বেলারুশের এক ছোট গ্রাম স্ট্যানকোভিচ। নভোগ্রুদেক আর লিডা নামের দুই শহরের মাঝে পড়েছে গ্রামটা; শান্ত, নির্ঝঞ্ঝাট জীবনযাপন করে গ্রামের বাসিন্দারা। বিয়েলস্কি পরিবার এই গ্রামেরই একমাত্র ইহুদী পরিবার। কৃষিকাজ আর কারখানা চালিয়ে নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করে তারা। পরিবারটি বেশ সচ্ছলই বলতে গেলে।
এই পরিবারের প্রধানের নাম ডেভিড, তার স্ত্রীর নাম বেলিয়া। সব মিলিয়ে বারোজন সন্তানের জনক-জননী তারা। তাদের দ্বিতীয় সন্তানের নাম তুভিয়া; কালো চুলের লম্বা, সুদর্শন একজন মানুষ সে। অন্য ভাই-বোনদের তুলনায় বেশ বুদ্ধিমান। সাম্প্রতিক কোনো ঘটনাকে ধর্মগ্রন্থের আলোকে এমনভাবে ব্যাখ্যা করে যে সবাই খুব অবাক হয়ে যায়। সবারই ধারণা, তুভিয়া জীবনে একদিন অনেক বড় কিছু করবে।
তাদের আরো দুই ভাই যুস বিয়েলস্কি ও অ্যাসায়েল। দুজন একটু মারদাঙ্গা প্রকৃতির, কথার আগে হাত চলে তাদের। তাদের দোষও যে খুব দেয়া যায়, তাও নয়। গ্রামে অন্য কোনো ইহুদী পরিবার না থাকায় বিভিন্ন সময়ে নানারকম কটূক্তি, বৈষম্য, ক্ষেত্র-বিশেষে নির্যাতনও সহ্য করতে হয়েছে তাদের। নিজেদের অস্তিত্বের প্রশ্নেই তাই এরকম হতে বাধ্য হয়েছে ওরা।
আরেক ভাইয়ের নাম অ্যারন বিয়েলস্কি। টিনএজ এক ছেলে ও, গা থেকে এখনো বের হয় কৈশোরের গন্ধ। বাস্তবতা কী জিনিস, তা এখনো বুঝে ওঠেনি ছেলেটা।এই চার ভাইকে কঠোর বাস্তবতা ও বেঁচে থাকার সংগ্রামের মুখোমুখি দাঁড় করালো হিটলার-বাহিনী। দিনটা ১৯৪১ সালের ৮ই ডিসেম্বর।
রাশিয়ার কাছ থেকে বেলারুশ স্বাধীনতা লাভ করে ১৯৯১ সালে। ১৯৩৯ সালের আগে বেলারুশের নাম ছিল বেলোরুশিয়া, পোল্যান্ডের অন্তর্গত ছিল তারা। ১৯৩৯ সালে হিটলার আর স্ট্যালিন জোট বেঁধে আক্রমণ করলেন পোল্যান্ড, জোট বেঁধে দখল করে নিলেন দেশটাকে। আগের চুক্তি অনুযায়ী বেলারুশ ছেড়ে দেয়া হলো রাশিয়াকে। আর পোল্যান্ড আক্রমণের মাধ্যমে শুরু হয়ে গেল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। দুই বছর পরে, নিজের করা চুক্তির কথা ভুলে গেলেন হিটলার, অপারেশন বারবারোসার মাধ্যমে আক্রমণ করে বসলেন রাশিয়াকেই। ফলে এতদিন নিরাপদ থাকলেও, এবার ফুয়েরারের তোপের মুখ পড়লো বেলারুশ। আর তার প্রেক্ষিতেই স্ট্যানকোভিচে হামলা চালালো জার্মান সেনারা।
স্ট্যানকোভিচে হামলার দিনই মারা গেলেন ডেভিড আর বেলিয়া, সাথে মারা গেল তাদের আরও দুই সন্তান। বেলারুশের নানা প্রান্ত থেকে ইহুদীদের ধরে আনছিল জার্মান সেনারা, এবং প্রায় সাথে সাথেই মেরে ফেলছিল তাদের। জীবন বাঁচানোর তাগিদে পরিবারের বাকি সবাইকে নিয়ে পালালো তুভিয়া। পরিবারের সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় ত্রিশ জন, তাই সেফ হাউজে আশ্রয় নিল আপাতত।
সামরিক প্রশিক্ষণ ছিল তুভিয়ার। তাই ও বুঝতে পারছিল, সেফ হাউজে বেশিদিন লুকিয়ে থাকা সম্ভব হবে না। তাহলে উপায় কী? যুস আর অ্যাসেলের সাথে পরামর্শ করলো ও। সিদ্ধান্তে উপনীত হলো, সবাইকে নিয়ে বেলারুশের গহীন জঙ্গলে সরে যেতে হবে।
পরিবারের অনেকেই রাজি হলো না প্রথমে। কিন্তু কারো কথা কানে তুললো না ওরা। ১৯৪২ সালের শুরুর দিকে গহীন বনে আশ্রয় নিলো তুভিয়ারা। বনটা আসলেই গভীর ছিল, তাই নিরাপত্তা নিয়ে সন্দেহ ছিল না কারো মনে। নিরাপদ আশ্রয় মিললো। এবার পাল্টা আঘাতের পালা!
যদি ভেবে থাকেন, বিয়েলস্কি ভাইদ্বয় এবার জার্মান বাহিনীর সাথে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত হবে, তবে ভুল ভাবছেন। সে সময় জার্মান অধ্যুষিত অঞ্চলে ইহুদী পরিচয়ের মানে একটাই, নির্মম মৃত্যু। সেই ইহুদীদের বাঁচানোর চেয়ে জার্মানদের জন্য পাল্টা আঘাত আর কী হতে পারে?
এই বুদ্ধিটা বের হলো তুভিয়ার মাথা থেকে। আবার পরামর্শে বসলো ও ভাইদের সাথে। বেলারুশে তখন ঘেটো (বস্তি) বানানো হয়েছে, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ইহুদীদের এনে রাখা হচ্ছে সেখানে। সেখানকার পরিবেশ মানবেতর বলাটাও বেশি হয়ে যায়। অবশ্য যেখানে জীবনেরই কোনো নিশ্চয়তা নেই, সেখানে অন্য কিছু নিয়ে মাথা ঘামায়ই বা কে? তুভিয়ার পরিকল্পনাটা এমন, এই ঘেটোতে গিয়ে ইহুদীদের সাথে দেখা করবে ওদের লোক। যারা রাজি হবে, তাদেরকে নিয়ে আসা হবে এই জঙ্গলে।
যুস আর অ্যাসায়েল প্রথমেই নাকচ করে দিল এই প্রস্তাব। ওদের বক্তব্য ছিল, মানুষ কম থাকার কারণে যত সহজে ওরা সবকিছু ম্যানেজ করতে পারছে, বেশি মানুষ হলে তা আর সম্ভব হবে না। কিন্তু তুভিয়া বললো, ‘দশজন নাৎসিকে মারার চেয়ে একজন ইহুদী বুড়িকে বাঁচানো আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’
পাকা সিদ্ধান্ত হয়ে গেল। এই কাজের ভার পেলো অ্যারনসহ আরও কয়েকজন। বয়স একদম কম হওয়ায় অ্যারনকে খুব কমই সন্দেহ করতো জার্মান সৈন্যরা। ঘেটোতে গিয়ে ইহুদী লোকজনের সাথে দেখা করতে লাগলো ওরা, জঙ্গলে পালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে ফুসলাতে লাগল। সহজ হলো না ব্যাপারটা। এক দল ইহুদীর ধারণা ছিল, নাজিরা আর যা-ই করুক, খুন করবে না ওদের। আরেক দল পালাতে রাজি ছিল বটে, কিন্তু বনের মধ্যে কী খাব, জীবনযাত্রা কী হবে, এই দুশ্চিন্তায় ভুগছিল। ঘেটোতে তো তাও দু’বেলা খাবার পাওয়া যায়। আরেক দল ছিল, যারা চিন্তা করলো, ঘেটোতে থাকলে এমনিতেও মরতে হবে, তার চেয়ে পালিয়ে দেখাই যাক না। মরার আগে একবার চেষ্টা করলে তো ক্ষতি নেই।
এরপর শুরু হয়ে গেল ইহুদীদের পলায়ন। বিয়েলস্কি ভাইদের লোক পথের হদিশ জানিয়ে দেয়, এরপরে একজন, দুজন করে রোজই কেউ না কেউ হাজির হতে লাগল জঙ্গলে। এভাবে ১৯৪২ সালের শেষে বিয়েলস্কি ভাইদের ক্যাম্পে লোকসংখ্যা দাঁড়ালো ৩০০ তে!
মানুষ সামাজিক প্রাণী। একা সে থাকতে পারে না। কয়েকজন হলেই তারা একটা সমাজ গড়ে তোলে। এখানেও তা-ই হলো। মানুষ আগে থেকেই ছিল, সেই সাথে নিয়মিত ভিত্তিতে আসছিল আরও ইহুদী। ফলে বনের মাঝে গড়ে উঠলো এক টুকরো ‘জেরুজালেম’।
মানুষ বেড়ে গেল। বেশি পরিমাণে দরকার হতে লাগলো সবকিছুই। এবার খাবারের জন্য আশেপাশের কৃষকদের দ্বারস্থ হতে লাগলো ওরা। এতে সর্বনাশ হওয়ার সম্ভাবনা ছিল ষোল আনা। কারণ, কৃষকদের একজনও যদি নাৎসিদের স্পাই হতো, তবেই খেল খতম হয়ে যেত ওদের। অনেক কৃষকই স্বেচ্ছায় খাবার দিল, আর যারা দিলো না কিংবা দিতে চাইলো না, চুরি করে আনা হলো তাদের বাড়ি থেকে।
এদিকে মানুষ বেড়ে যাওয়ায় তুভিয়াও বুঝতে পারল, অস্ত্র দরকার ওদের। হ্যাঁ, ওরা কোনো সশস্ত্র সংগ্রামে যাচ্ছে না ঠিকই, কিন্তু অস্ত্র সবসময় জীবন কেড়েই নেয় না। কখনো কখনো জীবন বাঁচায়ও।
এই অস্ত্র সংগ্রহের জন্য নন-জুয়িশ পার্টিজানদের সাথে যোগাযোগ করলো তুভিয়া। সহজ হলো না কাজটা। কারণ ওদেরকে বিশ্বাস করতে পারছিল না নন-জুয়িশ পার্টিজানরা। সেই অসাধ্যও সাধন করলো তুভিয়া। ওই এলাকার সোভিয়েত পার্টিজান কমান্ডার ভাসিলি ইয়েফিমোভিচ চেরনিশেভের সাথে মৈত্রী স্থাপন হলে অস্ত্র পায় ওরা। পরে সেই পার্টিজানদের সাথে লড়াইও করে একসাথে।
এদিকে দিনদিন বাড়ছিল আগত ইহুদীর সংখ্যা। অনেকেই পথ খুঁজে পাচ্ছিল না, পথও হারাচ্ছিল অনেকে। এবার ভিন্ন ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হলো বিয়েলস্কি ভাইরা। ইহুদীরা কখন নিজে থেকে এসে ওদের ক্যাম্পে পৌঁছাবে, সে অপেক্ষায় থাকার উপায় ছিল না। তাই ঘেটোতে লোক পাঠাতে শুরু করলো ওরা। যারা পালাতে চায়, পথ দেখিয়ে তাদেরকে নিয়ে আসা হলো সেই বনে। ১৯৪৩ সালের শেষে বনের মাঝের সেই জেরুজালেমে লোকসংখ্যা দাঁড়াল ১২০০!
কী ছিল না সেখানে? ঘুমানোর জন্য ক্যামোফ্লেজড ডাগআউট, বড় একটা কিচেন, একটা কারখানা, একটা বেকারি, একটা বাথহাউজ, দুটো ডাক্তারখানা, একটা ট্যানারি, একটা স্কুল, এমনকি একটা থিয়েটার পর্যন্ত ছিল!
বিয়েলস্কি ভাইয়েরা যে কী অসাধ্য সাধন করেছিল, তা কোনভাবেই লিখে বোঝানো সম্ভব নয়, তবুও চেষ্টা করা হয়েছে এই লেখায়। এবার শেষটুকু আপনাদের জানানো যাক।
১৯৪৪ সালের জুলাইয়ে অপেক্ষার অবসান ঘটে সেই লড়াকু ১২০০ ইহুদীর, যখন রেড আর্মির তাড়া খেয়ে পালায় জার্মানরা। জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসে ‘বিয়েলস্কি জনগণ’। ইউনাইটেড স্টেটস হলোকাস্ট মেমোরিয়াল মিউজিয়ামের তথ্যানুযায়ী, এদের মধ্যে ৭০%ই ছিল বয়স্ক পুরুষ, নারী ও শিশু। বিয়েলস্কি ভাইয়েরা উদ্ধার না করলে এদের পরিণতিই হতো একটাই। নাৎসিদের সাথে যেসব পার্টিজানবাহিনী লড়াই করছিল, তাদের মধ্যে জনসংখ্যার কারণে এই বাহিনীটা খুবই অস্বাভাবিক ছিল।
ভাইদের মধ্যে সবার প্রথমে মারা যায় অ্যাসায়েল, ১৯৪৫ সালে কনিগসবার্গের লড়াইয়ে মৃত্যু ঘটে তার। ১৯৪৮ সালের যুদ্ধে ইজরায়েলি সেনাবাহিনীর হয়ে লড়ে বাকি তিন ভাই; তুভিয়া, যুস আর অ্যারন। যুদ্ধ শেষ হলে আমেরিকায় পাড়ি জমায় তারা, নিজেদের একটা ট্যাক্সি সার্ভিস প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা খুলে বসে। তুভিয়া মারা যায় ১৯৮৭ সালে, যুস মারা যায় ১৯৯৫ সালে। আর সবার ছোট, সেদিনের সেই টিনএজ কিশোর অ্যারন বেঁচে আছে আজও। বিয়েলস্কি ভাইদের প্রতিরোধের শেষ সাক্ষী হিসেবে এই ৯৩ বছর বয়সেও টিকে আছেন তিনি।
বিয়েলস্কি ভাইরা বাঁচিয়েছিল প্রায় ১২০০ মানুষকে। বর্তমান পৃথিবীতে প্রায় ৩০০০০ মানুষ আছে, যারা কিনা সেই ১২০০ জনের বংশধর। সোজা বাংলায়, এই ত্রিশ হাজার মানুষ যে আজ পৃথিবীর আলো দেখতে পাচ্ছে, তার পেছনে মূল্যবান অবদান বিয়েলস্কি ভাইদের।
সত্য এই ঘটনার চলচ্চিত্রায়ন যদি দেখতে চান, তবে তাও পেয়ে যাবেন। বিয়েলস্কি ভাইদের এই অসম সংগ্রামকে রূপালী পর্দায় তুলে এনেছেন এডওয়ার্ড জুইক। ২০০৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমাটির নাম ‘Defiance’। যেখানে তুভিয়া বিয়েলস্কির চরিত্রে অভিনয় করেছেন জেমস বন্ডখ্যাত ড্যানিয়েল ক্রেইগ!