যে উড়োজাহাজটি বানানো হয়েছিল, তার নাম দেওয়া হয় ‘নর্গ’ (‘Norway’ এর নরওয়েজিয়ান রূপ ‘Norge’ এবং এর প্রকৃত উচ্চারণ ‘নর-গাহ’)। ১৯২৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি কিংস বে এর হ্যাংগার নির্মাণ কাজ শেষ হয় এবং ৭ মে ‘নর্গ’ সেই আর্কটিক চূড়ান্ত মিশনের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য হ্যাংগারে পৌঁছায়।
তবে সবাইকে অবাক করে দিয়ে রিচার্ড বার্ড নামক একজন আমেরিকান অভিযাত্রী মে মাসের ৯ তারিখ একটি ‘ফকার এফ-৭’ বিমানে করে উত্তর মেরু অভিমুখে যাত্রা করেন এবং ১৬ ঘন্টা পর ফেরত এসে দাবি করেন তিনি উত্তর মেরু জয় করে এসেছেন। প্রথমে খানিকটা বিরক্ত হলেও এমুন্ডসেন তাকে ঠিকই অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। অবশ্য পরবর্তীতে প্রমাণিত হয়েছিল যে, মি.বার্ড খুব বড় ধরনের প্রতারণা করেছিলেন; আদতে তার বিমান কখনোই উত্তর মেরুতে পৌঁছায়নি।
কিন্তু সে কথা জানতেন না এমুন্ডসেনরা, তারা বার্ডকেই আকাশপথে প্রথম উত্তর মেরু জয় করা অভিযাত্রী হিসেবে মেনে নিয়েই ১১ মে এক্সপেডিশন শুরু করেন। প্রায় সাড়ে পনের ঘন্টা পর তারা উত্তর মেরুতে পৌঁছান এবং দুদিনের মাথায় নর্গ আলাস্কায় গিয়ে ল্যান্ড করে।
এখানে একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, সাধারণ সমতল মানচিত্র দেখে মনে হতে পারে উত্তর মেরু থেকে আলাস্কা অনেক বেশি দূরে, কিন্তু সমতল মানচিত্র পুরোপুরি সঠিক নয়। পৃথিবীর প্রকৃত আকার, অর্থাৎ গোলাকার মানচিত্রে দেখলে খুব সহজেই বোঝা যায় যে নরওয়ে, উত্তর মেরু এবং আলাস্কা পরস্পর হতে খুব বেশি দূরে নয়।
এই অভিযান নবিলেকে বিপুল খ্যাতি এনে দেয়। কেননা, নরওয়ে থেকে আর্কটিক সাগর ও আইসক্যাপ পেরিয়ে আলাস্কা যাওয়ার ঘটনা, তাও আবার আকাশপথে, ইতিহাসে আর কখনো ঘটেনি। নবিলে ছিলেন এই মিশনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি! অবশ্য এ মিশনের কৃতিত্ব নিয়ে এমুন্ডসেনের সাথে তার দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়, কেননা এমুন্ডসেনও এই মিশনের কৃতিত্বের সমান দাবিদার।
তদুপরী, উক্ত ঘটনার সাথে যুক্ত ছিল ইতালিয় সরকার। মুসোলিনির নির্দেশে এই মিশনে পেছনে ইতালির অবদানকে ফলাও করে প্রচার করা হয় এবং এমুন্ডসেনের অবদানকে খাটো করা হয়। ফলস্বরূপ, নবিলের সাথে এমুন্ডসেনের সম্পর্ক খারাপ হয়।
দ্বিতীয় অভিযান: উড়োজাহাজ ‘ইতালিয়া’ এবং কিছু বিতর্ক
নর্গ এ চড়ে প্রথম আর্কটিক ফ্লাইট সম্পন্ন করার দুই বছরের মাথায় উমবের্তো নবিলে নতুন করে উত্তর মেরুতে আরেকটি অভিযান সম্পন্ন করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তবে এবারের অভিযান হবে সম্পূর্ণ তার নিজস্ব উদ্যোগে এবং উদ্দেশ্য হবে উত্তর মেরুর আশেপাশের অনাবিষ্কৃত বিশাল এলাকা আবিষ্কার করা এবং সে অঞ্চলগুলোর মানচিত্র তৈরি করা।
এই লক্ষ্য হাতে নিয়ে তিনি তৈরি করেন ‘ইতালিয়া; নামক আরেকটি উড়োজাহাজ এবং তৈরি হতে থাকেন মিশনের জন্য। পুনরায় ব্যবহার উপযোগী করে তোলা হয় সেই আর্কটিক হ্যাংগার। তবে এইবার ইতালি সরকারের পক্ষ থেকে আশানুরূপ সহযোগীতা পাওয়া যায়নি। কারণ, পূর্বেই বলা হয়েছে, নবিলের শত্রুর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছিল এবং তাদের অনেকেই ছিল সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের হর্তাকর্তা।
অবশেষে ১৯২৮ সালের ২৪ মে ইতালিয়া উত্তর মেরুতে পৌঁছায়। কিন্তু নবিলের দুর্ভাগ্যই বলতে হবে যে, সেখানে পৌঁছে ইতালিয়া ঝড়ের কবলে পড়ে এবং ফিরতি পথে এটি বিধ্বস্ত হয়; শুরু হয় নবিলের ক্যারিয়ারের এক দুঃসময়।
যেহেতু ইতোমধ্যেই নবিলে অত্যন্ত সুপরিচিত একজন ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছেন। এয়ারক্রাফট ডিজাইনার এবং পাইলট হিসেবে সারা পৃথিবীতেই তার খ্যাতি, তাই তাকে উদ্ধার করার জন্য আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক তৎপরতা শুরু হয়ে গেলো; বেশ কয়েকটি দেশ থেকে সার্চ-পার্টি গঠন করে খোঁজাখুঁজি শুরু হয়ে গেলো। এদিকে ইতালিয়া বিধ্বস্ত হওয়ার সাথে সাথেই কয়েকজন চিরতরে নিখোঁজ হন, বাকি যারা বেঁচে ছিলেন তাদের মধ্যে কয়েকজন অসুস্থ হয়ে মারা পড়েন। ধারণা করা হয়, জীবিতদের মধ্যে একজন ‘ক্যানিব্যালিজম’ এর শিকার হন। ‘ক্যানিব্যালিজম’ হলো নিজ প্রজাতিকে মেরে তার মাংস খাওয়া।
এদিকে ঘটে গেলো আরেক হৃদয়বিদারক ঘটনা; নবিলের পুরোনো বন্ধু এমুন্ডসেন নবিলের বিপদের কথা শুনে সকল মান-অভিমান ভুলে গিয়ে তাকে উদ্ধারের জন্য একটি উদ্ধারকারী বিমান ভাড়া করে উত্তর মেরুর দিকে রওনা হন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তিনিও সাতজন আরোহীসহ নিঁখোজ হয়ে যান; ধারণা করা হয় তার বিমানটি দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিল।
অবশেষে ইতালিয়া বিধ্বস্ত হওয়ার ৩১ দিন পর সুইডিশ বিমান বাহিনীর একটি স্কি-প্লেন তাদের খোঁজ পায়। নবিলে নিজেও আহত ছিলেন, কিন্তু তিনি একজন আদর্শ দলনেতার পরিচয় দিলেন। তিনি তার চেয়েও বেশি আহত যারা ছিল, তাদেরকে আগে উদ্ধার করে নিয়ে যেতে বললেন। কিন্তু সেই পাইলট কিছুতেই রাজি হলেন না,পাইলটের বক্তব্য ছিল, নবিলেকেই আগে উদ্ধার করতে হবে এবং সেরকম নির্দেশই ছিল তার উপর।
অবশেষে নবিলে তার দলের অন্য সদস্যদের সেখানে রেখে যেতে বাধ্য হন। কিন্তু তিনি নিজে উদ্ধার হওয়ার পরও তার দলের অন্যান্য সদস্যদেরকে উদ্ধার করার জন্য পুনরায় অভিযান চালানোর ইচ্ছা পোষণ করেন, কিন্তু কোনোভাবেই তাকে সে অনুমতি দেওয়া হয়নি এবং এতে নবিলে ক্ষুব্ধ হন। অবশ্য কয়েক সপ্তাহ পর তার অন্যান্য সঙ্গীদেরকে একটি সোভিয়েত আইস-ব্রেকার জাহাজ উদ্ধার করে।
ফিরে যাওয়া যাক ইতালিতে, যেখানে নবিলের প্রতিপক্ষরা ঠিক এমনই একটি সুযোগের জন্য অপেক্ষা করছিল। নবিলের যে জনপ্রিয়তা, সেটাকে ফ্যাসিস্ট ইতালি সরকারও ভালো চোখে দেখতো না। ফলে গোটা ইতালিজুড়ে মহা সমারোহে শুরু হয় নবিলে-বিরোধী প্রচারণা। ইতালিয়া বিধ্বস্ত হওয়ার পেছনে তাকে দায়ী করা হয়, নবিলে যে তার দলের অন্যদেরকে রেখেই নিজে উদ্ধার হয়ে ফিরে আসেন- সেটা ফলাও করে প্রচার করা শুরু হয় পত্র-পত্রিকায়, তাকে আইনের মুখোমুখি করার ভয় দেখানো হয়। তিনি যে ইচ্ছার বিরুদ্ধে উদ্ধার হয়েছিলেন এবং পরবর্তীতে তার দলের সদস্যদের উদ্ধার করার প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন, তা চেপে যাওয়া হয়।
ইতালির স্বৈরশাসক বেনিতো মুসোলিনির সাথে এক সাক্ষাতে নবিলে তার ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং অবিচল কণ্ঠে অভিযোগ করেন, তার সহযাত্রীদেরকে উদ্ধার করার জন্য ইতালির তরফ থেকে যথেষ্ট আন্তরিকতা দেখানো হয়নি। নবিলের এই নির্ভীক কন্ঠ মুসোলিনিকে রাগান্বিত করে এবং এটিকে তিনি চরম বেয়াদবি হিসেবে গণ্য করেন। ফলে নবিলের বিরুদ্ধে কুৎসা-অপবাদ রটানো আরো বেড়ে যায় এবং ইতালিতে তার জীবন আরো কঠিন হয়ে পড়ে।
রাগে-দুঃখে-ক্ষোভে তিনি সামরিক অফিসার পদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং ইতালি ত্যাগ করে সোভিয়েত ইউনিয়নে চলে যান। সেখানে প্রায় পাঁচ বছর অধ্যাপনা করার পর তিনি পুনরায় যান যুক্তরাষ্ট্রে। ইতোমধ্যে ইতালিতে রাষ্ট্রীয়ভাবে তাকে ‘ইতালিয়া ট্রাজেডির’ জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হয় এবং জাতির সামনে তাকে অমানবিক ও অপরাধী হিসেবে তোলে ধরা হয়। এভাবে ইতিহাসের একজন নায়ক পরিণত হন খলনায়কে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর উমবের্তো নবিলে তার মাতৃভূমি ইতালিতে ফিরে যান। তার বিরুদ্ধে আনিত সকল অভিযোগ তোলে নেওয়া হয় এবং তার সকল ধরনের পদমর্যাদা তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। তিনি তার সাথে ঘটে যাওয়া এসব প্রহসন নিয়ে কয়েকটি বইও লিখেছেন, যার মধ্যে ‘আই ক্যান টেল দ্য ট্রুথ’ (I Can Tell the Truth) অন্যতম।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এটি সত্য যে, একজন মানুষের চরিত্রে জোর করে কালিমা লেপন করা হলে, পরবর্তীতে প্রকৃত সত্যটা উন্মোচিত হলেও তার সে ভাবমূর্তি আর ফিরে আসেনি। উমবের্তো নবিলে তেমনই একজন হতভাগ্য ব্যক্তি। ভালবার্ডের কিংস বে’র সেই আর্কটিক হ্যাংগারটি আজ আর নেই; অনেক আগেই তার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। এতে ব্যবহৃত কাঠ ও লোহাগুলো দিয়ে কিংস বে’র অন্যান্য কিছু স্থাপনা বানানো হয়েছে, যা আজও টিকে আছে।
ঠিক এই মুহূর্তে কেউ যদি কিংস বে’তে বেড়াতে যান, তিনি সেই আর্কটিক হ্যাংগারের প্লাটফর্মটা দেখতে পাবেন, যার উপর একসময় দাঁড়িয়ে ছিল সুবিশাল সেই কাঠামোটা। আরও দেখা যাবে উড়োজাহাজ বেঁধে রাখার সেই মাস্তুলটা, যা ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে সগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু সে ইতিহাস প্রায় কেউই ঘেঁটে দেখার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন না। ইতিহাসের সেই পাতাগুলোতে অনেক বেশিই ঘষামাজা করা হয়েছে।