দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে গ্রীস মিত্রপক্ষে অংশগ্রহণ করেছিল। হিটলারের নাৎসি বাহিনী যখন গ্রীস দখল করে নিয়েছিল, তখন মূলত গ্রীসের দুটো বাহিনী নাৎসিদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করে। একটি ছিল গ্রীসের রাজতন্ত্রের সমর্থক, অপর বাহিনী গঠিত হয়েছিল গ্রীসের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যদের নিয়ে। আমরা সবাই জানি, ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যবনিকাপাত ঘটে, হিটলারের নেতৃত্বাধীন অক্ষশক্তি পরাজিত হয়। বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর যখন গ্রীসে রাজতন্ত্র পুনরায় প্রতিষ্ঠা করা হয়, তখন গ্রীক কমিউনিস্টরা রাজতন্ত্রে ফিরে যেতে অস্বীকৃতি জানায়। তারা রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হয়। গ্রীসে রাজতন্ত্রের সহায়তায় ব্রিটেন প্রথমে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল, কিন্তু পরবর্তীতে অর্থনৈতিক কারণে তারা গ্রীস থেকে সরে আসে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেন নিজেও এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল যে, তার পক্ষে গ্রীসে সামরিক সহায়তা অব্যাহত রাখা সম্ভব ছিল না। ফলে একসময় গ্রীসে কমিউনিস্টদের ক্ষমতা দখলের সম্ভাবনা দেখা দেয়, যা ছিল ইউরোপের পুঁজিবাদী দেশগুলোর জন্য একটি কড়া সতর্কবার্তা।
১৯৪৭ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস. ট্রুম্যান ‘সেক্রেটারি অব দ্য স্টেট’ এর মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে জর্জ মার্শাল নামের এক ব্যক্তিকে নিয়োগ দেন। মার্শাল ছিলেন এক সাবেক সেনা কর্মকর্তা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বেশ কিছু যুদ্ধে তিনি মিত্রবাহিনীর সেনাদলকে সফলভাবে নেতৃত্ব প্রদান করেন, এবং এ কারণে আমেরিকায় তার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। সদ্য নিয়োগ পাওয়া জর্জ মার্শাল অফিসের দায়িত্ব গ্রহণ করেই দেখতে পেলেন গ্রীসে বেশ বড় ধরনের সংকট তৈরি হয়েছে। ঘটনার আরও গভীরে গিয়ে দেখতে পান, সেসময় গ্রীসকে যদি পৃথিবীর কোনো দেশ সহায়তা করতে পারে, তাহলে সেটি একমাত্র আমেরিকা। যেখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিবদমান পক্ষগুলো যুদ্ধের কারণে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গুত্ব বরণ করেছিল, সেখানে অস্ত্র ব্যবসার মাধ্যমে আমেরিকার অর্থনীতি ফুলেফেঁপে উঠেছিল। মার্শাল প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান এবং আরও কয়েকজন রাজনৈতিক ব্যক্তিকে নিয়ে গ্রীসের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে হোয়াইট হাউজে বৈঠকের আহ্বান করেন। বৈঠকে জর্জ মার্শালের উপদেষ্টা ডিন অ্যাচেসন আশঙ্কা ব্যক্ত করেন এভাবে, “এটা কেবল শুরু। কমিউনিস্টরা এখানেই থামবে না। সোভিয়েত আধিপত্য হয়তো ছড়িয়ে পড়বে এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপে।“
এরও আগে, ১৯৪৬ সালে বিখ্যাত ‘ফরেন অ্যাফেয়ার্স’ (Foreign Affairs) ম্যাগাজিনে ‘এক্স’ (X) ছদ্মনামে একজন ব্যক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। তিনি ছিলেন জর্জ এফ. কেনান, যিনি মার্কিন ডিপার্টমেন্ট অব স্টেটে ‘রাশিয়ান এক্সপার্ট’ হিসেবে কাজ করতেন। সেই প্রবন্ধে তিনি লেখেন, “রাশিয়া কমিউনিস্ট দেশ হলেও তার আশেপাশে সব দেশই পুঁজিবাদ গ্রহণ করেছে, যেটি রাশিয়ার অস্বস্তির একটি বড় কারণ। এই অস্বস্তি দূরীকরণে রাশিয়া নিজেদের মতাদর্শের বিস্তার ঘটাতে চায়।” তিনি তার প্রবন্ধের শেষে বলেন, পশ্চিমা বিশ্বের উচিত এমন কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা, যেটি দীর্ঘমেয়াদে রাশিয়ার আধিপত্যবাদী প্রবণতার মেরুদণ্ড ভেঙে দেবে। তার এই প্রবন্ধ প্রকাশ পাবার পর চারদিকে আলোচনা ও তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়। বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের বাহিনীর বিরুদ্ধে একসাথে লড়লেও যু্দ্ধের পরে যে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পশ্চিমা বিশ্বের সম্পর্ক মোটেও ভালো নেই, এই বিষয়টি পৃথিবীবাসীর সামনে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে ওঠে।
মার্কিন সেক্রেটারি অব দ্য স্টেট জর্জ মার্শাল ভেবে দেখলেন ইউরোপের এই অবস্থা উত্তরণের জন্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেয়া দরকার। সে উদ্দেশ্যেই তিনি জর্জ এফ. কেনানকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করেন, যে কমিটির প্রধান কাজ ছিল এমন উপায় খুঁজে বের করা যার মাধ্যমে ইউরোপীয় দেশগুলো সোভিয়েত আগ্রাসন রুখে দিতে সফল হবে। কেনান তার রিপোর্টে ইউরোপের অর্থনৈতিক দুর্দশার কথা জোরালোভাবে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ইউরোপের প্রায় সব দেশে যুদ্ধফেরত সৈন্যরা স্বদেশে ফিরে চাকরি হারিয়েছেন, অনেকের ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। যারা মোটামুটি কাজকর্ম করে খেতে পারছিল, মুদ্রাস্ফীতির কারণে তারাও চরম বিপাকে পড়েছেন। কিছু শহরে সম্পূর্ণ অর্থনৈতিক অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। যুদ্ধের কারণে বেশিরভাগ দেশে কৃষকেরা ফসল উৎপাদন করতে পারেননি, যার কারণে অনেক অঞ্চলে দুর্ভিক্ষের মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। জর্জ এফ. কেনান তার রিপোর্টে সুপারিশ করেছিল যে আমেরিকার উচিত ইউরোপের দেশগুলোকে ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ দেয়া, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে যা সাহায্য দরকার তা প্রদান করা।
জর্জ মার্শাল প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানকে বোঝাতে সক্ষম হন যে পশ্চিম ইউরোপকে সোভিয়েতদের হাত থেকে রক্ষার মূল উপায় তাদেরকে বিশাল আর্থিক সহায়তা প্রদান করা। এছাড়া মার্শাল আরও বোঝান, যদি ইউরোপের দেশগুলোকে ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ দেয়া না হয়, তাহলে ভবিষ্যতে আমেরিকা বড় ধরনের বিপদের সম্মুখীন হতে পারে। কারণ ইউরোপের দেশগুলো ঘুরে দাঁড়ালে আমেরিকা তার দেশের উৎপাদিত পণ্যের বাজার হিসেবে ইউরোপকে ব্যবহার করতে পারবে। অন্যথায় আমেরিকার উৎপাদিত পণ্য ইউরোপে রপ্তানি করা না গেলে হয়তো অর্থনৈতিক মন্দাবস্থা সৃষ্টি হতে পারে। প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান পরবর্তীতে এই বিষয়টি সম্পর্কে আমেরিকার আইনসভায় বিস্তারিত আলোচনা করেন। প্রথমদিকে বেশ শক্ত বিরোধিতার সম্মুখীন হন ট্রুম্যান। বিরোধিতাকারীদের দাবি ছিল হয়তো শেষ পর্যন্ত এটা আমেরিকার জন্য কার্যকরী সুফল বয়ে আনবে না। কিন্তু পরবর্তীতে যেহেতু কমিউনিজম ঠেকানোর মোক্ষম উপায় হিসেবে এই পরিকল্পনার কথা বলা হয়, তখন আমেরিকার আইনসভা অনুমোদন দেয়। ১৯৪৮ সালে মার্কিন আইনসভায় ‘ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যাক্ট’ পাশ করা হয়।
যেহেতু মার্কিন সেক্রেটারি অব দ্য স্টেট জর্জ মার্শাল এই অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রণয়নের পেছনে মূল ভূমিকা পালন করেছিলেন, তাই তার নামানুসারে পরবর্তী এই অর্থনৈতিক সাহায্যের নাম দেয়া হয়েছিল ‘মার্শাল প্ল্যান’। মার্শাল পরিকল্পনার অধীনে ইউরোপের ষোলটি দেশকে প্রায় তের বিলিয়ন ডলার সহযোগিতা দেয়া হয়। বলে রাখা ভালো, আজকের দিনে সেই তের বিলিয়ন ডলারের মূল্য গিয়ে দাঁড়াতো ১০০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। মূলত তের বিলিয়ন ডলারের প্রায় পুরোটা (বারো মিলিয়ন ডলার) অর্থনৈতিক অনুদান ও ঋণের মাধ্যমে হস্তান্তর করা হয়। অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা কাটিয়ে ওঠার পর যেন সাহায্য গ্রহণকারী দেশগুলো ইউরোপে নিজেদের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্যের সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে, সেই সম্পর্কে নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। এছাড়া আমেরিকার এই সাহায্য যেন ইউরোপীয় দেশগুলো সুপরিকল্পিতভাবে কাজে লাগাতে পারে, এজন্য আমেরিকা থেকে অসংখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা প্রেরণ করা হয়। সাধারণত বিশ্বযুদ্ধের আগে যেসব দেশের অর্থনৈতিক অবকাঠামো তুলনামূলক উন্নত ছিল, তারা বেশি পরিমাণে সাহায্য পেয়েছিল।
১৯৪৮-৫১– এই তিন বছরে প্রধানত মার্শাল পরিকল্পনা অনুযায়ী ইউরোপের ষোলটি দেশে তের বিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ অর্থনৈতিক সহায়তা করা হয়েছিল। ইউরোপের দেশগুলো আমেরিকার সহায়তা হাতে পাওয়ার পর উপযুক্ত পরিকল্পনা প্রণয়ন ও সেগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে খুব দ্রুত নিজেদের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়। আমেরিকা মূলত যে উদ্দেশ্যে এই পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল, সেই উদ্দেশ্য শতভাগ বাস্তবায়িত হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে পশ্চিম ইউরোপের অনেক দেশেই কমিউনিস্ট পার্টিগুলো বেশ জোরেশোরে রাজনৈতিক কার্যক্রম শুরু করে, অর্থনৈতিক দুর্দশার সুযোগ নিয়ে জনমত গঠন করেছিল। কিন্তু এই অর্থনৈতিক সহযোগিতার কারণে সে দেশগুলো খুব দ্রুত পূর্বের অবস্থায় ফিরে যায়, কমিউনিস্ট দলগুলো রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের মতো জনসমর্থন তৈরি করতে ব্যর্থ হয়। তবে মার্শাল পরিকল্পনার মাধ্যমে আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে একধরনের মৃদু উত্তেজনা শুরু হয়, যেটি পরবর্তীতে স্নায়ুযুদ্ধে রূপ নিয়েছিল।