১৯৩৭ সালের ৬ মে। মার্কিন মুলুকে তখন সূর্য অস্ত গিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সিতে বছরের অন্যান্য দিন এই সময়ে কর্মজীবী মানুষজন দিনের কাজ শেষে বাড়ি ফিরে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। অনেকে আবার বন্ধুদের সাথে আড্ডার উদ্দেশ্যে শহরের নামীদামী সরাইখানায় ভিড় জমায়। দিনের মুখরতার পর সন্ধ্যায় এই শহরে এক নতুন প্রাণোচ্ছ্বলতার আবির্ভাব ঘটে।
কিন্তু সেদিন নিউ জার্সিতে এসবের কিছুই ছিল না। শহরের সরাইখানাগুলো সন্ধ্যার অনেক আগে থেকেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। শহরের পথঘাট ছিল একদম জনশূন্য। কারণ, বেশ কয়েকদিন ধরে নিউ জার্সির আবহাওয়ার অবস্থা ভালো যাচ্ছিল না। ক্ষণে ক্ষণে দমকা হাওয়া বইছিলো। ৬ মে দুপুরের দিকে বেশ বড় আকারের ঝড় নিউ জার্সিতে আঘাত হানে। তাই জনসাধারণের নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে কলকারখানা, অফিস নির্দিষ্ট সময়ের আগেই বন্ধ করে দেয়া হয়। সন্ধ্যার দিকে হাওয়ার জোর কমে আসলেও আকাশে মেঘ পুঞ্জীভূত হয়ে অশনি সংকেত দিচ্ছিলো। ঘড়ির কাঁটায় যখন সন্ধ্যা ৭:২৫ মিনিট, ঠিক তখন হঠাৎ করে আকাশ হলুদ আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। আলোর উৎস খুঁজতে উৎসুক মানুষ ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসলো। কিন্তু এরপর তারা যা দেখলো, তার জন্য কেউই মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল না।
শহরের পূর্বদিকে অবস্থিত লেকহার্স্ট নৌ ঘাঁটি থেকে কিছুটা দূরে আকাশে ভাসমান এক আকাশযানের (এয়ারশিপ) লেজের পাখায় বেশ বড় আকারের অগ্নিশিখা জ্বলে উঠেছে। ঝড়ো হাওয়ার প্রভাবে কয়েক সেকেণ্ডের মাথায় আগুন লেজ থেকে দেহের মাঝ বরাবর ছড়িয়ে পড়লো। ঘটনাস্থলের কাছাকাছি থাকা মানুষজন শুনতে পাচ্ছিলো অগ্নিশিখার ফুঁসে ওঠা আক্রোশধ্বনি। পরক্ষণেই সেই আওয়াজ ছাপিয়ে ভেসে আসতে থাকলো আকাশযানে আটকে পড়া যাত্রীদের আর্তচিৎকার। অনেকে প্রাণ বাঁচানোর উদ্দেশ্যে দরজা খুলে মাটিতে ঝাঁপিয়ে পড়লো। কিন্তু তাদের কেউই প্রাণ রক্ষা করতে পারেনি। মাত্র ৩৪ সেকেণ্ডের মাথায় পুরো জাহাজে আগুন ধরে গেলো। নিউ জার্সির মাটিতে আঁছড়ে পড়লো পৃথিবীর সর্ববৃহৎ যাত্রীবাহী আকাশযান ‘হিণ্ডেনবার্গ’। ঘণ্টাখানেকের মাথায় পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়লো হিণ্ডেনবার্গের করুণ পরিণতির কথা। প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিক হার্বার্ট মরিসনের বর্ণনায় বেতারের সামনে বসে থাকা মানুষগুলোর চোখের সামনে ভেসে উঠলো এক বীভৎস দুঃস্বপ্ন।
হিণ্ডেনবার্গ এয়ারশিপ
“আকাশযানটি দেখতে ছিল অদ্ভুত রকমের সুন্দর। চোখ ফেরানো যেত না। রূপালি যানটির পেছনে ঝলমলে পরিষ্কার আকাশ এক অসাধারণ অনুভূতির সৃষ্টি করতো। আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে মনোরম দৃশ্যের মধ্যে একটি হচ্ছে হিণ্ডেনবার্গকে উড়তে দেখা।”
লিবি ম্যাগনেস নামক এক বৃদ্ধা তার হিণ্ডেনবার্গের স্মৃতিচারণ করছিলেন দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় দেয়া এক সাক্ষাৎকারে। সেখানে উঠে আসলো তৎকালীন সর্ববৃহৎ যাত্রীবাহী এয়ারশিপ হিণ্ডেনবার্গের বিলাসিতার কথা। প্রায় ৪০০ ডলার টিকেটের মাধ্যমে যাত্রীরা উপভোগ করতে পারতো জাকজমকপূর্ণ যাত্রা। খাবার-দাবার থেকে শুরু করে শয়নকক্ষের আসবাবপত্রের মাঝেও যেন বিলাসিতার দাগ লেগে থাকতো। আর হিণ্ডেনবার্গের যাত্রা এতটাই আরামদায়ক হতো যে আকাশযান কখন ছেড়ে দিয়েছে তা অনেকে টেরই পেতো না। এর আগে অনেকেই ভারী বিমানে চড়ে আটলান্টিক পাড়ি জমিয়েছেন। কিন্তু হালকা আকাশযানে ভ্রমণ করার অনুভূতি ছিল সবকিছু থেকে আলাদা। লুই লুকনার নামক এক জার্মান সাংবাদিকের ভাষায়, “আপনার মনে হবে যেন স্বর্গ থেকে স্বয়ং পরীরা এসে তাদের কোমল ডানায় ভর করে আপনাকে নিয়ে ভেসে যাচ্ছে।” কোনো কোনো যাত্রী নাকি আকাশযান ছাড়ার ঘণ্টাখানেক বাদে ‘শিপ কখন ছাড়বে?’ প্রশ্ন করে ক্রুদের অস্থির করে তুলতো।
প্রায় ২৪৫ মিটার লম্বা এয়ারশিপ হিণ্ডেনবার্গের নির্মানস্থান ইউরোপের দেশ জার্মানি। ১৯৩৬ সালের মার্চ মাসে ফ্রেডরিখশেফেন অঞ্চল থেকে সর্বপ্রথম হিণ্ডেনবার্গের উদ্বোধন করা হয়। ঘণ্টায় ১৩৫ কিলোমিটার বেগে ছুটে চলা এই যানটি হালকা হাইড্রোজেন গ্যাস দ্বারা পূর্ণ ছিল। হিণ্ডেনবার্গের ক্রু সংখ্যা ৬১ জন। এটি সর্বোচ্চ ৭২ জন যাত্রী বহন করতে পারতো। জার্মানি থেকে উত্তর আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে এটি যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সিতে গিয়ে পৌঁছাতো। পৃথিবীর ইতিহাসে হিণ্ডেনবার্গ ছিল সর্বশেষ যাত্রীবাহী এয়ারশিপ। তখনকার সময়ে এটি ছিল আটলান্টিক পাড়ি দেয়ার দ্রুততম মাধ্যম। সাধারণ আন্তর্জাতিক রুটে চলাচল করা যাত্রীবাহী জাহাজের অর্ধেক সময়ে তা যুক্তরাষ্ট্র পৌঁছাতে পারতো। এর অভ্যন্তরে যাত্রীদের জন্য বিলাসবহুল ভোজনশালা, অডিটোরিয়াম, পানশালা, পিয়ানো কক্ষ, আরামদায়ক কেবিন এবং স্বতন্ত্র ধূমপান কক্ষ ছিল। ১৯৩৬ সালে জার্মান কর্তৃপক্ষের জরিপ অনুযায়ী প্রায় ১০ হাজার যাত্রী হিণ্ডেনবার্গে যাতায়াত করেছেন।
হিণ্ডেনবার্গের সর্বশেষ যাত্রা
১৯৩৭ সালের ৩রা মে হিণ্ডেনবার্গ মাত্র ৩৬ জন যাত্রী নিয়ে তার ৬৩তম ফ্লাইটে ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। জার্মান স্থানীয় সময় অনুযায়ী ফ্লাইটের সময় ছিল সন্ধ্যা ৭টা ৩৬ মিনিট। ফ্লাইটের সার্বিক দায়িত্বে ছিলেন কাপ্তান ম্যাক্স প্রুস। প্রথমদিন শেষে যানটি আটলান্টিকের দ্বীপ গ্রিনল্যান্ডে গিয়ে পৌঁছায়। কিন্তু সেখানকার আবহাওয়া অনুকূল না হওয়ায় যাত্রাপথে কিছুটা বিলম্ব ঘটে। তাই নির্ধারিত সময়ের ১২ ঘণ্টা পরে নিউ জার্সি অবতরণের সিদ্ধান্ত জানানো হয় ককপিট থেকে। সে অনুযায়ী আকাশযান অবতরণের নতুন সময় দাঁড়ায় ৬ মে সন্ধ্যা ৬টা। ৬ মে দুপুর ৩টায় বোস্টন গিয়ে পৌঁছায় হিণ্ডেনবার্গ। এরপর সেটি নিউ ইয়র্কের উপর দিয়ে উড্ডয়ন করে এগিয়ে যেতে থাকে গন্তব্যস্থল লেকহার্স্ট নৌ ঘাঁটির দিকে। বিকাল ৪টার দিকে এটি লেকহার্স্টের নিকটে চলে আসলেও প্রতিকূল হাওয়ার কারণে তা সামনে এগোতে পারছিলো না। তিনি দ্রুত লেকহার্স্ট কর্তৃপক্ষের নিকট তাদের অবস্থা জানিয়ে বার্তা প্রেরণ করেন। লেকহার্স্টের কমাণ্ডিং অফিসার চার্লস রোসেন্ডাল অবস্থা বিবেচনা করে হিণ্ডেনবার্গের অবতরণ বিলম্ব করার জন্য অনুরোধ করেন। এবার কাপ্তান প্রুস তার আকশাযানকে নিউ জার্সি থেকে সরিয়ে নিকটস্থ সমুদ্র সৈকত এলাকায় অবস্থান করেন এবং পরবর্তী নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন।
লেকহার্স্টের আবহাওয়া
ওদিকে সকাল থেকেই লেকহার্স্টের আবহাওয়া তেমন সুবিধার ছিল না। আকাশে জমে থাকা কালো মেঘ দেখে বেশ বড় ঝড়ের পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছিলো। কাপ্তান প্রুস যখন তার যান নিয়ে লেকহার্স্টের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন তিনি ঝড়ের কথা জানতে পারেন। বাতাসের ন্যায় হালকা এয়ারশিপের জন্য এ ধরনের ঝড় খুব বিপদজনক হয়ে দাঁড়ায়। দক্ষ চালকের জন্যেও সামান্য ঝড়ে এর নিয়ন্ত্রণ রাখা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। তাই কাপ্তান প্রুস ঝুঁকি নিতে চাননি। তিনি অপেক্ষা করাই সমীচীন মনে করলেন। তাই তিনি নিকটস্থ সৈকতের আকাশে চক্রাকারে ঘুরতে থাকলেন। বিকাল ৫টার দিকে কমাণ্ডার রোসেন্ডাল আকাশযানের সফল অবতরণের জন্য প্রায় ৯২ জন নাবিককে তলব করলেন। লেকহার্স্ট এবং এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চল থেকে নাবিকরা জরুরি ভিত্তিতে লেকহার্স্ট নৌ ঘাঁটির দিকে ছুটে আসতে থাকলো। সন্ধ্যা ৬টায় সামান্য বৃষ্টিপাতের পর আকাশ পরিষ্কার হতে থাকে। কমাণ্ডার রোসেন্ডাল ৬টা বেজে ১২ মিনিটে কাপ্তান প্রুসকে বার্তা প্রেরণ করেন, “আবহাওয়া আকাশযান অবতরণের অনুকূলে আছে।” কিন্তু হিণ্ডেনবার্গ লেকহার্স্ট থেকে খানিকটা দূরে অবস্থান করছিলো। তাই ৭টা বাজার পরেও এদের কোনো দেখা না পেয়ে কমাণ্ডার রোসেন্ডাল পুনরায় বার্তা পাঠান, “আকাশের অবস্থা উন্নতি ঘটেছে। যত দ্রুত সম্ভব অবতরণ করা উচিত।”
হিণ্ডেনবার্গ দুর্ঘটনা
রোসেন্ডালের বার্তা পাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই লেকহার্স্টের আকাশে হিণ্ডেনবার্গ আকাশযানের দেখা মিললো। সেটি ধীরে ধীরে নৌ ঘাঁটির চারপাশে আবর্তন করছিলো। কাপ্তান প্রুস এভাবে বাতাসের সাথে তাল মিলিয়ে যানটির গতি নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছিলেন। আবর্তনের সাথে সাথে যানটি নিচের দিকে নামতে থাকে। যাত্রীরা গন্তব্যস্থলে পৌঁছে যাওয়ার পূর্ব মুহূর্তে জানালার পাশে এসে ভিড় জমাতে থাকে। ঘড়ির কাঁটায় যখন সন্ধ্যা ৭:২১ বাজে, তখন হিণ্ডেনবার্গ ভূমি থেকে ৩০০ ফুট উচ্চতা পর্যন্ত নিচে নেমে আসে। অবতরণস্থলে অপেক্ষমান স্বজন এবং বন্ধুদের দিকে যাত্রীরা যানের জানালা থেকে হাত নেড়ে অভিবাদন জানাতে থাকে। তখন পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাক চলছিলো। কেউ তখন ভুলেও কল্পনা করতে পারেনি, কী ঘটতে যাচ্ছে আর অল্প সময়ের মধ্যে। আনন্দ, উচ্ছ্বাসে ঝলমল করা অপেক্ষমান মানুষগুলোর এই হাসি উবে যাবে এক বীভৎস দুর্ঘটনার ভয়াবহতায়!
কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই আকাশযানের লেজের দিকে ছোট করে মাশরুমের মতো আগুন জ্বলে উঠে। ওদিকে যানের ভেতর লেজ অংশের দায়িত্বে থাকা ক্রু দ্রুত কাপ্তান প্রুসের নিকট এই তথ্য পৌঁছিয়ে দিলেন। তিনি জানালেন কাপ্তানকে, লেজ অংশের একটি যন্ত্রে ছোট আকারের বিস্ফোরণ ঘটেছে। কাপ্তান দ্রুত সেদিকে ছুটে গেলেন। কিন্তু ততক্ষণে লেজের পুরো অংশ আগুনের লেলিহান শিখায় দাউ দাউ করে জ্বলছে। যাত্রীরাও ততক্ষণে টের পেয়ে গেলো বিপদের কথা। ভয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন যাত্রীরা। গন্তব্যের খুব কাছে এসে স্বজনদের দুর্ঘটনা নিজের চোখের সামনে প্রত্যক্ষ করা অপেক্ষমান মানুষগুলো তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের চোখে-মুখে তখন ফুটে উঠেছে আতঙ্কের অভিব্যক্তি। পুরো ঘটনায় স্থায়িত্বকাল ছিল মাত্র ৩৪ সেকেণ্ড। এর মাঝে প্রলয়কাণ্ড ঘটে গেলো। বিশাল আকাশযান হিণ্ডেনবার্গ আগুনে দগ্ধ হয়ে নিউ জার্সির মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। অনেকে ৩০০ ফুট উপর থেকে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো। তাদের সবাই ঘটনাস্থলে মৃত্যুবরণ করেছিলো। কিন্তু যারা ভূমির কাছাকাছি উচ্চতায় আসার পর ঝাঁপ দিয়েছিলো, তাদের অনেকে আহত হলেও প্রাণ রক্ষা করতে পেরেছিলো। আকাশযানে যাত্রী, চালক, ক্রু এবং অন্যান্য কর্মকর্তাসহ মোট ৯৭ জনের মধ্যে ৬২ জন অলৌকিকভাবে প্রাণে বেঁচেছিলো। কিন্তু প্রাণ হারিয়েছিলো ২২ জন ক্রু, ১৩ জন যাত্রী এবং একজন কর্মচারী। দুর্ঘটনার কিছু অংশ এক সাংবাদিকের ক্যামেরায় বন্দী হয়ে যায়। সেই ভিডিওচিত্র থেকে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে বিশ্ববাসী। তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতি ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট এবং রাজা জর্জ এই ঘটনার প্রেক্ষিতে জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাডলফ হিটলারকে সান্ত্বনাসূচক টেলিগ্রাম প্রেরণ করেছিলেন।
দুর্ঘটনার কারণ এবং পরিণাম
১৯৩৭ সালের দুর্ঘটনা নিয়ে কম অনুসন্ধান হয়নি। বেশ কয়েকটি দল স্বাধীনভাবে এই দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে নিয়োজিত ছিল। কিন্তু প্রাথমিকভাবে কেউই সুনির্দিষ্ট কারণ বের করতে পারেনি। অনুসন্ধানকারী দলের হতাশাব্যঞ্জক অগ্রগতিতে সমালোচনার ঝড় ওঠে। জার্মানির অনেকেই মনে করতো, হয়তো নাৎসি হিটলারের শাসনকে অপমানিত করার উদ্দেশ্যে এটি ছিল একটি সুপরিকল্পিত চক্রান্ত। আকাশযানের লেজের দিকে কেউ গোপনে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিলো বলে গুজব ছড়িয়ে পড়ে। আবার অনেকের মতে, দূর থেকে কেউ গুলি করে যানটি বিধ্বস্ত করেছিলো। তবে এসব ষড়যন্ত্র তত্ত্বের বাইরেও বেশ কিছু কারণ বেরিয়ে আসে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল হাইড্রোজেন বিস্ফোরণ।
দীর্ঘ ৮০ বছর ধরে চলা বিশদ অনুসন্ধানের পর ২০১৭ সালের মে মাসে ঘটনার ৮০ বছর পূর্তি উপলক্ষে দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত বিশেষ ফিচারে হিণ্ডেনবার্গ দুর্ঘটনায় হাইড্রোজেন বিস্ফোরণের প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করা হয়। ধারণা করা হয়, আকাশযান এবং এর বাইরের বাতাসের মাঝে বৈদ্যুতিক বিভব পার্থক্যের কারণে উত্তপ্ত স্ফুলিঙ্গের সৃষ্টি হয়েছিলো, যা যানের হাইড্রোজেন সরবরাহে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিলো। দুর্ঘটনার পর জরিপে প্রমাণিত হয়েছিলো, ভূপাতিত হওয়ার পূর্বে যানের গায়ে বড় রকমের ফাটল সৃষ্টি হয়েছিলো। এই ফাটল থেকে বিপুল পরিমাণ হাইড্রোজেন নির্গত হয়েছিলো, যা বিস্ফোরিত হয়ে আগুন ধরিয়ে দেয় যানের গায়ে। কিন্তু ঠিক কীভাবে যানের গায়ে ফাটল ধরেছিলো, তা জানা সম্ভব হয়নি। কিন্তু এই প্রতিবেদনের সাথে দ্বিমত প্রকাশ করেছেন নাসার বিজ্ঞানী এবং হাইড্রোজেন বিশেষজ্ঞ এডিসন বেন। তার মতে, হিণ্ডেনবার্গ আকাশযানের অগ্নিকাণ্ডের পেছনে খলনায়ক হিসেবে হাইড্রোজেনকে দায়ী করা মোটেও বিজ্ঞানসম্মত নয়। কারণ, হাইড্রোজেন কোনো দৃশ্যমান শিখা দেয় না। তাছাড়া হাইড্রোজেন যদি ফাটল থেকে বের হতো, সেক্ষেত্রে অনেক আগে থেকে তা নির্ধারণ করা সম্ভব হতো। কারণ, হাইড্রোজেন গ্যাস নির্গমন নির্ধারণ করার উদ্দেশ্যে এর সাথে রসুনের নির্যাস মিশ্রিত থাকে। এভাবে যুক্তি, পাল্টা-যুক্তির প্যাঁচে আটকে আছে হিণ্ডেনবার্গ বিস্ফোরণ। এই বিতর্কিত দুর্ঘটনার ফলে বিশ্বজুড়ে চালু হওয়া বিলাসবহুল আকাশযানের ব্যবসায় ধ্বস নামে। ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায় যাত্রীবাহী আকাশযান সেবা।
একটি দুর্ঘটনা মানে সারাজীবনের অভিশাপ। অনেকের জন্য তা স্বজন হারানোর দুঃসহ স্মৃতি। দুর্ঘটনায় আপনজন হারানোর কোনো ক্ষতিপূরণ হয় না। হিণ্ডেনবার্গ দুর্ঘটনাও তেমনি বহু পরিবারের মাঝে নিয়ে এসেছে শোকের বার্তা। বিলাসিতাকে আলিঙ্গন করতে যাওয়া মানুষ এই ঘটনায় নড়েচড়ে বসে। তাই বিলাসিতার আগে নিরাপত্তাকে প্রাধান্য দিয়ে হাইড্রোজেন গ্যাসপূর্ণ আকাশযান সেবার যবনিকাপাত করা হয়। কিন্তু যা হবার তা হয়ে গেছে। তাই তো প্রতিবছর মে মাসের ৬ তারিখে হিণ্ডেনবার্গ পুনরায় ফিরে আসে। বার বার কাঁদিয়ে যায় স্বজন হারানো পরিবারের সদস্যদের।