১৯২২ সালের ৩০ অক্টোবর। ইতালির ফ্যাসিস্ট পার্টির পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি সদস্য মিছিল করে এগিয়ে যাচ্ছিল রাজধানী রোম শহরের দিকে। পার্টির নেতা উনচল্লিশ বছর বয়স্ক বেনিতো মুসোলিনি সেদিন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। এই নতুন ফ্যাসিস্ট পার্টির বয়স তখন সবে এক বছর অতিক্রম করেছে।
অনেকদিন ধরে এই শুভদিনটির জন্যই মুসোলিনি অপেক্ষার প্রহর গুনছিলেন। এই দিনটির জন্য তো নিজেকে প্রস্তুত করেছেন সারা জীবন ধরে। কীভাবে হয়ে উঠলেন তিনি ইতালির একচ্ছত্র অধিপতি? তা জানতে ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি ফেরানো যাক।
পুরো নাম বেনিতো এমিলকেয়ার আন্দ্রে মুসোলিনি। জন্ম ১৮৮৩ সালের ২৯ জুলাই, ইতালির ফোরলি শহরে। বাবা পেশায় ছিলেন একজন কর্মকার। বাবা ছিলেন সেসময়ের সোশ্যালিস্ট পার্টির একজন সক্রিয় কর্মী। বিদ্রোহের চেতনায় তার শিরায়-শিরায় প্রবাহিত। মুসোলিনিও সোশ্যালিস্ট হিসেবেই তার জীবন শুরু করেছিলেন ।
ছোটবেলা থেকেই ছিলেন ভীষণ ডানপিটে। বিভিন্ন সময় স্কুলের বিভিন্ন কার্যক্রমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর কারণে বিভিন্ন স্কুল থেকে একাধিকবার বহিষ্কার হয়েছিলেন। ১৯০১ সালে টিচিং সার্টিফিকেট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে শিক্ষক হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু করেন।
১৯০২ সালে মাত্র উনিশ বছর বয়সে সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার পক্ষে জনমত গড়ে তোলার জন্য সুইজারল্যান্ডে চলে যান। মাঠপর্যায়ে তার আসাধারণ কর্মদক্ষতার জন্য সোশ্যালিস্ট পর্টির নেতাকর্মীদের কাছে খু্বই জনপ্রিয় এক ব্যক্তিত্বে পরিণত হন মুসোলিনি। সুইজারল্যান্ডের জনগণের মাঝে তার রাজনৈতিক মতাদর্শের সংখ্যা দিনে দিনে বাড়তে থাকায় সুইস কর্তৃপক্ষ চিন্তিত হয়ে পড়ে। ফলে সুইস সরকার মুসোলিনিকে দেশ থেকে বহিস্কারের নির্দেশ দেয়। তার ফলে খুব বেশি দিন সুইজারল্যান্ডে মুসোলিনি তার মতাদর্শ প্রচার করতে সক্ষম হননি। দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হন তিনি।
১৯০৪ সালে ইতালিতে ফিরে এসেই মুসোলিনি শুরু করলেন তার লেখালেখির জীবন। প্রথমে স্থানীয় এক পত্রিকায় সোশ্যালিস্ট পার্টির মতাদর্শ তুলে ধরে নানা প্রবন্ধ লিখতে থাকেন। ক্রমাগত লিখে চললেন একের পর এক প্রবন্ধ, সম্পাদকীয় মন্তব্য। ১৯১২ সালে ইতালির সোশ্যালিস্ট পত্রিকা দৈনিক ‘অবন্তি’র সম্পাদক নির্বাচিত হলেন তিনি।
এইসময় শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। ইতালির সরকার মিত্রবাহিনীর পক্ষে যুদ্ধে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। প্রাথমিকভাবে মুসোলিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইতালির প্রবেশের ব্যাপারে তীব্র নিন্দা জানিয়েছিলেন। কিন্তু পরে তিনি অনুধাবন করেন এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে একটি শক্তিশালী দেশ হিসেবে ইতালির আত্মপ্রকাশের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু এই সময় ইতালির সোশ্যালিস্ট পার্টির নেতৃস্থানীয়রা সিদ্ধান্ত নেন যে, এই যুদ্ধ থেকে নিজদেরকে দূরে সরিয়ে রাখবেন। কোনো পক্ষকে তারা সমর্থন জানাবেন না এবং যুদ্ধে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করবেন। কিন্তু মুসোলিনি পার্টির সিদ্ধান্ত অমান্য করে দেশকে মিত্রপক্ষের সমর্থনে যুদ্ধে যোগ দিতে আহ্বান জানালেন।
এর সমর্থনে পত্রিকায় প্রকাশ করতে লাগলেন নানা প্রবন্ধ। পার্টির নির্দেশিত লাইন থেকে সরে গিয়ে মুসোলিনির এ ধরনের একক সিদ্ধান্তের কারণে দল অস্বস্তির মুখে পড়ে। এভাবে দলের নীতি, আদর্শ থেকে বিচ্যুত হওয়ায় মুসোলিনিকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। সঙ্গে পত্রিকার চাকরিটিও হারাতে হয়।
১৯১৫ সালে, মুসোলিনি ইতালীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং সক্রিয়ভাবে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন। যুদ্ধে তিনি অসাধারণ ভূমিকার জন্য সেনাবাহিনীতে পদোন্নতি পান। পরবর্তীতে যুদ্ধে আহত হলে তিনি সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করে চলে আসেন।
সোশ্যালিজমের প্রতি তিনি তখন বীতশ্রদ্ধ। ১৯১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিকে, তিনি প্রথম একনায়কতন্ত্রের উত্থানের কথা বলেছিলেন। তিনি এক প্রকাশ্য সভায় বলেছিলেন-
“ইতালির জন্য এমন এক ব্যক্তির প্রয়োজন যিনি ইতালির রাজনীতির আবর্জনা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করার জন্য যথেষ্ট নির্মম এবং শক্তিমান।”
এর তিন মাস পর, বোলগ্না শহরে আয়োজিতএক সভায় বক্তৃতা দিতে গিয়ে তিনি ইঙ্গিত করেছিলেন যে তিনি নিজেকে ইতালির সেই ব্যক্তি হিসেবে প্রমাণ করতে প্রস্তুত। পরের বছরই মুসোলিনি তার এই উচ্চাভিলাষ সমর্থনের জন্য অবসরপ্রাপ্ত সরকারি আমলা, অসন্তুষ্ট সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, অসন্তুষ্ট সোশ্যালিস্ট, অস্থির বিপ্লবীরা এবং অবসরপ্রাপ্ত সৈন্যদের নিয়ে নতুন রাজনৈতিক দল গড়ে তুলতে উদ্যোগী হন।
এদিকে ১৯১৯ সালের ৬ জুন মুসোলিনি নিজের পত্রিকা প্রকাশে উদ্যোগী হন। ‘ইল পোপোলে ডি ইতালিয়া’ (‘দ্য পিপল অফ ইতালি’) নামে এক সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠা করে হলেন তার সম্পাদক।
১৯১৯ সালের ২৩ মার্চ নিজের কয়েকজন সঙ্গী-সাথী, বিশ্বস্ত অনুগামীদের নিয়ে প্রতিষ্ঠা করলেন নতুন রাজনৈতিক দল, ‘ ন্যাশনাল ফ্যাসিস্ট পার্টি’। ইতালির সব শহরেই ফ্যাসিস্ট পার্টির জন্য নতুন কর্মী সমর্থক নিতে শুরু করেন। বিভিন্ন শহরে ফ্যাসিস্ট দলের সংগঠন গড়ে উঠতে লাগলো। তার বক্তৃতার ধরন, চমৎকার বাচনভঙ্গি, তার ব্যক্তিত্ব- সবকিছুতেই মুগ্ধ হয়ে পড়েন দলের এবং দেশের আপামর জনতা। ফলে দলের একচ্ছত্র নেতা হয়ে উঠতে খুব বেগ পেতে হয়নি তাকে।
জনতার সামনে নাটকীয় ভঙ্গিতে যখন তিনি বক্তৃতা দিতে উঠতেন, প্রায় সময় দেখা যেতো তাতে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল উদ্ধত, বিভিন্ন সময় তার মতামতের বৈপরীত্য এবং বিভিন্ন ভুলে ভরা তথ্য দিয়ে বিপক্ষ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে আক্রমণ শানাতেন। কিন্তু তার মন্ত্রমুগ্ধকর সম্মোহনীশক্তি ও প্রাঞ্জলময় বক্তৃতার কারণে তার এসব অসত্য বাক্য যেন মানুষের কাছে সত্য হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে।
এদিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯১৫ সালে লন্ডনে ইতালির সাথে মিত্রপক্ষের দেশগুলোর মধ্যে এক গোপন চুক্তি হয়, যাতে বলা হয় যে, যুদ্ধে জয়লাভের পর ইতালিকে পুরষ্কৃত করা হবে। কিন্তু বিশ্বযুদ্ধ জয়ের পর প্যারিস শান্তি সম্মেলনে মিত্রপক্ষীয় শক্তিরা ইতালিকে দেয়া সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইতালির প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়।
এই যুদ্ধে ইতালির প্রায় ১২ মিলিয়ন ডলারের অধিক খরচ হয়েছিল এবং অনেক ইতালি সৈন্য নিহত হয়। ফলে ইতালি সরকার আর্থিক সঙ্কটে পড়ে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেতে থাকে। রাষ্ট্রক্ষমতায় অভিষিক্ত দুর্বল এক সরকার, বেকারত্ব ও মূল্যবৃদ্ধি দ্রুতগতিতে বেড়েই চলছে। এমন পরিস্থিতিতে ইতালির মানুষদের মধ্যে একধরনের হতাশা এবং শাসকদের প্রতি চরম বিতৃষ্ণা বিরাজ করতে থাকে।
১৯২২ সালের অক্টোবর মাসের মধ্যেই দেশের বিপর্যস্ত অবস্থাকে সুচতুরভাবে কাজে লাগালেন মুসোলিনি। সর্বত্র অশান্ত উত্তেজনা। এই সবকিছুকে দক্ষভাবে কাজে লাগালেন তিনি। তার দলের যুবাদের নিয়ে তৈরি করলেন প্যারামিলিটারী বাহিনী, যারা ‘ব্ল্যাক শার্ট’ নামে পরিচিতি পেতে লাগলো। তাদের একমাত্র কাজ যেনতেন প্রকারে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও বামপন্থীদের হেনস্থা করা। এভাবে চারদিকে ফ্যাসিস্ট দলের প্রভাব ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
ইতালির রাজনৈতিক এই বিশৃঙ্খলার মাঝে মুসোলিনি ঘোষণা করেন যে, একমাত্র তিনিই এই দুর্যোগ পরিস্থিতি থেকে ইতালিকে রক্ষা করতে পারবেন এবং তিনিই প্রধানমন্ত্রীর যোগ্য দাবিদার। ফ্যাসিস্টরাই যে এবার ক্ষমতায় আসছে, তা নিয়ে তখন কারো মনে কোনো সংশয় নেই।
এদিকে মিলান শহরে ইল দুচে (মুসোলিনির উপাধি) দলের একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিতে গিয়েছিলেন। দলের পরিকল্পনা অনুসারে তিন লক্ষ ফ্যাসিস্ট ক্যাডার ঝাঁকে ঝাঁকে এসে দখল করে নিল গোটা মিলান শহর। অবরোধ করলো রেললাইন, সরকারি অফিস ও বাড়িগুলো পর্যন্ত চলে এলো তাদের হাতে। গোলন্দাজ বাহিনীর হালকা বন্দুক, জন্তু-জানোয়ার শিকার করার জন্য পুরনো আমলের মরচে-পড়া বন্দুক, বারুদভরা প্রাচীন রাইফেল এ সমস্ত পুরনো অস্ত্র দখল করতে পেরে ফ্যাসিস্টদের উৎসাহ তখন আর বাঁধ মানছে না। মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। তার মধ্যেই এসব জীর্ণ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সেসব ফ্যাসিস্টকর্মীরা ‘রোমা! রোমা!’ নামে চিৎকার করতে করতে এগিয়ে যেতে লাগলো রাজধানী রোম শহরের দিকে। রাজধানীও এবার তারা দখলে আনতে চায়।
দলের পয়সাওয়ালা এক অভিজাত ফ্যাসিস্ট সভ্যের একটি ফিয়াট স্পোর্টস কার ছিল। সেই গাড়ির ছাদে মেশিনগান ফিট করে সে গাড়ি নিয়ে ঢুকে পড়লো রোম শহরে। অন্যরা বাগান করার কোদাল, শাবল, খুন্তি, টেবিলের ভাঙা পায়া, হাতের কাছে যা পেলো তা নিয়ে উঠে এলো শহরের প্রান্তে পাথরের সেতুগুলিতে। লবণমাখানো শুকনো শক্ত বাকালা মাছ আর হাতের কাছে পাওয়া ছোটখাটো অস্ত্র নিয়ে আর একদল তৈরি হয়ে থাকলো সৈন্যদলের মোকাবেলা করার জন্য।
শেষাবধি এতসব কিছুই হলো না। ফ্যাসিবাদের এই জোয়ারে আত্মসমর্পণ করলেন সম্রাট ভিক্টর এমানুয়েল। মন্ত্রীসভা গঠন করতে আহ্বান জানালেন মুসোলিনিকে। ট্রেনে আসতে আসতেই পোশাক বদলে মুসোলিনি পরে নিলেন একটি কালো জামা, ট্রাউজার্স ও বউলার হ্যাট। সেই পোশাকেই সম্রাটের সামনে উপস্থিত হয়ে তিনি বললেন,
“সম্রাট নিশ্চয় আমার এই পোশাক ক্ষমা করবেন। আমি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরাসরি এখানে এসেছি।”
ইতালিতে তেইশ বছরব্যাপী ফ্যাসিজমের রাজত্ব সেদিনই শুরু হলো।
ফিচার ইমেজ- billdownscbs.blogspot.com