২২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৫; আমেরিকার আলাবামা রাজ্যের মবিল বন্দর থেকে নয় নাবিক নিয়ে ছাড়ে কলম্বিয়া নৌবাহিনীর ‘ক্যালডাস’ নামের এক জাহাজ। নৌ-মহড়া দিয়ে ফেরায় বেশ ভালোরকম গোলাবারুদ আর অস্ত্রশস্ত্র বোঝাই ছিল জাহাজটি। জাহাজের লক্ষ্য ছিল কলম্বিয়ার কার্টাগেনা বন্দরে ফেরা। এর চারদিন পর, ২৬ ফেব্রুয়ারি, জাহাজটি মেক্সিকো উপসাগরে এসে পৌঁছায়। আগে থেকেই সতর্কবার্তা ছিল, ২৫-৩০ ফেব্রুয়ারি মেক্সিকো এবং ক্যারিবীয় অঞ্চলের আবহাওয়া কিছুটা প্রতিকূল থাকতে পারে। তারপরও সাগরে হালকা ঢেউ দেখে নাবিকরা পাড়ি জমান মেক্সিকো উপসাগরের মধ্য দিয়ে। তখন হালকা ঢেউয়েও দুলছিল জাহাজ।
২৬ তারিখ বেশ নির্ঝঞ্ঝাট কাটলেও ২৭ ফেব্রুয়ারি দুপুরের পর থেকে সমুদ্রে আবহাওয়া পরিস্থিতি কিছুটা খারাপের দিকে যেতে থাকে। জাহাজটি তখন বন্দর থেকে ২৪ ঘণ্টার দূরত্বে। ২৭ তারিখ রাত ১০টা থেকে জাহাজ বেশ জোরেশোরে দুলতে শুরু করল, যেটি মধ্যরাতে গিয়ে প্রকটাকার ধারণ করে। রাত দুটোর সময় জাহাজ ভয়ঙ্করভাবে দুলতে থাকায় সবাই আশ্রয় নিল ডেকের বিভিন্ন আসবাবপত্রের মাঝে। ওপর থেকে নির্দেশ এলো লাইফ জ্যাকেট পরার। কিন্তু বিধিবাম, কয়েকঘণ্টা পর, ২৮ ফেব্রুয়ারি সকাল ১১টা ৫০ মিনিটে হঠাৎ জাহাজটি শূন্যে উঠে গেল এবং নাবিক আর জিনিসপত্র সব ছিটকে পড়ল জাহাজের বাইরে। তখন কার্টাগেনা সমুদ্রবন্দর থেকে জাহাজের দূরত্ব ৫০ মাইল।
তবে সেখান থেকে নয়জনের মধ্যে বেঁচে ফিরেছিলেন শুধু একজন। তার নাম লুই আলেহান্দ্রো ভেলাসকো। তিনি সমুদ্রের প্রতিকূল আবহাওয়ায় দশ দিন দশ রাত ক্ষুধা, তৃষ্ণা এবং হাঙরের সাথে লড়াই করে টিকে বেঁচে ফেরেন। সবাই যখন জাহাজ থেকে ছিটকে পড়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়, তখন তিনি আঁকড়ে ধরেন জাহাজ থেকে পড়ে যাওয়া একটা বোট। তারপর চোখের সামনে একে একে মারা যেতে দেখেন তার বন্ধু রেমন হেরেরা, লুই রেনগিফো, জুলিও আমাডোর, ও এডওয়ার্ড কাস্টিলকে। দুর্ঘটনার দিন বিকেল চারটায় ঝড় থামে। প্রচণ্ড মানসিক ও শারীরিক যন্ত্রণা নিয়ে লুই অপেক্ষা করতে থাকেন উদ্ধারকারী হেলিকপ্টারের। কিন্তু হেলিকপ্টারের দেখা নেই।
এদিকে তৃষ্ণা আর ক্ষুধার তাড়নায় প্রতিদিন জুতোর সোল এবং পকেটে আগে থেকেই রয়ে যাওয়া কার্ড কেটে চুইংগামের মতো চিবিয়ে ক্ষুধার জ্বালা মেটান তিনি। প্রতিদিন বিকালে সময় মেনে শুরু হয় হাঙরের চোখরাঙানি আর আক্রমণ। তার উপর রোদের তাপে চামড়া পুড়ে তামাটে বর্ণ ধারণ করেছে। এভাবে দেখতে দেখতে সমুদ্রে আটটি দিন কেটে যায় তার। সমুদ্রে কাটানো নবম দিন হঠাৎ মাথার উপরের চিল দেখে তিনি আন্দাজ করেন, কূলের একেবারে কাছাকাছি চলে এসেছেন। তখন আর আগের মতো সমুদ্রের পানি নীল নয়, কিছুটা সবুজ বর্ণ ধারণ করেছে।
এরপর বারো ঘণ্টা অতন্দ্র অপেক্ষার পর আশ্চর্যজনকভাবে কিছু শেকড়-বাকড় চোখে পড়ল তার। সেটা দিয়ে কিছুটা ক্ষুধা মিটিয়ে আশা-হতাশার মাঝে দুলতে দুলতে অপেক্ষা করতে থাকলেন কূলের। হঠাৎ দিগন্তের দিকে তাকিয়ে কিছু নারকেল গাছ দেখতে পেলেন। তারপর বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহের পর অর্ধমৃত অবস্থায় তীরে পৌঁছালেন। অবশেষে দশদিনের অমানুষিক কায়ক্লেশের পর ৭ মার্চ তার মুক্তি মেলে সাগর থেকে।
তার উদ্ধারলাভের জায়গা ছিল কলম্বিয়ার সান জুয়ান উরারা অঞ্চলের উপকূলে। সমুদ্র থেকে বেঁচে ফিরে রীতিমতো জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন লুই অ্যালহান্দ্রো ভেলাসকো। কেউ কেউ তাকে বীর খেতাবেও ভূষিত করতে লাগল। তাকে একপলক দেখার জন্য দূরদূরান্ত থেকে লোকজন এসে ভিড় করতে থাকে তার কার্টাগেনার বাড়িতে। সাংবাদিকেরা ছদ্মবেশে আসতে থাকে তার সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য। সারাদেশের মানুষজন মাতামাতি করল তাকে নিয়ে।
১০ মার্চ তার নিজ শহরে ফেরার পর তাকে জুনিয়র নাবিক পদ থেকে এক লাফে নৌবাহিনীর ক্যাডেট পদে উন্নীত করা হয়। তার ঘড়ি, যাতে সমুদ্রের সেই প্রতিকূল দিনগুলোতে সময় দেখেছিলেন, সেই কোম্পানি তাকে পাঁচশো পেসো আর একটা নতুন ঘড়ি উপহার দেয়। ‘ক্যালডাস’ জাহাজে থাকতে কোনো এক অখ্যাত কোম্পানির চুইংগাম খাওয়ায় ওই কোম্পানি এসে হাজার পেসো দিয়ে যায় তাকে। যে জুতোর সোল খেয়ে সমুদ্রে নিজের ক্ষুধা আর তৃষ্ণা মিটিয়েছেন, সেই জুতোর কোম্পানিও তাকে উপহার দিয়েছিল ছয় হাজার পেসো।
কলম্বিয়ান নোবেলজয়ী লেখক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ তখন সাংবাদিক ছিলেন। তিনিই একমাত্র সাংবাদিক, যিনি লুইয়ের সমুদ্র থেকে ফিরে আসার পর তার পূর্ণাঙ্গ সাক্ষাৎকার নেন। প্রায় বিশ দিন, প্রতিদিন ছয় ঘণ্টা করে তার সাক্ষাৎকার নিতেন মার্কেজ। কিন্তু সেসময় সেখানকার সামরিক শাসক সংবাদপত্রের উপর বিভিন্ন বিধিনিষেধ জারি করায় তার সাক্ষাৎকার ছাপাতে পারেননি তিনি। এর ঠিক পনেরো বছর পর মার্কেজ তার এই সাক্ষাৎকারের উপর ভিত্তি করে এক বই লিখে ফেলেন; নাম- ‘দ্য স্টোরি অভ অ্যা শিপরেকড সেইলর‘।
লুইয়ের বীরত্ব ছিল ক্ষুধা ও তৃষ্ণা সাথে নিয়ে দশদিন-রাত ধরে টিকে থাকা। সেই দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে ফেরার আগপর্যন্ত তিনি কল্পনাও করতে পারতেন না, একজন লোক শুধু নিজের জীবন রক্ষার চেষ্টা করেও বীর বনে যেতে পারে। মার্কেজের সাক্ষাৎকারের একপর্যায়ে লুই বলেন,
“দশ হাজার কেন, এক মিলিয়ন ডলার দিলেও আর কখনো সমুদ্রভ্রমণের মতো মারাত্মক অভিযানে আমি যাব না।”
১৯৩৪ সালে কলম্বিয়ার কার্টাগেনায় জন্মগ্রহণ করেন লুই আলেহান্দ্রো ভেলাসকো। প্রথম জীবন নৌবাহিনীর নাবিক হিসেবে কাটালেও মাঝে সমুদ্রের তথাকথিত বীরত্বের জন্য ক্যাডেট অফিসার হিসেবে ছিলেন। তবে শেষজীবন নিজের জন্মস্থানে লেখালেখি করে কাটিয়েছেন তিনি। ২০০০ সালের ২ আগস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ৬৬ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। মৃত্যুর আগে নিজের পরিবারের কাছে ইচ্ছাপোষণ করে গেছেন, মৃত্যুর পর তার দেহ পুড়িয়ে ক্যারিবীয় সাগরের সেসব জায়গায় ছিটিয়ে দিতে, যেখান থেকে ৪৫ বছর আগে বেঁচে ফিরেছিলেন তিনি।