বসন্ত, বাংলাদেশের বৈচিত্র্যমন্ডিত ষড়ঋতুর একটি। ইংরেজিতে যাকে বলে স্প্রিং। নানা উদযাপনের মধ্য দিয়েই আমরা বরণ করে নেই বসন্তকে। কিন্তু কখনো কি ভেবে দেখেছেন, বসন্তে আমাদের দিনগুলো বড় হতে থাকে, স্প্রিংয়ের মতোই লাফিয়ে লাফিয়ে যে বড় হতে থাকে, এমন বলতেও অত্যুক্তি হবার কথা না।
আবার শুভ্র শরতে কেমন যেন দিনগুলো নান্দনিকতার রেশ ধরে রেখেই আস্তে আস্তে ছোট হতে থাকে। শরতের ইংরেজী ‘ফল’ (Fall), আর শরতেই স্বাভাবিকভাবে সময় ‘ফল’ করে, অর্থাৎ দিনের সময় কমতে থাকে।
কিন্তু কেন? এটা আপাতত ভাবনার খোরাক হিসেবেই থাকুক!
ডেলাইট সেভিং টাইম আবার কী?
এককথায়, ঘড়ির সময় ১ ঘন্টা কিংবা ২ ঘন্টা এগিয়ে দেবার রীতিই ডেলাইট সেভিং টাইম (Daylight Saving Time)। এই রীতিতে বসন্তে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের উত্তর গোলার্ধে বসন্তকালে ঘড়ির কাঁটা এক ঘন্টা এগিয়ে নেয়া হয় এবং শরতে এক ঘন্টা পিছিয়ে দেয়া হয়। ফলে সূর্যাস্ত-সূর্যোদয় হয় ঘন্টাখানেক পরে আর বিকেলে পাওয়া যায় কিছু অতিরিক্ত সময়।
আপনি হয়তো শুনে থাকতে পারেন, বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন নামের কেউ একজন এই ডেলাইট সেভিং টাইম প্রবর্তন করেছেন। তবে বিষয়টা কিন্তু আদতে একদমই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে আবিষ্কারের মতো কোনো বিষয় ছিল না। ১৭৮৪ সালে তিনি জার্নাল অফ প্যারিসকে তার নিজের ভোর ৬ টায় সূর্যকিরণের ছোঁয়ায় ঘুম ভেঙে যাবার ঘটনাই বর্ণনা করে ব্যাঙ্গ-তামাশার ছলে একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন, যেখানে তিনি ভুল করেও দুপুরের আগে ঘুম ভাঙার কথা ভাবেননি।
আমি মনে করেছিলাম যে, যদি একদম খুব ভোরেই ঘুম না ভেঙে যেত আমার, তাহলে পরে কম করে হলেও সূর্যের আলোতেই তথা দিবালোকেই আমার আরো ঘন্টা ছয়-সাত বেশি ঘুমানোর কথা ছিল, বদৌলতে আমার পরবর্তী রাতে ঘন্টা ছয়-সাত কুপির আলোতে বেশি জেগে থাকার কথা ছিল।
এমনই লিখেছিলেন বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন ওই চিঠিতে।
কিন্তু কুপির আলোর ব্যবস্থা করতে তো খরচ আছে, অথচ সূর্যের আলো তো পাওয়া যায় পুরোপুরি নিখরচায়। আর ঠিক এই চিন্তা করেই বেঞ্জামিন ঠিক করলেন তিনি প্যারিসের মানুষদের বিষয়টা ভালো করে বোঝাবেন আর সবাইকে উদ্বুদ্ধ করবেন যাতে করে সবাই শরতে আর গ্রীষ্মে সূয্যিমামার সাথেই জাগে। অর্থাৎ প্রভাতে দিবাভাগে সূর্যোদয় হয়ে যাবার পরেও যে অতিরিক্ত সময়টুকু মানুষ ঘুমিয়ে থাকে, তিনি সেই সময়টুকুই বাঁচাতে চাইছেন। এতে করে জৈবঘড়ি অনুযায়ী রাতে একটু আগেভাগেই সবার ঘুম চলে আসবে (বসন্ত-গ্রীষ্মে)। কুপির পেছনে খরচও কমে যাবে, আর দিনের আলোর সুব্যবহারও নিশ্চিত করা যাবে, তাড়াতাড়ি সব কাজ শুরু করা যাবে। অর্থাৎ জাগতিক সব কার্যক্রমই কিছু সময় এগিয়ে আসবে। আর সাশ্রয় হবে শক্তি।
হতে পারে ফ্রাঙ্কলিন ভাবনাটাই ভেবেছেন শুধু, পরে আর এই উদ্বুদ্ধকরণের পরিকল্পনার বাস্তবায়নে তিনি খুব একটা মনোযোগী ছিলেন না, বলা যায় আধা-সিরিয়াস। সে যা-ই হোক, ঘুরে-ফিরে কিন্তু চিঠির মূল বিষয়বস্তু আর উদ্দেশ্য ছিল ফরাসিদের অতিরিক্ত অলসতা আর ঘুমের জন্য ব্যাঙ্গ করা।
ফ্রাঙ্কলিনের এই চিঠি তৎকালীন ফ্রান্স আর আমেরিকায় কোনো ধরনের সময় পরিবর্তন তথা সময়ের সংযোজন-বিয়োজনের মতো ঘটনা কিংবা রেওয়াজের জন্ম দিতে না পারলেও দিবালোকের সময় সাশ্রয়ের মতো বিষয়কে উসকে দিতে পেরেছে এবং ঘড়ির কাঁটার নড়চড় করে তুলনামূলকভাবে অতিরিক্ত দিবালোক সংরক্ষণ তথা শক্তি (সৌরশক্তি) সঞ্চয়ের মূল মন্ত্র দিয়ে যেতে পেরেছে।
বেঞ্জামিন যা চেয়েছিলেন, ঠিক সেটাই কীভাবে সাধারণ মানুষের অভ্যাস হয়ে উঠেছিলো?
সত্যিকার অর্থে, উনবিংশ শতাব্দীর আগে সময় পরিবর্তন তথা ঘড়ির কাঁটা নড়চড় করার মতো কোনো পরিকল্পনা কেউ নিয়ে আসবে এমন কেউই ছিল না। গ্রেট ব্রিটেনে প্রভাবশালী কিছু অধিবক্তাদের গ্রুপ ডেলাইট সেভিং টাইমের বিষয়ে সরকারের কাছে তদবির করেছিলেন। কিন্তু সরকার তা প্রত্যাখ্যান করে।
বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, আর যুদ্ধের সময়ে অর্থকড়ি সাশ্রয় করা, ধন-সম্পদ মজুদ করা, এসব স্বাভাবিক কৌশলগুলোর একটা। আর এমনই যুদ্ধ অন্তর্বর্তীকালীন এক সময়ে জার্মানি ভাবছিলো কী করে অর্থ সাশ্রয় করা যায়। আর এই অর্থকড়ি সাশ্রয় করার উপায় অনুসন্ধান করতে গিয়েই জার্মানি এই আইডিয়া কাজে লাগায় এবং নিজস্ব ডেলাইট সেভিং টাইম প্রোগ্রাম চালু করে। এরপর ডেলাইট সেভিং টাইমের তাৎপর্য অনুধাবন করে আমেরিকা ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশও সেই পথ অনুসরণ করতে খুব বেশি সময় নেয়নি। অনেক দেশ এখনও এই ফরম্যাট অনুসরণ করে, আবার অনেক দেশ করেনা।
আফ্রিকার অধিকাংশ দেশই ডেলাইট সেভিং টাইমের বিষয়টিকে খুব একটা ভালোভাবে গ্রহণ করেনি, যদিও মিশির, লিবিয়া, নামিবিয়ার মতো কিছু দেশ রয়েছে ব্যতিক্রম, স্লিপ ডট অর্গের তথ্যানুযায়ী। চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান এবং ভারতও এটি অনুসরণ করে না।
অস্ট্রেলিয়ায় এই ফরম্যাট ব্যবহার করা হবে কি না তা সম্পূর্ণই অঙ্গরাজ্যগুলোর উপর নির্ভর করে এবং সেই ক্ষমতাবলেই পশ্চিম অস্ট্রেলিয়া, কুইন্সল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়ার উত্তরাঞ্চল এটি অনুসরণ করে না।
তবে বর্তমানে ডেলাইট সেভিং টাইমনিয়ে বিতর্কটা বেশ জমে উঠেছে। ধন্যবাদ সেই নতুন গবেষণার পেছনের সব মহারথীদের, যাদের অক্লান্ত গবেষণায় প্রতীয়মান হয়েছে যে, এই ধারণাটি প্রকৃতপক্ষে কোনো টাকা-পয়সা বাঁচাতে পারে না, আর তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনও আনতে পারেনি।
উত্তর আমেরিকা এবং ইউরোপের বাইরের বেশিরভাগ দেশই নিজেদের ঘড়ির কাঁটায় কোনো পরিবর্তন আনার কথা কখনও আমলে নেয়নি। একইভাবে অ্যারিজোনা, হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের মানুষজনও কখনও এই বিষয়টিকে খুব একটা ধাতে লাগায়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কেবলমাত্র এই দুটি অঙ্গরাজ্যই ডেলাইট সেভিং টাইম পালন করে না। আর ইউরোপে এমন রয়েছে শুধুমাত্র একটি দেশ, আইসল্যান্ড, যে দেশে বিশেষ সময়ে ২৪ ঘন্টাও দিবালোক বিরাজমান থাকে।
২০ জুন, ২০০৯; প্রথমবারের মতো বাংলাদেশেও শুরু হয়েছিলো ডেলাইট সেভিং টাইম। কিন্তু এই নিয়ম এ দেশে বেশিদিন টেকেনি। ডিজিটাল-অ্যানালগ টাইম এবং প্রচন্ড অনাগ্রহ আর অজনপ্রিয়তার ফলে সরকার তা পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়। ভবিষ্যতে আর কখনও এমন সময়ের ফরম্যাট প্রবর্তন করা হবে না বলেও দেশে সরকারি সিদ্ধান্ত বলবৎ হয়।