তৃতীয় রাজবংশের প্রথম ফারাও জোসেরের আমলে সাক্কারাতে নির্মিত ধাপ পিরামিড দুনিয়ার প্রথম ভবন, যা সম্পূর্ণভাবে পাথর দ্বারা তৈরি বলে দাবি করা হয়। এর পূর্বে প্রাচীন মিশরে ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে পাথরের ব্যবহার থাকলেও তা শুধু দরজা বা মূল কবর-কক্ষ তৈরিতেই সীমাবদ্ধ ছিল। ফারাও জোসেরের পর আরও দুজন মিশরীয় ফারাও ধাপ-পিরামিড নির্মাণের চেষ্টা চালান। তারা হলেন, ফারাও সেখেমখেত এবং ফারাও খাবা। কিন্তু তাদের সেই প্রচেষ্টা আলোর মুখ দেখেনি। এরপর অবশ্য ছোট আকারের (১০-১৭ মিটার উচ্চতাবিশিষ্ট) প্রাদেশিক পিরামিড নির্মাণ করা হয়েছিল। যেহেতু এই প্রাদেশিক পিরামিডসমূহ সমাধির কাজে ব্যবহার করা হয়নি, তাই মিশর তত্ত্ববিদদের ধারণা, এগুলো হয়তো নির্মাণ করা হয়েছিল ফারাওয়ের সাধারণ স্মৃতিসৌধ বা উপাসনার নিমিত্তে। অথবা সৌধগুলো ফারাওয়ের এই অঞ্চলের শাসন ইতিহাসের স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে রাখবে।
শাসনকেন্দ্রিক সুবিধার জন্য প্রাচীন মিশরকে তখন বিভিন্ন প্রদেশে ভাগ করে দেওয়া হয়েছিল। আর মিশরের বিভিন্ন প্রদেশে নির্মিত হয়েছিল বলে, এগুলোকে প্রাদেশিক পিরামিড বলা হতো। এর সিংহভাগই প্রাচীন সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত তৃতীয় রাজবংশের শেষ ফারাও হুনি (খ্রি.পূ. ২৬১৩ অব্দ পর্যন্ত) বা চতুর্থ রাজবংশের ফারাও স্নেফেরুর (খ্রি.পূ. ২৬১৩ অব্দ – খ্রি.পূ. ২৫৮৯ অব্দ) শাসনামলে গড়ে তোলা হয়েছিল। এই প্রাদেশিক পিরামিডসমূহ ছিল মূলত ধাপ-পিরামিড। সর্বশেষ প্রাদেশিক পিরামিড ‘সেইলার’ নির্মিত হয়েছিল রেড পিরামিড নির্মাণের পূর্বে, স্নেফেরুর শাসনামলে। ধারণা করা হয়, ফারাও হুনি কমপক্ষে পাঁচটি এবং এবং স্নেফেরুর হাত ধরে সর্বমোট চারটি পিরামিড নির্মিত হয়েছিল। ফাইয়ুম উপত্যকার সেইলা এলাকার পিরামিডটি স্নেফেরু নির্মাণ করেছিলেন বলে কেউ কেউ অনুমান করেন। ফারাও স্নেফেরুর পর কেউ আর ধাপ-পিরামিড নির্মাণে আগ্রহ দেখাননি। তখন ধাপ-পিরামিডের ধারণার উপর ভিত্তি করে পরবর্তী ফারাওয়েরা ক্রমশ জটিল পিরামিড নকশার দিকে ধাবিত হতে থাকেন।
সত্যিকারের পিরামিড নির্মাণের ইতিহাসের সাথে ফারাও স্নেফেরুর নাম অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে। তার হাত ধরেই শুরু হয়েছিল সত্যিকার পিরামিড নির্মাণের শুভযাত্রা। প্রথম দু’বারের প্রচেষ্টায় সফল না হলেও, তৃতীয়বারে সফলতার মুখ দেখেন তিনি। প্রথম ও দ্বিতীয় চেষ্টায় নির্মিত দুটি পিরামিড হলো যথাক্রমে মেইদুম পিরামিড, এবং দাহশুরের বেন্ট পিরামিড। প্রাচীন মিশরীয় শব্দ ‘মেইদুম’ অর্থ হচ্ছে ‘beloved of Atum’। আধুনিক কায়রো শহরের ৭২ কিলোমিটার দক্ষিণে, নিম্ন মিশরে বহু ইটের মাস্তাবায় তৈরি করা হয়েছিল এই পিরামিড। মেইদুমের ক্ষেত্রে ফারাও স্নেফেরুর ইচ্ছা ছিল, প্রথমে তিনি ধাপ পিরামিড নির্মাণ করবেন, এরপর একে সত্যিকারের পিরামিডে রূপ দিবেন। সম্প্রতি বিশেষজ্ঞরা জানতে পেরেছেন, ফারাও স্নেফেরু মেইদুম পিরামিডের নির্মাণকাজ শুরু করেন সিংহাসনে বসার ১৫ বছর পূর্বে। এরপর তিনি মেইদুম পরিত্যক্ত করে ৪০ কিলোমিটার দূরে দাহশুরে আরও দুটি পিরামিডের কাজে হাত দেন। কারণ, মেইদুমের চুনাপাথরের আবরণ পিচ্ছিল হয়ে পিরামিডের কাঠামোকে অস্থিতিশীল করে তুলছিল। রাজত্বের ২৯ তম বছরে কী মনে করে আবারও ফিরে গেলেন মেইদুমের কাছে। তার মনে সাধ জাগল, তিনি ধাপ-পিরামিডকে সত্যিকারের পিরামিডে রূপান্তরিত করবেন। ঠিক কী কারণে তিনি মেইদুম ধাপ-পিরামিডের টানে ছুটে গিয়েছিলেন, এর কারণ এখনও অজানা। এটাও নিশ্চিত নয়, তিনি একে সত্যিকারের পিরামিডে রূপ দিতে পেরেছিলেন কিনা।
জোসেরের ধাপ পিরামিডের তুলনায় মেইদুমের আভ্যন্তরীণ কাঠামো অতি সাধারণ গোছের। এটি মূলত ইটনির্মিত তিন স্তরের একটি ধাপ-পিরামিড। তবে জোসেরের ধাপ পিরামিড থেকে মেইদুমের ধাপ-পিরামিডে কিছু ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। যেমন, এর প্রধান সমাধিকক্ষ ছিল ভূ-পৃষ্ঠের উপরে। পিরামিড কমপ্লেক্সের ভেতর উপত্যকা মন্দির, শবাগার মন্দির, করবেল পদ্ধতিতে কাজ; সবই উদ্ভাবন হয়েছিল স্নেফেরুর আমলেই। মেইদুম পরিত্যক্ত করার পর স্নেফেরুর নজর সরে আসলো দাহশুরে। প্রাচীন মিশরীয় ধর্মীয় রীতির ক্ষেত্রে এখানে কিছু বিভেদ লক্ষ্য করা যায়। যেমন, তার পূর্ববর্তী ফারাওদের ধাপ পিরামিড নির্মাণের উদ্দেশ্য ছিল, তারা ধাপ বেয়ে বেয়ে শাশ্বত নক্ষত্ররাজির সাথে মিলিত হবেন। কিন্তু স্নেফেরুর সময় ধর্মীয় রূপরেখায় কিছুটা পরিবর্তন ঘটে। সূর্য দেবতা ‘রা’ অথৈ জলরাশির মধ্যে থেকে উঠে যে বেনবেনে দাঁড়িয়েছিলেন, সেখানে থেকেই সমস্ত প্রাণের উৎপত্তি ঘটেছিল। স্নেফেরু সেটাকে প্রতীকী হিসেবে ফুটিয়ে তুলতে চাইলেন পিরামিডে।
দাহশুরের হেলানো পিরামিডের নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল ছোট এক পিরামিড হিসেবে। এর ঢালুর কোণ ছিল ষাট ডিগ্রি। কিন্তু বালু এর ভিত্তি হওয়ায় মজবুত হয়ে দাঁড়ানোর তেমন সুযোগ পায়নি পিরামিডটি। অস্থিতিশীল এই পিরামিড প্রায় ৫৪ ডিগ্রি কোণে হেলে যায়, যা আজ অবধি বিদ্যমান। ওই যুগের তুখোড় স্থাপত্যবিদেরা পিরামিডের হেলে পড়া রোধ করতে পুনরায় ধাপ পিরামিডের নির্মাণ কৌশল অনুসরণ করলেও এতে আদতে লাভ হয়নি। পিরামিডটি ভেঙে পড়বে এই আশংকায় নির্মাণের মাঝামাঝি কোনো একসময়ে এর ঢালু ৪৩ ডিগ্রি কোণে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। রেড পিরামিড নির্মাণের পর স্নেফেরু হেলানো পিরামিড নির্মাণের কাজও সম্পন্ন করে ফেলেন।
স্নেফেরুর হেলানো পিরামিডে নতুন করে দুটি জিনিস যুক্ত হয়। আগের পিরামিডগুলোতে শুধুমাত্র একটি প্রবেশপথ থাকলেও, চিরাচরিত প্রথার খোলস ভেঙে তিনি মোট দুটি প্রবেশপথের ব্যবস্থা করেন। একটি ছিল উত্তর দিকে, অপরটি ছিল পশ্চিম দিকে। এছাড়াও তিনি পিরামিডের পাশে দুটি সমাধিকক্ষ নির্মাণ করেছিলেন। এই সমাধিকক্ষদ্বয় নির্মাণের কারণ বিশেষজ্ঞদের নিকট এখনও অজানা। হয়তো তিনি নির্দিষ্ট কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য এগুলো তৈরি করেছিলেন। মেইদুমের মতো এই হেলানো পিরামিডেও ছিল স্যাটেলাইট পিরামিড, পিরামিড কমপ্লেক্স, উপত্যকা মন্দির ও শবাগার মন্দির। তবে অতশত আয়োজনের পরেও তাকে সমাহিত করা হয়েছিল তার নির্মিত সর্বশেষ পিরামিড- রেড পিরামিডে। সেখানেই চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন তিনি।
রেড পিরামিডকে বলা হয় মিশরের প্রথম সত্যিকারের পিরামিড। এটি স্নেফেরুর নির্মিত তৃতীয় পিরামিড, যা নির্মাণ করা হয়েছিল খ্রি.পূ. ২৫৭৫ অব্দ থেকে ২৫৫১ অব্দের মধ্যে। কোনো কোনো প্রত্নতত্ত্ববিদের মতে, রেড পিরামিড বানাতে সময় লেগেছিল ১৭ বছর। আবার কেউ কেউ দাবি করেন, ১০ বছর ৭ মাসেই এর কাজ সম্পন্ন হয়েছিল। রেড পিরামিড বেন্ট পিরামিডের এক কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত। কুশলতাজনিত কারণে বেন্ট বা হেলানো পিরামিড যখন হেলে পড়ছিল (এর ঢালুর কোণ যখন ৪৩ ডিগ্রি ছিল), তখনই রেড পিরামিডের কাজে হাত দিয়েছিলেন স্নেফেরু। এই রেড পিরামিড নির্মাণে তিনি কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছেন- এর কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। হেলানো পিরামিডে হেলে পড়া নিয়ে যে সমস্যায় ভুগতে হয়েছিল সেটা নিরাময়ের জন্য স্নেফেরু রেড পিরামিডের ভিত্তিকে অধিক প্রশস্ত করে দিয়েছিলেন। এর ফলে পুরো পিরামিডের ভর আরও বেশি জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। তাই এটি হয়েছিল অন্যান্য পিরামিডের তুলনায় অধিক স্থিতিশীল। সকল মিশরীয় পিরামিডের মধ্যে আকারে এর ভিত্তি হলো দ্বিতীয় বৃহত্তর।
এই রেড পিরামিড ‘নর্দান পিরামিড’ নামেও পরিচিত। লালচে লাইমস্টোন (চুনাপাথর) দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল বলে একে ‘রেড পিরামিড’ বলা হয়। মজার ব্যাপার হলো, স্থানীয়রা এই পিরামিডকে রেড পিরামিড নামে অভিহিত না করে, ‘এল-হেরাম এল-ওয়াতওয়াত’ বলে সম্বোধন করে। যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায়, ‘বাদুর পিরামিড’। খুফুর পিরামিড, খাফ্রের পিরামিডের এটি হলো কায়রো শহরের তৃতীয় বৃহত্তর পিরামিড। এই পিরামিডের আভ্যন্তরীণ অবকাঠামো নির্মাণে তিনি অবশ্য মেইদুম ও বেন্ট পিরামিডের নকশার সাহায্য নিয়েছিলেন। বাকি দুই পিরামিডের মতো এই রেড পিরামিডেও স্নেফেরু সমাধিকক্ষ নির্মাণ করেছিলেন ভূ-পৃষ্ঠের উপরে। উত্তরদিকে ছিল এর প্রবেশপথ। প্রায় ৬৩ মিটার লম্বা একটি সরু পথ নিচের দিকে নেমে গিয়ে একটি আনুভূমিক করিডোরের সাথে মিশেছিল। এর পাশেই ছিল করবেলড প্রযুক্তিতে ছাদ করা দুটি অ্যান্টিচেম্বার। এদের অবস্থান ছিল মূল সমাধিকক্ষের বিপরীতে।
সমাধিকক্ষের আয়তন ছিল (৪.১৮ × ৮.৫৫) মিটার, যেখানে করবেলড ছাদের উচ্চতা ছিল ১৪.৬৭ মিটার। পিরামিডের পূর্বদিকের বিপরীতে নির্মাণ করা হয়েছিল একটি শবাগার মন্দির। স্নেফেরুর মৃত্যুর পর তাড়াহুড়োর মাধ্যমে সমাপ্ত করা হয় এর কাজ। পিরামিড থেকে উপত্যকা মন্দিরে যাওয়ার কোনো সংযোগ সড়কের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। সমাধিকক্ষে প্রবেশের পথ ছিল মাত্র একটি, যেটার সাথে দ্বিতীয় অ্যান্টিচেম্বারের দেওয়াল সংযুক্ত ছিল।
রেড পিরামিড পিরামিডের আচ্ছাদন হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে সাদা রংয়ের তুরা লাইমস্টোন। মধ্যযুগে অধিকাংশ তুরা লাইমস্টোন পিরামিড থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল কায়রো শহরের দালান-কোঠা নির্মাণের জন্য। সাদা লাইমস্টোনগুলো সরে যাওয়ার পরই লাল লাইমস্টোনগুলো উন্মোচিত হয়। এই পিরামিডে পাথরের ৬০টি স্তর বিদ্যমান।
মিশরীয় পিরামিডের সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা হলে অবশ্যই তাতে স্নেফেরুর নাম উঠে আসবে। কারণ, তিনিই ছিলেন মিশরের প্রথম সত্যিকার পিরামিডের সফল স্বপ্নদ্রষ্টা। পৃথিবীর ইতিহাসে রেড পিরামিড সবসময় অনন্য এক স্থাপত্যশিল্পের উদাহরণ হয়ে থাকবে।